বিয়ের কয়েকদিন বাদেই আমার দাদী শাশুড়ি এসে হাজির।তিনি আবার বেশ খুতখুতে স্বভাবের মহিলা।পান থেকে চুন খসলে কাউকে আস্ত রাখেন না। বাড়ির সকলের মুখে ওনার প্রশংসা শুনে ওনার আগমনে আমার হাত পা ক্রমশ ঠান্ডা হয়ে আসছে।আমি ওনার থেকে যতটা সম্ভব দূরে দূরে থাকার চেষ্টা করি।কিন্তু চৌম্বকীয় আকর্ষনে উনি বারবার আমার কাজ খুঁটিয়ে দেখতে থাকে।আমার পেছনে কাঁঠালেরআঠার মতো লেগে থাকেন। আজ সকাল আমাকে খুব মিষ্টি করে ডাকে,”কই গো,নাত বউ,এদিকে আহো তো।”আমার বুকের ভেতরটা কেমন যেন ধড়পড় ধড়পড় করে ওঠে।দুরুদুরু বুকে ক্রমশ এগিয়ে গেলাম তার দিকে।
–“দাদীমা ডাকছেন? “
—“হ ডাকছি।যাও তো আমার জন্য একপদ কিছু রান্না করে নিয়ে এসো।”ওনার কথা শুনে যেন আকাশ থেকে পড়লাম।জীবনে তো রান্নাঘরে উকি দিয়েও দেখি নি।অনেক কষ্টে মোটামুটি ভাত আর ডিম ভাজি শিখেছি।আর এখন কিনা ওনার জন্য কিছু রান্না করতে হবে?
—আমার শাশুড়ি মা এগিয়ে এসে বলে,”মা, আঁখি তো এখন নতুন বউ।কয়েকটা দিন যাক তারপর না হয় রান্নাঘরে যাবে।রান্নাঘরের কোথাই কি সেটাও জানে না বেচারি।”সেদিন শাশুড়ি মায়ের কথা শুনে খুশিতে গদগদ হয়ে ১১০ টা কিস করছলাম মনে মনে।দোয়া করছিলাম,বাংলার ঘরে ঘরে যেন এমন শাশুড়ি জন্মায়।তিনি আমাকে ভালবেসে এই মহিলার হাত থেকে বাঁচাতে এগিয়ে এসেছেন ভাবতেই মনে খুশির শীতল হাওয়া বয়ে যেতে থাকে।কিন্তু বুড়িটা একেবারে বদের হাড্ডি।শাশুড়ি মায়ের কথা উপেক্ষা করে আমাকে একা রান্না ঘরে পাঠানোর ফয়সালা করে।বলে,”সংসার সুখের হয় রমনীর গুনে।”উনি আমার গুনের পরিক্ষা নিতে চাইছেন।
“না না নিজেকে ছোট করলে চলবে নাই।আমি ওবা কম কিসের।”তাই ভাবখানা এমন করলাম যেন একজন অভিজ্ঞ রাধুনী। খুশিখুশি মুখ করে রান্না ঘরে চললাম।সবার সামনে বুক ফুলিয়ে চলে তো এলাম কিন্ত রান্নাঘরে এসে পড়লাম মহা মসিব্বতে।কি রান্না করবো, কিছুই তো পারিনা। বুঝলাম দাদীমা আমাকে জব্দ করতে চাইছে।অনেক্ষন চিন্তাভাবনা করার পর একটা শুভ বুদ্ধির উদয় হলো।রান্না সে আর এমন কি,শিখে নেবো এক্ষুনি।ইউটিউব থাকতে আর চিন্তা কি!খুশির ঠেলায় চোখে পানি চলে আসে।ইউটিউব না থাকলে যে আজ কি হতো!
অবশেষে ইউটিউব ঘেটে পোলাও মাংসের রেসিপি দেখে দেখে ঠিক তেমনটাই করে যাচ্ছি।কিছুক্ষণ পর খাবারের সুবাসে চারিদিক ম ম করতে থাকে।খাবারের ঘ্রান শুনে নিজেই ফিদা হয়ে গেলাম,নিজের রান্নার তারিফ করতে থাকলাম।রান্নাটা প্রায় শেষেরদিকে, ঠিক তখনি আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ার উপক্রম।রান্নাটা একদম জগা খিচুড়ি হয়ে গেছে। রান্নাটা অর্ধেক করেছি পোলাও মাংসের আর বাকিটা করেছি খিচুড়ির রেসিপি দেখে।বিশ্বাস করেন, রান্নার মতো তখন আমার মাথাটাও জগা খিচুড়ি হয়ে গেছিলো।এটা সবার সামনে নিয়ে গেলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে ।মান ইজ্জতের বারো’টা তো বেজেই যাবে।
ঠিক তখনই দাদীমার ডাক পড়েছে।ঘরে কুরুক্ষেত্র বাধিয়ে ফেলেছে এতক্ষণে।অগত্যা আমি ভয়ে ভয়ে আমার হাতের তৈরি সেই অখাদ্যই তার সামনে হাজির করি।বাড়ির সকলেই আমার এরুম কাজ দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়।একবার খাবারের বাটির দিকে আর একবার আমার দিকে তাকিয়ে থাকে।আমি আর কি করবো,সকলকে উদ্দ্যেশ্য করে কিঞ্চিৎ হাসি দিলাম। দাদীমা এক চামুচ মুখে তুলতেই চিৎকার করে ওঠে,”এ কি করেছিস রে আঁখি!”ওনার চিৎকারে আমার হার্টবিট বেড়ে গেলো,ভয়ে গলাটা শুকিয়ে গেলো।মান ইজ্জত বুঝি গেলো। আমার শাশুড়ি মা এগিয়ে এসে বলেন,”মা কি হয়েছে,খাবার ভালো হয় নি,থাক আপনাকে আর খেতে হবে না।”
—তিনি আবারো চিৎকার করে বলে উঠলেন,”একে কোথ থেকে এনেছিস রে।আরে এই মেয়ে তো আমাকে পাগল করে ছাড়বে।খাবারটা যা বানাইছে না পুরাই ফাটাফাটি।এর হাতে তো জাদু আছে।” ওনার কথা শুনে বাড়ির প্রত্যেকের মতো আমিও হা হয়ে গেলাম।আমার হাতে আবার কিসের জাদু সেটাই দেখার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কিছুই পেলাম না।হতবম্ভ হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওনার খাওয়া দেখে যাচ্ছিলাম।এমন মনে হচ্ছিল যেন প্লেটও খেয়ে ফেলবেন।আমি আবারও হাতের তালুর দিকে তাকিয়ে মিনমিনে গলায় বললাম,”আমার হাতের এতো গুন!”।
–“নাত বউ,তুমি তো আগে কও নাই যে তুমি কেকাপ্পার স্টুডেন্ট।”ওনার কথা শুনে মাথাটা ঝিমাতে শুরু করলো।চোখে যেন সরষে ফুল দেখছি।কেকাপ্পা আবার কেডা?তারেই তো চিনি না,স্টুডেন্ট হইলাম কবে?আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই তিনি আবারো বলতে আরম্ভ করেন যে উনি কেকাপ্পার খুব বড় একজন ফ্যান। খুব শখ ছিল কেকাপ্পার রান্না ফলো করবেন।তাই আমাকে আদেশ করে,এ বাড়িতে এখন থেকে কেকাপ্পার রেসিপি ফলো করেই রান্না করতে হবে।আমার নামের সাথে মিল রেখে আমার রেসিপি গুলার নাম রাখেন আখাপ্পা রেসিপি। শাশুড়ি মা চোখ বড়বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে।আমাকে এভাবে দেখার কি আছে সেটা বুঝছি না।
এভাবেই চলতে থাকে আমার আখাপ্পা রেসিপি ভোজন।প্রথম প্রথম কেমন যেন বমি পেত,নিজের রান্না নিজেরই গলা দিয়ে নামতো না।কিন্তু এখন বেশ মজায় লাগে।বাড়ির সকলেই বিরক্ত হয়ে গেছে এসব অখাদ্য খেতে খেতে।কিন্তু দাদীমার ভয়ে কেউ কিছু বলে না,ভয়ে সকলে চুপসে গেছে ।এরপর থেকে মাঝে মাঝে আমি দাদীমাকে আসতে বলতাম,আর উনিও মন চাইলেই চলে আসতেন আমার আখাপ্পার টানে।
গল্পের বিষয়:
গল্প