ব্যস্ততা

ব্যস্ততা
যে হাত দিয়ে কাজ করলে কষ্ট হয়, সে হাত থাকার থেকে না থাকাইতো ভালো’ শ্বাশুড়ির এমন কথায়, হাতের যন্ত্রণার থেকে ভেতরের যন্ত্রণাটা বেশি হতে লাগলো। সকালে আলু ভর্তা করার সময় ঝাল পিয়াজ ডলে গুঁড়ো করেছিলাম, তারপর থেকে হাতটা জ্বলতে শুরু করলো। ছোট বেলা থেকেই আমার এমন সমস্যা হয়, একটু ঝাল লাগলেই হাত জ্বলতে থাকে। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি। ফ্রিজ থেকে বফর জমে ওঠা ঠান্ডা পানি এনে তাতে হাত ডুবিয়ে রাখতেই ঘটনা চোখে পড়ে আমার শ্বাশুড়ির। তারপর থেকেই নানান কথা শোনাতে লেগে গেছেন৷ মাহির এসে বললো, ‘আহা মা, এত চেঁচাচ্ছো কেন? হাত জ্বলতেই পারে। তারপরেও তো ভাবি কখনও তোমায় সাহায্য করতে ডাকে নি। নিজেই তো করছে বাড়ির সব কাজগুলো।’
মাহিরের কথায় প্রতিবাদ করে উঠে তিনি বললেন, ‘আমায় ডাকলেই হয়। এরকম নাটক দেখানো তো দরকার নেই। আহ্লাদী হাত, মরিচ ধরতে পারে না। আগে তো মানুষজন মরিচ বেঁটে তরকারি রাঁধত, তাদের কিছু হত না। এখনকার মেয়েদের যত সমস্যা।’ মাহির শান্ত স্বরেই বললো, ‘মা সবাই সবকিছুতে ঠিকঠাক না। এই তুমি যেমন আমাদের কখনও বেগুন ভেজে খাওয়াতে না। তেলে বেগুন দিলেই তেল ছিটে তোমার হাত পুড়ে যেত সবসময়।’ মাহিরের কথায় চুপ হয়ে যান শ্বাশুড়ি। মাহির আমার পাশে এসে দাঁড়ায়। আমি তাকাতেই হেসে ওঠে। ‘কই দেখি ভাবি তোমার হাতের কি অবস্থা?’ আমি হেসে বলি, ‘নাহ্ ঠিক আছে। তুমি ভার্সিটিতে যাবে না আজ?’ মুচকি হেসে আস্তে জবাব দেয়, ‘নাহ্ আজ যাবো না। আজ প্রিয়ন্তী আসবে না।’ মাহিরের কথায় হেসে ফেললাম আমি৷ মাহির চলে গেলো।
কাজের খালা ছুটিতে গেছেন গ্রামের বাড়ি। সঙ্গে তার বোনের মেয়েটাকেও নিয়ে গেছেন। একজন ছুটা বুয়া অনেক খুঁজেও পাওয়া গেলো না। এবার একটু বেশি কষ্ট হয়ে যাচ্ছে আমার। বেশ কয়েকমাস হলো বাবা মা কে দেখতে যাওয়া হয় না। কয়েকদিন ধরে বাবা মায়ের জন্য ভেতরটা ছটফট করছে৷ আজ নাবিল ফিরলে বলবো একবার ও বাসায় যাওয়ার কথা৷ নাবিলের অফিসের কাজের খুব চাপ যাচ্ছে। অবশ্য সবসময়ই ওর এমন ব্যস্ততা থাকেই। আমার সঙ্গে বসে দু এক মিনিট কথা বলার সুযোগও তার নেই। শেষ কবে আমরা মন খুলে কথা বলেছি ভুলে গিয়েছি। ‘নাবিল তুমি কি কাজ সেরেই ঘুমিয়ে পড়বে?’ নাবিল ল্যাপটপের দিকে চোখ রেখেই বললো, ‘হ্যাঁ।”তোমার কাজ কখন শেষ হবে?’ ‘বুঝতে পারছি না, রাত হবে অনেক। তুমি ঘুমিয়ে পড়।’ ‘কফি এনে দেই?’ ‘হ্যাঁ খুব ভালো হয় তবে।’
কফির মগে চুমুক দিতে দিতে কাজ সারছে নাবিল। মগ থেকে ধোঁয়া ওড়ছে। সে ধোঁয়ায় আমার দীর্ঘশ্বাসগুলো মিলিয়ে যাচ্ছে। আমি এখন বিছানায় নাবিলের জন্য অপেক্ষা করতে করতেই ঘুমিয়ে পড়ি। আর ঘুম থেকে জেগে দেখি সুর্যের আলো ঝলমল করছে। নাবিলকে ডেকে তুলি, নাস্তা বানাই, নাবিল খেয়ে অফিসে ছোটে। তারপর রাতে বাড়ি ফিরে ল্যাপটপ সামনে নিয়ে বসে পড়ে। ওর সাথে আমার কথা বলার সুযোগই নেই। অবশ্য নাবিল কখনও ওভাবে জানতেও চায় না আমি কিছু বলতে চাই কিনা। ‘বউ মা একটু এদিকে আসো তো।’ দুপুরে রান্নাঘর থেকে শ্বশুরের ডাকে ছুটলাম সে ঘরে। ‘কি হয়েছে বাবা?’
‘আমার চশমাটা খুঁজে পাচ্ছি না, তোমার শ্বাশুড়ি চলে যাওয়ার পর থেকে। তোমার শ্বাশুড়িকে যে ফোন করে জিজ্ঞেস করবো চশমাটা ভুল করে নিয়ে গেলো কিনা, তাতো ফোন বন্ধ বলছে’ আমি হাসি চেপে বললাম, ‘বাবা চশমা তো আপনার চোখেই।’ তিনি চোখে হাত দিতেই হেসে ফেললেন। বললেন, ‘দেখো মা, বয়স হলে যা হয়। তোমাকে রান্নাঘর থেকে শুধু শুধু ডেকে এনে কষ্ট দিলাম।’ ‘না বাবা ঠিক আছে। আপনার কিছু লাগলে বলেন, এনে দেই।’ তিনি হেসে জবাব দেন, ‘না কিছু লাগবে না, তুমি যাও।’ কলবেলের আওয়াজে দরজা খুলেই দেখি মাহির। ‘কি ব্যাপার আজ এত তাড়াতাড়ি?’ ‘ভাবি মা কোথায়?’
সিটকানি লাগিয়ে উত্তর দিলাম, ‘সে তো জুলিয়ার বাসায় গেছে।’ ‘আপার বাসায় গেলো কখন?’ ‘সকালেই। কেন কিছু বলবে? জরুরি দরকার?’ চুপ থেকে খানিক পরে জবাব দেয় মাহির, ‘তোমার কাছে কিছু টাকা হবে?’ ‘কত টাকা?’ ‘হাজার তিনেক। প্রিয়ন্তীর জন্মদিন আজ। হাতে টাকা খুব কম।’ আমি হেসে বললাম, ‘আচ্ছা আমি দিচ্ছি। তুমি বসো।’ টাকা এনে দিতেই খুশিতে গদগদ হয়ে উঠলো মাহির। বের হওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ায়। আমি বললাম, ‘এক গ্লাস শরবত করে দিচ্ছি। খেয়ে যাও।’ মাহির হেসে বললো, ‘ধন্যবাদ মহীয়সী ভাবি। শরবতের আর দরকার নাই।’ বলেই হন্তদন্ত হয়ে চলে গেলো।
প্রিয়ন্তীর জন্মদিনের কথা শুনে মনে পড়লো আমার জন্মদিনগুলোর কথা। বিয়ের প্রথম বছরগুলোতে নাবিলসহ পরিবারের সকলে মিলে কত আয়োজন করে জন্মদিন পালন করা হত। তারপর ব্যস্ততার কবলে সময় হত না নাবিলের। আর এখন তো মনেই থাকেনা কবে জন্মদিন যায়, আসে। জন্মদিনের সঙ্গে আমাদের বিশেষ দিনগুলোও তলিয়ে গিয়েছে। ‘আমাদের এত বেশি আড়ম্বরপূর্ণ জীবনযাপনের দরকার নেই। যা আছে এতেই সুখ আছে। আমাদের এখন দরকার দু’জন দু’জনকে সময় দেওয়া।’ এই কথাটা নাবিলকে যতবারই বোঝাতে গিয়েছি ততবারই ঝগড়া হয়েছে। তাই এখন আর কথাগুলো তুলিই না। অবশ্য এখন ঝগড়া করার মতও সময় নাবিলের হাতে নেই। বান্ধবীদের ফেসবুকের ওয়ালে যখন দেখি পরিবার নিয়ে ঘোরাঘুরি করার ছবি। ভেতরটা ভারি হয়, লম্বা নিঃশ্বাস ছাড়ি। তারপর একটা মলিন হাসি দিয়ে ছবিতে লাভ রিয়াক্ট দিয়ে সুন্দর কিছু মন্তব্য করে দেই। ওরা ভাবে, আমিও বেশ আছি।
ব্যস্ত নাবিলের সাথে আমার বের হওয়া হত যখন নাবিলের অফিসের কোনো পার্টি থাকতো। নাবিল সঙ্গে করে আমায় নিয়ে যেত। আমি অনেক বোঝাতাম, আমি এসবে মানানসই না। আমার এসব ভালো লাগে না, অসস্তি লাগে। প্রথম কানে না তুললেও বেশ কয়েকবার ঝগড়াঝাটি হওয়ার পরে এখন সব পার্টি নামক অসস্তি থেকে মুক্তি মেলে আমার।
শ্বাশুড়ি তার মেয়ের বাসায় গিয়েছে বেশ কয়েকদিন হলো। ফোন করে আসার জন্য বললাম। তিনি বললেন, ‘এসে কি করবো? এবাড়িতে আমার নাতি নাতনি আছে, ভালো লাগে। ও বাড়িতে তো আমায় দাদি বলে ডাকার মত কেউ নেই।’
বেশ কর্কশ কন্ঠে কথাগুলো বললেন তিনি। চোখ দু’টো ছলছল করে উঠলো। বিয়ে হয়েছে সাত বছর হলো। এখন অব্দি মা হতে পারিনি, এই কষ্টটা যে ভেতরে ভেতরে আমাকেও পোড়ায়।
নাবিলকে অনেকবার বলেছি দু’জন মিলে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার জন্য, নাবিল কানেই তোলে নি। পরে বাধ্য হয়ে আমি একাই গিয়েছি, রিপোর্টে খারাপ কিছুই আসেনি। সব ঠিকঠাক। ডাক্তার বললেন নাবিলকে নিয়ে আসার জন্য, নাবিল যাবো যাবো করলেও তার সময় আর হয়ে ওঠেনা। এখন তাই বলাও ছেড়ে দিয়েছি। আমার শ্বাশুড়ি দৃঢ় বিশ্বাস করেন, বাচ্চা না হওয়ার সমস্যা আমারই। সুযোগ পেলে কথাও শুনিয়ে বসেন, আমি কানে তুলি না। পড়াশোনার জন্য কখনও কোনো মানুষকে কাছে ঘেঁষতে দেই নি। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর ইচ্ছে ছিলো বেজায়। পড়াশোনা শেষ করতেই বাবা সুপাত্রের খোঁজ পেয়ে একদিন বলে বসলেন, বিয়ের পরেও নিজের পায়ে দাঁড়ানো যায়।
বিয়েটা হয়েও যায় অমতে৷ কিন্তু বিয়ের পরে প্রতিদিন আমি নাবিলের প্রেমে পড়তে থাকি। ভালোবাসায় ভরিয়ে রাখতো আমায়। এত ভালোবাসা পেয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর ইচ্ছেটাকেও মাটি দেই নাবিলের কথায়। নাবিল প্রতিদিন তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতো, দুপুরে খেতে আসতো, সকালে আমার সঙ্গে নাস্তা করেই বের হত। সারাদিন একটু পর পর ফোন দিয়ে খোঁজ নিতো, আচমকা ‘ভালোবাসি’ বলে উঠতো, মাঝে হুট হাট বাসায় এসে চমকে দিতো৷
চোখের দিকে তাকিয়ে দুষ্টুমি করে বলতো, ‘তৃষ্ণা? আমার ভীষণ তৃষ্ণা পেয়েছে।’ লজ্জায় লাল হওয়া আমি তখন পালাতে চাইতাম। নাবিল আমায় শক্ত করে ধরে বসতো। পালানো আর হত না। সময় তখন দিব্যি কেটে যেত টেরই পেতাম না৷ আর এখন সময় কাটেই না। এক একটা মুহুর্ত, এক একটা দিন মনে হয়। পুরোনো মধুর স্মৃতি মনে পড়লে ঠোঁটের কোণে হাসি জেগে উঠলেও, পরক্ষণেই বিষাদ নেমে আসে চোখ মুখ জড়িয়ে।
শ্বশুর-শ্বাশুড়িকে বলে কয়ে রাজি করলাম, তারপর প্রিয়ন্তীকে একদিন বাসায় নিয়ে এলো মাহির। বেশ হাসিখুশি মেয়েটা। বাড়ির সকলেরই বেশ পছন্দ হয়। নাবিলকে হেসে বললাম, ‘জানো আজ প্রিয়ন্তী বাসায় এসেছিলো। ভীষণ মিষ্টি মেয়েটা।’ নাবিল ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, ‘প্রিয়ন্তী কে?’ নাবিলকে প্রিয়ন্তীর কথা এর আগে অনেকবার বলেছি। নাবিল ভুলে গিয়েছে। আর এভাবেই ভুলে যাচ্ছে সংসারের সব। মা ফোন করে নাবিলকে নিয়ে খুব করে যেতে বলেছে। নাবিলকে বললাম যাওয়ার কথা। নাবিল বললো গাড়ি পাঠিয়ে দিবে আমি যেন চলে যাই। নাবিলকে ছাড়াই আবারও আমার বাবা বাড়িতে আসা। বিয়ের পর মেয়েরা স্বামী ছাড়া একা কোথায় গেলেই লোকজন জানতে চায়, বর কোথায়? সে কেনো আসে নি?
এই সব প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি আমি। নাবিলকে ছাড়াই আমার আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধবীদের সব অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে হয়। জোর করে মুখটা হাসি হাসি রেখে বোঝাতে হয়, আমি বিবাহিত জীবনে খুব সুখে আছি। নাবিলের কথা জিজ্ঞেস করলে ব্যস্ততার অজুহাতে কাটানো যায়। কিন্তু যখন জিজ্ঞেস করে, আমরা এখনও কেনো বাচ্চা নিচ্ছি না? এই প্রশ্নটা খুব বিব্রতকর হয়ে দাঁড়ায়। ‘চেষ্টা করছি’ বলে কত বার এড়ানো যায়। সমস্যা কার? ডাক্তারের কাছে কেনো যাচ্ছি না? এমন অনেক প্রশ্ন জড় হয় এখন। এখন তাই বেশি লোকজনে আমার বিরক্ত লাগে৷ বুদ্ধি করে এড়িয়ে চলতে হয় প্রসঙ্গ। এসবে আমি এখন খুব ক্লান্ত। দিনশেষে তবুও যদি নাবিল আমায় বুঝতো!
না পাওয়ার আক্ষেপ, অবহেলার হাহাকার, শূণ্যতার আহাজারি, বালিশ ভেজানো চোখের জল দিন দিন সবকিছু বিষাক্ত করে তুলছে। ভালো থাকার মিথ্যা অভিনয়, আমাকে কুঁড়ে খাচ্ছে। আমার এখন একটু বিশ্রাম দরকার। নাবিলের থেকে অনুরোধ করে হলেও একটু সময় নিয়ে নাবিলকে বোঝানো দরকার। মেলে ধরা দরকার আমার ভেতরটাকে। এভাবে আমি আর পারছি না, হতাশায় তলিয়ে যাচ্ছি প্রতিনিয়ত। দেখতে দেখতে দশবছর ঘনিয়ে আসছে সাংসারিক জীবনের। নাবিল নিজ থেকেই জিজ্ঞেস করলো, ‘বলো, এই বিবাহ বার্ষিকীতে কি চাও তুমি আমার কাছে?’ আমি মলিন হাসি দিয়ে বললাম, ‘দিবে তুমি চাইলেই?’ ‘অবশ্যই দিবো। বলো?’ ‘তোমায় চাই, তোমার থেকে কিছুটা সময় চাই। দিবে?’
নাবিল মুচকি হাসলো। এই হাসিটাও আমি দেখিনা অনেক বছর। কাছে এসে বললে, ‘আচ্ছা ওই দিন আমি তোমার। তোমার জমানো যত গল্প আছে আমি শুনবো।’ বিশ্বাস হতে কষ্ট হলেও নাবিলের কথায় আশ্বাস পেলাম ভীষন। অবিশ্বাস করতে মনই চাইলো না। খুশিতে হেসে উঠলাম। নাবিল বললো এবারের বিবাহ বার্ষিকীটা পারিবারিকভাবে পরিবারের লোকজন মিলে বেশ আয়োজন করে পালন করার কথা। শুনে আমারও ভালো লাগলো। সবাই মিলে কতদিন একসঙ্গে বসা হয় না, কথা হয় না। পরিবারের সবার জন্যইতো সবার কত কথা থাকে, শুধু সঠিক সময়টা আসে না বলেই বলা হয় না। নাবিলকে ‘ভালোবাসি’ বলা হয় না বেশ কয়েক বছর। ভেতরের দূরত্বটা কমাতে হবে এবার। শূণ্যস্থানগুলো এবার সব আস্তে আস্তে পূর্ণ করতে হবে। এবার সত্যিই ভেতর থেকে ভালো থাকতে হবে৷
নাবিলও অনেকদিন চোখে চোখ রাখে না। দুষ্টুমি করে বলে না, ‘তৃষ্ণা? আমার ভীষণ তৃষ্ণা পেয়েছে।’ বাড়িতে বেশ আয়েজন করে রান্না বান্না হচ্ছে। সবার পছন্দের রান্নাই আজ করা হচ্ছে। নাবিলের পছন্দের সব রান্না আমি নিজ হাতে যত্ন সহকারেই রাঁধলাম। দুপুরে একসঙ্গে খেতে বসবো সবাই। তারপর সবাই মিলে গল্পের আসর জমানো হবে। আজ আর শ্বাশুড়ি মা কোনো কাজে ত্রুটি খুঁজলেন না। মুখ খানা হাসি হাসি তার৷  দুপুর গড়িয়ে বিকেল। নাবিল এলো না। ফোনটাও তার মতই ব্যস্ত। সবার খাওয়া শেষ। আমার কেবল অপেক্ষা, এই বুঝি এলো বলে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত। রাত আরও গভীর হয়। সবাই ঘুমি তলিয়ে৷ আমার কেবল অপেক্ষা, চলে এলো বুঝি।
একসঙ্গে খাবো বলে দুপুর থেকে অপেক্ষা। খিদেটাও তলিয়ে গেছে রাতের গভীরতায়। ঠিক তখন নাবিলের ফোনকল। তাড়াহুড়ো করে রিসিভ করতে গিয়ে ফোনটা ফ্লোরে পড়ে গেলো। তবুও ফোনকল বেজে চলছে। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে বললো, ‘তৃষ্ণা, অফিসের জরুরি কাজে আমি খুলনা যাচ্ছি। পরশু ফিরবো। আমার জন্য চিন্তা করো না। ঘুমিয়ে যেও।’ আমার থেকে কিছু শোনার অপেক্ষায় আছে নাবিল। অনেক বছর পরে আজ নাবিল নিজের কথা শেষ করে আমাকেও বলার সুযোগ দিচ্ছে। অথচ আজ আমার সুযোগ চাই না। ফোনটা সুইচড অফ করে দিলাম।
নাবিলের সহজ সাবলীল কথাগুলো আমার ভেতরটায় আগুন জ্বালিয়ে দিলো। স্বপ্ন পোড়ানোর আগুন। চোখ থেকে কপলে বাঁধাহীন অশ্রু বয়ে চলছে। চিৎকার করে কান্না করা গেলে, এত বছরের পুষে রাখা বুকের ভেতর শক্ত পাথরটা হয়তো ভাঙচুর হতো। আশেপাশের অন্ধকার জানিয়ে দেয়, আমার শূণ্যতার কথা। একটু পরে ভোরের আজান হবে। মসজিদে প্রবেশ করবে মুসলিমগন। রাস্তাঘাটে আধো আধো আলো থাকবে। সেই আলো গায়ে মেখেই আমার প্রস্থান হবে দূরে, বহুদূরে৷ চারপাশ সুনসান৷ এখনও শহরের ঘুম ভাঙ্গে নি। ঘুম ভাঙ্গেনি এ বাড়ির লোকের। চললাম আমি নতুন ব্যস্ততা ছুঁতে। এবার শুরু হোক আমার ব্যস্ততা। পেছন থেকে কেউ একজন ডাকলো, ‘তৃষ্ণা? দাঁড়াও।’ রাস্তার মাঝপথেই দাঁড়িয়ে রইলাম। পেছন ফিরে তাকানোর ইচ্ছে হলো না। নাবিলের কন্ঠস্বর।
‘আমায় সঙ্গে নিয়ে যাও। না হলে থেকে যাও। তোমাকে আমার বড্ড প্রয়োজন।’ ভেতরটা মোচড় দিলো। পেছন ফিরে তাকালাম। দেখি অন্ধকার। কেউ নেই আশে পাশে। মস্তিষ্ক সজাগ হয়ে উঠে খবর পাঠালো এসবই ভ্রম। আমি পথ চলতে লাগলাম। বারবার মনে হচ্ছে পেছন থেকে প্রত্যাশিত সেই কন্ঠস্বরের আওয়াজ, ‘ভালোবাসি।’ আমি পেছন ফিরে তাকাই না। জানি পেছনে শুধুই শূণ্যতা। মনের ভেতর শক্ত করে গেঁথে নিই, ‘সে ফিরবে না। সে ডুবে আছে ব্যস্ততায়।’
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত