জীবন যোদ্ধা

জীবন যোদ্ধা
রাত এক’টা বাজে। ডা. ইউসুফ এর স্ত্রী তাঁর ৬ মাসের ছেলেটাকে পাশে নিয়ে শুয়ে আছে। একটু পরই ডা. ইউসুফ কল করেন তার স্ত্রী রূপালীকে। রূপালী অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় ছিল এই কলটার। ফোনটা রিসিভ করেই তিনি বলেন,
~ আসসালামু আলাইকুম।
– অলাইকুম আসসালাম। কেমন আছো তোমরা?
~ আলহামদুলিল্লাহ। আপনি?
– সত্যি বলতে এখন পর্যন্ত আল্লাহ বাচিঁয়ে রেখেছেন। আচ্ছা বাবু কি ঘুমিয়েছে?
~ হুম। খেয়েছেন কিছু?
– আর খাওয়া। জানো আজ খুব অসহায় লাগছে নিজেকে।
~ কেন?
– আমার চোখের সামনে দুজন করোনা রোগী তাঁর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে। পারি নি তাদের কোন ভাবেই বাঁচাতে। হাজার চেষ্টা করছি তাও।
~ কান্না করছেন এখন?
– রূপালী আমাদের ছেলেটাকে তুমি অনেক বড় ডাক্তার বানাবে। দেশের বাইরে পাঠিয়ে পড়াশোনা করাবে। জানি না আমি সে সময় পর্যন্ত তোমাদের সাথে থাকতে পারবো কিনা। আমার সবচেয়ে কাছের কলিগ করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। শুধু ও না আরো চার জন। এরপরের জন যে আমি হবো না তার কোন নিশ্চয়তা নেই রূপালী। তুমি আমাদের ছেলেটাকে অনেক বড় ডাক্তার বানাবে। যাতে এরকম পরিস্থিতিতে ও কখনো আমার মতো অসহায় না হয়ে পড়ে।
~ আপনি কান্না থামান প্লিজ। আমার কষ্ট হচ্ছে।
– যেদিকেই তাকাই সেদিকেই করোনা রোগী। আজ ৩ টা মাস হয়ে গেল নিজের ছেলেটাকে দেখি না। কীভাবে কান্না থামাবো বলতে পারো? কোন বাবা পারবে তার ছোট্ট দুধের শিশুটাকে এতোদিন না দেখে থাকতে? রূপালী আমি কীভাবে পারছি বলতে পারো? আমি কি পাষাণ হয়ে গিয়েছি?
~ না। মোটেও না। আপনি হলেন আমার ছেলের শ্রেষ্ঠ বাবা। ও অনেক ভাগ্যবান যে ও আপনার মতো একজন বাবা পেয়েছে। যে নিজের জীবন বাজি রেখে হাজারো মানুষের জীবন বাঁচাচ্ছে। তাদের মুখে হাসি ফোঁটাচ্ছে। আপনার প্রতিটি কষ্ট আমি অনুভব করি। টানা ১৮/২০ ঘন্টা কোন প্রকার ওয়াশরুমে না গিয়ে পিপি পরে ডিউটি করা কোন সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। আপনারা আমাদের জন্য কি জানেন?
– কি?
~ আল্লাহর ফেরেস্তা। যাদের চোখে দেখা যায়৷ যারা দিন রাত এক করে আমাদের সেবা দিয়ে যাচ্ছে। সত্যি আমি আপনার স্ত্রী হয়ে অনেক গর্ব করি।
– দোয়া করো। এখন যেতে হবে। ১৬ ঘন্টা হয়েছে কিছু খাইনি। একের পর এক রোগীর অবস্থা খারাপ হচ্ছে। শুধু আল্লাহকে ডাকছি আর বলছি, আল্লাহ তুমি এদের সুস্থ করে দেও। এদের তুমি ছাড়া আর কেউ নেই। আসি রূপালী।
~ একটু সময় করে কিছু খেয়ে নিবেন।
– আচ্ছা। রাখি এখন। তোমরা ভালো থাকো।
ডা. ইউসুফ ফোন কেটে দেন। রূপালী খুব কষ্টে নিজের কান্নাটাকে এতক্ষণ ধরে রেখেছিলো। কিন্তু এখন আর পারে না। অঝোরে কেঁদে দেয়। ডা. ইউসুফের সামনে রূপালী কাঁদতে পারে নি। নাহলে সে দুর্বল হয়ে পড়বে। তা রূপালী খুব ভালো করেই জানে। তাঁর একমাত্র শক্তি রূপালী। রূপালীর সাথে এই রাত এক’টায় কথা বলা তাকে আগামী দিনের শক্তি আর মনোবল দেয়। রূপালী কাঁদছে তাঁর ছেলেটার দিকে তাকিয়ে। নিষ্পাপ ছেলেটা কতদিন ধরে বাবার কোলে যায় না। আর কতদিন?
এটা একজন ডাক্তার বাবার গল্প হলেও পুলিশ, আর্মি কিংবা করোনাকালে নিয়োজিত সকল ব্যাক্তিবর্গদের অবস্থা ঠিক এরকমই। তাঁরা নিজের সাথে যুদ্ধ করে টিকে আছে। আমাদের দিন রাত সেবা দিয়ে যাচ্ছে জীবনের কোন পরোয়া না করে। পরিবার, ছেলেমেয়ে, খাওয়া দাওয়া সব ছেড়ে আমাদের সেবা করে যাচ্ছে। যেখানে আমরা ঘরের চার দেয়ালে থেকেও নিজেকে সেইফ মনে করি না, সেখানে তাঁরা ২৪ ঘন্টা মাঠে কাজ করছে। পরিবারের কাছেও ফিরে যেতে পারে না। যদি এ যাওয়া তাদের মৃত্যু নিয়ে আসে। আসলে বলা যায়, তাঁরা যেন শহীদ হতেই এই জীবন যুদ্ধে নেমেছে। জানি না তাদের আবার ঘরে ফেরা হবে কিনা। জানি না আবার পারবে কিনা পরিবারকে কোন ভয় ছাড়া শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে। আমি সত্যি জানি না।
পরিশেষে বলতে চাই, এতোগুলো মানুষ জীবনের মায়া ছেড়ে দিয়েছে শুধু আমাদের বাঁচানোর জন্য। আমরা কি তাদের বাচিঁয়ে রাখতে সচেতনতা মেনে চলতে পারি না? নিজেকে এই প্রশ্নটি করবেন। আপনার বিবেক জাগ্রত থাকলে অবশ্যই এর উত্তর পাবেন। ধন্যবাদ।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত