মেঘমুক্ত নীলাকাশ

মেঘমুক্ত নীলাকাশ
মৃত্যুর সময় আমার মা আমাকে একটা চিঠি দিয়ে বলেছিলেন, ” সজীব এই চিঠিটা তোর কাছে রেখে দে বাবা , আমার মৃত্যুর কিছুদিন পরে পড়িস । এর মধ্যে তোর বাবার আর আমার জীবনের কিছু গোপন কথা লেখা আছে । বেঁচে থাকতে সেগুলো বলার সাহস পাইনি তোর কাছে, তাই চিঠিতে লিখে দিয়ে গেলাম ৷ আমি জানি তুই চিঠি পড়ার পরে আমাকে হয়তো অনেক ঘৃণা করবি । কিন্তু পৃথিবীতে এমন সত্য কথাগুলো তোর জানা দরকার তাই লিখে দিতে বাধ্য হলাম ৷ তবে চিঠিটা পড়া না পড়া সম্পুর্ণ তোর নিজের ইচ্ছে, জোর করবো না । “
মা মারা গেছে ৬ বছর হয়ে গেছে কিন্তু আজও আমি সেই চিঠি পড়িনি । কারণ চিঠি পড়ে মা’কে ঘৃণা করতে হবে সেটা আমি চাই না । তাই কিছু কৌতুহল নিজের মধ্যে লুকিয়ে রেখে চিঠিটা যত্ন করে সবসময় কাছে রাখতাম ৷ মাঝে মাঝে যখন পৃথিবীতে কেউ নেই জেনে আত্ম চিৎকার করি তখন পড়তে খুব ইচ্ছে করে ৷ কিন্তু অজানা এক বাঁধা পেয়ে আবারও ভাজ করে রেখে ঘুমিয়ে পরি । কিন্তু আজকে হঠাৎ মনের মধ্যে হতে বারবার কেবল চিঠিটা পড়ার জন্য ইচ্ছে জেগে উঠছে । তাই ৬ বছর ধরে জমিয়ে রাখা কৌতূহল দমন করে চিঠি খুলে পড়া শুরু করছি । বাবা সজীব , আমার মৃত্যুর পরে কেমন আছো তুমি? পৃথিবীতে থাকতে কষ্ট হচ্ছে খুব তাই না ? আজকে এই চিঠিতে কিছু অপ্রিয় সত্যি ঘটনা তোমাকে জানাতে চাই । আশা করি তুমি সম্পুর্ণ চিঠি পড়বে, এরপর যদি আমাকে ঘৃণা করো তাহলে সমস্যা নেই কারণ আমি অপরাধী । আমার অপরাধের শাস্তি এই পৃথিবীতে আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন । বাকিটা হয়তো মৃত্যুর পরে আবার শুরু হবে কারণ পাপ তার বাপকেও ছাড়ে না ।
তুমি ছোটবেলা থেকে জানতে তোমার বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেছে এবং এই পৃথিবীতে তোমার আর আমার আপন বলতে কেউ নেই । আসলে কথাটা সত্যি নয় । তোমার বাবা আমাদের ছেড়ে চলে যায় নি বরং আমি তোমাকে নিয়ে তোমার বাবাকে ছেড়ে চলে এসেছিলাম । তোমার দাদার বংশে ও নানার বংশের অস্তিত্ব আছে । কিন্তু আমার করা ভুলের জন্য আজকে তোমার জীবনটা এলোমেলো ।
আমাদের বিয়ের আগে থেকে তোমার বাবা বিদেশে থাকতেন । ৫ বছর বিদেশে থাকার পরে দেশে ফিরে আসলে তখন তোমার বাবার সাথে আমার বিয়ে হয় । আমি তখন একটা ছেলেকে ভালবাসতাম, কিন্তু আমার মা-বাবার মুখের ওপর কথা বলতে পারিনি বলে তোমার বাবাকে বিয়ে করেছিলাম । কিন্তু মন থেকে তোমার বাবাকে কখনো মেনে নিতে পারিনি তাই সবকিছু তাকে খুলে বললাম । তোমার বাবা আমাকে অনেক ভালবাসতো সেটা আমি আগেও স্বীকার করতাম এবং আজও স্বীকার করি । তাকে ছেড়ে চলে এসেছি তাই বলে যে তাকে মিথ্যে দোষ দেবো সেটা আমি ভাবতেও পারিনা । তুমি এতদিন ধরে জানো তোমার বাবার নাম ইকবাল কিন্তু সেটা ভুল, তোমার আসল জন্মদাতার নাম মোঃ মোশতাক সরোয়ার (মিজান) ।
মিজান আমাকে সবসময় ভালবাসা দিয়ে আমার অতীতকে ভুলানোর চেষ্টা করতো । কিন্তু আমি কখনো অতীতকে ভুলতে পারিনি বলে তোমার বাবাকেও ভালবাসতে পারিনি ৷ বিয়ের পরে ৫ মাস তোমার বাবা বাংলাদেশে ছিলেন আর তখনই তুমি আমার গর্ভে চলে এলে ৷ তোমার জন্মের আগমন বার্তা তোমার বাবা দেশে থাকতে শুনে গেছেন । তবে আমি তখন তোমাকে জন্মদিতে চাই নাই কারণ আমি অন্য কাউকে ভালবাসি । তাই আমি তোমার বাবা মিজানের সন্তানের জননী হতে চাইনি । কিন্তু তোমার বাবা ইচ্ছে করে তোমাকে পৃথিবীতে আনতে চেয়েছে কারণ তার ধারণা ছিল যে, একটা সন্তান হলে আমি স্বাভাবিক ভাবে সংসার করবো ।
কিন্তু আমি স্বাভাবিক হতে পারি নাই । তোমার জন্ম হয়েছিল তোমার দাদা বাড়িতেই তখন তোমার দাদী জীবিত ছিল কিন্তু দাদা মৃত কবরবাসী । আমি কিন্তু তোমাকে নষ্ট করার জন্য অনেক চেষ্টা করছি কিন্তু তুমিও শপথ করেছিলে হয়তো যে তুমি পৃথিবীতে আসবেই ৷ তাই বারবার বিভিন্ন ঔষধ খাবার পরেও তোমাকে নষ্ট করতে পারি নাই ৷ তোমার জন্মের পরে আমি তোমাকে দেখে অনেক খুশি হলাম । প্রথমে ভেবেছিলাম তোমাকে তোমার দাদীর কাছে ফেলে রেখে আমি আমার পছন্দের মানুষের সাথে পালিয়ে বিয়ে করবো । কিন্তু তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে সেটা আর করতে পারি নাই ।
তোমার বয়স যখন এগারো মাস তখন তোমাকে নিয়ে আমি আমার নিজের ব্যাবহৃত গহনাপত্র এবং তোমার বাবার পাঠানো অনেকগুলো টাকা নিয়ে পছন্দের মানুষের হাত ধরে এই ঢাকা শহরে চলে আসলাম । মিরপুরের জনতা হাউজিংয়ের মধ্যে একটা এক রুমের বাসা ভাড়া করে আমরা থাকতে শুরু করলাম । তোমার বাবাসহ পৃথিবীর সকল পরিচিত মানুষের সাথে আমি যোগাযোগ বন্ধ করে দিলাম । এর ঠিক ৭ মাস পরে তখন তোমার বয়স ছিল আঠারো মাস । আমার পেটের মধ্যে প্রচুর ব্যাথা করতো আর হঠাৎ হঠাৎ করে ব্যাথায় অজ্ঞান হয়ে পরতাম । আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হলো, ডাক্তার সবকিছু পরীক্ষা নিরিক্ষার পরে বললেন আমার পেটের মধ্যে ছোট্ট একটা ক্যান্সার সৃষ্টি হয়েছে কিন্তু ভয়ের কিছু নেই । কারণ অপারেশন করলেই রোগী সুস্থ হয়ে যায় তবে কিছু টাকা খরচ করতে হবে ।
আমার কাছে টাকা অবশিষ্ট ছিল না কারণ সবকিছু আমি ওকে দিয়ে দিছিলাম কিন্তু গহনাপত্র ছিল । আমি তাকে বললাম, গহনাপত্র বিক্রি করে আমার অপারেশনের ব্যবস্থা করতে । সে গহনাপত্র বিক্রি করেছে ঠিকই কিন্তু সেটা আমার চিকিৎসার জন্য না । সে সেই মুহূর্তে আমাকে ওই হাসপাতালে ফেলে রেখে গহনা বিক্রির টাকা নিয়ে পালিয়ে গেল । তুমি তখন আমাদের বাসার পাশের ফাতেমা ভাবির কাছে থাকতে । ফাতেমা ভাবি পরবর্তীতে সবকিছু জেনে তার স্বামীর কাছে বলে । তার স্বামী বিষয়টা বাড়ির মালিকের কাছে বলে । বাড়ির মালিক সেই বছর হজ্জ করে এসেছেন, তিনি আমার চিকিৎসার জন্য ৪২ হাজার টাকা খরচ করেছেন । এবং তিনি আমাকে বলেছেন যে, আমি যতদিন তার বাসায় থাকবো ততদিনে কোন ভাড়া দিতে হবে না । একটা মানুষ এত ভালো হয় কিভাবে ? আমি জানিনা, তবে সেদিনই বিশ্বাস করেছি জগতে এখনো ভালো মানুষ আছে , তার কাছে আমি চির কৃতজ্ঞ ।
এরপর থেকে আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত শুরু হয়ে গেল, আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলাম বারবার কিন্তু তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে সেটা পারিনি । ফাতেমা ভাবির মাধ্যমে যোগাযোগ করে মিরপুরেই গার্মেন্টসে চাকরি শুরু করলাম । গার্মেন্টসের জব কতটা গালাগালি সহ্য করে করতে হয় সেটা শুধু গার্মেন্টস শ্রমিকরাই জানে । সারাদিন অফিসের মধ্যে কাজ করতাম আর গালাগালি করলে কান্না করতাম । বাসায় ফিরে রান্না করে তোমাকে নিয়ে বুকে জড়িয়ে সুয়ে থাকতাম ৷ তোমার বাবার সেই নিশ্বার্থ ভালবাসাকে স্মরণ করে বুক ফেটে কান্না বেরিয়ে আসতো ।
তোমার মনে পরে ? মাঝে মাঝে তুমি ঘুম থেকে উঠে দেখতে আমি কান্না করি । তুমি বলতে ” মা তুমি কান্না করো কেন ? সুমন কি তোমাকেও মেরেছে ? ” সুমন ছিল ফাতেমা ভাবির ছেলে , আমি অফিসে গেলে তোমাকে সবসময় মারতো আর তুমি কান্না করতে । তাই আমি কান্না করলেও তুমি মনে করতে যে সুমন মনে হয় আমাকে মেরেছে ।
আস্তে আস্তে কান্না করতে করতে চোখের নোনাপানি শুকিয়ে গেল । তুমি বড় হয়ে গেলে আমিও আর আগের মতো কান্না করতাম না । কলোনির সবার বাবা যখন আদর করতো তখন তুমি তোমার বাবার কথা জানতে চাইতে ।
কলোনির সবাই জানতো যে, ইকবাল তোমার বাবা কিন্তু কথাটা মিথ্যা । ওহহ তোমাকে বলা হয়নি, যার সাথে পালিয়ে এসেছিলাম তার নাম ইকবাল । তোমাকে এগারো মাসের শিশু অবস্থায় নিয়ে এসেছি তাই সবাই জানতো যে তুমি ইনবালের সন্তান । তাই কলোনির সবাই এবং আমি এতদিন তোমাকে ভুল জানিয়ে এসেছি । তুমিসহ কলোনির সবাই জানে যে তোমার বাবা একজন বিশ্বাসঘাতক বেঈমান । কিন্তু আজকে আমি তোমার কাছে প্রকাশ করছি, তোমার জন্মদাতা পিতা বেঈমান ছিল না । বেঈমান ছিল সেই মানুষটা যাকে আমি বিশ্বাস করে তোমার বাবাকে ঠকিয়েছি ।
তুমি বড় হয়ে যখন মাঝে মাঝে তোমার বাবাকে ঘৃণা করার কথা বলতে । তখন বারবার আমি বলতে চেয়েছিলাম যে তোমার বাবাকে ঘৃণা করো না কারণ সে ফেরেশতার মতো মানুষ । কিন্তু আমি তখন ভয়ে বলতে পারিনি তাই এ জীবনে বেঁচে থাকতে তোমাকে বলা হলো না ।
আমার মৃত্যুর পরে তুমি বড় একা হয়ে যাবে তাই আমি চাই তুমি তোমার বাবার কাছে ফিরে যাবে । আমার বিশ্বাস আজও তোমার বাবা তোমাকে ভালবাসবে । আমাকে এখন সে ভালবাসে কিনা জানিনা, তবে তুমি যদি সত্যি সত্যি যাও তাহলে তার কাছ থেকে চুপিচুপি জেনে নেবে । সে কি আজও আমাকে ভালবেসে নাকি ঘৃণা করে ? জানার পরে গভীর রাতে আকাশে দিকে তাকিয়ে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলে দিও আমি শুনতে পাবো ।
জেলা;- বাগেরহাট ।
থানা;- মোড়েলগঞ্জ ৷
গ্রাম ;- সূর্যমুখী ।
গ্রামের মধ্যে গিয়ে তোমার বাবার নাম বললে সবাই দেখিয়ে দেবে । বলবে তালুকদার বাড়ি মোশতাক সরোয়ার মিজানের বাড়ি যাবো । বাজারের কাছে প্রাইমারি স্কুলের পাশ দিয়ে একটা রাস্তা । সেই রাস্তা দিয়ে সামান্য ভিতরে গেলে দেখবে রাস্তার বাম হাতে দোতলা পাকা বাড়ি । তোমার বাবা বিদেশে যাবার এক বছর পরেই টাকা পাঠিয়ে পাঠিয়ে ১০ মাসের মধ্যে ওই বাড়ি করেছিলেন । বাড়ির সামনের দিকে লাল রং করা আছে তবে এত বছর পরে রং হয়তো খসে গিয়েছে তাই নতুন কালার করতে পারে । তোমার বাবার কাছে গিয়ে আমার সবকিছু খুলে বলবে । বলবে যে তাকে ছেড়ে আসার পর থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমি তার কাছে ও আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়েছি । আমি চাই যেদিন তুমি চিঠিটা পড়বে সেদিনই তুমি গ্রামের বাড়ি চলে যাবে । ঠিকানাটা মনে রেখো কিন্তু আবার ভুলে যেও না ।
ইতি,
তোমার আম্মু
ফারজানা কবিতা ।
চোখের পানি মুছে বাহিরে তাকিয়ে দেখি এখনো অন্ধকার হয়ে আছে । মসজিদের ইমাম সাহেব সবাই কে মাইকে বলছেন , ” প্রিয় এলাকাবাসী আজকে পবিত্র রমজানের শেষ দিন , সবাই তাড়াতাড়ি সেহরি খেতে উঠুন ৷ “
কলোনির মধ্যে ২৩ টা পরিবার থাকতো, তাদের মধ্যে ১৭ টা পরিবার ঈদের ছুটি কাটাতে গ্রামের বাড়ি চলে গেছে । তাই কলোনির মধ্যে তেমন হইহট্টগোল শোনা যাচ্ছে না । আমি রুমের বাতি অন করে ব্যাগের ভেতর কাপড় গুছিয়ে নিচ্ছি । এমন সময় দরজায় ঠকঠক করে কড়া নেড়ে উঠলো, নিশ্চয়ই বৃষ্টি এসেছে সেহরির খাবার নিয়ে । মা মারা যাবার পরে আমি বৃষ্টিদের বাসায় খাওয়া দাওয়া করি বিনিময়ে প্রতিমাসে চার হাজার টাকা তাদের দেই ।
– দরজা খুলে দিলাম বৃষ্টি আমাকে ব্যাগে কাপড় ভরতে দেখে বললো , কি করো এগুলো ? (বৃষ্টি)
– কাপড় গোছাচ্ছি গ্রামের বাড়ি যাবো । (আমি)
– কার কাছে ?
– বাবার কাছে !
– মানে কি ? তোমার বাবার খবর পাওয়া গেছে ? এত বছর পরে আবার কোই থেকে বের হলো ?
– সবকিছু পরে বলবো , আমাকে এখনই বের হতে হবে তুমি খাবার রেখে যাও আমি খেয়ে তারপর সাথে সাথে বেরিয়ে পরবো ।
– আমিও তোমার সাথে যাবো ।
– পাগল নাকি তুমি ? আমার নিজের সেখানে কেমন অবস্থা হবে জানিনা তারমধ্যে আবার তুমি ?
– তুমি খুব ভালো করে জানো যে আমি তোমার জন্য গ্রামের বাড়ি যাইনি । মা-বাবা যেতে চেয়েছে তবুও আমি যাবনা বলে তারাও যায়নি । আর সেই তুমি আমাকে রেখে চলে যাবে ?
– দেখো বৃষ্টি, আমি যদি ফিরে আসি তাহলে সবকিছু আর কাউকে কিছু না বললেও তোমাকে বলবো ।
– কিন্তু তোমাকে একা কোথায় ছেড়ে দেবো আমার যে খুব ভয় লাগে ।
– চিন্তা করো না তুমি , আমি ফিরে আসার চেষ্টা করবো ।
– মানে কি এসবের ? চেষ্টা করবো মানে কি ? বলো তুমি আমার কাছে ফিরে আসবে ।
– বৃষ্টি তুমি কিন্তু ভালো করেই জানো যে, আমি একটুতেই অনেক রেগে যাই । তাই এই মুহূর্তে আমার রাগ বাড়িয়ে দিও না প্লিজ প্লিজ ।
– সারাক্ষণ কল দিয়ে কথা বলবে তো ?
– তা হয়তো পারবো না, কিন্তু আমি ঝামেলা শেষ করে তোমার সাথে যোগাযোগ করবো । তুমি সেই বিশ্বাস রাখতে পারো ।
– ঠিক আছে তাহলে তুমি খাও আমি তাকিয়ে দেখি ।
– কোন দরকার নেই তুমি রুমে গিয়ে সেহরি খাও ৷
বৃষ্টি আমাকে ভালবাসে, কলোনির মধ্যে আমরা একসাথে বড় হয়েছি । ক্লাস নাইনে পড়ার সময় থেকে ও গার্মেন্টসে চাকরি করা শুরু করে । আমি অবশ্য এসএসসি পাস করেছিলাম, তারপর মা মা’রা গেল আর আমারও পড়াশোনা সমাপ্ত হয়ে গেল । মা যখন মা-রা গেছে তখন আমার বয়স সতেরো বছর আর আজ ছয় বছর পরে আমার বয়স তেইশ ।
বাসা থেকে বেরিয়ে মিরপুর থেকে সরাসরি চলে গেলাম যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তায় । আমাদের কলোনির এক লোকের বাড়ির বাগেরহাট মোংলা তাই সে বলেছেন যে যাত্রাবাড়ী হয়ে গেলে নাকি সুবিধা হবে । অবশ্য আমার ইচ্ছে ছিল এখন থেকে কাছেই গাবতলী বাস স্টেশন থেকে যাবো । যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তায় এসে দেখি হাজার হাজার মানুষের বাড়ি ফেরার প্রচেষ্টা । আমি ঠিক কি রকম গাড়ির মধ্যে উঠবো সেটা ভাবছি আর তখন চোখ পরলো একটা মহিলা তার স্বামীকে ঝাড়ি দিচ্ছে । মহিলার কোলে ছোট্ট একটা বাচ্চা, মহিলার স্বামী বারবার এদিক সেদিক তাকাচ্ছে ।
যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা থেকে আসলাম মাওয়া ঘাটে তারপর ফেরি পার হয়ে মাইক্রোবাসে করে সরাসরি বাগেরহাট । বাগেরহাট থেকে আবার লোকাল বাসে করে মোড়েলগঞ্জ বাস স্টেশন । সেখান থেকে জিজ্ঞেস করে জানলাম যে, সূর্যমুখী গ্রাম এখান থেকে ৮ কিঃমিঃ দুরত্ব । মোটরসাইকেল করে ২০০ টাকার চুক্তিতে আমি উঠে বসলাম এবং প্রায় ২৫ মিনিট পরে আমি তালুকদার বড়ি মোশতাক সরোয়ার মিজান মানে আবার বাবার বাড়ি এসে পৌছলাম ।
মায়ের বলা বর্ননা সবকিছু ঠিক আছে, বাড়ির রং লাল ঠিকই কিন্তু সচ্ছ ঝকঝকে মনে কিছুদিন আগে রং করা হয়েছে । আমি বাড়ির মধ্যে গেলাম, দুই সাইডে ফুলের গাছ তার মধ্যে দিয়ে ইট বিছানো রাস্তা ঘরের সাথে মিলেছে ৷ রাস্তা দিয়ে হেঁটে হেঁটে ঘরের সামনে সিঁড়ির কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম । সিড়ির উপর একটা লোক বই হাতে বসে আছে, চোখে চশমা বয়স আনুমানিক পঞ্চাশ কি পঞ্চান্ন ।
– আমার দিকে তাকিয়ে দেখে আবারও বইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন , কাকে চাই ? (লোকটা)
– আমি মোশতাক সরোয়ার মিজান সাহেবের সাথে দেখা করতে চাই ৷
– লোকটা বই থেকে চোখ সরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন । বাম হাত দিয়ে চোখের চশমা খুলে নিলেন কারণ চশমা শুধু বইয়ের জন্য । মানুষের সাথে কথা বলার জন্য না । বললেন , মোশতাক সরোয়ার কে তুমি চেনো না ?
– জ্বি না কখনো দেখিনি তবে আমার মা দেখলে চিনতে পারবে ।
– তোমার মায়ের নাম কি ?
– জ্বি ফারজানা কবিতা, আমি মোশতাক সরোয়ার সাহেবের ছেলে মোঃ সাইফুল ইসলাম সজীব ।
– ওহহ আচ্ছা ৷
– “এবার তিনি বসা থেকে উঠে সিঁড়ির সামনে গিয়ে দোতলার জানালায় তাকিয়ে ডাক দিলেন, মাহি কোই তুমি ? “
– উপর থেকে চিকন কন্ঠে একটা মেয়ে বললো, জ্বি বাবা বলো ৷ ( মনে হয় মেয়েটির নাম মাহি )
– তোমার আম্মুকে নিয়ে নিচে আসো , তাকে বলো তোমার বড় আম্মুর ছেলে সজীব এসেছে ৷
আমি সিঁড়িতে বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলাম , তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন , তুমি থাকো তাহলে আমি একটু বাহিরে যাচ্ছি ৷ বলেই তিনি পিছনের দিকে ফিরে রাস্তার দিকে হাটা শুরু করলো । একটু পরে ১৫/১৬ বছরের একটা মেয়ে ও মায়ের বয়সী এক মহিলা মাথায় কাপড় দিয়ে আমার সামনে এসে দাড়ালো । আমার দিকে তাকিয়ে আছে কেউ কিছু বলছে না , আমি একটু ইতস্তত বোধ করে নিজেই বললাম ; ” আসসালামু আলাইকুম , কেমন আছেন আপনারা ? “
– এবার মহিলাটা মুখ ফুটে জবাব দিয়ে বললো, ওয়া আলাইকুম আসসালাম, আমরা সবাই ভালো আছি । তুমি কেমন আছো বাবা ? “
– জ্বি আলহামদুলিল্লাহ ভালো ।
– বাইরে দাড়িয়ে আছো কেন ? চলো ভিতরে চলো , ও মাহি তোর ভাইয়ের কাছ থেকে ব্যাগটা হাতে নে কত কষ্ট করে শহর থেকে এসেছে ।
আমি তাদের পিছনে পিছনে দোতলায় উঠলাম, উপরে গিয়ে একটা তালাবদ্ধ ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম । “মহিলা বললো, ও মাহি ! তোর বাবার টেবিল থেকে এই রুমের চাবি নিয়ে আয় । ” মাহি চলে গেল চাবি আনার জন্য দুই মিনিটের মধ্যে আবারও চাবি নিয়ে হাজির । তালা খুলে রুমের মধ্যে প্রবেশ করলাম, ভেবেছিলাম বদ্ধ ঘরে মনে হয় ধুলো ময়লা জমা থাকবে । কিন্তু আমার ধারণা ভুল কারণ রুম ঝকঝকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন । বিছানা ধবধবে সাদা চাদর দিয়ে ঢাকা, চারিদিকে আসবাবপত্র সবকিছু অনেক নতুন নতুন লাগে । আমি খাটের ওপর বসলাম, মাথার উপর সিলিং ফ্যান চালু করা হলো । মহিলাটা আমার পাশে বসে বললেন, ” তুমি বিশ্রাম করে গোসল করো, আমি রান্না ঘরের দিকে যাচ্ছি । মাহি তোমার কাছাকাছি আছে কিছু দরকার হলে ওকে বলবে । “
– ” আমি বললাম, আসলে আন্টি আমি তো আগে কখনো আসিনি তাই কাউকে চিনিনা । এমনকি আপনাদের সাথেও তো পরিচয় নেই । “
– ” শোন কথা ছেলের , আমি তোমার বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী আর তোমার ছোট মা আর এ হচ্ছে তোমার বোন মাহি । আর বাহিরে যার সাথে প্রথম দেখা হয়েছে সেই হচ্ছে তোমার বাবা । “
আমি অবাক হলাম, বাবাকে চোখের সামনে দেখে কিছু বলতে পারিনি । আমাকে দেখে বাবা রাগ করেছে নাকি খুশি হয়েছে মনে নেই । বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করে স্ত্রী সন্তান নিয়ে সুখে আছে, অবশ্য এটাই হওয়ার ছিল । আমার মা নিজের ভুলের জন্য শাস্তি ভোগ করতে করতে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে । কিন্তু বাবা তো ভুল করেনি তাই পুনরায় বিয়ে করে সুখী হবার অধিকার বাবার আছে । ভাবছি রাতে বাবাকে জিজ্ঞেস করবো আমার মা’কে সে ক্ষমা করতে পেরেছে কিনা ? তারপর গভীর রাতে এই বাসার ছাঁদে দাঁড়িয়ে মা’কে জানিয়ে দেবো । সৎ মা হলেও তার ব্যবহার আমার কাছে খুব ভালো লাগলো যা সচারাচর সবসময় দেখা যায় না । মাহি আমার বোন , সম্পুর্ণ নাম জানা হয়নি , সে আমার সাথে কথা বলতে একটু কেমন সঙ্কোচ বোধ করে । তার জড়তা কাটিয়ে দিতে হবে কিন্তু তার আগে নিজে ফ্রেশ হতে হবে ।
রুমটা খুব পছন্দ হয়েছে আমার , এতক্ষণে দেয়ালে তাকিয়ে দেখি আমার মা ও বাবার একটা ফ্রেমে বাঁধানো ছবি ঝুলছে । বাবার মুখটা হাসিহাসি কিন্তু মায়ের মুখটা কালো মনে হয় ছবি তোলার সময়ও মা মনে মনে বাবাকে সরিয়ে রেখেছে । অনেক্ক্ষণ ধরে রুমের চারিদিকে তাকিয়ে রইলাম তারপর জানালা খুলে দিলাম । দক্ষিণ ও পশ্চিমে দুটো জানালা যা এই রুমের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য যথেষ্ট । দক্ষিণের জানালা দিয়ে বাতাস আর পশ্চিমের জানালা পড়ন্ত বিকেলের অপরুপ চিত্র দেখা যাবে ৷
ইফতার করলাম মাগরিবের নামাজ আদায় করছি কিন্তু বাবা বাসায় আসলো না । আগামীকাল ঈদের দিন তাই বাহিরে মানুষের বাজি ফাটানোর শব্দ শোনা যাচ্ছে । চাঁদ চাঁদ বলে বাচ্চারা চিৎকার করে করে দৌড়চ্ছে মনে হয় । ছোট মা’কে জিজ্ঞেস করে জানলাম বাবা নাকি প্রতিদিন বাড়িতেই ইফতার করতেন কিন্তু আজকে হঠাৎ বাড়িতে এলেন না । আমি মনে মনে ভাবলাম, তবে কি আমার জন্য এমন করা হয়েছে ? তাহলে কি আমি ভুল করছি ?
রুমের মধ্যে এসে মায়ের কিছু স্মৃতি কল্পনা করতে করতে তন্দ্রা লেগেছিল । মাহির ডাকে ঘুম ভেঙ্গে গেল , ” মাহি বললো ভাইয়া মা তোমাকে খেতে ডাকছে ।
– ” বললাম, বাবা এসেছে ? “
– “হ্যাঁ, বাবা খাবার টেবিলে বসে আছে । “
– ” আচ্ছা চলো তাহলে । “
খাবার টেবিলে আমি বাবা আর মাহি একসাথে বসলাম , ছোট মা খাবার বেরে বেরে দিচ্ছেন । নানা ধরনের তরকারি রান্না করা হয়েছে , সবার প্রথম আমার প্লেটে ইলিশ মাছের মাথা আর মাছের ডিম দেয়া হলো ।
– নিচের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে খাচ্ছি হঠাৎ করে বাবা বললো , তারপর কি খবর তোমার ? কেমন আছো ?
– জ্বি আলহামদুলিল্লাহ ।
– হঠাৎ করে আমাদের বাড়িতে কি মনে করে আসলে ? তোমার তো এ বাড়িতে আসার কথা না । কোন উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছো সেটা বোঝা যাচ্ছে ।
– আমি এবার দাঁড়িয়ে থাকা ছোট্ট মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলাম, তিনিও আমার দিকে তাকিয়ে আবার বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন । কারণ বাবা পরবর্তীতে কি বলে সেটা জানার জন্য । বললাম, তেমন কোন উদ্দেশ্য নেই হঠাৎ করে চলে এসেছি । একটা কাজের জন্য এসেছিলাম বাগেরহাট তাই ভাবলাম ঘুরে যা-ই ।
– ওহহ আচ্ছা, তাইতো বলি যে, ফারজানার ছেলে হঠাৎ আমার বাড়িতে কি করে ? তা ঈদের দিন মায়ের কাছে থাকতে মন চায় না ?
– এবার আমার চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে গেল , তাই কোনমতে নিজেকে সামলে বললাম , আমার মা মারা গেছে ছয় বছর আগে ।
– এবার বাবার কথা শুনে আমি আকাশ থেকে পরলাম ! বাবা বললো, তোমার মা মা-রা গেছে তা আমি জানি । আমি বলছি দীর্ঘ এক মাস রোজার পরে ঈদের দিন মায়ের কবরের কাছে সন্তানের যাওয়া উচিৎ ছিল ।
– জ্বি তা ছিল , কিন্তু আপনি আমার মায়ের মৃত্যুর সংবাদ জানেন ?
– হ্যাঁ জানি, কেন জানতে পারি না ?
– জ্বী পারেন ।
– তাহলে আর কি ? আচ্ছা যে দরকারে এসেছো সেবা যদি শেষ হয়ে থাকে তাহলে তো কালই চলে যাবে মনে হয় ?
– জ্বি আমি কালই চলে যাবো ।
বাবা হাত ধুয়ে উঠে চলে গেলেন আমি দুচামচ ডাল নিয়ে বাকি ভাত গুলো খেয়ে উঠে পরলাম । আমার জন্য বরাদ্দ করা রুমের মধ্যে গিয়ে দক্ষিণ জানালা খুলে বাহিরে তাকিয়ে আছি । বাবার প্রতিটি কথা কানের মধ্যে বেজে উঠল, আমি এসে তাদের মাঝে একটা ক্ষনিকের অশান্তি সৃষ্টি করেছি । ফসলের মাঠের মধ্যে আগাছা হয়ে ঢুকে গেলাম কিন্তু যেটা উচিত ছিল না । বাবার কাছে মায়ের শেষ প্রশ্নটা করতে ইচ্ছে করে কিন্তু সাহস পাচ্ছি না । পরিস্থিতি সেই সুযোগ তৈরী করে দেয়নাই আমাকে, তবে যতটুকু বুঝতে পারছি ততটুকু বা কম কিসে ? আমি যত দ্রুত সম্ভব চলে যাবো, কারণ আগামীকাল ঈদের দিন বাবার অনেক পরিচিত ব্যাক্তি অথবা গ্রামের অনেকে আসবেন ।
তাদের সামনে হয়তো আমি ফারজানা কবিতার ছেলে পরিচয় দিয়ে দাড়াতে পারবো না । বাবা হয়তো আমার জন্য লজ্জিত হবে তারচেয়ে আজকে সকালে যেভাবে সূর্য ওঠার আগে ঢাকা থেকে রওনা দিলাম । ঠিক তেমনি করে আগামীকাল সূর্য ওঠার আগেই এই সূর্যমুখী গ্রাম ত্যাগ করতে হবে । আমার মায়ের কোন সম্মান হয়তো কারো কাছে নেই , মায়ের সাথে সাথে আমিও আজ দুর আকাশ পথের যাত্রী । বাবা ভালো থাকুক, ছোট মা আর মাহি কে নিয়ে তার জীবন পেরিয়ে যাক আনন্দে । আমি নাহয় ব্যাস্ত শহরের মাঝে দিনশেষে মায়ের কবরের পাশে দাঁড়ালে দুফোঁটা চোখের পানি ফেলে বাসায় ফিরে ঘুমিয়ে পরবো । জীবন এমন কেন ? মানুষ সঠিক সময়ে সঠিক কাজ করতে চায় না কেন ? আজকে আমি এভাবে কেন ?
– নিজের কাঁধের উপর কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখি ছোট মা দাঁড়িয়ে আছে । বললেন, বাবার কথায় কষ্ট হচ্ছে তাই না ?
– একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম, ” না মা সত্যি মেনে নিতে আমার তেমন কষ্ট হয়না কারণ ছোটবেলা থেকে কষ্টের মাঝে বড় হয়েছি । “
– ” তোর বাবার উপর রাগ করিস না বাবা । “
– ” তুই হচ্ছে আদরের ডাক, তাই ছোট মায়ের মুখে তুই শুনে ভালো লাগলো , রাগ করার ক্ষমতা আমার নেই মা । “
– তোর বাবাকে যতটা কঠিন মনে করছিস তিনি কিন্তু ভিতর সম্পুর্ণ বিপরীত । তোর মায়ের জন্য আর তোর জন্য রাতের পর রাত কষ্ট পাচ্ছে ।
– একটা কথা বলবেন মা ?
– বল ।
– বাবা আমার মায়ের মৃত্যুর খবর কিভাবে জানে ?
– তোর বাবা তোদের খবর সবসময় রাখতেন সেই ২২ বছর আগে থেকে ।
– মানে ?
– ” তোর মা তোকে নিয়ে চলে যাবার মাস খানিকের তোর বাবা দেশে ফিরে আসে ।
তারপর বিভিন্ন যায়গা খোঁজ খবর নেয় কিন্তু খবর পেতে পেতে ৬/৭ মাস লেগে গেল । তোর মা যাকে বিয়ে করেছিল তার বাড়ি তোর নানাবাড়ির পাশের গ্রামে । তাকে খুঁজে বের করা হলো কিন্তু তখন তোর মা হাসপাতালে । ছোটবেলায় নাকি তোর মা একবার অসুস্থ হয়েছিল তখন তোর মা যাকে বিয়ে করেছিল সে নাকি সবকিছু নিয়ে পালিয়ে গেল । তার এক আত্মীয়ের মাধ্যমে তার সাথে তোর বাবা যোগাযোগ করে । সে তখন তোর আর তোর মায়ের ঠিকানা বলে তখন তোর বাবা খবর নিয়ে জানেন যে তোর মা হাসপাতালে ভর্তি । তোর বাবা বাড়ির মালিকের কাছে বলে টাকা দিয়ে অপারেশনের ব্যবস্থা করে । তোদের জন্য বাড়ি ভাড়া মাফ করে দিতে বলে কারণ প্রতি মাসে তোর বাবা ভাড়া দিয়ে দিত । তোর বাবা তখন তোর মা’কে ফিরিয়ে আনতে চেয়েছে কিন্তু তোর দাদী জীবিত ছিল বলে পারে নাই । তোর দাদী পালিয়ে যাওয়া পুত্রবধূকে পুনরায় ঘরে তুলতে পারবে না । এবং তারই জোরাজোরিতে আমাকে বিয়ে করে ঘরে নিয়ে আসে । তোরা যে বস্তিতে থাকতি সেখানে সবাই তোকে তোর মা যার সাথে পালিয়ে গেল তার সন্তান জানে তাই তোর বাবা কখনো সামনে গিয়ে দাবি করেনি ।
কারণ তোর বাবা যদি সবার সামনে গিয়ে সবকিছু বলে তারপর তোকে নিয়ে আসতে চাইতো তাহলে সেইখানের সবাই তোর মা’কে অপমান করতো । তোর মা’কে সবাই খারাপ মনে করতে আর তোর মা কষ্ট পেত । তাই তোর বাবা এতটা বছর ধরে নিজের কষ্ট নিজের কাছে রেখে দিয়েছে কখনো প্রকাশ করেনি । তোর মা যখন মারা গেছে তখন সে অনেক কান্না করছে কিনা জানিনা তবে কয়েকটা রাত ছাঁদে কাটিয়ে দিয়েছে । তুই এই-যে রুমের মধ্যে আছিস এটা তোর মায়ের রুম । তোকে নিয়ে এগারো মাস এই রুমের মধ্যে থাকতো তোর মা । এই রুমটা সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে শুধু তোর জন্য ৷ আমি বউ হয়ে আসার তিন মাস পরে তোর দাদীর মৃত্যু হলো । আমাদের বিয়ের পাঁচ বছর পরে তোর বোন মাহির জন্ম হয়েছিল । তুই তোর বাবার সাথে রাগ করে চলে যাসনে বাবা, কারন তোর বাবা তোকে পেয়ে কতটা আনন্দিত সেটা আমি বুঝতে পারছি । হয়তো অনেক অভিমান নিয়ে বসে আছে তাই এমন করে কথা বলে তাই বলে বাবার সাথে রাগ করে চলে যাসনে ।
– আমি হতবাক হলাম, বললাম ঠিক আছে মা তাহলে আপনার কথাই রাখবো । আমার মা আমাকে বলেছিলেন যে, আমি যেন বাবাকে জিজ্ঞেস করি বাবা কি মা’কে ভালবাসে নাকি ঘৃণা করে ?
– আজও তোর বাবা খুব ভালবাসে তোর মা’কে, তার সাথে সংসার করতে করতে অনেক বছর পার হয়ে গেছে । তাই আমি জানি তোর বাবা তোকে আর তোর মা’কে কতটা ভালবাসে । আচ্ছা তুই ঘুমিয়ে পর তাড়াতাড়ি কাল সকালে খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠতে হবে কিন্তু ।
– আচ্ছা ঠিক আছে ।
বাতি বন্ধ করে বিছানায় সুয়ে আছি নতুন অপরিচিত স্থান তাই ঘুম আসছে না । এমন একটা উত্তেজনা পূর্ণ রাতে ঘুম আসার কথা নয় তবুও বৃথা চেষ্টা করছি । মায়ের কথা খুব মনে পরছে, কি অপরাধ তার ? সে একটা মানুষকে ভালবেসে স্বপ্ন দেখেছিল আর স্বপ্ন পূরণ করতে সবাইকে ছেড়ে চলে গেছে । এটাই তার অপরাধ ? যার সাথে পালিয়ে গেল সে যদি মা’কে ভালবাসা দিয়ে আগলে রাখতো তাহলে মায়ের জীবনের গল্পটা ভিন্ন হতে পারতো । কিন্তু হয়নি কারণ প্রকৃতি সবকিছুর হিসাব রাখেন । সবকিছু সবাইকে ফিরিয়ে দেবে ।
দরজা খুলে কে যে অন্ধকারে প্রবেশ করলো , রুমে অন্ধকার তবুও চোখ সয়ে গেছে । বাহিরে জোৎস্না নেই কারণ আজকে শাওয়াল মাসের নতুন চাঁদ উঠেছে । সেই চাঁদের আলোয় জানালার উপরের ভেন্টিলেটর দিয়ে আলো আসা সম্ভব না । তবুও ঘরের মধ্যে তাকিয়ে বোঝা যাচ্ছে বাবা প্রবেশ করেছে । কারণ মা অথবা মাহির দেহ এতটা লম্বা আর সাস্থ্যবান না । আমার খাটের পায়ের কাছে টেবিলের কাছে গিয়ে কি যেন রাখলেন । আমি নিঃশব্দে তাকিয়ে আছি , টেবিলের কাছ থেকে আমার মাথার আসলো । মশারিটা আস্তে আস্তে তুলে আমার কপালে হাত রাখলেন । আমি ঘন ঘন নিশ্বাস ছেড়ে দিচ্ছি, বাবা তার মাথা নিচু করে আমার কপালে আস্তে একটা চুমু দিল । তারপর হাত সরিয়ে মশারী ঠিক করে দিয়ে পিছনে ফিরে যেভাবে এসেছে সেভাবেই চলে গেল । আমি অন্ধকারের মত সবকিছু গোপনে দেখলাম, বাবা গোপনে এসেছে তাকে গোপনেই যেতে দিলাম । সাড়া দিয়ে তাকে অপ্রস্তুত করে কি লাভ হতো ?
সকাল বেলা মাহির ডাকে ঘুম ভেঙ্গে গেল, গতকাল সারাদিনের ক্লান্তি আর গভীর রাতে ঘুমানোর জন্য ভাঙতে চায় না । তবুও চোখ ডলতে ডলতে উঠে বসলাম । জানালা খোলা তবুও বাহিরে অন্ধকার মনে হচ্ছে মনে হয় আকাশে মেঘ জমেছে । আজকে ঈদের দিন বৃষ্টি নামলে মানুষের আনন্দ মাটি হয়ে যাবে তাই প্রার্থনা করি বৃষ্টি না আসুক ।
– মাহি বললো, ভাইয়া তুমি তাড়াতাড়ি গোসল করে পাঞ্জাবি-পায়জামা পরে নিচে আসো । বাবা তোমার জন্য অপেক্ষা করছে ?
– বললাম, আমার তো পাঞ্জাবি নেই মাহি ।
– বারেহহ বাবা তোমার জন্য রেখে গেছে ও-ই যে টেবিলের উপর, তাড়াতাড়ি করো ।
– আমার জন্য পায়জামা-পাঞ্জাবি কিনলো কখন ?
– গতকাল তুমি আসার সাথে সাথে বাবা বেরিয়ে গেল মনে আছে ? বাবা তখন মোড়েলগঞ্জ বাজারে গিয়ে তোমার জন্য এগুলো কিনে এনেছে । আমরা তো প্রথমে ভেবেছিলাম বাবা হঠাৎ আজকে ইফতার করতে এলো না কেন ? কিন্তু পরে যখন জানলাম তোমার জন্য এগুলো কিনতে গেছে তখন সবকিছু বুঝতে পারছি । এখন তুমি কথা না বাড়িয়ে খুব তাড়াতাড়ি তৈরী হও মা নাস্তা রেডি করেছে, নাস্তা খেয়ে বাবার সাথে ঈদগাহ ময়দানে নামাজ পড়তে যাবে ।
– আচ্ছা তুই যা আমি আসছি ।
মাত্র ১০ মিনিটের মধ্যে গোসল করে বেরিয়ে পরলাম আর তাড়াতাড়ি করে পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে রেডি হচ্ছি । পাঞ্জাবি ঠিকই আছে কিন্তু লম্বা একটু বেশি হয়ে গেছে তবুও ব্যাপার না ঠিক আছে । নিচে গিয়ে দেখি ছোট মা নাস্তা টেবিলে সাজাচ্ছে, বাবা পাঞ্জাবি পরে টেবিলের সামনে চেয়ারে বসে আছে । আমিও একটা চেয়ার টেনে বসে পরলাম । নাস্তার প্লেট সামনে নিয়ে খাওয়া শুরু করছি তখন মা বললো ,
– কিরে পাঞ্জাবি ঠিক মত হয়েছে তো ?
– হ্যাঁ ঠিক মত হয়েছে সমস্যা নেই ।
– পছন্দ হইছে তোর ? তোর বাবা নিজে পছন্দ করে কিনে এনেছে ।
– হ্যাঁ খুব সুন্দর, সাদা পাঞ্জাবি অন্যরকম একটা অনুভূতি ।
– এখন নাস্তা করে তোর বাবার সাথে নামাজ পড়ে আয়, তারপর তোর অনেক কাজ আছে আজকে ।
– কি কাজ ?
– আগে নামাজ পড়ে আয় পরে বলছি ।
– আচ্ছা ঠিক আছে ।
জীবনের প্রথম বাবার সাথে ঈদের নামাজ পড়তে যাবো, মনের অনুভূতি অন্যরকম লাগছে । মনে হচ্ছে আকাশ থেকে মা আমাকে আর তার স্বামীকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেছে । এলাকার আরো দুজন মানুষ আমাদের সাথে হাঁটছে । আমার দিকে একবার ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে মনের মধ্যে প্রশ্ন রেখে হাঁটছে ৷ বাবার পাশাপাশি সবার সাথে ঈদগাহ ময়দানে বসে নামাজ পড়লাম । খুতবাহ্ শেষে মুনাজাত ধরা হলো, বাবার চোখে পানি দেখতে পেলাম । আমিও দুফোঁটা চোখের পানি বের করে আল্লাহর কাছে মা-বাবার জন্য দোয়া করলাম ৷
মুনাজাত শেষ করে দাঁড়িয়ে বাবা কয়েকজনকে ডাক দিলেন । সবার সাথে এক এক করে কোলাকুলি করলেন তারপর আমার দিকে দুহাত বাড়িয়ে দিয়ে ডাকলেন । আমিও দুহাত বাড়িয়ে বাবাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম । আমার চোখে আবারও পানি বের হয়ে গেল বাবা আমাকে জড়িয়ে ধরে সবাইকে বললো , ” আমার সন্তানকে সবাইকে চিনতে পেরেছ ? কারো উত্তর দেবার আগে সে আবারও অন্য প্রসঙ্গ তোলে । এক এক করে বিভিন্ন কথা বলে যাচ্ছে । আমি শক্ত করে বাবাকে জড়িয়ে ধরে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি । মনে মনে বলছি, মা তুমি কি তোমার উত্তর পেয়েছ ? সকালে আকাশ মেঘলা ছিল কিন্তু এখন মেঘ দেখা যাচ্ছে না বরং নীল আকাশটা দেখা যাচ্ছে । মিষ্টি মিষ্টি রোদ গায়ে পরছে, বাহহ চমৎকার পরিবেশ ” মেঘমুক্ত নীলাকাশ ” ।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত