কিংকর্তব্যবিমুঢ়

কিংকর্তব্যবিমুঢ়
বাড়িওয়ালা আরিফ ভাই প্রায় উনার স্ত্রীকে মারধর করেন। মাঝে মাঝে দুতলা বেয়ে উঠার সময় দরজার সামনে চিৎকারের আওয়াজ শুনতাম। আমার ইচ্ছে হতো দরজায় একবার নক দিয়ে জিজ্ঞেস করি সমস্যাটা কি? কিন্তু উনাদের নিজেদের ব্যাপার বলে আমি আর দরজায় নক দিতাম না। উনাদের মেয়ের নাম সিফা। আরিফ ভাই যখন ছাদে নিয়ে আসতো আমি উনাদের দেখতাম। উনার স্ত্রীও সাথে থাকতো। কিন্তু তখন উনাদের চোখে মুখে আমি কখনো বিষণ্নতা বা হতাশা দেখতাম না। এই জন্য আমি কখনো জিজ্ঞেস করিনি। কিন্তু একবার আমি আরিফ ভাইকে জিজ্ঞেস করেছিলাম “কিছু মনে না করলে ছোট ভাই হিসেবে একটা কথা বলতে পারি?”
উনি হেসে দিয়ে বলেছিলেন “এই মাসে ভাড়া দিতে সমস্যা? প্রবলেম হলে পরের মাসের সাথে এড করে দিও।” কিন্তু আমি বললাম “বিষয়টা তা না। আপনার মেয়েটা অনেক সুন্দর।একদম পরীর মত। সিফার চোখে মুখে প্রায় ভয়ের ছাপ দেখি আমি। এটা কি আপনারা টের পেয়েছেন? কখনো কখনো ঝিম মেরে থাকতে দেখি। তুমি কেমন আছো বললে প্রথমে উত্তর দেয় না। আপনাদের বাসায় কি কোন সমস্যা চলছে?” আরিফ তখন সিগারেট খাচ্ছিল। আমার এই কথা শুনার পর উনি সিগারেট মুখ থেকে নামিয়ে পায়ে পিষে আমার সামনে থেকে চলে গিয়েছিল।
এরপর অনেক দিন উনাদের সাথে আমার কথা হয়নি। আমি চিৎকারের আওয়াজও শুনতে পাইনি। কিন্তু গতকাল বিকেলের দিকে যখন বাসায় ফিরলাম তখন জানতে পারলাম আরিফ ভাই বিষ খেয়ে হাসপাতলে ভর্তি।উনি যে এমন কিছু একটা করবে আমার বিশ্বাসযোগ্য ছিল না। অবশ্য মানুষ কখন কি করে বসে তার ঠিক নেই। যখন মানুষকে বিষণ্নতা আকড়ে ধরে ফেলে চারপাশ থেকে তখন বিষাদের মাঝ থেকে সবাই মুক্তি চায়। চায় একটু প্রাণ ভরে শ্বাস নিতে। মাঝে মাঝে আমিও শ্বাস নেই। খুব শ্বাস নেই।আমার এই শ্বাস নেওয়ার শব্দ গুলো কখনো মিলির কাছে পৌছেছে কিনা আমার জানা নেই।
আমি তাকে পছন্দ করি তা সত্য। কিন্তু এই পছন্দের কথাটা তাকে বলাটা আমার পক্ষে জীবনেও সম্ভব না।মাঝে মাঝে আমি তাকে অহেতুক ফোন দিয়ে কথা বলি। সেদিন বলেছিলাম “করিম মামার জ্বর। আমার মনে হয় উনার ফুচকার ভ্যানটা দুই তিন দিন চালু করতে পারবে না। তোমার তো করিম মামার ফুচকা পছন্দ। এখন কি হবে?” আমি বুঝতে পারতাম এপাশ থেকে মিলি আমার কথায় আওয়াজ ছাড়া হাসতো। আমার তখন একটুও খারাপ লাগতো না। ও যখন হাসে ওর বামকোনে বড় দাঁতটা বের হয়ে আসে। মেয়েটা এই দাঁতটার জন্য ভালো করে হাসতে পারে না।
যখন হাসে তখন ঠোট দুটো বন্ধ করেই হাসে। তাতে কি? এই হাসিটাই আমার পছন্দ। একদম ভিন্ন রকম। এরপর ও বললো “তুমি এই কথা বলার জন্য ফোন দিছো? নাকি আমার সাথে লাইন মারার জন্য ফোন দিছো?” আমি জিহ্বায় কামড় দিয়ে বলেছিলাম “না তা না। আসলে তোমার থেকে সেদিন চিরুনি নিয়ে চুল আচড়িয়ে ছিলাম ওটা আমার কাছে রয়ে গেছে। তুমি তো ওটার খোঁজ নিলা না। একটা সমস্যা হয়েছে। চিরুনির দুইটা দাঁতা ভেঙ্গে গেছে। তুমি চিন্তা কইরো না। আমি তোমাকে নতুন একটা চিরুনি কিনে দিবো ঠিকাছে?” আমার কথা শুনে মিলি বলেছিলো “শোভন তুমি ঠিক মত মিথ্যা কথাটাও বলতে পারলে না এটা তুমি বুঝো? চিরুনিটা নতুন কিনেছিলাম। এক মাস ব্যবহার করেছি। তুমি কি আমাকে আহাম্মক পাইছো? আমি কি গাঞ্জা খাই? তোমার এসব গাঁজাখুরি কথা আমাকে বিশ্বাস করতে বলতেছো? রাত অনেক হইছে। রাতের একটায় সে আমাকে চিরুনির দাঁত ভেঙ্গে যাওয়ার গল্প শোনাচ্ছে। আজাইরা।”
কথা সত্য আমি যখন ইনিয়ে বিনিয়ে কিছু বলতে যাই মিলি এটা বুঝে ফেলে। ওর চিরুনির কোন দাঁত ভাঙ্গে নাই। চিরুনিটা আমার কাছেই রেখে দিয়েছি। ওর এই চিরুনিটা আমার বাসায় থাকলে কেন যেন এই কয়েক দিন ধরে মনে হয়েছিল ও আমার এই রুমটার ভিতরেই আছে। পুরো রুম জুড়ে ওর গায়ের গন্ধটা, ওর চুলের গন্ধটা ছড়িয়ে আছে। কি শান্তি লাগে।কিন্তু আমাকে এখন একটা ঘুম দিতে হবে।এই কয়েকটা দিন আমার ভালো যাচ্ছে না। তারউপর গতকালকের আরিফ ভাই এর ব্যাপারটা আমার কাছে ভালো লাগে নি। মানুষটা এমন করলো কেন? কিন্তু আল্লাহর রহমতে এখনো বেঁচে আছে। এলাকায় ব্যাপারটা ছড়িয়ে গেছে। কেউ কেউ বলাবলি করছিলো আরিফ ভাই এমন করতেই পারে না। উনার স্ত্রী হয়তো খাবারের সাথে বিষ খাইয়ে দিয়েছে।মেয়ে সুবিধার না। বিয়ের পর থেকেই ছেলেটা অন্য রকম হয়ে গেছে।
আজকের আকাশটা মেঘলা। বৃষ্টির দিন।আমি সাজিদের পাশে বসে আছি ক্লাস শেষে। সে আমাকে বললো “দোস্ত আজকে মনে হয় তাসনীমের সাথে দেখা হবে না। আকাশের অবস্থাটা এমন না হলেই পারতো না?” আমি তার কথার প্রতিভাষ না দিয়ে বললাম “অস্থির লাগে। মায়ের কথা মনে পড়ে। গ্রামটা খুব টানে।”
আমি জানি আমার এসব কথা এখন ওর কানে পৌছাবে না। আমি আবার বললাম “তাসনীম কি সত্যিই তোরে ভালোবাসতে পারছে? ওর তো আগের একটা রিলেশন ছিলো এবং সেই ছেলের সাথেই কয়েক মাস আগে দেখা করেছিলে নীল ক্ষেতে। এটা তুইও দেখছিস আমিও দেখছি। পরে এই কথা ওর কাছ থেকে জানতে চাইলে প্রথমে ও অস্বীকার করেছে। তোর দরকার ছিল তখনই ওর সামনে উপস্থিত হওয়া।তুই ছাগল এই মেয়ের মাঝে কি পাইছিস আমি বুঝি না।” সাজিদ হাসে। আমাকে বলে “মানুষ মাত্রেই ভুল। একটু একটু ভুল তো করবেই। ভালোবাসার মানুষ ভুল করলে সেই ভুল গায়ে মাখতে নেই। এতে ভালোবাসাটা নোংরা হয়। এখন সব ঠিকাছে। কাল রাতে আমাকে বৃষ্টির গান গেয়ে শুনায়ছে।বলছে তুমি এতো পাগল পাগল টাইপের কথা বলো কেন?” আচ্ছা দোস্ত আমি কি আসলেই পাগল টাইপের? আমাকে নাকি চিড়িয়াখানায় ছেড়ে দিয়ে আসবে। আমি বলছি “তোমার কাছেই রাখো। তিন বেলা খাবারের বদলে তিন বেলা ভালোবাসা দিলেই হবে।” সে কি করছে জানোস? ওপাশ থেকে আমারে তিনটা চুমু দিছে।” ও একটু পাগলি আছে। অনেক ভালোবাসি বুঝছোস?”
আমি কিছু বলি না।ভালোবাসাটা খুব অদ্ভুত। ভয়াবহ। এটা যখন যাকে ছুয়ে যায় তখন তার ভিতরে অজান্তেই একটা জগৎ হয়ে যায়। তার সাথে কথা না বললে, যোগাযোগ না থাকলে কেমন বিষণ্ন লাগে। অস্থির লাগে। যেমনটা আমার হয়। মিলির জন্য। মাঝে মাঝে নিজেকে একটা দাড়কাক মনে হয়। মনে হয় আমি শুধু উড়ে বেড়াই তার আশপাশে। আমার এই উড়ে বেড়ানোটা তার কাছে কি আনন্দের নাকি বিরক্তকর আমি এটা অনুধাবন করতে পারি না।কিন্তু এমন দাড়কাক হয়ে থাকতেই আমার ভালো লাগে।ওর চলা, কথা বলা সব কিছুতেই আমি মুগ্ধতা খুঁজি।খুঁজি ভালোবাসার অসীম ছায়াকে।
মিলির সাথে সেদিন ভার্সিটিতে দেখা হয়নি। সেদিন বললে ভুল হবে। তার আরো তিনদিন মিলির সাথে আমার ভার্সিটিতে দেখা হয়নি। ভার্সিটিতে আসেনি।ফোনও অফ করে রেখেছে। তাই সরাসরি ওর বাসায় গেলাম।বাসায় ঢুকতেই আন্টি প্রথম আমাকে বললো “ওর মাথা ঠিক নেই। কাল রাতে খাবারের প্লেট একটা ভেঙ্গেছে। আমার মেয়েটা এখন কেমন যেন হয়ে থাকে। তিনটা দিন ধরে তেমন কিছু খাচ্ছেও না।কিছু খেলেই কিছুক্ষন পর গলা দিয়ে বমি করে বাহির করে দেয়। আমার মেয়েটার কি হলো। তুমি বসো। আমি ওকে ডেকে দেই।” আমি শুধু হুম করে একটা শব্দ করলাম।
আমি বসে বসে ড্রইংরুমের দেয়ালের ছবিটার দিকে তাকিয়ে দেখছিলাম ছোট্ট মিলি ওর বাবার কোলে বসে একটা লাজুক হাসি দিয়ে আছে।আমি উঠে ছবিটার আরো কাছে যাই। ভালো করে দেখি। যখন দেখছিলাম তখন মিলি একটা কাশি দিয়ে এসে আমার পাশে দাঁড়িয়ে বলতে লাগলো “আমার বয়স যখন চার তখনি ছবিটা তুলেছিলাম। বাবার সাথে আমার এই একটাই ছবি এবং এটাই লাস্ট। এই ছবিটা তোলার ঠিক তিন মাস পরে বাবা মারা যান।
আমি ওর দিকে তাকিয়ে বললাম “দুঃখিত আহত করলাম। তোমার কি হয়েছে?” ও সোফায় বসে বললো “তেমন কিছুই না। বৃষ্টির দিন। বাসায় তিন দিন ধরে আম্মু শুধু খিচুড়িই রান্না করছে। খিচুড়ির গন্ধে আমি বাহির হতে পারছি না। আমার আবার খিচুড়ি পছন্দ তো তাই।তুমি যাবার সময় খিচুড়ি খেয়ে যেও।আমার মায়ের হাতের রান্না একবার খেলে তা আর ভুলতে পারবা না।” আমি ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম অনেকক্ষন।তারপর বললাম “কিন্তু তোমার উদাস করা চোখ তো অন্য কথা বলে। আমি তোমার চোখ পড়তে পারি। আমাকে বলবা কি হয়েছে?” মিলি একটু হেসে দিয়ে বললো “উড়িব্বাস।জানতাম না তো তুমি আমার চোখও পড়তে পারো। শোন আমার চোখ পড়ে লাভ নাই। তুমি তোমার বউ এর চোখ পড়বা ঠিকাছে?” আমার কি বলা উচিৎ ঠিক বুঝতে পারলাম না। বলতে চাইলাম বউ ভাবতে কি প্রবলেম আছে?”
কিন্তু আমি চুপ করে রইলাম।আমার এমন চুপ হয়ে যাওয়া দেখে ও আবার বললো “জীবনটা পুরোটাই একটা যুদ্ধ। এই জীবনে অনেক কিছুই হয়ে যাবে। একবার মন খারাপ লাগবে আবার ভালো লাগবে। এই ধরো প্রকৃতির মত। রোদের মত। বৃষ্টির মত।আমরা প্রায় সময় জীবনের অর্থ খুঁজি। তাতে কত স্মৃতি থাকে কত কিছু। এসব স্মৃতিরা যখন সামনে হাজির হয়ে যায় বা তার সাথে দেখা হয়ে যায় তখন কেমন অনুভূতি হয় বলতে পারো?”
আমার ভীষন খারাপ লাগে। ওকে কখনো আমি এমন করে কথা বলতে দেখিনি। তবে আমি জানি কলেজে থাকতে ওর একজন ভালোবাসার মানুষ ছিল। আমি সাহস করে ওর হাতটা ধরলাম। ওকে বললাম “ওর সাথে কি তোমার দেখা হয়েছে?” মিলি প্রায় কেঁদেই দিলো। আমাকে বললো “শোভন তুমি কি সত্যিই আমার চোখ পড়তে পারো?” আমি কিছু বলি না। ওর চোখের পানি মুছে দেই। ও আমাকে বলে “ওকে আমি দুর থেকেই অন্যজনের সাথে দেখেছি। খুব ক্লোজড হয়ে। ও তো আমার জীবনে নেই। ওকে নিয়ে আমি ভাবিও না। কিন্তু দেখোই না তিনটা দিন ধরে আমার এতো খারাপ লাগছে কেন?
আমার ভিতরটা পুড়ে যাচ্ছে কেন? কেন?” আমি বললাম “আমি গ্রামের একজন ছেলে। আমার জীবনটা সবুজের মাঝে বেড়ে উঠেছে।পড়াশোনার জন্য যেদিন এই শহরটায় আসলাম চারপাশে খুব অশান্তি লাগছিল। কিন্তু তোমার সাথে পরিচয়ের পর একসময় শান্ত হয়ে গিয়েছিলাম। তারপর থেকেই মনে হতো আমার দুটো শহর। একটা গ্রামের আর একটা এখানের। যদিও এখানের শহরটা জরাজীর্ণ যান্ত্রিক।কিন্তু আমি মানুষটা তোমার মত মানুষের দেখা পেয়েছি, তোমার নিশ্বাস শুনেছি। অন্য রকম হাসি দেখেছি। তোমার সব কিছুর মাঝেই আমার গ্রামের গন্ধটা পাই, নদীর গন্ধটা পাই। সবুজ ঘাষের গন্ধটা পাই। প্লিজ এমন হয়ে থেকো না। না হয় নদীটা শুকায় যাবে। নদীটা শুকালে চারপাশটা কি ভালো দেখায়?”
আমার কথা শুনে মিলি আরো একটু কাঁদে। তারপর আমাকে বলে “এমন করে বলো কেন?।এমন করে বলবা না। এমন করে শুধো কাছের মানুষরাই কথা বলে। আমি তোমার কাছের মানুষ না। আচ্ছা বলো আমার লাল লিপস্টিকটা কই? ব্যাগে রাখছিলাম। পরে আর খুঁজে পাইনি।” আমি একটু হেসে বললাম “ওটা আমার কাছে। আমার কাছে ওটা থাক। ওটাতে তোমার জাদু লেগে আছে। তোমাকে আমি আরেকটা কিনে দিব।” মিলি আমার কান ধরে বললো “তুমি একটা খারাপ প্রকৃতির ছেলে। এমন করো কেন?” আমি বললাম “ছাড়ো লাগছে। একদিন দেখবা তোমারেই আমি চুড়ি করে আমার মাঝে রেখে দিব।” আমার কথা শুনে ও হাসতে লাগলো। না এখনের এই হাসিটা ঠোট বন্ধ করা হাসি না।কি নিঃস্বার্থ একটা হাসি। এমন হাসিটাকেই, হাসির মানুষটাকে যুগ যুগ ধরে ভালোবাসা যায়। কিন্তু ভাবছি অন্য কথা। যে আমি কিনা কখনো সাহস হয়নি এমন করে ওকে কখনো বলতে। সেই আমি আজ ওকে এমন করে কথা গুলো কি করে বললাম? কি অদ্ভুত ও কি আমার এই চাওয়ার ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে কখনো?
খুব সকালে আমার ঘুম ভাংলো আরিফ ভাই এর বউ লুনা ভাবীর শব্দে। আমি দরজা খুলতেই তিনি কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন “ভাই আমার সাথে একটু আসবা? তোমার ভাই আবার কেমন যেন করছে। মানুষটা পাগল হয়ে যাচ্ছে। আমার ভয় করছে। মেয়েটাও ভয়ে প্রায় শেষ। একটু আসবা ভাই? একটু আসবা?” আমি উনার কথায় ভীষম খেয়ে সোজা উনার সাথে গিয়ে দেখি আরিফ ভাই টেবিল থেকে গ্লাস নিয়ে মেঝেতে ছুড়ে মারলো। মানুষটা সপ্তাহ খানেক হলো একটা অবস্থা থেকে উঠে আসছে।
আবার এখন এমন করছে। আমি একটু ভয় পেলাম। ভয় পাওয়া স্বত্তেও উনার কাছে গিয়ে উনাকে ধরে বললাম “ভাই এমন করেন কেন? শান্ত হোন। দেখেন আপনার বাচ্চাটা ভয় পাচ্ছে। কান্না করছে। আপনার দোহাই লাগে শান্ত হোন। আমাকে বলেন কি হয়েছে। আমি আপনাকে সাহায্য করবো। ভাবী আপনাকে জ্বালাতন করে? উনার জন্য এমন হচ্ছে?” উনি আমার কথা শুনে কিছুক্ষন আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর কেঁদে দিলেন। বললেন “ভাইরে আমি অনেক খারাপ একটা মানুষ। আমার বউকে আমি সন্দেহ করি। এই সন্দেহ এর কারণে ওকে আমি মারি। ও একটা বারও আমার মারের প্রতিবাদ করে না। পরে এটা নিয়ে আমার অনেক খারাপ লাগে। কিন্তু তারপরো আমি পুনরায় আবার সন্দেহ করি। আমার মনটা খুব বাজে। ওকে কারণে অকারনে সন্দেহ করি। এতো কিছু করার পরো আমার সাথে সংসার করে যাচ্ছে। আমার ভিতরে এতোটা ঘৃনা এতোটা এতোটা।
এই ঘৃনাটা আমাকে ঠিক মত থাকতে দিচ্ছে না। আমি ঘুমাতে পারি না। তাই চিরদিনের জন্য ঘুমাতে চেষ্টা করছিলাম। আমি চিরদিনের জন্য ঘুমাতে পারলে ও তো একটু শান্তিতে থাকতে পারতো। কি পারতো না? কিন্তু দেখোই না বাইচা গেলাম। তোমার ভাবীরে বলবা এই খারাপ মানুষটাকে ছেড়ে দিতে? ও যেন ওর মত থাকে?” এটা বলেই উনি মেঝেতে বসে কাঁদতে লাগলেন। আমি ভাবীর দিকে তাকালাম। এখানে আমার কি কিছু বলার আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না। ভাবী, আরিফ ভাই এর পাশে বসে উনি নিজেই কেঁদে দিয়ে বললেন “এতো সোজা আমাকে ছেড়ে দেওয়া।আমাকে মারছো, বকছো, এই গুলার প্রতিশোধ না নিয়ে আমি তোমায় ছেড়ে দিব? তুমি আমাকে বেশি ভালোবাসো তাই আমাকে নিয়ে বেশি ভাবো। সন্দেহ করো। আমি তো অনেক ভাগ্যবতী। এমন ভালোবাসা আমি পাবো? আমি জানি তুমি একদিন ঠিক হয়ে যাবা। আমার জন্য। আমাদের সিফা মায়ের জন্য।তুমি দেইখো।”
অনেকদিন পর মনে হলো মাকে একটু ফোন দেই। মাকে ফোন দিতে আমার খারাপ লাগে। যখনি ফোন দেই খালি কাঁদে।সে কারণে মায়ের সাথে তেমন একটা কথা হয় না। যা কথা হয় বাবার সাথেই হয়।খুব ছো্ট বেলায় আমি গাছ থেকে পড়ে পা মচকায় ফেলছিলাম। এর ব্যথায় আমার জ্বর হয়েছিল। আমি কিছুক্ষন পর পর বমি করতাম। মাথা তুলতে পারতাম না।ঘুমাতে পারতাম না। একটু চোখ বুঝলে তার কিছুক্ষন পর আবার জেগে উঠতাম। মা সারা রাত আমার পাশে জেগেছিল। আমার খুব মনে আছে। মা কোরআন পড়ে আমার বুকে ফু দিতেন।নামাজে প্রার্থনা করতেন। আমাকে ঘুম পারিয়ে তারপর নিজে ঘুমাতেন। আমার মা খুব সাধারণ একটা মানুষ। কিন্তু আমার কাছে দুনিয়ার সব থেকে শ্রেষ্ঠ হলেন মা। ফোন করেই আমি বলার আগে মা আমাকে বললেন “মায়ের কথা মনে পড়ছে তাই না? মন কাঁদে? ও বাবা মনকে শান্ত রাখন যায় না? মা দুরে কিন্তু দেখো মায়ের মন সব সময় তোমার আশেপাশে থাকে।”
মা কেমন করে যেন আমার সব কিছু বুঝে ফেলে। আমার মাকে আমি মিলির কথা বলেছিলাম। আমার মায়ের কাছে আমি সব শেয়ার করি। মা শুধু বলেছিলে “মেয়েটারে জ্বালাইও না। তবে খুব যত্ন নিবা। খোঁজ খবর নিবা। দেখবা সব ঠিক থাকবে।আল্লাহ আছে নাহ? মন থেকে চাইলে সব পাইবা।” আমি বললাম “মা আমি খুব ভালো আছি। তোমার কথা মনে পড়ে সব সময়।নিজের যত্ন নিবা।সামনে আমার পরীক্ষা দোয়া করবা।” মা শুধু বললো “অনেক বড় হও আব্বু। অনেক অনেক।”
খুব ভয়ংকর একটা ব্যাপার ঘটে গেলো। মিলি আমাকে কিছুক্ষন আগে একটা মেসেজ দিয়ে বললো “শোভন তুমি এখন যেখানেই থাকো আমার সামনে হাজির হবা। এবং আমাকে প্রপোজ করবা। আমি চাই এই বৃষ্টির দিনে তুমি আমাকে তোমার কথাটা বলো। বলতে না পারলে তোমার কপালে খারাপ কিছু আছে।” আমি মেসেজ পেয়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেলাম। আমার কি ওকে হাসির ইমো দিয়ে রিপ্লে দেওয়া দরকার। নাকি যা বলছে তাই করা দরকার।খুব অস্থির লাগছে। ও আমাকে হঠাৎ এমন করে বললো কেন? তাহলে সত্যিই আমার চাওয়ার ব্যাপারটা ও বুঝতো? কিন্তু এমন করে কেন? আচ্ছা আমার ভিতরটা কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে থাকুক। সব বুঝতে হবে বা জানতে হবে এমন তো কোন নিয়ম নেই। মাঝে মাঝে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হওয়াটা খারাপ তো কিছু না।কথা দিচ্ছি আমি কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়েই আজকের এই বৃষ্টির দিনে তোমার হাত ধরবো আর তোমার হৃদয় ছুয়ে থাকবো…
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত