নগ্ন প্রায় আছিয়া বানুকে যখন গাছের সঙ্গে কষিয়ে বাঁধছিল হাবিলদার কলোনির মহিলারা তখন সে পুরোপুরি নিঃশ্চুপ হয়ে ছিল।রিক্সা চালক রমিজ রাজা আর তার সাঙ্গপাঙ্গরা জর্দা-পানে লালচে চিটচিটে দাঁত কেলিয়ে সোৎসাহে বন্ধন কাজ সম্পাদনায় উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছে
–” ও শিউলির মা,শাকিলের মা হুনো..বান্ধো শক্ত কইরা বান্ধো বেশ্যাটারে, ছি ছি কি যুগে আইছি! সারাজীবন পতিধর্মা থাইকা এই চল্লিশ বছরে বুড়ি হইয়া কেলেঙ্কারি! “
আছিয়ার উঁচু পেটের দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে গোটা দশেক মধ্যবয়সী দিনমজুরের দল।প্রৌঢ়ের কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়া এক কঙ্কালসারের ঝুঁকে পড়া অনাকর্ষনীয় তবে রক্ত শূন্যতার কারণে ধবধবে ফ্যকাশে বুকটাও এখন কাঁপুনি ধরাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে সমশেরের,শ্যামল ,রইসুদ্দিনের।রইসুদ্দিন আছিয়ার পাশের ঘরে বাসিন্দা।তাই সে সোৎসাহে সাক্ষী দিয়েছে মাঝরাতে আছিয়ার ঘর থেকে শতবর্ষীয় চৌকির ক্যাচক্যাচ শব্দ আর নিমিষেই অন্ধকারে উধাও হওয়া ছায়ার সে একমাত্র সাক্ষী! প্রথমে ব্যাপারটাকে চোখের ভ্রম মনে করলেও এখন আছিয়ার ছ’মাসের অন্তঃস্বত্ত্বা উঁচু পেটই তার সত্যতার প্রমাণ দিচ্ছে। বিজয়ী চেহারায় সাফল্যের হাসি ঝুলিয়ে রইসুদ্দিন গদগদ গলায় উপস্থিত সালিসী মাতব্বরদের সামনে জোর গলায় বলেছে- “হাদীসে আছে, দেখা আর শোনা ৫০০ বছরের রাস্তা!
যদি আমি শুধু চৌকির ক্যাচক্যাচানি শুইনা সাক্ষী দেতাম তয় পাপ হইতো আমি নিজের চউখ্যে দ্যাখছি সেদিন অমাবইশ্যার রাইত,অন্ধকারে কিডা জানি হের ঘর থিইক্যা বাইরে চলে গেল! নিদ চউখ্যে বালা দেখলাম নাহ্”
এরপর আর কিন্তু থাকে না।বিচারকমণ্ডলীরা মুখ চাওয়া চাওয়ি করে মাথা নাড়েন। চোখের ভাষায় চোখ পড়েন।ওদিকে শাস্তির জন্য মরিয়া হয়ে উঠা আছিয়ার বড় ছেলে রুহুল রক্তচক্ষুতে বান মারছে যেন গর্ভধারিণীকে।
আছিয়া এসব জোরগলায় অস্বীকার করেছে।কেঁদে গলা ফাটিয়ে বলেছে “এসব মিথ্যা, কেউ তো বিশ্বাস করো! আমি দিনকেদিন ব্যরাম্মা হয়া যাচ্ছি,বমির লাইগা মেলাদিন হয় ভালো করে কিছু খাতি পারি নাহ্,আমার পেট উঁছা হতিছে,ব্যাথার যন্ত্রণায় আমি রাইতে ছটফট করি কহনও চৌকিতে,কহনো মাডিত ।তয় আমি সতী,আমার পেটের ছাওয়াল রুহুল পড়শীগো কান কথায় আমার বিরুদ্ধেই বিচার দিল!” আছিয়ার কান্না আর আহাজারিতে উপস্থিত অশিক্ষিত জনা সাতেক বিচারপতির মন গলেনি। উপরঞ্চ রুহুল দাঁতে দাঁত পিষে বলেছে–“হাবলু চাচা, সাধন চাচা আপনারা এই মাগিটার বিচার করেন,মা নামে কলঙ্কিনী হেতি! গতরের এত খায়েশ! হেতিরে কলোনি থিইক্যা বাইর কইরা দেন জাহান্নাম যাক।
গাছের লগে বাইন্দা থোন।দোর্রাহ্ দেন।হেতেও লইজ্জা হবিনা! কাপড় খুইলা গাছের লগে বান্দেন টাক চুলকে হীরাধন ভ্রু কুঁচকে সন্ধিহান দৃষ্টি ফেলে বলল -” হয় রইসুদ্দিন বেটা তুমি সত্য বলিছো মনে হতিছে। লক্ষণ সব মিইলা যাতিছে।এই নষ্টা মহিলারে এখানে রাহাডা পাপ হবিনে। হাদীসে উল্লেখ আছে এই ধরনের ব্যভিচারীকে পাথর ছুঁড়ে মারার নির্দেশ আছে। এই কলোনির জমিদার সুবল মিঞা তোমার সাতাইশ খানা রুমের মধ্যে ইরাম কলঙকিনী আর দেহিনাই। তুমি অতিসত্বর এই পাপিষ্ঠার বিচার করো এবং তারে কলোনি থিক্কা বাইর করি দেও। ছে ছে পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে ইডা কিমুন কাম হরলো বেশ্যাটা!” মহিলাদের জটলা থেকে কানাঘুষা শুরু হল। বিন্তির মা ঝাঁঝিয়ে বলল–
–এই কলঙকিনীর বিচার না হয় করবেন কিন্তু পেডের ছাওয়াল টার কি দোষ?
–আরে রাহো ঐ জারজ আইনা কলোনিত অলক্ষ্ণী টাইনা আনার চিন্তা ছাড়া তোমার ভালো চিন্তা নাই ? মরুক বেশ্যাবুড়ি পেডের ছাওয়ালও মরুক লগে।
–“এই বেডিগো আবার এতো আলাপ কিসের? থামো তোমারা।রুহুলের কতা অনুযায়ী আমি এই মহিলারে গাছের লগে বাইন্দা রাখার নির্দেশ দিতাছি যতক্ষণ পর্যন্ত না নিজের মুহে শীহার হরবে কিডা হেতির সর্বনাশ করছে। ততক্ষণ তুমরা হের পাহারায় থাকবা।” রুহুল গায়ে রি রি ভাব ছড়িয়ে বললো–
–এই মাগিটারে নেংটা কইরা বাইনবেন। আমি আমার বৌয়েরে দুইবার মারছি এইটা মিত্যা রটনা কইয়া। হের কতা কানেই তুলিনাই। অহন আমার মুখে চুনকালি দিয়া ছি ছি আছিয়া তাকিয়ে আছে নিজের ঘরের দাওয়ায় নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে থাকা ছোট ছেলে রাতুলের দিকে। রাতুলকে মায়ের এমন পরিস্থিতি যেন একটুও নাড়াতে পারেনি। বিচার শেষে রাতুল রংচটা শার্টটা গায়ে চাপিয়ে কর্মস্থলে রওনা হল একটু আগে বিচারের রায়ে তাকে উলঙ্গ করে এই জলপাই গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখার রায় হয়েছে। পরনে পেটিকোট আর ব্লাউজ দয়া দেখিয়ে রেখে দিয়েছে শাকিলের মা আর অন্য মহিলারা।ওদের আর কিইবা দোষ? নিজের পেটের সন্তানই যেখানে অভিযোগ আর শাস্তি দাতা হয়ে উঠেছে সেখানে পড়শীদের আর দোষ কি ?
ভর দুপুরের জোয়ারের পানির মতো আছিয়ার চোখ ছলছল করছে। স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করে ফেরারী হবার পর আছিয়া দুই ছেলে এক মেয়েকে নিয়ে ক্ষিদে আর মাথা গোঁজার ঠাঁই মিলাতে বুয়ার কাজ থেকে শুরু করে রাস্তার মাটিকাটার কাজ পর্যন্ত কোনো হেন কাজ নেই যে সে করেনি।তবুও মৌলিক চাহিদা মেটাতে সে হিমশিম খেয়ে সন্তানদের শিক্ষার দুয়ার বন্ধ করে দিয়েছে।সন্তানদের মধ্যে সবার ছোট মেয়ে ‘বিন্দু’ ।বিন্দুকে আছিয়া দশম শ্রেণী অব্দি টেনে টুনে নিয়েছিল উপবৃত্তির লোভে।মেয়েদের পড়াশোনার জন্য সরকার উপবৃত্তি দিচ্ছে কিন্তু ছেলেদের জন্য তো দিচ্ছেনা। তাই দুই ছেলে রুহুল আর রাতুলের কেউই স্কুলের দুয়ারে দুই-তিন ক্লাসের বেশি যাওয়া হল না।
মায়ের ইনকামে জোগান দিতে রুহুল তেরো চৌদ্দ বছর বয়সেই রিক্সা ভ্যান নিয়ে রাস্তায় নেমেছিল। এখন রাজমিস্ত্রির কাজ করছে হরদমে ।এখন রুহুল শক্ত সামর্থ্য বাইশ বছরের তাগড়া যুবক। মাস ছয়েক হল সে তার পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করে বৌ নিয়ে আলাদা রুম ভাড়া করে থাকছে।ছোট আঠারো বছরের রাতুল মায়ের সঙ্গে থাকে। তবে তাকে ইদানিং বেশিরভাগ রাতেই অন্যের দোকানে পাহারায় থাকে।যেখানে সকাল থেকে রাত বারোটা পর্যন্ত থাকতে হয় সেখানে রাতেও থাকতে হচ্ছে পাহারায়।মহল্লায় কদিন যাবৎ রাতে চোরের উপদ্রব চলছে। রাতুল গত তিন মাসে দু-একটা রাতই মায়ের কাছে থেকেছে। একটা মাত্র চৌকিতে আছিয়ার সতেরো বছরের ছেলের সাথে একসঙ্গে ঘুমুতে অস্বস্তি হয়। হয়তো এজন্যই মোটা চিটচিটে একটা কাঁথা বিছিয়ে
মাটিতেই শোয় সে।
আর বিন্দু মাধ্যমিক পার হবার আগেই বিয়ে দিয়ে পরের ঘরে পাঠিয়ে বোঝা হালকা করে আছিয়া যখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে চাইছে তখনই এমন একটা কলঙ্ক! প্রায় কঙ্কালসার শরীরে এই বয়সে বিন্দু মা হতে চলেছে।এলাকাবাসীদের এক মহিলা প্রায় মাইল খানেক দূরে বিন্দুর শ্বশুর ঘরে আছিয়ার বিচারের খবর পৌঁছে দিল। বিন্দু তিনমাস হল মায়ের ঘরে আসছেনা। স্বামীর কড়া নিষেধ যতখন না বিন্দূর বরকে একটা ভ্যান কিনে না দিচ্ছে ততক্ষন বিন্দু মা-ভাইদের সঙ্গে দেখা করতে পারবেনা। মায়ের উলঙ্গ বিচারের কথা শুনে বিন্দু চিৎকার তুলে অজ্ঞান হল।জ্ঞান হবার পর এক দৌড়ে পৌঁছলো মায়ের কাছে। শ্বশুরের ঘরের দরজা হয়তো এই উছিলায় চিরতরে বন্ধ হবে। হয়তো বিন্দুর বর এই সূত্র ধরে অত্যাচারে পিশাচ হতে হতে সম্পর্কটা ভঙ্গুর হবে, ডিভোর্স হবে! কিন্তু বিন্দুর মাথায় এখন এসব কাজ করছেনা।তার মা এখন নিয়তির চরম নিষ্ঠুরতার কাছে হার মেনে মাথা হেঁটকরে জলপাই গাছের সঙ্গে উলঙ্গ অবস্থায় সৃষ্টিকর্তার পানে মৃত্যু কামনা করছে…
–মা ও মা তুই এইডা কি করলি মা?তোর এই সব্বোনাষ কিডায় করলো? তুই তার নামে মাজারে মোমবাতি দিলিনা কেন ? ও মা আমরা তো তোর ছাওয়াল, বাপ থাইকাও যখন মরা তখন যদি তুই নিজেকে নষ্টা না করলি এহন এই বয়সে ক্যান নতমুখো আছিয়া একটুও যেন চমকালোনা! যেন না দেখেই বুঝেছে বিন্দু এখন সব বাধা ছিন্ন করে তার কাছে আসবারই ছিল।তার ভাইদের মতোই ঘেন্নায় চোখ পাকিয়ে অর্ধোলঙ্গ থেকে পূর্ণোলঙ্গ করতে আদেশ করে চলে যাবে। আহা মেয়েটার শ্বশুরালয়েও এই খবর পৌঁছেছে। আজীবন মেয়েটাকে শ্বশুরবাড়ির লোকজন তিরস্কার করে বলবে “বেশ্যার মাইয়া” আছিয়ার যেন আর কিছু করার নেই, মনে মনে আছিয়া দোয়া ইউনুস পড়ছে। পাগলের মতোই বিন্দু দিশেহারা হয়ে মায়ের গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।প্রশ্নের পর প্রশ্ন ছুঁড়ছে।
নিরূত্তর মাকে একবার লক্ষ্মী আবার কালনাগিনী বলে ঝাঁকুনি দিচ্ছে।আবার মায়ের শরীরের উপর ছটফটিয়ে কাঁদছে আর সৃষ্টিকর্তার কাছে বিচার দিচ্ছে। ঘন্টাখানেক মাকে প্রশ্ন করেও যখন বিন্দু উত্তর পেলোনা তখন পাগল হয়ে উঠলো। রাগে অপমানে অপদস্থ বিন্দু মায়ের গালে দুহাতে কষিয়ে চড় বসাতে বসাতে চিৎকারে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে তুলল যেন। আশপাশের নিন্মবিত্তের প্রতিবেশীরা এসব যেন মজায় লুফে নিচ্ছে। ছিঃছিক্কারে যেন বিন্দুর আকাশটা ভেঙে খান খান করে দিচ্ছে। পাগলপ্রায় সদ্য অন্তঃসত্ত্বা বিন্দু ছটফটিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্লান্তিতে ক্ষ্যন্ত হল যেন।আছিয়া নির্বিকার, যেন বহুকাল পথ চলার পর ও কোথায় পথ হারিয়ে ফেলেছে।আচমকাই এক ঝটকায় যে পথে এসে পড়েছে সে পথ বড্ড অচেনা কণ্টকাকীর্ণ! এপথের বাতাসটাও যেন ওর মুখ-গলা চেপে বধির করে দিয়েছে!
প্রায় দুই ঘন্টা কান্না,আহাজারি আর আর্তচিৎকারে ক্লান্ত শ্রান্ত বিন্দু অজ্ঞানের মতো চোখ বুজে শুয়ে থাকলো মায়ের পায়ের কাছে।ধুলোমাটিতে তার সর্বাঙ্গ ভর্তি,দীঘল চুল এলোমেলো জটপাকিয়ে রাস্তার উন্মাদিনীর মতো লাগছে। প্রতিবেশীদের কয়েকজন এসে অনেক বুঝিয়েও বিন্দুকে শান্ত করানো গেল না। আধমরার মতো কিছুক্ষণ পড়ে থাকার পর চোখ মেলল বিন্দু, মায়ের মুখটায় ভালো করে কিছু পড়তে চাইল। নাহ্ এই নতমুখো বয়স্কা নারীর মুখ দেখে কিছু বুঝবার উপায় নেই। তবে কী সত্যিই এ দোষী? সত্যিই এই মহিলার উঁচু পেটে কারো খায়েশী সম্ভোগের ফসল?! সব রহস্য লুকিয়ে হজম করে এই মহিলা কি বোঝাতে চায় তবে? বিন্দু ক্লান্ত,দুর্বল, চোখের পাতা ফেলতেও যেন কষ্ট হচ্ছে।এমনই ভঙ্গিতে টলেটলে উঠে দাঁড়িয়ে মায়ের দিকে চেয়ে করুণ স্বরে বলল–
–মা , ও আমার লক্ষ্মী মা তোর খোদার কসম লাগে একবার ক’ তোরে এই নষ্টা করছে কোন জালিমের পুতে? ক’ মা ক’ এই মা, আমি কতা দিতেছি মা আমি সব শুইনা তোরে ছাইড়া যামুনা।সত্য কতিছি মা আজীবন তোরে নিয়া থাকুম,তোর মতোই সোয়ামী ছাড়া! তবুও ক’ মা কি হইছে তোর ? তোর পেডে ঐডা কার ছাওয়াল? কইবিনা তুই? তাইলে … তাইলে এই দ্যাখ আমি তোর সামনে ফাঁসি খামু মূহুর্তেই যেন ফের রাজ্যের শক্তি এসে ভর করল বিন্দুর শরীরে! হন্তদন্ত বিন্দু দিগ্বিদিক ছুটে দড়ি যোগাড় করতে নিতেই কলোনির মহিলা পুরুষের হায় হায় রব উঠল। ঘিঞ্জি বস্তিবাসীর মাঝে এমন প্রকাশ্যে আত্মহত্যা সম্ভব নয়। তবুও যেন পাগলপ্রায় বিন্দুর আজ কিছু একটা করতেই হবে আছিয়া তখনও নতমুখো, নির্বিকার।তেল চিটচিটে ফ্যকাশে পাতলা চুলের ফাঁক গলিয়ে কপাল বেয়ে মাথার ঘাম ঝরছে। বড় বড় শ্বাস পড়ছে।অর্ধনগ্ন উঁচু পেটটার উঠানামা স্পস্টতই বোঝা যাচ্ছে এখন, দেখে মনে হচ্ছে অনাগত সন্তানটার দুমাসও বাকি নেই পৃথিবীর মুখ দেখার।
বিন্দুকে সবাই মিলে শ্বশুরালয়ে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার জন্য প্রস্তুত করছে,হাজার হোক শ্বশুরবাড়িই হল মেয়েদের আসল ঠিকানা। স্বামীর নিষেধ অমান্য করে এখানে আসাটা যে অনুচিত এবং এর ফলে যে হাজারো নারীর স্বামীহীন জীবনের দুঃখ দুর্দশার কারণ তাও তারা বিভিন্ন কাহিনী দ্বারা বোঝাতে লাগলো। ক্রোধ,অপমান,সিদ্ধান্ত হীনতায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় বিন্দু শূন্য দৃষ্টিতে কি যেন ভেবে চলেছে। তার ভাবনায় বিচ্ছেদ ঘটিয়ে দুতিন জন মহিলা তাকে তার শ্বশুরালয়ে ফিরিয়ে দিতে সঙ্গী হল।বিন্দুর যেন পা চলছে না। মহিলারা তাকে ধরে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
বিন্দুর কাঁপা কাঁপা পা এগুচ্ছে ধীরে । শ্বশুরবাড়ির মানুষজন কিংবা স্বয়ং স্বামীই তার এই অপরাধ কিভাবে নেবে কতটা হিংস্র হয়ে উঠবে সেটা বিন্দুকে মোটেও ভাবাচ্ছে না। তাকে ভাবাচ্ছে মায়ের নতমুখটা। যেতে যেতে অদূরে হঠাৎ থেমে গেল বিন্দু।পেছন ফিরে একনজর দেখতে চাইলো মায়ের বদন। দূর থেকেও যেন ঠিক ঠিক বোঝা যায় মায়ের বুকের কাঁপন, শ্বাসকষ্টের হাঁসফাঁস,ব্যাথার কুঁকড়ানো গোঙ্গানির নিঃশ্বব্দ আওয়াজ!আহ্ এইই তো মা! কতটা বছর ঐ কাঁপা বুকটার মাঝে নিরাপদে আগলে রেখেছে,বড় করেছে,মায়া-শাসন করেছে! এই বুকের ধড়ফড়ানি মিথ্যা হবার নয়,ঐ শ্বাসকষ্ট লোক দেখানো নয়, ঐ নতমুখে অপরাধী ভাব নয় বরঞ্চ প্রবোঞ্চনা আর ব্যাথার ছাপ স্পস্ট! চোখের এসব বোঝাপড়া মিলাতে মিলাতে বিন্দু আছিয়ার কাছে এসে মুখোমুখি দাঁড়ালো।মায়ের মুখটা দুহাতে তুলে ধরে বলল–
–মাহ্,,, তুই আমারে মিত্যা বলেছিস ক্যান? তুই তো কোনো পাপ করিসনি।তাইলে মুখটা অমোন নিচু কইরা আছোস ক্যান? তোর চোখ দুইটায় কতবছরের কান্নার কালা দাগ শুকাইয়া আছে! এই চোখে হয়রানি ছাড়া আর কোনো পাপ নাই,, কোনো পাপ নাই মা…
–বিন্দু… বিন্দু মা’রে আমার খুব খারাপ লাগতেছেরে মা।
–হ মা তুই আগেও কয়েকবার বলেছিলি তোর খারাপ লাগা রোগের কতা,তল পেটের ব্যাথার কতা। আইচ্ছা মা সত্য কইরা কওতো তুই ব্যাথার জন্য ডাক্তার দেহাসনাই?
–না রে মা, ডাক্তার কি করবো? আমার বাঁচনের চাইতে মরণ ভালা।
–বড় ভাইজান তোরে ডাক্তার দেহায়নাই ঠিক না? আমি চাইর মাস আগে তোর লগে দেহা করতে আইসা তোর ছটফটানি দেইখা ভাইজানরে বলছিলাম তোরে যেন ডাক্তার দেহায়।
–ঐগুলান বাদ দে,আমারে ,, আমার গলাটা শুকায়ে কাঠ হয়ে গেছে। একটু পানি খাওয়াবি ? আছিয়ার পানির খাওয়ার ইচ্ছা শুনে পাহারাদার দের মধ্যে সোরগোল বাঁধল। কিছুতেই বিচার অমান্য করে পানি দেওয়া যাবে না ।বিন্দুও নাছোড়বান্দা,
–ক্যান পানি দেওয়া যাইব না? এহন যদি মায়ে পানির অভাবে মইরা যায় তুমরা হের দায় দিবা? ক্যমনে বুঝলা মায় কলঙ্কিনী? এইসব লক্ষণ অন্য রোগেরও হইতে পারে।
–হে হে …নষ্টা বেডির নষ্টা মাইয়ার কতা হুনো,, হে হে হে
কলোনির গেট দিয়ে ঢুকতেই রাতুল সোরগোল থেকে উপহাসের হাসি শুনতে পাচ্ছে।সেই সাথে বিন্দুর তেজী গলায় শাঁসানি ! বড়ভাই রুহুল আজকাল বিয়ে করে বৌয়ের আঁচলে থাকে এটা সে বুঝে। তাইবলে নিজের মায়ের বিরুদ্ধে এমন বিচার দিবে এটা সে ভাবেনি। দোকানে গিয়েও কাজে মন বসেনি রাতুলের। মায়ের কান্না মাখা মুখখানি চোখে ভাসছে। তাই হাজারো ভাবনা মাথায় করে ঘরে ফিরছে।অবশ্য তার ছোট মাথায় এসব ভাবনা ধরবেনা বলেই তার বিশ্বাস। তবে বিন্দু কে সে খুব ভালোবাসে। বোনটা শ্বশুর ঘরে চলে যাবার পর তার ঘরে ফিরতেও মন চায় না। কলোনির এই মানুষগুলো তার অপছন্দ।এদের পেটে খাবার নেই, পরনে কাপড় নেই কিন্তু পরনিন্দা আর কানকথার খুব ভালো যোগানদাতা। একটা অসহায় নারীকে বিদ্রুপের মাত্রা দেখে মনেই হচ্ছে না এরা হতদরিদ্র,অভাবী ছাপোষা মানুষ।
–বিন্দু’ তুই আসছিস?!
–হুম, মায়েরে ধরতো।
পানি খাইতে চাইছে বলে এরা কেমুন করতেছে! ছোটভাই তুই ও একবার ডাক্তার দেখালিনা? আমার তো মনে হতিছে মায়ের খুব খারাপ অসুখ করেছে। দ্যাখ মা কেমুন করতিছে! মা ও মা চোখ খোল আমার মা’র যদি কিছু হয় এগুলা একটারেও আমি ছাড়ুম না।পুলিশে খবর দিমু। সব গুলারে জেলে পাঠামু আছিয়া অজ্ঞান হয়ে বাঁধনের দড়িতে শরীর ঢলে পড়লো। দরদর করে ঘাম ঝরছে তার শরীর থেকে। দুবার ঝাঁকুনি দিয়ে উঠে পরক্ষণেই শরীর থেমে গেল! আশপাশের মানুষের বিদ্রুপে কিছুটা ভাটা পড়লো। কয়েকজন অবস্থা বেগতিক হবে ভেবে কেটে পড়লো।ততক্ষণে ভাইবোনে মিলে মায়ের শরীরের বন্ধন খুলতে লাগলো।
ষাটোর্ধ্ব মধুমিঞা তার ভ্যান খানা নিয়ে এলো তিনজনে মিলে ধরাধরি করে ভ্যানে তুলে হস্পিটালে নেয়া হচ্ছে আছিয়াকে।চারদিকে সুরের মাতম তুলে মাগরিবের আজান হচ্ছে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দিনটা একটা অজ্ঞ পরিবারের জন্য কেমন এবং কতটা অযৌক্তিক তার প্রমাণ দিয়ে পরদিন সন্ধ্যায় আছিয়ার জ্ঞান ফিরলো। তার পেট কেটে ডাক্তাররা দুই কেজি প্রায় পরিমাণ সাইজের একটা টিউমার কেটে বের করে আনলো।টিউমারটার দিকে তাকিয়ে বিন্দুর গা গুলিয়ে উঠেছে।হড়বড় করে বমি করেছে কয়েকবার। আর এসবের জলজ্যান্ত সাক্ষী থাকল ষাটোর্ধ্ব এক বৃদ্ধ মধু মিঞা!
শুধুমাত্র একজন মা’ই পারে একাধারে মা এবং বাবা হয়ে উঠতে।তবে তার জন্য প্রয়োজন শিক্ষা এবং উপযুক্ত পরিবেশ। শিক্ষা এবং পরিবেশের অভাবে আমাদের দেশীয় চিত্র কতটা নির্মম হতে পারে এই গল্পটা না শোনা হলে কখনো গভীর ভাবে উপলব্ধি করতে পারতাম না।
গল্পের বিষয়:
গল্প