আমার বাবা’র অনেক আচরণ ভালো লাগে না আমার। যেমন আজ ওনার তিন বছর থেকে ব্যবহৃত রাবারের স্যান্ডেল গুলো নোংরা, ময়লা অবস্থায় আমাকে ছাই দিয়ে ধুয়ে পরিস্কার করতে বলে বাইরে চলে গেলেন খালি পায়ে। আমাদের স্যান্ডেল ছিঁড়ে গেলেই তো নতুন স্যান্ডেল এনে দেন তবে কেনো তাকে এই তলা ক্ষয়ে যাওয়া স্যান্ডেল পরে দুনিয়ার সব জায়গায় চলাফেরা করতে হবে।
কি বিশ্রী অবস্থা হয়ে গেছে স্যান্ডেল জোড়ার একটায় তিনটা অন্যটাতে চারটা জায়গায় সেলাই করা আবারও ছিঁড়ে গেছে দুই জায়গায় নিজে সেলাই করার সুযোগ পায় নাই হয়তো তাই ওই অবস্থায় আছে স্যান্ডেল জোড়া । স্যান্ডেল জোড়া পরিস্কার করে মনটা খারাপ হয়ে গেলো বাবা কি জন্য নিজের সাথে এতো কিপ্টামি করেন, আমি ভেবে পাইনা। বাড়িতে গোশত রান্না হলে যদি সবাই মিলে একসাথে খেতে বসি তাহলে বাবা আমাদের তিন ভাই বোনের পাতে একটু না একটু গোশত তুলে দিবেনেই নিজের প্লেট থেকে না খেয়ে। আর একলা খেতে বসলে হাঁকডাক করে আমাদের ডেকে এনে মুখে তুলে দেবেন ওনার প্লেটের গোশত। আমার অনেক খারাপ লাগে ওই গোশত খেতে, এঁটো খাবার খেতে পারি না আমি।
তবুও বাবাকে ভয় পাই জন্য কিছু না বলে খেয়ে নিই সেই এঁটো গোশত, আমার ছোট ভাই আর বোনটা তো বেশ সানন্দে খায় বাবার দেয়া এঁটো গোশতের টুকরোটুকু। এবার ঈদে নতুন কাপড় কিনতে পারে নাই বাবা আমাদের জন্য ,মা’র জন্য আর নিজের জন্য তো কোনো ঈদেও কাপড় কিনেননা তিনি। কিছুদিন আগে বাবা পাট বিক্রি করতে বাজারে গেলে করোনা ভাইরাস এর জন্য লকডাউন এ সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাগণ টহল দিচ্ছিলেন গাড়িতে করে তখন ভয় পেয়ে বাবা সহ অন্য সবাই সবার ফসল সেই বাজারেই ফেলে ছুটে পালিয়ে আসে তাদের সামনে গাড়ি আসার আগেই। পরে আর সেই পাট গুলোর কোনো সন্ধান পায় না বাবা, কেউ হয়তো নিয়ে গেছে।
তাই হাতে টাকাপয়সা নাই বাবার, আর আমাদের ঈদের নতুন কাপড় ও তিনি কিনে দিতে পারলেন না তাছাড়া এই অবস্থায় বাইরে থেকে কাপড় কিনাটাও রিস্কি। না জানি কোন কাপড়ের ভিতরে লুকিয়ে আছে করোনা ভাইরাস । কিন্তু ছোট বোন অনেক বায়না করাতে মা গতবছর ঈদে মামার দেওয়া সিল্কের মতো শাড়ীটা কেটে তিন ভাই-বোন কে নতুন কাপড় তৈরি করে দেন তা পেয়েই মহা খুশি আমরা। সেলাইয়ের জন্য একটা পুরোনো হাত মেশিন কিনেছেন মা অনেক দিন আগে, আমাদের বাড়ির সবার টুকটাক কাপড় সেলাই করে সেটাতে তাতে টেইলার্স এর ভারি মজুরি টাও বেঁচে যায়। আমিও শিখেছি সেলাইয়ের কাজ।
মা আশেপাশের মানুষদের কাপড় সেলাই করতে চাইলেও বাবার কড়া আদেশ তিনি বেঁচে থাকতে যেনো মা অন্যের কাপড় সেলাই করে টাকা নিয়ে বংশের অমর্যাদা না করেন, বিনাটাকায় সেলাই করে দিতে পারেন তাতে সমস্যা নাই।
এ পরিবারের দায়িত্ব তাঁর একার নাকি। বিকেল বেলা বাবা ঘরে শুয়ে আছেন, আমি আস্তে আস্তে হেঁটে ঘর থেকে লুডু টা বের করে আনার জন্য ঘরে ঢুকলাম। দেখি বাবা ঘুমায়নি ডানহাত টা কপালে দিয়ে রাখছেন আর এক হাতে কয়েকটা নতুন চকচকে পাঁচ টাকার নোট। বুঝতে পারলাম আমাদের ঈদের সালামি এবার পাঁচ টাকা করে তাই বাবা চিন্তায় কপালে হাত তুলেছেন শেষ পর্যন্ত, গতবছর পঞ্চাশ টাকা দিয়েছিলেন আমায় বাবা ঈদের সালামি। যখন খুব চিন্তিত থাকেন তখনই কপালে হাত দিয়ে শুয়ে থাকেন বাবা।
আমি ঘরে ঢুকেছি বাবা লক্ষ্য করেন নাই, বুকটা ব্যাথায় ভরে গেলো আমার বাবার এই অবস্থা দেখে। এখন বুঝতে পারছি নিজে না খেয়ে আমাদের খাওয়ানো আর নিজে চৌদ্দ ছিঁড়া ও সেলাই করা স্যান্ডেল পরে বেড়ানোর পিছনে আছে এক মহৎত্যাগ তা শুধুমাত্র আমাদের ভালো থাকার জন্য। লুডু না নিয়েই বেড়িয়ে এলাম ঘর থেকে হুহু করে বুকের ভিতরটা কাঁদছে আমার। বিষন্ন মনে বসে আছি মা ভাত রান্না করছেন চুলায়, এমন সময় বাবা ডাকলেন মা জান্নাতি এদিকে একটু শুনে যা তো। বাবার সামনে গেলে গত কয়েকবছর থেকে যে মোটা সাদা কাপড়ের পাঞ্জাবি টা পরে তিনি ঈদের নামাজ আদায় করতে যান সেটা ভাঙা আলমারি থেকে বের করে ধুয়ে রোদে ভালোভাবে শুকাতে বললেন।
ঠিক আছে বাবা আমি করে নেব কাজটা। রাতেই পাঞ্জাবি টা বের করার পর দেখি তেলাপোকা সেখান থেকে তাদের খাদ্য সংগ্রহ করেছে। কয়েক জায়গায় বেখাপ্পা ভাবে কেটে ফেলছে ,অনেক যত্ন সহকারে সেলাই করলেও খারাপ লাগবে দেখতে পাঞ্জাবি টা। বাবাকে ব্যাপারটা জানালে তিনি বলেন সমস্যা নাই তার কোনো ছিঁড়া কাপড় পড়তে। আমি যেন সেটা ভালো ভাবে ধুয়ে পরিস্কার করে শুকিয়ে যত্ন করে রেখে দেই। পাঞ্জাবি টা ধুতে কেঁদে ফেললাম আমি, এতো কষ্ট আর ত্যাগ স্বীকার করেন বাবা আমাদের জন্য আর সেই বাবাকে ভুল বুঝে আসছি এতোদিন আমি। আমি যে কিছুতেই নিজেকে ক্ষমা করতে পাচ্ছি না। পাঞ্জাবি শুকাতে দিয়ে দৌড়ে ঘরে এসে বিছানার তোশক এর নিচ থেকে বাবার দেয়া টিফিনের বাঁচানো টাকা গুলো গুনতে লাগলাম।
প্রতিদিন টিফিনের টাকা দেয় না বাবা তবে প্রায় দেন, আমি পুরো টাকা না খেয়ে তোশক এর নিচে রেখে জমা করি নিজের পছন্দের চুড়ি ফিতা, টিপ, লিপস্টিক কিনার জন্য। আমাদের কলেজের পাশে একটা বড় দোকান আছে মেয়েদের কসমেটিকস এর। গুনে দেখি আশি টাকা হয়েছে, কিন্তু আমি তো বাবাকে একটা সুতি কাপড়ের পাঞ্জাবি তৈরি করে দিবো তারজন্য আরও টাকার প্রয়োজন। ছুটে গেলাম মা’য়ের কাছে, মা দশটাকার বেশি দিতে পারলেন না। মা’র একটু একটু করে জমানো টাকায় সংসার চলছে এখন, সেকথা মায়ের কাছ থেকেই শুনলাম। ইচ্ছে করছে মা’কেও নতুন কিছু একটা কিনে দিই কিন্তু সে সাধ্য আমার নাই। ইচ্ছে স্বপ্ন আছে অনেক কিন্তু আমার অর্থ নাই।
জমির চাচার কাছে গেলাম দুইগজ সুতি কাপড়ের দাম কতো শুনতে ঈদের বাজারে কাপড়ের দাম কমবেশি হতে পারে তাই । শুনলাম একশো বিশ টাকা, তারমানে আমার আরো ত্রিশ টাকার দরকার। কিন্তু এই ত্রিশ টাকা কোথায় পাবো আমি, হঠাৎ মনে পরলো বাবা-র হাতের সেই চকচকে পাঁচ টাকা গুলোর কথা। বাবা এই সময় ঘরে নাই, পাগলির মতো খুঁজতে শুরু করলাম সেই টাকা গুলো অনেক খোঁজার পর পেলাম সেই টাকা গুলো। গুনে দেখি ত্রিশ টাকাই আছে তারমানে একজনের ভাগে দশটাকা করে পরতো আমাদের। লাগবে না ঈদের সালামি আমাদের এবার,নিয়ে নিলাম সেই টাকা গুলো চুপ করে। এই প্রথম নিজের ঘর থেকে নিজের বাবা-র টাকা চুরি করলাম আমি।
জমির চাচাকে দিলাম একশত বিশ টাকা সাদা কিংবা সোনালী রঙের সুতি পাতলা কাপড় আনতে। বাবাকে যেন না বলে কাপড়ের কথা সে কথাও বলে দিলাম। গ্রামের বাজার থেকে চাচা বিকেল বেলা আমাকে এনে দিলেন দুই গজ সোনালী রঙের সুতি পাতলা কাপড়। কাপড় হাতে পেয়েই মুখটা খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো আমার, দুইদিন পর ঈদ। মায়ের সাহায্য নিয়ে বাবার জন্য একরাত একদিনে তৈরি করে ফেললাম একটা পাঞ্জাবি কিন্তু সেটা কাপড়ের অভাবে না হয়েছে ফতুয়া না হয়েছে পাঞ্জাবি। সে যাই হোক আমি বানিয়েছি আমার বাবার জন্য, এই নতুন কাপড় খানা পরেই তাঁকে ঈদের নামাজ আদায় করতে হবে।পরক্ষণে মন খারাপ হয়ে গেলো বাবা যদি আমার ছেলেমানুষি দেখে রেগে যান এমন কাজের জন্য।
আজ ইফতারে পর ভয়ে ভয়ে বাবার সামনে সেই বানানো পাঞ্জাবি খানা মেলে ধরে বললাম বাবা এটা আমি বানিয়েছি তোমার জন্য। গা কাঁপছে আমার না জানি বাবা কি বলেন। হুট করে বাবা পাঞ্জাবিটা হাতে নিয়ে আমায় জড়িয়ে ধরে বললেন এটা পরেই আমি ঈদের নামাজ পড়তে যাব রে মা। আমার মেয়ে বানিয়েছে আমার জন্য আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ ঈদ হবে এই ঈদ। আমি খুশিতে কেঁদে উঠলাম আর বললাম বাবা-মা সামনের ঈদে তোমাদের এই বড় মেয়ে ঠিকই তোমাদের নতুন কাপড় কিনে দিবে।
গল্পের বিষয়:
গল্প