রাফখাতা

কেমন আছো দাশগুপ্ত ?গল্প লিখতে বসেছ?পারবে লিখতে?এই এক জীবনে মায়া-বাস্তবের নুড়ি-পাথরে গড়া রাজপথে তুমি একজন মাঝবয়েসী পথিক।চালশের গানটা আজকাল বড় বেশি ভালবাস তুমি।তুমি কি করে লিখবে গল্পটা?তবুও চেষ্টা করে দেখ।আমি বরং সাহায্য করি তোমায়।তবে তাই হোক———–
মগজের চিলেকোঠা ঘরটা ভাল করে গুছিয়ে নাও একটু।প্রথমে কাকে দিয়ে শুরু করবে ভেবে দেখ।ঘরের মানুষ না,মনের মানুষকে দিয়েই শুরু করে দাও।
তোমার অঞ্জলিদির কথা মনে পড়ে?সেই যে তোমার পাড়ার হারু কাকুর ছোট মেয়েটা।কি সুন্দর গান গাইত!মনে পড়ে—–তুমি মনে মনে তার নাম দিয়েছিলে বুলবুল পাখি।তোমার সেই বুলবুল পাখিটা একদিন তোমাকে কিছু না বলেই মাত্র ছয়টা শব্দে শেষ গানটা গেয়ে শূন্যে উড়াল দিল।মনে পড়ে তোমার সেই দীর্ঘশ্বাসের কথা?-

“ও বুলবুল পাখি তোমার গান ফুরোল ঘুমের বড়ি খেয়ে
ছাদের ওপর শুকনো কাপড়,তারের ওপর ক্লিপগুলো আটকানো
পরশু থেকে কেউ তোলে নি,পিছন দিকের দেবদারুগাছ থেকে
উল্টোপাল্টা পাতা কেবল আছড়ে এসে পড়ছে খুশিমতো
বিকেলবেলার মেঘ সরেছে,রোদ হেলেছে হেমন্তকাল বেলা
ঘরের কিছু সরায় নি কেউ?টেবিলে সেই শিশি,টেবিলক্লথ?
এককোণে চুপ জলের কুঁজো,বোকা গেলাস উল্টে আছে মুখে
খাটের ওপর না-খোলা বই,ড্রেসিং টেবিল,আয়নায় টিপ আঁটা,
ওরাই শুধু সব দেখেছে,ওরা তখন ঘরেই ছিল,ওরা
সমস্ত ঠিক বলতে পারে,কী বলবে আর কেউ–দায়ী-নয় চিঠি?
ঐ খাট সব বলতে পারে কখন তুমি কাঁদলে উপুড় হয়ে,
পাশের বাড়ির ভাড়াটে বউ,নিচের তলার মন্দিরাদির বাবা
দুদিক থেকে ধ’রে তোমায় অ্যাম্বুলেন্সে তুলল,তখন ক’টা!
পাড়ায় কখন খবর এল,কারা তোমার অন্যরকম চেনা,
তোমার সঙ্গে কার কী ছিল-গল্প চলল জটলায় জটলায়….
আমিও এই পাড়ার ছেলে,পাড়ার পুজোয় চাঁদাও নিয়ে গেছি,
লাইব্রেরিতে তোমার হাতেই বই দিয়েছি পাল্টে কতবার
না হয় তোমার ছোটই হবো,না হয় তোমায় দিদি-ই বলতাম,
না হয় তোমার বন্ধুও নই,না হয় নই অন্যরকম চেনা-
হঠাৎই সব করে বসলে-ও বুলবুল পাখি,তুমি
আমার কথা একবারও ভাবলে না।”

মেহের আলীকে বোধহয় এখন আর খুঁজো না তুমি।মনে পড়ে উত্তরপাড়ার সেই সংসারী বাউলটার কথা,যে তোমায় একদিন ধাঁধার ছলে মানুষের গান শুনিয়ে গিয়েছিল-
“আজব মানুষ এক-সকাল বেলায় চারপেয়ে
ও সে দুপুরে হয় দুই পেয়ে
সন্ধে বেলায় তিন পায়ে ভাই
কোন দেশেতে যায় রে সে।”
জানি ভুলে গেছ।তোমার উচ্চবিত্ত মোবাইল ফোনটার জমকালো মিউজিক প্লেয়ারটাতে এখন মালিকানা নিয়ে বসেছে “বিটলস” আর “জাস্টিন বিবার”।তোমার আর এখন ধাঁধাও ভাল লাগে না।তুমি এখন যথেষ্ট “আপডেটেড” এবং “স্ট্রেইট ফরোয়ার্ড”।

কানাইপুরের মেলায় এখন আর যাওয়া হয় না তোমার।মেলাটা কিন্তু এখনও বসে,দিপান্বিতা অমাবস্যার ডাকে।তালপাতার বাঁশিটা এখনও কোন নওল কিশোরের শ্বাস থেকে শক্তি কুড়িয়ে নিয়ে বাতাসে সুরের নকশীকাঁথা বুনে।টিনের তৈরী খেলনা বন্দুকটাতে এখনও বারুদ নিয়ে খেলে কোন কিশোর।বায়োস্কোপের রঙিন নেশার ঘোরটা এখন কেটে গেছে তোমার,আর কেন নয়,বিশেষ করে ড্রয়িং রুমে যখন একটা দামী হোম থিয়েটার আছে।মেলার ঝুমুর দলে গান গাওয়া সেই নিতাই কবিয়ালের কথা মনে আছে তোমার।মনে পড়ে, নিতাই গেয়েছিল——-
“মাগো,জীবন এতো ছোট কেনে
এ ভুবনে?”
জানি,মনে নেই।কারণ এই ক’দিনে জীবনটা তোমার অনেক বড় হয়ে গেছে।

আম কাঠের হাতলজোড়া আরাম চেয়ারটায় বসে থাকা প্রিয় দাদুর ছবিটা কি এখনো বেঁচে আছে তোমার চোখের ঘরে?আছে,আছে।ঐ বুড়োটা তোমাকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসতো,কখনো কথনো তোমার মায়ের চাইতেও বেশি।তোমাকে নীল কাগজের ঘুড়ি বানিয়ে দিত।লাটিম ঘুরাতে ঐ বুড়োটা ছিল জবরদস্ত।ভূতের গল্পের রাজা ছিল তোমার দাদু।আর তুমিও কেমন ভূতের গল্প পেলে নাওয়া-খাওয়া ভুলে যেতে।কিন্তু এখন তুমি আর ওসব ভূতের গল্পে বিশ্বাসী নও।রাতেও রোদচশমা পড়ে হাঁটো।সুতরাং ভূত দেখার কোন চান্সই নেই।ত্রি-জিতে বসে ফোর-জি এর অপেক্ষায় আছো।তোমায় ওসবে বিশ্বাস করা মানায় না।এর চেয়ে বরং তুমি তোমার ছোট্ট ছেলেটার বেস্ট ফ্রেন্ড সেই ভিনদেশী আয়রন ম্যানের শক্তিতে যথেষ্ট আস্থাশীল।মনে পড়ে,তুমি তখন মাত্র ক্লাস ত্রি-তে পড়।তোমার কোলে মাথা রেখেই বুড়ো শেষ গল্পটা শুনিয়েছিল।ভুলে গেছ সেই গল্পটা?-আরে ঐ গল্পটা-“ভগবান ভক্ষক”।চরম হাসির খোরাকী ছিল গল্পটা,অথচ দুর্ভাগ্য,গল্পটা শোনার পর তুমি একদমই হাসতে পারছিলে না,উল্টো অঝোরে কাঁদছিলে,কিন্তু কেন?

স্কুল মাস্টার মধ্যবিত্ত বাবাটার কোন ছবি নেই তোমার নতুন ঘরের পাশদেয়ালে।বেচারা শেষমেশ বৃদ্ধাশ্রমের শ্মশানে চন্দনকাঠের পালকিতে চড়ে চলে গেছে অন্যলোকে।আফসোস,বাবার মুখে শেষ আগুনটা দেবার ভাগ্যটাও তোমার হলো না।অথচ এই লোকটাই তোমায় একদিন ফানুশ উড়ানো শিখিয়েছিল।দুটোই তো আগুনের খেলা,তাই না দাশগুপ্ত।শেষ খেলাটায় তুমি হেরে গেছ।এই বাবাটাকে তোমার একটুও ভয় করত না।তাই লোকটা তোমাকে শাসন করার জন্যে জালিবেতে লাল রং মাখিয়ে এনেছিল একদিন,তোমাকে ভয় দেখাবে বলে।সব পুরুষই বাবা হতে পারে না,কিন্তু ঐ লোকটা পেরেছিল।তুমিও তো একজন জন্মদাতা,আদরের ছেলেটাকে একটা ফুলের ঠোকাও দাও নি কোনদিন,তবুও তুমি বাবা হতে পারলে না।তোমার ছেলেটা তোমার কাঁধে চড়ে নি কোনদিন,তবে তুমি কিন্তু সুযোগ বুঝে মজা লুটে নিয়েছিলে,মনে আছে।তোমার বাবার কাঁধটা অনেক চওড়া ছিল,তোমারটা বোধহয় ততটা নয়।পঞ্চম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষায় বাংলা রচনার উপসংহারে তুমি একবার লিখে দিয়েছিলে-“আমার বাবা সেরা বাবা”-মনে আছে?ভুলতে নেই।

লালুর কথা নিশ্চয়ই মনে আছে তোমার?কালো পশমে ঢাকা শীরণ শরীরটা নিয়েও রাজার মতো চলত।তার সবকিছুই ছিল আলাদা।তোমার কাছে পোষ মেনেছিল বটে,কিন্তু কেন জানি সবসময় পোষা কুকুর হয়ে থাকতে চাইত না সে।লালুকে নিয়ে তোমার বিচ্ছুবন্ধুরা তোমাকে কত হিংসে করত,মনে পড়ে।বাদ দাও।এত কিছু মনে করতে হবে না।এখন বলো, তোমার হলুদ রংয়ের সেই এলসেসিয়ানটা কেমন আছে,তোমার বউ কি এখনও ঐটাকে আগের মতো ভালোবাসে।নতুন একটা জার্মান শেপার্ঢ কিনবে বলে ভাবছ নাকি?

নন্দীমাঠে আরেকবার খেলবে যদি সুযোগ পাও?জানি খেলবে না। এমন একটা সময় ছিল,যখন একটা খালি মাঠ চোখে পড়লে তুমি ভাবতে,কি করে দাড়িয়াবান্ধা খেলার ঘর বানানো যায় সেখানে।কিন্তু এখন কোন খালি জায়গা চোখে পড়লেই তমি ভাব-জায়গাটা কত ডেসিমেল?এখানে কোন প্রজেক্টটা সাকসেসফুল হবে?আরও কত কি!!

সুতপা তোমার বউ হতে পারে নি। অথচ আবেগের রোশনাই ছড়ানো মাতাল কৈশোরের শুরুতে তোমার প্রথম প্রেম হয়ে এসেছিল মেয়েটা।তার সবকিছুই ভাল লাগত তোমার,শুধু অনুপস্থিতিটা ছাড়া।মনে পড়ে,প্রথম চিঠিটা কিন্তু সে-ই লিখেছিল।শুরুতেই প্রথম প্রেমের বানান ভুল।তবু তুমি ঠিকঠাক করেই পড়ে নিয়েছিলে।চিঠির উত্তরে তুমি কি লিখেছিল মনে আছে,যাক্, বাদ দাও ,ইচ্ছে করে কষ্ট কুড়োতে হবে না।কিন্তু বন্ধু,সুতপা যখন কয়েকদিন পর নিজের চিঠিটা ফেরত নিতে আসল তোমার কাছ থেকে,তখন কিন্তু তুমি অনিচ্ছেতেই কষ্ট কুড়িয়ে নিয়েছিলে।সুতপার কোনকিছুই স্বাভাবিক মনে হচ্ছিল না তোমার কাছে।তাই সুবোধ বুঝি তোমার জন্যেই লিখেছিল——

“মেয়েরা ঈষৎ উন্মাদ হলে চিঠি লেখে,কিন্তু বেশি উন্মাদ হয়ে গেলে
চিঠি ফেরত নিতে আসে।”

তোমার কি কোন দোষ ছিল সেদিন?না।অথচ সুতপারও কোন দোষ ছিল না।বেচারী কিশোরী প্রেমিকা প্রথম প্রেমের উন্মাদনায় খেই হারিয়ে ফেলে ধরা পরে গিয়েছিল বাবার হাতে।তারপর তো সব শেষ।মাত্র পনেরোতেই সংসারী হয়ে গিয়েছিল সুতপা।এখন সে রায়নগরের মোড়ে ভাড়া বাসার সংসারে পুরোদস্তুর গৃহীণি।পথের ধারের কলটাতে তাকে তুমি প্রায়ই সপ্তাহান্তের ময়লা কাপড়গুলো কাঁচতে দেখো।দেখেও বুঝি না দেখার ভান করো?তোমার লাল মারুতি গাড়িটার গ্লাস ভিউতে সুতপাকে দেখতে আগের মতো এত সুন্দর লাগে না।না না, সুতপা আগের মতোই আছে,গ্লাস ভিউতেও ময়লা জমেনি,আসলে বদলে গেছে তোমার দৃষ্টিভঙ্গিটা।আর তাই বুঝি তোমার সংসারের উর্বশী বউটাকে আজও চিনতে পারোনি তুমি ।

তোমার ঘাসফড়িং শৈশবের সেই হলুদ পাঠশালাটায় তুমি আর যাও নি কোনদিন।পাঠশালাটা রং বদলেছে অনেক বার।তারপর শেষমেশ গ্রামের পঞ্চায়েতের মারপ্যাচে রং খসিয়ে ভেঙে পড়েছে।তোমার সলিল স্যার-যার কাছে তুমি প্রথম অ,আ,ক,খ-টা শিখেছিলে,লোকটা একদিন এসেছিল তোমার কাছে,ঐ পাঠশালাটার বিষয়ে একটা সমাধান চাইতে,কিন্তু তুমি কোন সমাধান করে দিতে পার নি।কারণ তোমার গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধানেরা সবাই তোমার স্বার্থবন্ধু।যে রাজনীতিটা তুমি বোঝ,সেই রাজনীতিটা তোমার বেচারা সলিল স্যার বুঝতে পারে না,তার মননে এত প্রজ্ঞা নেই।
সেই পাঠশালার বারান্দায় ঝুলানো ছুটির ঘন্টাটার কথা মনে আছে তোমার?এখনও বোধহয় তুমি মাঝে মাঝে ঘুমের ঘোরে সেই ঘন্টার শব্দটা শুনো।কিন্তু তোমার রতন মামা এখন আর সেই ঘন্টাটা বাজায় না,সে নিজেই যখন শেষ ছুটির ঘন্টা শুনে ফেলেছে।ঘন্টাবাদক অনেকই বদলে গেছে,কিন্তু সেই ঘন্টাটা সবকিছু শেষ হয়ে যাওয়ার একটু আগেও আগের মতোই ছিল,যেমনটা তুমি দেখে গিয়েছিলে,যেমনটা তুমি শুনে গিয়েছিলে।

তুমি তখন সপ্তম শ্রেণীতে।তোমাদের হলুদ রংয়ের স্কুলে তোমার একটাই মাত্র ভাল বন্ধু ছিল।পয়েলা বৈশাখের দেয়ালিখা লিখতে গিয়ে তুমি খুঁজে পেয়েছিলে তোমার সেই বন্ধুটাকে।মনে পড়ে?হ্যাঁ,ঠিক ধরেছ,আমি সুনীলের কথাই বলছি।দেয়লিখায় লিখা সুনীলের প্রথম কবিতাটার কথা মনে পড়ে?ওটা ভুললে চলবে কি করে?ওই কবিতাটাই তো নিজে প্রথম হয়ে তোমাকে দ্বিতীয় করে দিল-

“তার একটা মাত্র পা/আর একটি মাত্র ডানা-
সে হাঁটতে পারে না /আর উড়তে পারে না।
তা-ও হাঁটতে হাঁটতে উড়ার/নকশা আছে নানা,
ফলে ভেঙে-যাবার দশা/দেহের পাত্রখানা।
তাকে বললাম একদিন / “এবার হাত গুটিয়ে বসে
তুমি কথা বলতে থাকো/আহত আক্রোশে।”
সে অমনি জুড়ে দিল/রানিং কমেন্টারি,
হায় তার সে কথকতায় / নেই কমা নেই দাঁড়ি।
এখন কথার নদী হয়ে / বয়ে চলছে সে যে
তাকে থামাই এক একবার / সেমিকোলন সেজে।”

কবিতাটা পড়ে তোমার খুব হিংসে হচ্ছিল।তোমার সমবয়সী কেউ এমন সুন্দর একটা কবিতা লিখতে পারে সেটা যেন তোমার বিশ্বাসই হচ্ছিল না।দাশগুপ্ত,তোমার সেই হিংসাটা এখনও রয়ে গেছে,তুমি এখনও সেই আগের মতোই হিংসুটে,কিন্তু তুমি এখন আর কবিতা লিখো না,কবিতা বুঝ না।
একটানা জ্বর রোগ লেগে থাকত সুনীলের।তবুও দুষ্টুমিতে ছিল তোমার চেয়ে একডিগ্রি উপরে।মিথ্যে কথা বলতে পারত অনর্গল।দোষ না করেও পিঠ পেতে সাজা নিত।তারপরও মুখে বিশ্বজয়ের হাসি।মনে পড়ে, ও ছিল বিচ্ছু বাহিনীর রাজা ,আর তুমি ছিলে সেনাপতি।রাজা হওয়ার জন্যে তোমার মনে গোপন ইচ্ছে ছিল।জানি,স্মৃতিগুলো রোজ রোজ ধূসর জামা পরে পায়চারি করে তোমার মগজের ড্রেসিংরুমে।আর তাছাড়া তুমি এখন কোন মিথ্যেবাদীকে একদমই পছন্দ কর না।তোমার মোরালিটি তোমাকে শিখিয়ে দিয়েছে-তুমি অনেক বড় হয়ে গেছ,তোমার আর মিথ্যে বলা সাজে না।আর তোমার কাছে এখন আর সেই “রাজা” আর “সেনাপতি” পদগুলো বড় হাস্যকর মনে হয়।তুমি এখন একটা মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর,তুমি তো হাসবেই,তাই না।
তবু তুমি অনেক ভাল আছ।আগেও হাসতে,এখনও হাস,ভবিতব্যেও হাসবে।কিন্তু যে তোমাকে হাসতে শিখিয়েছিল,সেই বন্ধুটা এখন আর আগের মতো হাসতে পারে না। মনে পড়ে,একদিন তাকে তুমি লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদতে দেখেছিলে,কিন্তু তার কারণটা জিজ্ঞেস করার সময় ছিল না তোমার হাতে,তুমি যে তখন উপরে উঠার সিঁড়ি পেয়ে গেছ।কিন্তু তখন তোমার বন্ধুটার বড় প্রয়োজন ছিল তোমাকে।তুমি যদি তার কান্নার রংটা ছুঁয়ে দেখতে তবে বুঝতে পারতে-

“মানুষ অন্ধকারে যত কাঁদে আলোয় তত কাঁদতে পারে না।”

ছোট্টবেলার চোর-পুলিশ খেলার কথা মনে পড়ে তোমার।সেই যে কৃষ্ঞচূড়া গাছের ডাল থেকে তলোয়ার বের করে এনে,মেহগনি গাছের ফল দিয়ে হাত বোমা তৈরী করে,খামোথা হৈ চৈ আর ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ায় পেরিয়ে যেত তোমাদের এক একটা দুরন্ত বিকেল।ঐ দিন গুলো আর পাবে না দাশগুপ্ত।তার চেয়ে বরং তুমি খবরের চ্যানেলে হেডলাইনে চোখ রাখ,কান রাখ।সত্যিকারের চোর-পুলিশের খবর পাবে।আগের মতো মজা না পেলেও,থ্রিলটা পাবে,আমি নিশ্চিত।

তুমি যখন ইন্টারমিডিয়েটে পড়,তখন তোমার ফুলমামা মারা গেল।সেই থেকে মামাবাড়ির সাথে তোমার সম্পর্ক শেষ।একটাই মাত্র মামা ছিল তোমার,যে কিনা নিজের ছেলের অভাব পুষিয়ে নেবার ইচ্ছায় তোমাকে বারবার কাছে ডাকত।তখন তুমিও মামা আর মামাবাড়ি বলতে একেবারে অজ্ঞান ছিলে।বছরের মোটমাট তিন তিনটা মাস তুমি মামাবাড়ির মাটি-জলে মিশে থাকতে,মনে পড়ে।কিন্তু একটা কথা মনে হলে এখন খুব হাসি পায়-তুমি আবেগের আতিশয্যে ভেসে একদিন তোমার ছোট বোনকে বলেছিলে,তুমি দেহত্যাগ করলে, তোমার মাটির শরীরটা যেন মামাবাড়ির শ্মশানে রাখা হয়।অথচ সেই তুমিই পুরনো কথাটা ভুলে গিয়ে,তোমার শহুরে সমাজের সুশীল স্তরে উঠার গুপ্ত অভিলাস মনে পুষে রেখে,রাজবাড়ি আবাসিক এলাকার গণশ্মশানক্ষেত্রে সাড়ে তিন হাত মাপে নিজের শেষ ঠিকানাটাও কিনে রেখেছ!কিন্তু বন্ধু,তোমার আজীবনের নিশ্চয়তায় করা জীবন বীমাটা তোমার শরীরের খোঁজ হয়তো রাখে,কিন্তু তোমার মামাবাড়ির জল-মাটি-বাতাস তোমার আত্মার খোরাকীর খবরটা রাখে,কোন এগ্রিমেন্ট ছাড়াই,কোন হিসেব-নিকেষ ছাড়াই।তোমার মামাবাড়ির সেই বড় বরই গাছটা কথা মনে পড়ে?মনে পড়ে শীতের রাতে বরই ঝরে পড়ার শব্দে তোমরা ঘুমোতে পাড়তে না।তবুও ভীষণ ভালবাসতে ঐ গাছটাকে,তার মিষ্টি ফলের জন্যে।ঐ গাছটা একদিন ঝড়ে ভেঙে গেল হঠাৎ।খবরটা শুনে তুমি খুব কেঁদেছিলে্।এখন বুঝি আর মনে পড়ে না।আর পড়বেই বা কি করে?তোমার ড্রয়িং রুমের ঐ তিনটা বনসাঈয়ের দাম কত তা আমি খুব ভাল করেই জানি,ওগুলোর যত্ন নিও বন্ধু।

কি হল? কাঁদছ কেন?গল্পটা হচ্ছে না বুঝি?মন খারাপ করো না। আমি বলি শোন।বুঝলে দাশগুপ্ত———তুমি যখন কলম হাতে নিয়ে আরাম চেয়ারটায় বসে উদোম পাকশীর বুকে অযথাই কালি ঢালছিলে,আমি ঠিক তখনই বুঝে গেছি,তোমার ন্যাংটাকালের সেই গল্পটা আর তোমার কাছে আসতে চাইছে না ।সে ছুটি নিয়ে চলে গেছে দিনযাপনের ভিড়ে।বুঝলে বন্ধু,তুমি আমূল বদলে গেছ,ভীষণ বাজে ভাবে।তোমার মগজের কোষে কোষে আজ শুধুই বিষ,অমৃতের স্বাদটা ভুলিয়ে দিয়েছে ঘুণ পোকার দল।তাই তোমার প্রজাপতি শৈশবটা আজ চিলেকোঠা ঘরে গল্প হয়ে উঠতে চাইছে না।তার চেয়ে বরং হাল ছেড়ে দাও,নিজেকে আর ওভাবে কষ্ট দিও না,আমি জানি- তোমার নস্টালজিক হতে আজকাল বড় ভয় লাগে,এর চেয়ে বেশি কষ্ট।গল্পটা লিখতে গেলে অনেক কাঁটাছেড়া হবে,তুমি বোধহয় সহ্য করতে পারবে না।এর চেয়ে বরং রাফখাতাটাই তুলে দাও সময়ের হাতে—————————-।।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত