ঘুম থেকে উঠে জানলার পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকাতেই বেশ বড় ধরনের একটা ধাক্কা খেল রাশিক ।
ধুলায় ধূসরিত শুনেছে সে , কিন্তু এ যেন তুষারে তুষরিত । নিজের অজান্তেই মনে মনে বলল ‘ও বাজিরে !’ ।
বলে, সে নিজে নিজেই হেসে দিল । দীর্ঘদিন হয়ে গেল সে তার আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে না । সকাল বিকাল ইংরেজিতেই কথা বলতে হয় তাকে । ইদানীং এল্প বিস্তর রাশিয়ান ভাষা শেখার চেষ্টা করছে । হঠাত্ তার মনে হল ‘ও বাজিরে’ কথাটা রাশিয়ান ভাষায় কি হতে পারে ? আলেসান্দ্রা কে জিজ্ঞেস করে জেনে নিতে হবে । আলেসান্দ্রা কাগজে-কলমে রাশিকের পত্নী । ব্রিটিশ সিটিজেন সান্দ্রার বাড়ি রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরে ।
আলেসান্দ্রা তাদের দুই জনের জন্য কফি বানিয়ে এনেছে । রাশিকের হাতে কফির মগটা দিয়ে সেও বাইরের দিকে তাকিয়ে বলল , ” ইটস্ বিউটিফুল , ইজন্ট ইট ! ”
রাশিক বলল , হ্যাঁ । চমৎকার ।
কাল সারারাত তুষার পড়েছে । এখনো পড়ছে । লন্ডন শহরকে মনে হচ্ছে কোন মৃত নগরী । রাস্তাঘাট, দালান কোঠা সব কিছুতে তুলার মত সাদা সাদা ধুলা জমে আছে । অথচ চারদিক কেমন আলোকিত !
সান্দ্রা জিজ্ঞেস করলো , কি ভাবছো ?
রাশিক কোন জবাব দিলো না । সে এখন মনে মনে একটা কবিতা লিখছে । তার বেশির ভাগ কবিতাই সে মনে মনে লিখে , মনের মাঝেই ছিঁড়ে ফেলে । সে এসব কবিতার নাম দিয়েছে ” মন কলা ” ; সান্দ্রা আরো একবার জিজ্ঞেস করলো , ” কি ভাবছো ? ”
রাশিক বলল , ‘ আমি একটা কবিতা লিখছি । তুমি শুনতে চাও ? ‘
সান্দ্রা বেশ আনন্দিত হয়ে বলল , ” অবশ্যই ” ।
“সাদা সাদা পাখির পালক
কিংবা তুলা ,
আকাশ হতে বৃষ্টির মত পড়ছে কতোগুলা ।
কি জানি আজ কি হয়েছে আকাশে !
মেঘগুলো সব তুলার মত পড়ছে খসে খসে । ”
সান্দ্রার চোখে পানি জমে গেল । এর একটু হলে পড়েই যেত । সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে জিজ্ঞেস করলো , ” এর মানে কি ” ?
রাশিক বেশ আশ্চর্য হয়ে বলল , ” তুমি কাঁদছ কেন ? তুমি তো এর আগা মাথা কিছুই বুঝনি । ”
সান্দ্রা অনেক কষ্টে কান্না থামাল । বলল , ” তুমি এত সুন্দর করে বললে , চোখে পানি চলে এলো । “সাদা চামড়ার মানুষগুলোর এই একটা প্রব্লেম । তাদের সবকিছুতেই বাড়াবাড়ি । শ্যামলা চামড়ার এশিয়ানদের প্রতি তাদের বর্ণবাদী মনোভাব যেমন চরম , আবার সেই সব এশিয়ানদের প্রেমে যদি কোন সাদা চামড়া ভুলে একবার পড়ে যায় তবে তাকে সারাজীবন আদিখ্যেতার চূড়ান্ত দেখতে হয় । সকালে ঘুম ভাঙে ন্যাকা ন্যাকা গলায় ” হানি ” ডাক শুনে, ঘুমাতে যায় ‘গুড নাইট হানি’ কানে নিয়ে । এতো মধু যে এরা কই পায় !
স্নো পড়ে যখন চারদিক সাদা হয়ে যায়, আমার কাছে মনে হয় এর মত সুন্দর আর কিছু নেই এই পৃথিবীতে ।” কান্না জড়ানো কণ্ঠে সান্দ্রা বলে ।
রাশিকের দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে সান্দ্রা জানতে চায় , ‘ তুমি এর চেয়ে সুন্দর কিছু কি আগে কখনো দেখেছো ? ‘
“তুই বেটি সুন্দরের দেখছ কি!” রাশিক মনে মনে বলে । কিন্তু মুখে বলে “হ্যাঁ দেখেছি । অনেক আগে একবার।”
সান্দ্রা বেশ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে , কি সেটা ?
রাশিক কিছুটা সময় নেয় । এরপর আস্তে আস্তে বলে …” অনেক আগে আমি একবার বেশ কিছু বন্ধুর সাথে সেন্টমার্টিন দ্বীপে গিয়েছিলাম । যাবার পথে আমাদের ট্রলার যখন বঙ্গোপসাগরে পৌঁছল তখন মীরা আমাকে ডেকে বলল , ‘ এদিক আয় । আমার চোখের দিকে তাকা । কিছু দেখতে পাচ্ছিস ? ‘
আমি বোকার মত তাকিয়েই ছিলাম । কিছুক্ষণ ওভাবে তাকানোর পরে কবি কবি ভাব নিয়ে বললাম , তোর চোখ এতো লাল কেন ?
শুনেই তেড়ে আসলো মারতে । বললো , ‘ভালো করে তাকা , চোখের একেবারে গভীরে ।’
এরপর আমি যা দেখলাম সেটা পার্থিব কোন দৃশ্য নয় । আমার মনে হল সেই দৃশ্যেরও প্রাণ আছে । মহাশূন্যের ব্লেক হোলের মত সবকিছু টেনে নিয়ে যাবার ক্ষমতা আছে ।”
“কি দেখেছিলে তুমি ?” সান্দ্রা প্রচণ্ড কৌতূহলে জানতে চায় ।
“আমি দেখলাম, মীরার চোখের গভীরে নীলাভ জলরাশি । থৈ থৈ করছে জল, যেন একটা অতল সমুদ্র । সেদিন আমাদের ছোট ট্রলারের চারদিক ঘিরে যে নীল সমুদ্র ছিল তার পুরাটাই হয়ত মীরা ধারণ করেছিল তার চোখে । এমন সুন্দর চোখ আমি আমার জীবনে দেখিনি । এরপর থেকে মীরার যুগল চোখ আমার চোখে অমরাবতী হয়ে আছে ।”
সান্দ্রা আবারো কাঁদছে । কান্না জড়ানো কণ্ঠে জানতে চাইল , ” মীরা কে ? ”
রাশিক খুব বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো । ঠিক বুঝা গেলো না দীর্ঘশ্বাসটার শানে নজুল কি ছিল । মীরার কথা মনে করে , নাকি এই ছিঁচ কাঁদুনে মেয়েটার কাঁদুনি অত্যাচারে ।
“মীরা আমার প্রথম জীবনের সবচে ভালো বন্ধু, হইছে! এইবার প্লিজ কান্না থামিয়ে আমাকে উদ্ধার করো ।” বলেই রাশিক টয়লেটে ঢুকে গেলো । মনে মনে আরো একবার বললো , “ভালোবাসার অত্যাচারের মত বড় কোন যন্ত্রণা আর কিছু কি আছে পৃথিবীতে !”
তবে , এই অত্যাচারের কলসি গলায় বেঁধে সাধে প্রেমসাগরে নাইতে নামেনি রাশিক । তার একটা ছোট খাট ইতিহাস অবশ্যই আছে ।
২)
আজ কত কাল পর মীরার কথা মনে পরলো। কলেজ শেষ হয়েছে প্রায় দশ বছর । ভাবতে ভাবতে জানালার বাইরে দৃষ্টি মেলে দেয় রাশিক । সে জীবনে মীরাই তার সবকিছু ছিল , সেও কি মীরার ? প্রশ্নটার ঠিক জবাব তার কাছে নেই । জানতেও চায়নি কোন দিন । এমন কঠিন হৃদয় পেয়েছিল মীরা যে, তার সাথে রাশিকের মেলামেশাকে খুব অনর্থ করলেও রাশিকের প্রতি তার দুর্বলতা প্রমাণ করা যাবে না । তবে সে ছিল তার জীবনে একজন সত্যি নারী । বড় বড় মায়াকাড়া চোখ , কি গভীর তার চাহনি ! হৃদয় ফোঁড়ে গল গল করে বের হয়ে আসা হাসি ; যেন অবিরল রঙের ধারা । ভীষণ শান্ত , শামুক স্বভাবের মীরার মাঝে একটা অস্বাভাবিক অহংকার ছিল বটে । বসনার ভাঁজে ভাঁজে আন্দোলিত নিহত প্রেমিকের আহাজারিতেই কেবল তা প্রকাশ পেত ।
মীরার জীবনের গল্পটা রাশিকের কাছে অমীমাংসিত’ই থেকে গেলো । শেষদিকের মীরাকে যে-কেউ দেখলে বলে দিতে পারতো , সে ভালো নেই । একবার কথায় কথায় বলেছিল মীরা , জীবনের উপর বড়ো অভিমানী হয়ে উঠছে সে নিয়মিত । আরো অনেক কিছুই হয়ত বলতে চাইতো । কিন্তু কি যেন একটা বাঁধা বারবার প্রচণ্ড আক্রোশে মীরার কণ্ঠনালী আঁকড়ে ধরতো ।
অমলের সাথে তার ভাব ছিল খুব । কিন্তু এতো ভাবের মাঝেও প্রায়শ কিসের যেন একটা অভাব বোধ করতো মীরা । কি বলে সেটাকে ? বিশ্বাস ? রাজনীতি করতো অমল । সে সময়ের তুখোড় ছাত্রনেতা । কেবল এইটুকুই জানে রাশিক তার সম্পর্কে । এর বেশি কখনো জানতেও চাইনি সে ।
প্রথম যেদিন সে মীরাকে দেখেছিল , তার মনে হয়েছিল মর্তের পথে পথ ভুল করে হঠাৎ চলে আসা কোন ষোড়শী রাজকন্যা । কিন্তু সেই মীরা-ই একদিন এতোগুলো ছেলেদের মাঝে নিজে এসে তার কাছে জানতে চেয়েছিলো, “কলা ভবনটা কোন দিকে বলতে পারেন ?”
আচমকা কোন কথা বলতে পারেনি রাশিক । শুধু আঙুল উঁচিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল কলা ভবনের পথ । সেই থেকে কলেজের সব’চে চঞ্চল ছেলেটিকে বোবায় ধরলো । এরপর কতদিন তারা একসাথে হেঁটে বাড়ি ফিরেছে । এভাবে একসাথে হাঁটতে হাঁটতে রাশিক একদিন পথ হয়ে গেলো মীরার চরণ তলে ! সেই পথ ধরে মীরা প্রায় আসতো যেতো , কিন্তু তাকে কখনোই ক্লান্ত মনে হতো না । অন্য যে কোন নারীর মত মীরাও সেই পথকে সড়ক ভেবে তার উপর অধিকার জমিয়েছিল । কিন্তু রাশিক হয়ত অন্য কিছু ভেবেই বসে ছিল ।
মীরাদের গ্রামের সবচে উত্তর দিকে অনেকটা জায়গা নিয়ে জমিদার বাড়ি । জমিদার বাড়ির জমিদারী ফুরিয়ে গেছে সেই ক’বে , কেবল শা-নটুকু রক্ষা করে চলেছে শান বাঁধানো ঘাট সহ একটা প্রকাণ্ড দিঘি । রাশিক জানে এই জায়গাটা মীরার ভীষণ প্রিয় । পশ্চিমের আকাশে সন্ধ্যা মিলিয়ে যাবার আগ পর্যন্ত মীরা এই দিঘির ঠাণ্ডা জলে পা ডুবিয়ে বসে থাকে । রাশিক প্রায় মানা করতো ,
“দিঘির এতো কাছে যাসনে, এই দিঘির রাক্ষুসে জল । গিলে খাবে তোকে ।”
খিল খিল করে হেসে উঠতো মীরা । এই অপ্রকৃতিস্থ হাসির মানে কখনোই বুঝেনি রাশিক । মীরা কিছু বলতো না , তাকিয়ে থাকতো নিমীলিত চোখে রাশিকের দিকে । পলক পড়ে না । কি দেখতো মীরা অমন করে ! কিছু একটা বলেতে চাইতো । ভীষণ আগ্রহে বলতে চাওয়া তার সহস্র কথার বর্ণমালা সাজাতো তার লাজুক চাহনিতে । সে ভাষা বোঝার সাধ্য কার ! রাশিক ও বুঝেনি । তবে এখন বুঝে , চেনা চেনা সেই চকিত চাহনি , ছল করে দেখা সে অনুক্ষণ ।
একদিন ভোরে ফজরের নামাজের পর মসজিদ থেকে বের হয়ে দেখে জমিদার বাড়ির সামনে লোকজন জটলা পাকিয়েছে । সবার মাঝে এক ধরনের চাপা কৌতূহল ।
অদ্ভুত এক হাহাকার নিয়ে ছুটে গিয়েছিল রাশিক সেখানে । গিয়ে যা দেখলো সেই দৃশ্যের কোন বর্ণনা হয় না । শুধু একখণ্ড অলৌকিক ছবি । দিঘির স্বচ্ছ জলে ভেসে আছে মীরার নীলাভ মুখখানা ; যেন পৃথিবীর যাবতীয় দুঃখ-যন্ত্রণা নিয়ে সদ্য ফোঁটা এক মহান নীলপদ্ম । একখণ্ড অখণ্ড অহংকার ।
রাশিকের কানে তখনো বজ্রের মতো বেজে উঠে সেই খিল খিল হাসির শব্দ । সেই নিমীলিত চোখের দৃষ্টি , আর তাদের শেষ সংলাপটুকু । চোখে মুখে গভীর বিষাদ টেনে এনে মীরা সেদিন বলেছিল ,
“জানিস রাশিক, প্রতি রাতে আমি ঘুমাতে পারিনা । অসীম শূন্যটা থেকে ছুটে আসা একটা বিন্দুর মত অস্তিত্ব আমাকে ব্যাকুল হয়ে ডাকে । অকুতি মিনতি করে বলেতে থাকে, আমাকে তুমি বাঁচিয়ে রেখো । তুমি প্রস্তুত হও । তোমাদের পৃথিবী আমাকে বাঁচতে দিবে না । জানিস রাশিক, আমার খুব ভয় হয় । আমি কিছুতেই ঘুমাতে পারি না ।”
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে রাশিক । চারদিকে আলো জ্বলমল করছে । কিন্তু বিপুল গভীর অন্ধকারের বাঁধভাঙ্গা স্রোত জানালা দরজার সব রন্ধ্রপথ দিয়ে হুড় হুড় করে ঢুকে পরে রাশিকের ভেতর । এতকাল পরে এক অদ্ভুত বোধ জন্ম নেয় তার ভেতর । সে কেনো বুঝেনি মীরার চোখের সে ভাষা !!
৩)
আজ সকাল থেকে বৃষ্টি হচ্ছে । বেশ কয়েকদিন আগে স্নো পরাতে রাস্তা-ঘাট পিচ্ছিল হয়ে আছে , এই বৃষ্টিটা খুব দরকার ছিল বটে । বৃষ্টির কথা ভাবতে ভাবতে খানিকটা উষ্ণ হয়ে উঠে রাশিকের মন । এই বৃষ্টিটুকুই যেন তার সবচে পুরুনো বন্ধু । বড় আপন । বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে দেখে এসেছে তার প্রতিটা জন্মদিনে আর কেউ তাকে মনে রাখুক আরা না রাখুক ঝুম বৃষ্টি এসে নিয়ম করে বলে যায় “ ভিজো বৎস, আজ তোমার জন্মদিন ।” এরপর কেটে গেছে কতো কাল , কিন্তু ব্যতিক্রম দেখেনি সে কোন বছর ।
তুমি এখনো রেডি হওনি ?
সান্দ্রার কথায় কিছুটা ভয় পেল কি রাশিক ? হয়ত । ইদানীং তার কিছু একটা হয়েছে । প্রায় অন্যমনস্ক হয়ে থাকে সে । বেশ কয়দিন হলো কি যেন একটা গোপন ভয় তার ভেতরে আহত পাখির মত ছটফট করছে , ডানা ঝাপ্টাচ্ছে ।
গোসল সেরে সবে মাত্র রুমে ঢুকলো আলেসান্দ্রা । বাসি বেলি ফুলের একটা চাপা সৌরভ নাকে এলো রাশিকের । এই বাড়িতে গন্ধটি তার কাছে অপরিচিত । তাহলে সান্দ্রা কি নতুন কোন শাওয়ার জ্যাল ইউজ করছে ? রাশিক একবার ভাবলো তাকে জিজ্ঞেস করবে কি না । সদ্য স্নান করে আসা সান্দ্রার খোলা পিঠের দিকে চোখ পরতেই চোখ সরিয়ে নেয় রাশিক । মেয়েটাকে খুব বেশী একটা সুন্দর বলা যাবে না । তবে তার মাঝে কোথায় যেন একটা স্নিগ্ধতা আছে । চোখ পড়লে চট করে তা ফিরিয়ে নেয়া যায় না ।
কই উঠলে না যে এখনো ?
সান্দ্রা ইদানীং ভাঙা ভাঙা বাংলা বলতে চেষ্টা করছে । প্রথম দু একদিন খুব কানে লাগতো । এখন তেমন কিছুই মনে হয় না । বরং শুনতে মজাই লাগে ।
‘আর ইউ গোয়িং এনি-ওয়ার ?’ রাশিক প্রশ্ন করে ।
‘আজকে না ল’য়ারের সাথে দেখা করার কথা ? তুমি কি ভুলে গেছো ?’ সান্দ্রার গলা খানিকটা বিরক্ত শুনায় ।
‘কিন্তু এপয়েন্টমেন্টতো ৩ টায় । এখন বাজে ৯,৩০ টা । এতক্ষণ আগেই বা যাবে কোথায় ?’
‘আজকে সারা দিন আমরা একসাথে ঘুরবো ।’
সান্দ্রা একটার পর একটা প্লান বলতে থাকে । রাশিকের কোন উচ্ছ্বাস নেই সেদিকে । তার ভাবনার কেন্দ্র বিন্দুতে এখন ল’য়ারের এপয়েন্টমেন্ট । সব ঠিক ঠাক থাকলে আজকেই তার ভিসা সমস্যার চূড়ান্ত সমাধান হয়ে যাবার কথা । সুখী সুখী আয়েশে পাশ ফিরে শোয় রাশিক । ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলে , ‘তুমি যাও । আমি আর একটু ঘুমাবো । ২ টাই তোমার সাথে মিট্ হবে কোথাও ।’
সান্দ্রা আর কথা না বাড়িয়ে বেরিয়ে পড়ে । রাশিক তার বের হয়ে যাবার পদধ্বনি শুনতে পায় । শুনতে শুনতে আধো ঘুমের ঘোরে সে আবার উজানে চলে যায় । তিন বছর আগের সেই কফি হাউজে ।
টটেনহাম কোর্ট রোডের একটা কফি হাউজে সান্দ্রার সাথে রাশিকের প্রথম পরিচয় হয় । তখন রাশিকের খুব দুর্দিন । চাকরি নেই , টাকা-পয়সা নিয়ে ভীষণ টানাটানির জীবন । এমন কি ভিসা বাড়ানোর জন্যও কোন টাকা হাতে ছিলোনা রাশিকের । সারাদিন এখানে ওখানে চাকরির সন্ধানে ঘুরতে থাকে । সত্যিকার বন্ধু বলতে কেউ ছিলো না তার । এখনো কি আছে ? প্রশ্নটা চারদিকে বড় বড় ধ্বনী তোলে । সত্যিই, পকেটে পড়ে থাকা অবশিষ্ট ৫ পাউন্ডের নোটটির মত একা সে । পকেটে হাত ঢুকিয়ে রাশিক আনমনে ছুঁয়ে দেখে সেই একাকীত্ব ; পাঁচ পাউন্ডের নোট । কফি হাউজের আলো অন্ধকারে বিচিত্র মুখগুলো দেখতে থাকে রাশিক । হঠাত তার চোখ পড়ে সান্দ্রার মলিন মুখের উপর গিয়ে । বিল মিটাতে গিয়ে কি যেন ঝামেলা হচ্ছিলো ওখানটায় । নিজের সীমাবদ্ধতার কথা চিন্তা করে কৌতূহলের পিপাসা গরম কফির সাথেই গিলে ফেলতে চায় রাশিক । পারেনি অবশ্য । জগতে সে এ-যাবত কি কি পারেনি তার একটা খসড়া তৈরি করতে করতে কাউন্টারের দিকে এগোয় রাশিক ।
সাবধানে বুঝে নেয় কত বিল হয়েছে মেয়েটার । মাত্র ৩ পাউন্ড ৪০ পেনি । এই ‘মাত্র’ শব্দটা নিয়ে অতিমাত্রায় খচখচ চলতে থাকে তার মাঝে । পরে সান্দ্রার দিকে সুসভ্য একটা দৃষ্টি টেনে রাশিক বলেছিল , ‘ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড , মে আই পে ইউর বিল ?’
বিস্ময়ে খুব একটা কিছু বলতে পারেনি সান্দ্রা , ছোট্ট করে বললো ‘সো নাইস অফ ইউ’ ।
নিজের কফি তার মেয়েটার বিল মিটিয়ে রাস্তায় নেমে এলো রাশিক ।
সে বছর ঠাণ্ডাও পড়েছিল বেশ জমিয়ে । সিগারেট জ্বালিয়ে স্টেশনমুখী হাঁটতে গিয়ে দেখলো মেয়েটা তাকে পেছন দিক থেকে ডাকছে । সেই ডাকটাই তাদের দুজনকে আজ এতো কাছে নিয়ে এলো । ল্যাম্পপোস্টের মৃদু আলোয় সস্তা মেকআপে মেয়েটাকে মোটেই খারাপ লাগেনি তার । নাকি একাকীত্বের দশখানা লোভী চোখ তার দৃষ্টিময় ছায়া ফেলে রেখেছিল সেদিন ? একটা বন্ধু তার দরকার ছিল সে কথা অস্বীকারের দায়মুক্ত । তাই বলে কেবল মেয়েদের শরীরের প্রতি তীব্র কোন টান তার কোন কালেই ছিলো না , যেখানে কারো ভালোবাসা তাকে যতটা না দুর্বল করতে পারতো । কিন্তু এই মেয়েকে ভালোবাসার কথা ভাবাও সম্ভব নয় তার ।
সান্দ্রার ও ভারী দুর্দিন তখন । বেপরোয়া জীবনে অবশিষ্ট কিছুই ছিলো না । তাই কি প্রকৃতি দুই প্রান্তের দুর্দশাগ্রস্ত দুইজন মানব-মানবীকে একটুকরো কাগজের বন্ধনে অবদ্ধ করতে চায়েছিল ?
সান্দ্রাই প্রথমে রাশিক কে প্রস্থাবটি দেয় । তারা ইচ্ছে করলেই কন্ট্রাক ম্যারেজে যেতে পারে । তাতে লাভ অবশ্য দুজনেরই । রাশিকের ভিসা সমস্যার একটা পার্মানেন্ট সলিউশন , আর বিনিময়ে সান্দ্রাকে সে ৫ হাজার পাউন্ড দিবে । ৫ হাজার পাউন্ড রাশিকের জন্য কম নয় বরং অতিমাত্রায় বেশী । কিন্তু সান্দ্রার কথা টাকাটা একসাথে না দিলেও চলবে । আস্তে আস্তে দিলেই হলো । আর একসাথেই তো থাকছে তারা , সমস্যা নেই ।
এরপর সমস্ত দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে সিদ্ধান্ত নেয় রাশিক । প্রস্তাবটা মন্দ নয় । সমস্যা কেবল টাকাটাই । এরকাছ থেকে ওর কাছ থেকে , দেশ থেকে কিছু টাকা রাশিক ম্যানেজ অবশ্য করে । একটা চাকরির ভীষণ দরকার ছিল তার । সান্দ্রার এক বন্ধুর সুবাদে তারও একটা সমাধান হয় । তারপর থেকেই তারা একই ছাদের নীচে দুজন আলাদা প্রাণ , অন্তত রাশিকের জন্য ।
৪)
নেম প্লেটে সুন্দর করে লেখা , ব্যারিস্টার অরবিন্দর সিং । গুছানো অফিস , এক কোনায় লিংকন্স ইনের একটা সার্টিফিকেট বাঁধানো আছে । হাল্কা চোখে রুমের ইন্টেরিয়র দেখছে রাশিক । সান্দ্রা তার সদ্য লাগানো ফলস নকগুলো দেখছে ।
আজ যদি ভিসা হয়ে যায় , এরপর কি প্ল্যান তোমার ? সান্দ্রা হঠাত রাশিককে উদ্দেশ্য করেই জানতে চায় ।
প্রশ্নটার জন্য একদমেই প্রস্তুত ছিলো না সে । অনেক্ষন চুপ চাপ তাকিয়ে থাকে সান্দ্রার দিকে । মুখের কোনে হাসি টেনে বলে , ‘মানে কি এর ? আই মিন , প্রশ্নটা ঠিক বুঝতে পারিনি । একজেক্টলি কি জানতে চাও তুমি ?’
দুইজনের কথোপকথনের মাঝখানে ব্যারিস্টার অরবিন্দর সিং এর হাস্যোজ্জল প্রবেশ । কথাটার রেশ কিন্তু থেকেই যায় দুইজনের মাথার ভেতর ।
‘কংগ্রাচুলেশন রাশিক সাহেব । আপনার আবেদন এক্সেপ্টেড । এই নিন আপনার পাসপোর্ট ।’
হাসতে চেষ্টা করে রাশিক । তার ভীষণ খুশি হবার কথা , ভীষণ উল্লাসিত হবার কথা । কিন্তু কি লজ্জায় সংকোচে হাত বাড়িয়ে রাশিক পাসপোর্টটি নেয় , তা রুমের ভেতরকার অন্য দুজনের দৃষ্টি এড়ানোর কথা নয় ।
‘কাল সকালের ডাকেই পেয়েছি এটা । ইচ্ছে করেই বলনি ফোনে । দেখতে চাচ্ছিলাম আপনার অনুভূতি কেমন হয় ।’
মলিন একখানা হাসি ঝুলিয়ে রাশিক অরবিন্দকে উদ্দেশ্য করেই বলে, ‘থ্যাংকস , ইউ হ্যাভ ডান এ’লট ফর মি ।’
‘আমি কি আর করলাম, প্রফেশনে এটুকু সবাই করে, সত্যি অর্থে যদি থ্যাংকস দিতেই হয় তো অলেসান্দ্রাকে দিন । সে’ই ধন্যবাদটুকুর যোগ্য দাবিদার ।’
অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে রাশিক । শুধু ধন্যবাদটুকুই কি প্রাপ্য সান্দ্রার । খেই হারা জীবনের পাল ঠিক ঠাক করে সঠিক দিক দেখিয়েছে সান্দ্রা তাকে । এই অসামান্য সহযোগিতার জন্য সামান্য ধন্যবাদ বড়ো তুচ্ছ হয়ে যায় , ক্ষুদ্র হয়ে যায় ।
কিন্তু ভিসার এই স্টেটসটুকুর জন্য সে তো পয়সাও দিয়েছে সান্দ্রাকে । যেমন অরবিন্দর সিং নিয়েছেন । তবে সান্দ্রার সাথে কি তার শুধুই প্রফেশনাল সম্পর্ক , অরবিন্দের মতো । গত তিন বছরের অজস্র মুহূর্ত তন্ন তন্ন করে খুঁজলে কি এমন অনেক মুহূর্ত পাওয়া যাবে না , যার ঠিক ঠাক অর্থ করলে রাশিকের প্রতি সান্দ্রার ভালোবাসা প্রকাশ পায় ? যাবে , অবশ্যই যাবে ।
একসময় ভালোবাসা হতো প্লাবনের মতো , ঝড়ের মতো । চোখা চোখি হতেই প্রেম । কিন্তু এখন চোখ বুঝে কেউ ভালোবাসে না । মিলনে-বিরহে-সংকটে ধীরে ধীরে ভালোবেসে ফেলে মানুষ ।
বড় বিচিত্র এই জীবন । চিত্র এঁকে, হিসেব কষেও এই জীবনের সমীকরণ বের করা সম্ভব নয় । একটা সময়, খুব স্বাপ্নিক ছিল রাশিক । স্বপ্ন দেখতো মীরার মত কোন অহংকারী মেয়ে এসে তুমুল বদলে দিবে তার জীবন । বাবুই পাখির বাসার মত ছোট্ট একটা ঘর হবে তার ; শৈল্পিক । আজ কেনো কোন স্বপ্ন নেই তার ? এক জীবনে, জীবনের দুর্দিনে সে তার সর্বস্ব বিকিয়ে খেয়েছে । সেই ফাঁকে স্বপ্নগুলোও কি বেচা বিক্রি হয়ে গেছে ?
একটা তীব্র নিঃশ্বাস দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে বেরিয়ে পড়ে রাশিকের ভেতর থেকে । লন্ডন ব্রিজের নীচে একটা রেস্তোরায় তাকে বসিয়ে রেখে সান্দ্রা কোথায় যেন গেছে । বেশিক্ষণ হয়নি , তা’ও খানিকটা অস্থির বোধ করতে থাকে নিজের ভীতর । কিছুদিন ধরে সান্দ্রার ভেতরও একটা অস্থিরতা খেয়াল করেছে রাশিক । হাল্কা একটা পরিবর্তন এসেছে সান্দ্রার মধ্যে । স্বভাব সুলভ স্থিরতাটা আর নেই তার ভেতর । কেমন যেন শুঁকিয়ে মিইয়ে গেছে সান্দ্রা । চোখে মুখে সব সময় একটা দুশ্চিন্তার ছাপ পড়ে থাকে । কি যেন বলতে চায় , অথচ বলতে পারে না । আজ জিজ্ঞেস করে দেখতে হবে , মনে মনে ভেবে নেয় রাশিক ।
বস্তুত রাশিক এখন মুক্ত মানুষ । সারাজীবন এই দেশে থাকার কোন প্রবলেম নেয় এখন তার । ইচ্ছে করলে যে কোনখানে যেতে পারে সে । সান্দ্রাও বাঁধা হবার কথা নয় । চুক্তির শর্ত এবং মেয়াদ দুইটাই পূরণ হয়ে গেছে । রাশিক পেয়ে গেছে তার সোনার হরিণ ,ভিসা । আর সান্দ্রা তার কন্ট্রাকের টাকা । টাকার কিছুটা এখনো বাকি আছে , কিন্তু সেটা কোন প্রব্লেম নয় । সমস্যা হলো তার আর সান্দ্রার মাঝে শুধুই কি একটুকরো কাগজ ? আর কিছুই কি তৈরি হয়নি তাদের মাঝে ? তিন বছর একসাথে থাকার পর আজো কি সান্দ্রা তার কাছে এক টুকরো কাগজ কিংবা একটা সতেজ যৌবন ?
প্রশ্নগুলো রাশিক কে আরো অস্থির করে তুলে ।
সান্দ্রা এসে একটা চেয়ার টেনে রাশিকের পাশে বসলো । তার হাতে একটা গিফট বক্স ।
‘সো, হুয়াটস্ ইউর প্ল্যান না’উ?’ গিফট বক্সটা রাশিকের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে প্রশ্ন করে সান্দ্রা ।
‘জানি না , ভেবে দেখি নি । তুমি কি করবে ?’ পাল্টা প্রশ্ন করে রাশিক ।
‘আমার কেটে যাবে কোনরকম । তুমি চলে গেলে খালি খালি লাগবে , এই যা ।’
‘হুম্ম’
‘তুমি আবার বিয়ে করবে না?’ প্রশ্নটা করেই সান্দ্রা কেমন যেন একটা অস্বস্থি ডেকে আনে নিজের ভিতর ।
‘বিয়ে তো করেছি একবার , আবার করাটা কি জরুরী ?’
‘সেটা তো কাগজের বিয়ে । শুনেছি এভাবে যারা বিয়ে করে তারা আবার বিয়ে করে । অন্য কাউকে ; যাকে সে ভালবাসতে পারবে ।’ সান্দ্রার গলাটা ভারী শুনায় ।
‘তুমি করবে না বিয়ে ?’
কোন জবাব দেয় না সান্দ্রা । তার ঠোঁটের কোনায় ম্লান একটা হাসি দেখা যায় শুধু ।
‘অনেকদিন ধরে তোমাকে একটা কথা বলবো বলে ভাবছি ।’ ফুসফুসে ভীষণ সাহসী বাতাস টেনে সান্দ্রা বলেই ফেলে কথাটি ।
‘হ্যাঁ , আমিও লক্ষ্য করেছি বিষয়টা । কিন্তু ভেবে পাচ্ছিলাম না , কি এমন কথা যার জন্য এতো ফর্মালিটিস ।’ খানিকটা নড়েচড়ে বসে রাশিক ।
তারপর দুজনেই আবার চুপ ।
‘কই বলছো না তো , কি কথা !’ নীরবতা ভাঙে রাশিক ।
‘রাশিক, আমরা অনেক ভেবে, চিন্তা করে একটা নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে একসাথে ছিলাম । আজ সে উদ্দেশ্য শেষ হয়ে এসেছে । এখন চাইলেই আমরা কেউ কাউকে ধরে রাখতে পারিনা । যেখানে আমার প্রতি তোমার কোন মানসিক দুর্বলতাই নেই , ধরে রাখার প্রসঙ্গ এখানে অবান্তর । আজ একটা বিষয় আমি বুঝে গেছি , শরীরের কোন আলাদা ক্ষমতা নেই । একটা শরীর আরেকটা শরীরকে কাছে টানে মাত্র । কিছুক্ষণের জন্য ক্লান্ত করে শুধুই । ধরে রাখতে পারে না সারাজীবনের জন্য । কিন্তু মনের ক্ষমতা কি অসীম ! কি সম্পূর্ণ !!
আমি তোমার মনেই ছিলাম না কোন দিন ; শুধু তোমার চোখের সামনে থেকে মনে করিয়ে দিতাম আমার উপস্থিতি । তাই ইদানীং ভাবি, তুমি চলে গেলে বুঝি আমাকে ভুলেই যাবে । তাই না ?’
অনেকক্ষণ চুপ থাকে দুজন । অপলক তাকিয়ে আছে সান্দ্রা , রাশিকের দিকে । অবিকল মীরার সেই চাহনি ।
‘কি হয়েছে তোমার ? এসব কথাই বা কেনো আসছে ? তুমি ঠিক আছো তো ?’ পরপর প্রশ্নগুলো করে ফেলে রাশিক ।
“প্রায় দুই মাস হতে চললো রাতে আমি ঘুমাতে পারিনা । অসীম শূন্যটা থেকে ছুটে আসা একটা বিন্দুর মত অস্থিত্ব আমাকে ব্যাকুল করে তোলে । অকুতি মিনতি করে বলেতে থাকে , আমাকে তুমি বাঁচিয়ে রেখো । তুমি প্রস্তুত হও । তোমাদের পৃথিবী আমাকে বাঁচতে দিবে না । জানো রাশিক , আমার খুব ভয় হয় । আমি কিছুতেই ঘুমাতে পারি না । ” কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে সান্দ্রা বলে ফেলে তার এতদিনের জমানো কথা ।
এই তুমি কি শুনালে !
কি শুনালে ! বলে একটা ঘুঘু অবিরাম ভাঙ্গা বাদ্যের মতো থেমে থেমে ডাকতে থাকে রাশিকের মনের ভেতর । আস্তে করে চেয়ার থেকে উঠে নদীর পাড়ে রেলিং এ হাত দিয়ে দাঁড়ায় রাশিক । এদিকে ওদিকে তাকিয়ে কা’কে যেন খুঁজতে থাকে মনে প্রাণে । তার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে , এ আমি কি শুনলাম ! কি শুনলাম !!
এখান সেখানে সম্ভাব্য সবখানে যিনি বসে বসে কল কাঠি নাড়ছেন তার কাছে আজ রাশিকের বড়ো জানতে ইচ্ছে করছে ,
“এ কেমন নাড়ালে, যেটুকু নাড়ালে নড়ে যায় ভেতর-বাহির ?”
বহুদিন আগে ঠিক এমন করেই কি কথাগুলো বলেছিল মীরা ? এতোটাই মায়া কি ধরে রেখেছিলো সেদিন তার মুখ ? প্রশ্ন, প্রশ্ন, প্রশ্ন স্তূপ হয়ে জমতে থাকে রাশিকের ভেতর ।
কিন্তু এতো কিছুর পর, এতো প্রশ্নের পরে রাশিক একটা প্রশ্নের উত্তর জেনে গেছে ঠিকই । সান্দ্রাই তার জীবনের সবচেয়ে বড় সত্য ।
মীরা , তার ভেতরে ‘ অমলের ‘ রেখে যাওয়া প্রায় শূন্যের কাছাকাছি ছোট্ট একটা ভ্রূণ বহন করতে না পেরে দিনে দিনে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র হতে হতে একদিন সকালে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র হয়ে মিলিয়ে গেছে অসীমে ; সে’ই কি তবে নব উল্লাসে ফিরে আসছে ?
হয়ত ।
সান্দ্রা রাশিকের হাত ধরে দাঁড়িয়ে দেখছে , পূর্ণ চোখে তাকায় রাশিকের দিকে । রাশিক ও তাকিয়ে আছে সেই চোখে । অবিকল মীরার সেই চোখ । সেই দৃষ্টি । রাশিক জেনে গেছে , এই দৃষ্টি উপেক্ষা করার সাধ্য নিয়ে সে জন্মায়নি ।
আকাশ কালো করে মেঘ জমেছে । বৃষ্টি কি হবে ??
রাশিক ছোট ছোট শব্দে উচ্চারণ করে কিছু শব্দ । বুঝা যায়না কাকে উদ্দেশ্য করে বলছে সে কথাগুলো …
” কতদিন কাছে থেকে রেখেছো গুটিয়ে
আজ দূর থেকে ছুঁতে চাও পল্লবিত শুঁড়ে
নিষ্ঠুর শামুক ।
আজ দূরে গিয়ে দীর্ণ হও স্মৃতির উজানে
যা কিছু মেঘ জমেছে চোখের কোনে
বৃষ্টি হয়ে নামুক । “