সিমি অনেকক্ষণ ধরে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। জানালাটা বেশি বড় না। মাঝারি আকারের, গ্রিল দিয়ে আটকানো। সিমি কি দেখছে তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছেনা। শুধু দেখে বোঝা যায় গভীর মনোযোগে একটানা একদিকে তাকিয়ে আছে। সিমিকে জিজ্ঞাসা করলে হয়তো সে নিজেও বলতে পারবে না। হতে পারে তার চোখ ঝাপসা বলে তেমন বিশেষ কিছু দেখছে না কিংবা তার মনোযোগ সেদিকে নেই বলেই হয়ত বুঝতে পারছে না।
চোখ ঝাপসা কারণ সিমির চোখে পানি, তবে মনোযোগ না থাকার কারণ আর চোখে পানি থাকার কারণ এক না। সে ভাবছে আজ রাতের অনুষ্ঠানে কি পরবে। নীল একটা জামা তোলা আছে তবে এখন আর সেটা ভাল লাগেনা। “কষ্টের রঙ নীল” কথাটা সে এক বই থেকে জেনেছিল। জানার পর থেকেই সেই জামাটা পরলে মনে হয় দেহের ভেতরের সব কষ্ট গায়ে দিয়ে ঘুরছে। আরেকটা জামা আছে গোলাপি, তার ছোটখালা আজই পাঠিয়েছে। এই গোলাপি রঙ আর তার খালা- দুটোকেই সিমির সবচেয়ে বেশি অপছন্দ। ছোটবেলায় শখ করে একবার গোলাপি একটা ব্যাগ কিনেছিল সিমি, সেইসময় ছোটদের একটা রীতি ছিল, প্রতি ঈদে সালামির টাকা রাখার জন্য নতুন ব্যাগ একটা ব্যাগ কিনতেই হবে। সিমি সেইবারই নিজের পছন্দের ব্যাগ কিনেছিল। কিন্তু তার ছোটখালা তাকে সেই ঈদে সেই রঙ্গেরই একটা জামা উপহার দিয়েছিল। যা হবার তাই হলো, ব্যাগটাকে আলাদা করে না দেখে জামাটাকেই সবাই খেয়াল করছিল। অতটুক বয়সেই সিমি বুঝে গিয়েছিল কোনো কিছু নিয়ে আয়োজন যত বেশি, পৃথিবীর আকর্ষনও সেটার প্রতি তত বেশি। সেই থেকে শুরু। কি যেন মনে করে ছোটখালা প্রতিবছর জন্মদিনে তাকে একটা করে গোলাপি জামা উপহার দেয়, সিমি সেটা বছরের শেষ দিন গরিব কাউকে দিয়ে দেয়। একদম নতুন জামা বলে যাকে দেয় সে অনেক খুশি হয়। হাসি ব্যাপারটাও সুখের মতই আপেক্ষিক। নিজের জন্য যা মন খারাপের কারণ, সেই একই জিনিস অন্যের মুখে হাসিও ফোটাতে পারে।
সিমির কাছে আজ তার জন্মদিন বলে মনে হচ্ছেনা, মনে হচ্ছে এইদিনে জন্ম নেওয়াটা ঠিক হয়নি। জন্মদিন ব্যাপারটাতে আনন্দের কি আছে সিমি কখনই খুঁজে পায় না। একটা মানুষের জীবনের একটা বছর হারিয়ে যাচ্ছে, ছোটবেলার স্মৃতিগুলো পুরনো হয়ে যাচ্ছে, এখানে আনন্দের কি আছে! সিমি একমাত্র মেয়ে বলেই হয়তো তার জন্মদিনটা প্রতিবছর এত ঘটা করে পালন করা হয়। আজও তার ব্যতিক্রম হবে না। আচ্ছা আজকে সুতির শাড়িটা পরে কেক কাটলে কেমন হয়? সব মানুষ সেজেগুজে আসবে, তাদের দেখতে ঝলমলে লাগবে আর সিমিকে লাগবে একদম সাধারণ, সাদামাটা। ব্যাপারটা খারাপ হবে না। চোখে কি যেন পড়েছিল অনেকক্ষণ আগে। চোখ দিয়ে পানি পড়েছে অনেক, চোখটা ধোয়া উচিত। সিমি জানালা ছেড়ে উঠে গেলো।
রাত ৮টা ১৬। সিমি কেক এর সামনে দাঁড়ালো। সোনালি জরির হাল্কা কাজের মধ্যে কালো জমিনের জর্জেট শাড়িটায় সিমিকে খুব মানিয়েছে বলা যায়। প্রায় শ খানেক মানুষের মাঝে সিমিকে একটু আলাদাই দেখাচ্ছে। তার সুতি শাড়ি পরার ইচ্ছাটা শেষ মুহূর্তে বাতিল করেছে সে। আজকে কেন জানি মানুষকে বিব্রত করতে ইচ্ছা করছেনা। কেক কাটার পর আবার শান্তর নাম্বারে ফোন দিল সে। ফোন এখনো বন্ধ। আজ তো তার কোনো খেলা নাই, তাহলে কেন ফোন বন্ধ সিমি বুঝতে পারছেনা। হয়তো নীরার সাথে রাগ করে ফোন বন্ধ রেখেছে। কিংবা সিমিকে দূরে রাখতেই এই চেষ্টা। সিমি সবাইকে এড়িয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। বারান্দা বরাবর রাস্তাটায় প্রায়ই শান্ত এসে দাঁড়ায়। আজ সেখানে কেউ নেই। সিমি এক দৃষ্টিতে ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে আছে। লাউড স্পিকার দেওয়া হয়নি তাও বোঝা যাচ্ছে অপারেটরের মহিলা কণ্ঠটা ফোন বন্ধ বলছে। সিমি আকাশের সন্ধ্যা তারাটার দিকে তাকিয়ে গুন গুন করে গান গাইছে। পুরো গান বোঝা যায় না তবে “আজ জন্মদিন তোমার” লাইনটা স্পষ্ট বোঝা যায়…
শান্ত সেলেব্রিটি মাপের ক্রিকেটার। বড় বড় বিলবোর্ড শান্তর ছবিতে ছেয়ে গেছে। শান্তর সাথে সিমির সম্পর্ক তৈরির ব্যপারটা অদ্ভুত। শান্তকে সিমি একটা ফ্যাশন শো তে প্রথম সামনা সামনি দেখে। দেখেই সিমির ভাল লেগে যায়। কিন্তু সেটা নিজের ভেতরেই রেখে দেয় সে। কিছুদিন পরে সোনালি একটা চিঠির খাম শান্তর ঠিকানায় পাঠিয়ে দেয়, যেখানে সিমির নাম ঠিকানা কিছুই লিখা নেই। সিমি জানতো ভার্চুয়াল জগতের পাঠানো হাজারটা মেসেজের চেয়ে সত্যিকার জগতের একটা চিঠির খাম অনেক বেশি আকর্ষনীয়। সেই থেকে শুরু, প্রতি মাসে কমপক্ষে একটা আর বেশি হলে ৩ টা করে মুখবন্ধ চিঠির খাম শান্তর ঠিকানায় পোঁছে যেত। এভাবে কেটে গেলো ৪ মাস।
প্রথম যেদিন শান্ত সোনালি খামটা পেয়েছিল সেদিন খুব অবাক হয়েছিল। তার কাছে এমন চিঠি সেই প্রথমই এসেছিল। মনের অজান্তে শান্তও পরবর্তী খামের অপেক্ষায় প্রহর গুনত।
ঠিক ৭ মাসের মাথায় মাথায় সিমি সেই হোটেলে গিয়েছিল যেখানে সব ক্রিকেটারদের থাকতে হচ্ছিল। সিমি খামটা ইনফরমেশনের লোকটিকে দিয়ে বললো যেন শান্তকে দেয়। খামটি দিয়ে সিমি তার পছন্দের চিজ কেক খেতে বসলো ইনফরমেশনের ঠিক সামনের লবিতে। শান্ত রুমের চাবি নিতে আসলো আর লোকটি শান্তর হাতে খামটা ধরিয়ে দিল। শান্ত খাম দেখেই হাতে নিলো আর খুলে ফেললো। খুলেই চওড়া একটা হাসি দিয়ে নিজের রুমের দিকে চলে গেল। “মানুষের হাসি এত সুন্দর কিভাবে হয়?” এই ভাবতে ভাবতে সিমি নিজেও হেসে দিল। হাসি ব্যাপারটা একটু বেশিই সংক্রমক।
ঠিক ২ মিনিট পর শান্ত হাঁপাতে হাঁপাতে এসে ইনফরমেশনের লোকটিকে জিজ্ঞাসা করলো এই খাম কে দিয়ে গেছে। লোকটি আঙ্গুল উঁচিয়ে সিমিকে দেখালো। শান্ত তাকিয়ে আছে একটা ১৯ বছরের কিশোরীর দিকে যার গাল দুটো লজ্জায় লাল হয়ে আছে আর ঠোঁটের কোণায় হাসি মিলিয়ে যাওয়ার একটা আভা তখনো রয়ে গেছে। শান্ত এগিয়ে গেল, সিমি উঠে দাঁড়ালো। দুজনই চুপ। কেউ কোনো কথা বলছে না। চোখের মাঝে দিয়ে মনের কথা সব বলা গেলে ভাল হতো, না বলা সব কথাই বলে দেওয়া যেত। হঠাত সিমির মনে হলো শান্ত যেন তার চোখের দিকে তাকিয়ে তার ভেতরের সব কথা পড়ে ফেলছে। সিমি চোখ নামিয়ে ফেললো। শান্ত হাল্কা একটা হাসি দিয়ে বললো
-খামটা প্রতিবার খালি কেন থাকে?
-যেন আমাকে সবার মাঝে থেকে আলাদা করা যায়
শান্ত হেসে দিল। আর বললো
-চিঠি লিখলেও হয়তো আলাদা করে ফেলতাম
-এত কথা চিঠিতে আঁটবেনা, তাই লিখি না
-এটা আমার নাম্বার। কাগজে না আঁটা কথাগুলো এখানে বলতে পারবেন
সেইদিন সিমি অনেকটা সময় পার করেই শান্তকে ফোন দিয়েছিল। ২য় রিং এর সময়ই শান্ত ফোন ধরলো আর কিছু না শুনেই বললো “ভাল আছেন?”। সেই থেকে শুরু। তাদের বন্ধুত্বের দেড় বছর কেটে গেছে। শান্তর একটা স্বভাব ছিল, ফোনে কথা বলতে বলতে গাড়ি ড্রাইভ করে সিমির বাসার সামনে এসে দাঁড়াতো আর গাড়ি থেকে বের হয়ে গাড়িতে হেলান দিয়ে বাকি কথাগুলো বলতো। সেইসময় সিমি থাকতো গাড়ি বরাবর বারান্দায় দাঁড়িয়ে। দুজন-দুজনের দিকে তাকিয়ে রাজ্যের কথা বলতো তবে সেটা ফোনের মাধ্যমে।
শান্তর সাথে সিমির পরিচয় হওয়ার ৩ বছর আগে থেকেই নীরা ছিল শান্তর জীবনে। শান্তর সাথে সিমির সম্পর্ক বন্ধুত্বের মাঝে বাঁধা কিন্তু সেই বন্ধুত্বের পরিধি অনেক বিশাল। শান্ত আর সিমি দুজনেই সিধান্ত নিয়ে রেখেছে আজই তাদের বন্ধুত্বর সমাপ্তি করবে। কারণটা খুবই সাধারণ। সিমি পরশু চলে যাচ্ছে কানাডা, ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হতে আর শান্তও দীর্ঘ ৮ মাস পর জাতীয় দলে আবার ডাক পেয়েছে। তারা যে পথে আছে সেটার গন্তব্য এক করা না গেলেও ভিন্ন ঠিকই করা যায়। সেই কারনেই হয়তো দুজনেই চাচ্ছে দুদিকে সরে যেতে। নীরা থাকুক শান্তর জীবনে আর সিমি থাকুক পরদেশে, একজন শুভাকাংখী হয়ে।
এখন রাত ১১ টা ২০। খাওয়া-দাওয়ার পর্ব অনেক আগেই শেষ। ধীরে ধীরে সব অতিথিও চলে যাচ্ছে। আত্মীয়দের সবাই কেন যেন সিমির জন্মদিনের আনন্দের চেয়ে তার দেশের বাইরে যাওয়া নিয়ে বেশি চিন্তিত। সিমি নিজেও জানে তার দেশে থাকা কিংবা চলে যাওয়া তার আত্মীয়দের উপর কোনো রকম প্রভাব ফেলবে না, তবুও কেন তারা মিথ্যে অভিনয় করছে সেটাই সে বুঝতে পারছে না। ভেতর থেকে কোনো অনুভূতি না আসলে হয়তো অভিনয় দিয়েই পার পেতে হয়। সিমি ফোন হাতে নিয়ে সোফায় বসে আছে। সিমির বাবা পাশে এসে বসলেন। আর মেয়ের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। সিমি বুঝতে পারছিল তবুও ব্যাপারটা এড়িয়ে গেল। সিমির বাবা নিজেই প্রশ্ন করলেন-
-মন খারাপ?
-হু?
-তোর মনটা কি কোনো কারনে খারাপ?
-না বাবা।
-চলে যাচ্ছিস বলে মন খারাপ হলে সেটা তো আজ হওয়ার কথা না, কাল হওয়ার কথা।
-নাহ বাবা আমার মন ভাল
-তোর বন্ধুটা আসেনি? যাকে ঘটা করে দাওয়াত দিলি?
-কে শান্ত? নাহ আসেনি। মনে হয় ব্যস্ত
-ফোন দিয়েছিলি?
-হ্যাঁ অনেক আগে।
-এখন আবার দে
-নাহ বাবা লাগবেনা
-দিয়ে দেখ। লাগবে নাকি লাগবেনা সেটা পরের হিসাব
-আচ্ছা দেই।
সিমি ওর বাবার সামনেই শান্তর ফোনে ফোন দিল। ২ টা রিং হতেই শান্ত ফোন রিসিভ করে শান্ত গরগর করে কথা বলা শুরু করলো
-সিমি আমি বুঝি নাই এত লেট হয়ে যাবে। আমি তোমাকে ফোন দেওয়ার সাহস পাচ্ছিলাম না। ভাগ্যিস তুমি ফোন দিলে। আমি অনেক বেশি সরি।
-তুমি কই?
-তোমার বাসার সামনে
-কখন এসেছো?
-৩৭ মিনিট ধরে।
-ফোন দাওনি কেন?
-ভয়ে। বেশি রাত করে ফেলেছি, তাই। আমি কি এখন আসবো?
-দাঁড়াও আমি বাবাকে জিজ্ঞাসা করে দেখি।
সিমি ফোন কেটে দিয়ে বাবার দিকে তাকালো। বাবা একটা হাসি দিয়ে বললো
-তোর মাকে জিজ্ঞাসা কর। আমার কোনো সমস্যা নাই। জগতের সব সমস্যা মহিলারাই করে।
সিমি একটা হাসি দিয়ে দৌড়ে মায়ের কাছে গেল। অন্য সময় হলে কখনই সিমির মা এমন অনুরোধ কানেও তুলত না। কিন্তু সিমি চলে যাবে বলেই হয়তো মা কিছু বললো না, শান্তকে আসার অনুমতি দিল। কিন্তু সময় বেঁধে দিল আধা ঘণ্টা। ১২ টার মধ্যেই শান্তকে চলে যেতে হবে। সিমি খুশি হয়ে মাকে থ্যাংকিউ বলে রুম থেকে ছুটে বেড়িয়ে বারান্দায় গেল। ঠিকই সামনে শান্ত দাঁড়িয়ে আছে যেভাবে সে অন্য সময় দাঁড়ায়। ল্যাম্পপোস্টের আলোও স্পষ্ট দেখা গেল সিমিকে দেখে শান্ত কান ধরেছে। সিমি হেসে শান্তকে ফোন দিয়ে বললো
-আসো, তোমার সময় ৩০ মিনিট। সময় শুরু এখন…
শান্ত ফোন কেটেই দৌড়ে গেট দিয়ে ঢুকে গেল। সিমি সিঁড়ির একদম শেষ মাথায় দাঁড়িয়ে ছিল, শান্তকে দেখে কেমন যেন নিশ্চুপ হয়ে গেল। খুবই নরম গলায় বললো,
-আসো, ভেতরে বাবা অপেক্ষা করছে
-ঠিকাছে
শান্ত বসার ঘরে সিমির বাবার সামনের সোফায় বসলো। সোফাগুলো একটু কাতকরে রাখা বলেই হয়তো পুরো ঘরের সবটাই বলতে গেলে দেখা যায়। শান্তর একটু অস্বস্তি লাগছে, কারণটা কি সে নিজেও বুঝতে পারছেনা। এমন নয় যে শান্ত এমন পরিপাটি, জাঁকজমক বসার ঘর আগে দেখেনি কিংবা এমন জায়গায় আগে বসেনি, তবুও খুব বেশি অপ্রস্তুত লাগছে শান্তকে। শান্তর মনে হচ্ছে ঘরের ভেতরেই হাহাকারবোধ ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাই এমন লাগছে। শান্ত ভদ্রতার খাতিরে সিমির বাবার সাথে কিছুক্ষণ কথা বললো। সিমির বাবাও শান্তর খেলার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলো, নিজের অভিব্যাক্তি জানালো ওর খেলার প্রতি। এক কথায় যাকে বলে ফরমালিটিজ মেইন্টেউন করা! তাদের কথার মাঝে সিমি এসে যদি বাঁধা না দিতো তাহলে হয়ত শান্তর অনেক কষ্ট হয়ে যেতো কথা খুঁজে পেতে।
-“বাবা, ওকে একটু ছাড়ো। মা খেতে ডাকছে”
-“হ্যাঁ বাবা তুমি খেতে যাও। অনেক রাত হয়েছে”
শান্ত হাসিমুখে বললো-
-“জ্বি আংকেল, আপনিও আসুন?”
-“বাবা আমি খেয়েছি অন্যদের সাথেই। সিমি খাবে তোমার সাথে। সিমি যা খেয়ে আয়”
-“হুম বাবা যাচ্ছি”
সিমি শান্তকে ডাইনিং রুমে নিয়ে গেল। সিমি আর শান্ত দুজনেই চুপ হয়ে আছে। নিস্তব্ধতা ভাঙল সিমি নিজেই।
-নিরা ভাল আছে শান্ত?
-হুম, ভাল
-আজ না তোমার তিন বছর পূর্তির দিন?
শান্ত চোখে তুলে অনেক অবাক চেহারা নিয়ে বললো
-তোমার মনে আছে ডেট?
-হুম, আমার জন্মদিন বলেই হয়তো মনে ছিল, নাহলে মনে থাকতো না
-সেই জন্যেই দেরি হয়ে গেছে বেশি! তবে হ্যাঁ, আসলেই তোমার মনে রাখার ক্ষমতা অনেক। এটা ভাল দিক
-সবসময়ের জন্য ভাল না।
-কেন?
-এই যে এই মুহূর্তগুলোও মনে থাকবে তাই
শান্তর নির্বাক চাহনি দেখেই বোঝা যাচ্ছে ব্যাপারটা শান্তকেও পোড়াচ্ছে। কিছু না বলে সে আবার খেতে শুরু করলো। খাওয়া শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত দুজনেই খাবারের বাটি দেওয়া- নেওয়া সম্পর্কিত কথা ছাড়া আর কোনো কথাই বললো না।
খাওয়া শেষ হওয়ার পর সিমি বললো
-শান্ত?
-হুম?
-আমি একটু বেশিই পাগল ছিলাম তাই না?
শান্ত হেসে দিল। সিমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। তার মাথায় এখনও সেইদিনের মত একই কথা ঘুরছে “এত সুন্দর করে মানুষ িভাবে হাসে?”।
-“সিমি তুমি এখনো পাগলই আছো, নাহলে আমাকে কথাটা জিজ্ঞাসা করতে না”
কথাটা বলে শান্ত আবার হেসে দিল। কিছু মানুষ আছে যাদের হাসি দেখলে বিরক্ত লাগে, আর কিছু মানুষ আছে যাদের হাসি দেখলে নিজেদেরও হাসতে ইচ্ছা হয়। শান্ত দ্বিতীয় দলের মানুষ বলেই সিমিও শান্তর হাসি দেখে হেসে দিল। এরপর যা ঘটলো তা আকস্মিক ছিল বটে, কিন্তু অস্বাভাবিক না। শান্ত সিমিকে আলতো করে জড়িয়ে ধরলো এবং সাথে সাথে ছেড়ে দিল। সিমি কয়েক সেকেন্ড শান্তর দিকে তাকিয়ে রইলো এরপর শান্তর হাত ধরে ছুটে বের হয়ে সেই বারান্দায় নিয়ে আসলো যেখানে দাঁড়িয়ে সিমি শান্তর সাথে কথা বলতো। শান্ত অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে সিমির দিকে। চাঁদের আলোয় কালো শাড়ি পরা মেয়েটাকে দেখতে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে। কাজল দেওয়া চোখের জল গড়িয়ে পড়ার আগে যেমন ছল ছল করে, সিমির সৌন্দর্যও যেন একটু পরই গড়িয়ে পড়বে তাই ছল ছল করছে।
সিমি পলকহীন দৃষ্টিতে শান্তকে বললো
-এখন জড়িয়ে ধরো, শান্ত।
শান্ত বাধ্য ছেলের মত সিমির কথা রাখলো। শান্তর বুকে মুখ গুঁজে সিমি চোখ বন্ধ করে ফেললো। সিমির মনে হচ্ছে পৃথিবীটা খুবই ছোট, আর সিমি সেই পৃথিবীতে মুখ গুঁজে আছে। শান্তর হৃদস্পন্দন এর সাথে সিমির হৃদস্পন্দন ও তাল মেলাতে শুরু করেছে। শান্তর বুকের ধুক-ধুক আওয়াজটা কেমন যেন অসমাপ্ত শোনাচ্ছে। মনে হচ্ছে কোনো এক অজানা কারণে সেটি অপূর্ণ। সিমি সেই আওয়াজে কান পেতে রয়েছে, কেমন যেন একটা স্বর্গীয় ব্যাপার আছে সেখানে।
সিমি নিজেই শান্তর কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। প্রথম এবং শেষ আলিঙ্গন থেকে আলাদা হওয়ার ব্যাপারটা কেমন যেন কষ্টদায়ক। সিমি একটু সামনে এগিয়ে রেলিং ধরে দাঁড়ালো। শান্তও এগিয়ে এসে পাশে দাঁড়ালো।
-“সিমি”
-“বলো”
-“অনেক বেশি ভাল থেকো।“
-“আচ্ছা”
-“নিজের খেয়াল রেখো”
-“আচ্ছা”
-“খাওয়া-দাওয়া ও ঠিক সময়ে করো”
-“আচ্ছা”
-“শুভ জন্মদিন সিমি”
সিমি শান্তর দিকে ঘুরে বললো
-“থ্যাংক ইউ”
-“আমি আসি সিমি, আমার ৩০ মিনিট শেষ হয়ে আরও ১৯ মিনিট চলে গেছে। আমাকে যেতে হবে”
-“ভাল থেকো শান্ত”
-“আসি, সিমি! আল্লাহ হাফেয”
-“আল্লাহ হাফেয”
শান্ত বারান্দা থেকে বের হয়ে গেল। সিমি দেখতে পেলে শান্ত নিচে নেমে গাড়ি স্টার্ট দিচ্ছে। হঠাত গাড়ি থামিয়ে দরজা খুলে শান্ত বেরিয়ে এল। আর সিমিকে ফোন দিল। সিমি শান্তর দিকে তাকিয়েই ফোনটা রিসিভ করলো।
-“সিমি”
-“হ্যাঁ বলো”
-“তোমাদের ডাইনিং টেবিলের উপরে তোমার গিফটটা রাখা আছে, দেখে নিও”
এই বলে ফোন কেটে দিল শান্ত। সিমি শান্তর দিকে একবার তাকালো, এরপর বারান্দা থেকে বের হয়ে গেল। ডাইনিং রুমে যাওয়ার সময় শুনতে পেল গাড়িটা একটা জোরে টান দিয়ে চলে যাচ্ছে।
সিমি ডাইনিং রুমে ঢুকলো। টেবিলের উপরে সিমির জন্য উপহার রাখা। একটা সোনালি খাম। সিমি খামটা হাতে তুলে নিয়ে খামের মুখ খুললো। খামের ভেতরটায় কিছু নেই, সম্পূর্ন খালি।
গল্পের বিষয়:
গল্প