হারিয়ে খুজি তোমায়

হারিয়ে খুজি তোমায়

রিক্সা ভাড়া দিয়ে অরণ্য নারিকেল গাছের নিচে দাড়িয়ে থাকল । পকেটে টাকা দূরে থাক একটা পয়সাও নেই । বাংলাদেশে যদি এখনও পাঁচ পয়সা থাকতো অরণ্যর পকেটে এখন সেটাও থাকতো না । অরণ্য দাড়িয়ে আছে লাবণীর জন্য । লাবণী ভার্সিটি থেকে বের হবে কিছুক্ষণ পর । কিছুক্ষণ অরণ্যর সাথে রাস্তায় রাস্তায়
ঘুরে তারপর বাসায় যাবে । রাস্তায় সারা দুনিয়ার কথা বলবে । ভাগ্য খারাপ হলে
অরণ্য কিছু বকা এমনকি মারও খেতে পারে ।

লাবণী অনেক সহজ একটা মেয়ে । যা বলার খুব সহজে গুছিয়ে বলে দিতে পারে ।
অরণ্যকে অনেক বড় বড় লেকচার দিবে যার আগা-মাথা কিছুই লাবণী নিজে মানে না কিন্তু অরণ্যকে মানতে হবে । অরণ্য কিছুক্ষণ যুক্তি দিয়ে ওর কথার ভুল দেখাতে চাইবে পরে হাল ছেড়ে দেয় । তারপর রিকশায় করে বাসায় চলে যাবে । যাবার আগে রিকশাওয়ালাকে ভাড়ার টাকাও দিয়ে দিবে এবং অরণ্যকে বাসায় পৌঁছে দিতে
বলবে । ওরা কিন্তু প্রেমিক প্রেমিকা না, শুধুই বন্ধু । পরানের বন্ধু, বসম ফ্রেন্ড ।
লাবণী ভার্সিটি থেকে বের হল । প্রথমেই ওর হাসির শব্দ শুনা গেলো । বান্ধবীদের
সাথে কি নিয়ে জানি হাসছে । অনেক সুন্দর হাসি । দেখলে শুধু তাকিয়ে থাকতেই
ইচ্ছা করে । অরণ্যকে দেখেই বান্ধবীদের বিদায় জানিয়ে ওর কাছে চলে আসতে
লাগল । কিছুক্ষণ এসে একটা মুচকি হাসি দিল । অরণ্য চিন্তা করতে লাগল , ওকে হেসে দেখল নাকি দেখে হাসল ।

কিরে ছাগলা তর চেহারার এই অবস্থা কেন ? কয়দিন ধরে গোসল করিস না ? আর এই লম্বা চুল কাটিস না কেন ? ঘোড়ার লেজের মত এই চুল কি তর মনে ফ্যাশন? আজকেই চুল কাটবি , শেভ করবি তারপর বাসায় গিয়ে গরম পানি দিয়ে গোসল করবি । মানুষে আমাকে দেখলে কি বলবে ?

কি আর বলবে ! বলবে দেখো লাবণীর বন্ধুর চুল ঘোড়ার লেজের মত । গোসল কয়দিন ধরে করেনা , গায়ে পাঁঠার গন্ধ । লাবণী ভার্সিটির পর এই ছাগলের সাথে কিভাবে যে ঘুরে এক আল্লাহ মালিক জানেন ।

লাবণীর রাগান্বিত মুখ হাসিতে ভরে গেলো । বলল , মশকরা করিস আমার সঙ্গে ?
মানুষ এইসব কেন বলবে । তুই না একটু আগে আমাকে এইসব বললি ।
তাহলে মানুষ কেন বলতে পারবেনা । আমার ইচ্ছা হয়েছে আমি বলেছি । আমার দোস্তকে আমি যা ইচ্ছা তা বলব । ছাগল বলব না গরু বলব । মানুষ একবার বলে দেখুক নাক ফাটিয়ে ফেলব জ্যাকি চেনের ঘুসি মেরে । কত্ত বড় সাহস তরে এইসব বলবে , হু !

২.
লাবণী আর অরণ্য পার্কের গাছের নিচ ধরে হাঁটাহাঁটি করছে । আস্তে আস্তে হাঁটা ।
যে হাঁটা কখনো না ফুরালেই পথিকের মনে শান্তি । দুজন দুজনার হাতে হাত ধরেও নেই আবার অনেক দূরেও নেই । গায়ে গা ঘেঁষার থেকে সামান্য দূর ।
কিরে ছাগল কিছু বল । বোবার মত চুপ হয়ে আছিস কেনো ?
অরণ্য লাবণীর দিকে তাকিয়ে বলল, তকে আজকে অনেক সুন্দর লাগছে । অনেক। মনে হচ্ছে আকাশের কোন পরী ভুলে ভুলে পৃথিবীতে নেমে এসে আমার মত ছাগলের সাথে পার্কে হাঁটছে ।

অরণ্য লাবণীর দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ । অপূর্ব এক সৃষ্টি । ঘন মেঘের মত
কালো চুল পিঠ বেয়ে নিচে নেমে গেছে। কপালে একটা ছোট নীল টিপ । বড় বড়,
টানা টানা চোখ । লম্বা চোখের পল্লব । ঠোঁটের উপরে হালকা গোলাপি রঙের
একটা তিল । চোখে অনাবিল এক সুখের মেলা । সারাদিন তাকিয়ে থাকলেও
তৃষ্ণা মিটবেনা ।

লাবণী একটু লজ্জা পেল । চোখ নিচে নামিয়ে ফেলল । গালে লাল আভা ছড়িয়ে
গেলো । তারপর অরণ্যর পিঠে একটা আস্তে করে ঘুসি দিয়ে বলল , সুন্দরী মেয়ে পেয়ে লাইন মারিস নাকিরে ছাগল ?

অরণ্য লজ্জিত হয়ে বলল, না মানে সুন্দর লাগছে তো তাই বললাম । প্রতিদিন তো আর
বলি না । আর তর সাথে লাইন মেরে কি আমি মরবো নাকি । এমনিতেই যে মার
মারিস , লাইন মারলে যদি পটে যাস তাহলে তো আমি জিন্দা লাশ হয়ে থাকব ।
হয়েছে হয়েছে আর ব্যাখ্যা করতে হবে না ।
বুঝি বুঝি সবই বুঝি ।
কি বুঝস ? কিছুই বুঝস না ।
লাবণী আবার লজ্জা পেল । টপিক বদলানোর জন্য বলল ওই দেখ গাছটা কত সুন্দর , চল নিচে
গিয়ে বসি ।
অরণ্য বলল , তারচেয়ে বরং বাসায় যা ।
আজকে বৃষ্টি হবে ।
বৃষ্টি হবে কিভাবে জানলি ? আকাশ তো
পুরাই ফকফকা , গাধা ।
সবসময় বাহির দেখে ভিতর বুঝা যায় না ।
আকাশের আবার ভিতর বাহির কিরে
ছাগল ?
আমি অন্যকিছুর কথা বলছিলাম ।
৩.
এক ঘণ্টা পর লাবণী উঠল বাসায় যাবে বলে ।
ঠিক সেই মুহূর্তেই বিনা মেঘে বজ্রপাতের
মত বিনা মেঘে বৃষ্টি । লাবণী অবাক হয়ে
অরণ্যর দিকে তাকিয়ে বলল তর কথা তো
ঠিক হয়েছেরে , ঠিকই বৃষ্টি পড়ছে ।
অরণ্য একটা হাসি দিয়ে বৃষ্টিতে ভিজবে
বলে গাছের নিচ থেকে বেড়িয়ে গেলো ।
প্রায় ২ মিনিটের মত আকাশের দিকে
চেয়ে থাকল । আর পুরো শরীর ভিজে চলল ।
তারপর লাবণীর দিকে তাকাল । লাবণী
অবাক হয়ে ওর কাণ্ড দেখছে ।
তর কি জ্বর বাঁধানোর ইচ্ছা ? পরে ডাক্তার
কে দেখাবে ? এক্ষনি গাছের নিচে আয় ।
বৃষ্টিতে ভিজছিস কোন দুঃখে ? ছাগল
কোথাকার ।
অরণ্য ওর কথা কানে নিলোনা । ভিজতে
থাকল ।
লাবণী গাছের নিচ থেকে বেড়িয়ে এসে
অরণ্যর হাত ধরে গাছের নিচে নিয়ে এলো ।
তারপর বলল , এই ছাগলের ছাগল একবার বলছি
ভিজবিনা শুনিস নাই ? একটা থাপ্পড় দিব
আর তর বৃষ্টি-বিলাস সারা জীবনের জন্য
শেষ হয়ে যাবে । এই লম্বা চুলে বৃষ্টির পানি
জমে থাকলে কি অবস্থা হবে জানিস ? ১০০
ডিগ্রী জ্বরে দিনরাত ঘরে কাপতে থাকবি
। তখন আমি কার সাথে ঘুরব ? আমার কোন
খেয়াল আছে ? বলে লাবণীর ওড়নার মাথা
দিয়ে অরণ্যর চুল মুছে দিতে লাগল ।
অরণ্য সবকিছু ভুলে ওড়নার ঘ্রাণ নিতে লাগল
। এত সুন্দর গন্ধ কোথাও নেই , কোথাও । ওড়না
দিয়ে মাথা মুছার সময় লাবণীর নিঃশ্বাস
অরণ্যর মুখে পড়তে লাগল । এত কাছে
লাবণীকে অরণ্য কখনো পায়নি । অরণ্যর ইচ্ছা
করল লাবণীর হাত ধরে বলতে , আমায় ছেড়ে
কোথাও যাসনে । এই ওড়নার ঘ্রাণ আমি
সারা জীবন পেতে চাই । তর এই গরম
নিঃশ্বাস যা আমার হৃদয় ঠাণ্ডা করে দেয়
তা আমি সারাজীবন পেতে চাই । ঠিক
তখনই লাবণী ওর কাছ থেকে দূরে সরে
গেলো । বিব্রত পরিস্থিতির মাঝে পড়ে
গেলো লাবণী । অরণ্য লাবণীর চোখের
দিকে অপলক চেয়ে আছে । লাবণী চোখ
নিচে নামিয়ে ফেলল । নিঃশ্বাস অতি
দ্রুত থেকে দ্রুততর হতে থাকল এবং গভীর
থেকে গভীরতম । দুজনই নীরব , চারদিক নীরব ,
শুধু বৃষ্টির শব্দ । কেউ বলেছিলেন , “ Silence is
golden “ . অরণ্যর কাছে মনে হচ্ছে কথাটা ভুল ।
বলা উচিত ছিল , “ Silence is diamond “ . হীরার
থেকেও দামি কিছু থাকতে পারে । এই
মুহূর্তে অরণ্যর তা মনে পরছে না । একটা কথাই
মনে হল তার , সে এখন দুনিয়ার সবচে রূপবতী
যুবতীর একদম কাছে তার চোখে চোখ রেখে
দাঁড়িয়ে আছে ।
কিছুক্ষণ পর বৃষ্টি কমে গেলো । লাবণী
নীরবতা ভেঙ্গে বলল অরণ্য আমি যাই । একটা
রিক্সা ডেকে দে আর তুই আজকে হেঁটে যা ।
স্বাস্থ্যের জন্য ভাল ।
অরণ্য বলল , লাবণী আমি তকে কিছু বলতে
চাই ।
লাবণী বলল কি ?
আজ না , কাল বলব । আজকে বাসায় যা ।
অনেক দেরি হয়েছে ।
আচ্ছা ।
৪.
পরদিন অরণ্য আবার ভার্সিটির সামনে
দাঁড়িয়ে আছে । লাবণীর ছুটি হয়েছে প্রায়
১ ঘণ্টার মত হয়েছে । লাবণী আসেনি । কাল
বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর করল নাকি অরণ্যর
চিন্তা হতে লাগল । লাবণীর বাসায়
যাওয়া উচিত । এই সুযোগে আঙ্কেল
আন্টিকেও দেখা হয়ে যাবে ।
অরণ্য কলিং বেল টিপার পর লাবণীর মা
দরজা খুলে দিলেন । অরণ্য লাবণীর কথা
জিজ্ঞেস করতেই বললেন , লাবণী জানত
তুমি আজকে আসবে । তোমার জন্যই অপেক্ষা
করছে । আমি বলেছিলাম তোমাকে কল
দিতে , বলল তোমার মোবাইল বন্ধ । যাও
বাবা , ছাদে লাবণী বসে আছে ।
অরণ্য ছাদে যেতে যেতে চিন্তা করতে
লাগল , লাবণী কি জন্যে ভার্সিটি যায়নি
আর ওর জন্যই বা কেন অপেক্ষা করছে ।
অরণ্য ছাদে যেতেই লাবণী চিৎকার দিয়ে
বলে উঠল দোস্ত ! মিষ্টি খাবি নাকি আগে
বল ? অনেক বড় সুখবর আছে ।
অরণ্য বলল কি ?
তুই না কাল আমাকে কি বলতে চাইছিলি ?
আজকে বল ।
অরণ্য বলল তরটাই আগে শুনি ।
লাবণী বলল আচ্ছা শুন । আমার বিয়ে ঠিক
হয়েছে । পাত্র বিলেত প্রবাসী । বাপের
প্রচুর টাকা পয়সা । তা বাদ দে । তার উপর
পাত্র দেখতে মারাত্মক হ্যান্ড-সাম । আমার
বড় আপ্পি যে লন্ডন থাকে সে বলেছে ,
দেখতে নাকি শাহীদ কাপুরের মত । শাহীদ
কাপুররে চিনস তো ? ওই যে হিন্দি
ছিনেমার সুইট হিরোটা ।
অরণ্য আগে নিজেকে সামলে নিলো ।
তারপর আস্তে করে বলল , হ্যাঁ চিনি ।
লাবণী বলল , ছেলে লন্ডনের বিখ্যাত
ডাক্তারদের মধ্যে একজন । ওর একটা দামি
ফেরারি আছে । বিয়ের পর আমি ওই
ফেরারিতে ঘুরব ।
অরণ্য বলল , ও আচ্ছা । খুব ভাল পাত্র তো
দেখা যায় । অনেক সুখে থাকবি ।
সুখে কিরে গাধা ! মহাসুখে থাকব । পাত্র
নাকি অনেক রোমান্টিক টাইপের । আর শুন
আমার বিয়ের সবকিছু কিন্তু তুই করবি । আমার
গায়ে হলুদের স্টেজ , বিয়ের শাড়ি , বাসর
সজ্জা ……
লাবণী বলতেই থাকল । অরণ্য কিছু শুনতে
পাচ্ছে না । অরণ্য শুধু বলল , “ হ্যা থাকব , অবশ্যই
থাকব ”
লাবণী বলল , “ আচ্ছা এখন বল কি বলতে
চাইছিলি ? আমিই তো এতক্ষণ বকবক করলাম ।
আর তর মন খারাপ দেখা যাচ্ছে কেন ? ”
অরণ্য বলল , “ কই কিছু নাতো । ”
লাবণী বলল , “ আচ্ছা বল না , কি বলবি । “
অরণ্য লাবণীর চোখের দিকে তাকিয়ে সব
ভুলে গেলো । ইচ্ছে করল বড় বড় ওই চোখ
দুটিতে ডুবে যেতে । কখনো যাতে আর
ভাসতে না হয় । কিন্তু এই চোখ দুটিতে ডুবার
অধিকার এখন আরেকজনের । ইচ্ছা করলেও
ডুবতে পারবেনা । অরণ্য যা বলত চাইছিল তা
এখন আর বলতে পারবেনা , বলা ঠিকও হবেনা
। কি বলবে তাই ভাবছে । শেষে বলল , “ দেখ
আমি আজকে শেভ করেছি । চুলও কেটেছি ।
তারপর গরম পানি দিয়ে গোসল করে দামি
পারফিউম লাগিয়েছি । আজকে তর ছাগল
উন্নতমানের ছাগল হয়েছে ” ।
বলে অরণ্য নিজেকে সামলে নিচে নেমে
এলো । লাবনী অরণ্যকে ডাকল অনেকবার ।
অরণ্য আর ফিরে তাকালনা ।
৫.
অরণ্য আজকে আবার পার্কে গেলো । আজ ও
একা । অনেক একা । কালকের সেই গাছের
নিচে বসল । কিছুক্ষণ পর আজকেও বৃষ্টি নামল ।
অরণ্য গাছের নিচ থেকে বের হয়ে বাইরে
গেলো । উপরের দিকে তাকিয়ে বৃষ্টিতে
ভিজতে লাগল । আজকে ওকে কেউ
থামাবেনা । কেউ বলবেনা , “জ্বর উঠলে পর
আমার সাথে কে ঘুরবে , আমার খেয়াল কিছু
আছে ?” আজ ও যত খুশি বৃষ্টিতে ভিজতে
পারবে । ভিজার পর কেউ ওর চুল পরম
ভালবাসায় ওড়না দিয়েও মুছে দিবেনা ।
আজ অরণ্য দু চোখ ভাসিয়ে কাঁদলেও কেউ ওর
চোখের জল মুছে দিবেনা । দূরে কোথাও
গান বাজছে ,
“ যদি ডেকে বলি , এসো হাত ধরো
চল ভিজি আজ বৃষ্টিতে ।
এসো গান করি , মেঘমল্লারে ,
করুণা-ধারা দৃষ্টিতে ।
আসবেনা তুমি , জানি আমি জানি….

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত