আমাদের বাড়িতে নীলার প্রথম ঈদ এটা। গত কুরবানী ঈদের পর আমাদের বিয়ে হয়। এরপর এটাই প্রথম রমজানের ঈদ।নীলা যে খুব চতুর মেয়ে তেমনটা নয়। যথাসম্ভব সহজ সরল আর শান্ত স্বভাবের মেয়ে সে।একটু ভীতুও। কেন জানি আমাদের বাড়ির সবকজন মানুষকেই সে ভয় পায়! এমনকি আমাকেও।নীলা কাজে কর্মে একটু অপটু।এক বাপের এক মেয়ে তো তাই বাপের বড় আদর যত্নে বেড়ে উঠেছে। গৃহস্থালির হাঁড়ি পাতিলের ধারে কাছে তার যত সামান্যই যাওয়া হয়েছে। কিন্তু আমাদের বাড়িতে আসার পর থেকেই এটা ওটা নিয়ে সব সময় পড়ে থাকে সে। যদিও তার কাজগুলো খুব গোছানো হয় না।কিন্তু সে প্রবল চেষ্টা করে সুন্দর করে কাজটা শেষ করতে। তবুও কেন জানি সুন্দর হয় না।
আমাদের বাড়ির কেউ কখনো তাকে তার কাজের ব্যাপারে মন্দ কিছু বলেনি।এমনকি অন্য সব শাশুড়িদের মতো আম্মা তাকে রাগে দুটো কথাও কোনদিন বলেননি। তবুও সে ভয়ে তটস্থ থাকে না জানি কখন আম্মা তার অগোছালো কাজের জন্য ধমক দিয়ে বসেন। বিয়ের পর স্বাভাবিক ভাবেই বাড়িতে আত্মীয়-স্বজনরা বেড়াতে আসলে আম্মাই রান্না বান্না করেন। কিন্তু এবার ঈদে আম্মা বললেন,’নীলা, তুমি গরুর মাংসটা রান্না করো।’ শুনে নীলা মনে মনে কেঁদেই ফেলল।ভাবলো, এই বুঝি আমার মান সম্মান সব গেল! তবুও তো আর শাশুড়ির হুকুম অমান্য করা যায় না! নীলা বড় মন খারাপ আর মনে ভয় নিয়ে গরুর মাংস রান্না করতে কিচেনে গেল।রান্নাও করলো। সেই রান্না নিজে চেকে খুব হতাশ হলো। আমার কাছে এসে কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,’আজ আমি খুব অপমানিত হবো!’
আমি বললাম,’কেন,কী হয়েছে?’ ‘আম্মা আমায় গরুর মাংস রান্না করতে বলেছিলেন। আমি রান্না করেছি।’ ‘এটাতো ভালো করেছো।এর জন্য অপমানিত হবে কেন?’ নীলা এবার কেঁদেই ফেলল। এই মেয়েটা এমনি। সামান্য কারণেই চোখের জল ফেলে নদী করে ফেলে। আমি তাড়াহুড়ো করে ওর হাত ধরে বললাম,’আরে কী হলো বল তো! কাঁদছো কেন?’ ‘তরকারিটা খুব বাজে হয়েছে। মুখে নেয়ার মতো না।’ ‘ধুর। তোমার জিহ্বায় হয়তো ঘা হয়েছে। আমি চেকে দেখি।’ বলেই আমি কিচেনে গেলাম। তারপর পাতিল থেকে এক টুকরো মাংস আর খানিক ঝোল নিয়ে দেখি তরকারির অবস্থা ভয়াবহ খারাপ। মুখে তোলার মতো না।
তবুও আমি মৃদু হেসে নীলার দিকে তাকিয়ে বললাম,’আলহামদুলিল্লাহ। অনেক ভালো হয়েছে তরকারি। সত্যি সত্যি ভালো হয়েছে।’ নীলা এবার একটু হাসলো। হেসে ভয় ভয় চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,’সত্যি বলছো তুমি?’ ‘হুম। তুমি তো জানো আমি মিথ্যে বলি না।’ নীলা বিশ্বাস করলো কথাটা। এরপর এক ফাঁকে আমি আম্মাকে বললাম,’এটা কী করলে তুমি, নীলাকে দিয়ে রান্না করালে কেন? এখন মেহমানরা খেয়ে কী বলবে!’ আম্মা হেসে বললেন,’উচ্চ প্রশংসা করবে।এই তুই নিজেই একটু চেকে দেখ না।’ বলেই আম্মা অন্য একটা পাতিল থেকে একটা মাংসের টুকরো আমার হাতে তুলে দিলেন। সেই টুকরো আমি মুখে নিয়ে দেখি অমৃত। এবং এই রান্নার হাতটা আমার চেনা। আম্মা রেঁধেছেন। আমি বললাম,’আম্মা, এই তরকারি তো আপনিই রান্না করছেন!’ আম্মা বললেন,’করেছি। কিন্তু মেহমান জানবে এটা নীলার রান্না করা তরকারি।’
আম্মা এই সময় আরেকটা কাজ করলেন।কাজটা করলেন তিনি খুব সাবধানে। কিচেন থেকে নীলার রান্না করা মাংসের পাতিলটার সবটুকু মাংস আম্মার পাতিলে নিয়ে আম্মার রান্না করা মাংসটুকু তার পাতিলে ঢেলে রেখে দিলেন। নীলা কিছুই টের পেল না। বিকেল বেলা মেহমানরা বেড়াতে এসে খাওয়া দাওয়া করে তো নীলার প্রশংসাই পঞ্চমুখ। আমার বন্ধু বান্ধবেরা আম্মাকে বললো,’আন্টি, আপনার পুত্রবধূর হাত তো সোনা দিয়ে বাঁধানো।আহা!কী টেস্ট যে লাগলো মাংসটা।’ আম্মা হেসে বললেন,’সে আর বলতে হয়। এমন লক্ষ্মী মেয়ে কটা হয়!’ সে রাতে নীলার বাবাও আসেন আমাদের বাড়িতে।তাকেও এই মাংস দিয়েই পোলাও ভাত দেয়া হয়। খেতে খেতে আনন্দে তার চোখে জল এসে গেল। তিনি সঙ্গে সঙ্গে আম্মাকে ডেকে বললেন,’বেয়াইন সাহেব, আপনি আমার মেয়েকে এতো ভালো রান্না শিখিয়েছেন?’ আম্মা হেসে বললেন,’আপনার মেয়ে বড় লক্ষ্মী ভাই।যা দেখে তাই হুবহু শিখে ফেলে।’
সবার খাওয়া দাওয়া শেষে রাতে নীলা আর আম্মা খেতে বসলো।নীলা মাংসের ঝোল দিয়ে মাখা ভাত মুখে দিয়েই চমকে উঠলো। এই রান্না তো তার না। আম্মার রান্না। নীলা সঙ্গে সঙ্গে কেঁদে ফেললো। কেঁদে কেঁদে বললো,’আম্মা, আপনি আমায় প্রশংসিত করতে এতো কিছু করলেন আমার জন্য! নিজের সবটুকু চেষ্টা দিয়ে রান্না করা ভালো তরকারিটা আমার নামে চালিয়ে দিলেন সবার কাছে।এমনকি আমার আব্বার কাছেও। আমি শুনে এসেছি এবং দেখেছিও শাশুড়িরা হয় খুব কঠিন মানুষ।তারা সব সময় বউয়ের দোষ ধরতেই তটস্থ থাকে।আর আপনি বউয়ের দোষ গুলো ঢেকে কীভাবে মিছেমিছি গুণের প্রচার শুরু করলেন! আম্মা বিশ্বাস করুন,আমি কল্পনায়ও কোনদিন ভাবিনি আপনার মতো এতো ভালো শাশুড়ি মা আমার হবে!’
আম্মা তখন নীলাকে কাছে টানতে টানতে হেসে বললেন,’মারে, আমার নিজেরও মেয়ে আছে।তাদেরও বিয়ে হয়েছে।আজ যদি আমি তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করি তবে আমার মেয়েও তো তার শাশুড়ির কাছে এমন খারাপ ব্যবহারের শিকার হবে। তাছাড়া শাশুড়িদের কারণেই পুত্রবধূরা বেশি খারাপ হয়। শাশুড়ি যদি তার পুত্রবধূকে নিজের মেয়ের মতো আপন করে নিতে পারে তবে পুত্রবধূও তো শাশুড়িকে আপনার মা করে নিতে বাধ্য।’ আম্মার কথাগুলো শুনে কেমন চুপ হয়ে গেল নীলা।চুপ হয়ে সে জলভরা চোখে আম্মার মুখের দিকে কেমন ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে।যেন জগতে এমন পবিত্র মুখ আর এতো মূল্যবান কথা সে কোনদিন শুনেনি।
গল্পের বিষয়:
গল্প