ধোঁকা

ধোঁকা
তিন বার কবুল বলে একজনের জীবনের সাথে জড়িয়ে গেলাম। ভুলে গেলাম আগের যতো অনুভূতি জমা ছিলো মন পাঁজরে,সব কিছু জলাঞ্জলি দিয়ে অন্যকে রাঙ্গাতে চোখ বন্ধ করে কবুল বলে দিয়েছিলাম। আমারা গরিব কিন্তু আমার বাবার সততার জন্য জায়গা পেয়ে গেলাম ধনীর পরিবারে , পেয়েছি হ্যান্ডসাম হাজবেন্ড। কিন্তু সত্যি কি সে আমার ছিলো?
আমার স্বামী ঢাবিতে পড়ছে , এবার ফাইনাল দিবে।আর আমি ইন্টারমিডিয়েট এর ছাত্রী। তার বাবার অনেক টাকা , কিন্তু ছেলে প্রতিষ্ঠিত হ্ওয়ার আগে কি কারনে বিয়ে দিয়েছে এটা অজানা। বাসর রাতে আমার স্বামী ড্রিংকস করে ঘুমিয়ে পড়েছেন আমার মুখও দেখেনি , স্বপ্ন গুলো যেন আস্তে আস্তে চাপা পড়ে যাবে এমন টা মনে হয়েছিলো। সারারাত খাটের কোনে বসে স্বামীর ঘুমন্ত মুখটা দেখে কেটে গিয়েছিলো। এতোটা নিষ্পাপ মুখ কারো হতে পারে?, কখন যে ভোর হয়ে গিয়েছে বুঝতে পারেনি । উনি উঠলো আমাকে এভাবে বসে থেকে তাকিয়ে থাকতে দেখে কিছুটা বিব্রত বোধ করছে তবুও আমি তাকিয়ে আছি, আমার কাছে এসে হাতদুটো উনার হাতের ভাঁজে নিয়ে বলছে
আসলে স্যরি। কাল রাতে অতিরিক্ত ড্রিংকস করে ফেলেছি,এটা উচিত হয়নি আমার। তুমি চিন্তা করো না আমাদের প্রতিটি রাত হবে একেকটি বাসর রাত।
লজ্জায় কিছু বলতে পারলাম না।কি বেহায়া আমি এতোক্ষণ কিভাবে তাকিয়ে ছিলাম। লজ্জায় লাল হয়ে চোখ নামিয়ে নিলাম। উনি উঠে গেলো,আমিও উঠে শাড়ি ছাড়িয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। বিয়ের এক পরেই আমার স্বামীর সাথে ঢাকায় চলে আসলাম। ছোট্ট একটা ফ্ল্যাটে থাকার ব্যবস্থা হলো ,নিজেকে কেমন সাংসারিক লাগছে। ছোট ছোট কাজের মধ্যে এতো আনন্দ আগে জানতাম না।জীবনটা কেমন পরিপাটি হয়ে উঠেছে। আমার বউটা এত্তো কাজ করতে পারে আগে তো জানতাম নাতো? ব্উ শব্দটি হৃদয়ে কেমন একটা ধাক্কা খেলো, নিজেকে খুব সুখী লাগছিলো। উনি আবার কাছে এসেছে আবারও তার হাতের ভাঁজে আমার হাত নিয়ে বলছে আমি তোমাকে পরিপাটি করতে পারবো কিন্তু পরিপূর্ণ নয়। উনার দিকে জিজ্ঞেসু দৃষ্টিতে থাকাতেই উনি বললো মানেটা বুঝোনি ,শুনো আমি প্রতিষ্ঠিত হ্ওয়ার পরেই তোমাকে আপন করে নিব এর আগে না। কথার মাঝেই আমার কপালে ঠোঁট ছুঁয়ালো,আমি যেন কেঁপে উঠলাম। উনি আবারও বললো এতটুকুতে হবে তো?
মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানিয়ে লজ্জায় দৌড়ে চলে আসলাম রুমে। চলতে থাকলো এভাবেই দিনগুলো,আমি কলেজে ভর্তি হয়েছি,উনি সবসময় বাসায় ফিরে না তা নিয়ে চিন্তা হলেও যখন জানতে চাইতাম তখনই আলতো করে চুমু দিয়ে সব ভুলিয়ে দিতো। অন্ধের মতো বিশ্বাস করতাম খুব ভালোও বাসতাম, হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ি খুব জ্বর। উনি বাসায় নেই , দুইদিন হলো বাসায় আসছে না। তিন দিনের মাথায় বাসায় আসলো চুল গুলো উস্কো খুস্কো,চোখ দুটো লাল, আর প্রচুর ড্রিংকস করেছে। অসুস্থ শরীর নিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম,উনার অবস্থা দেখে ধরতে গেলে ধাক্কা মেরে মেঝেতে ফেলে দেয়। জোরে চিৎকার করে বলতে থাকে তোর জন্য আমার এই অবস্থা, তোর জন্য আমার ভালোবাসা আজ অন্য কারো হাত ধরে হাঁটছে, শুধু মাত্র তোর জন্য আজ আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে, তোর জন্য আমার ভালোবাসার সাক্ষী আমার সন্তানকে দুনিয়ার মুখ না দেখিয়ে মেরে ফেলেছে।
কি আজেবাজে কথা বলছেন কি হয়েছে আপনার? আবার উঠে ধরতে গেলে ধাক্কা দিয়ে ফেলে বেল্ট খুলে আমাকে মারতে শুরু করে। মারতে মারতে একসময় ক্লান্ত হয়ে ছুড়ে মারে আমাকে অন্যত্র, জীবন টা যেন বেরিয়ে যাচ্ছিলো কি বলছে আমার মাথায় কিছু আসছে না। কথা গুলো বার বার কানের মধ্যে ঝড় তুলেছে, নির্জীব হয়ে পড়ে আছি মেঝেতে । যখন চোখ খুলি তখন রাত,আস্তে আস্তে উঠে উনার কাছে গেলাম। উনার ফোনটা অনবরত বেজে চলছে কাঁপা কাঁপা হাতে রিসিভ করে কানে দিতেই মেয়েলি কন্ঠের আওয়াজ শুনলাম।বলছে শুনো ইমরান তোমার ওই ব্উকে ডিভোর্স দাও না হয় মেরে ফেলো। তুমি যদি তা না করো তাহলে তোমার সন্তান এখনো আছে আমার পেটে ওকে মেরে ফেলতে ভাববো না। ওইদিন ডাক্তারের কাছে গিয়ে চলে এসেছি কিন্তু এবার আর ভুল হবে না। তুমি তো বলেছিলে ওই গাইয়া মেয়েকে মেরে ফেলবে ,বিশ ও নিয়েছিলে এখনো বেঁচে আছে কিভাবে তাহলে? হ্যালো কথা বলছো না কেন? হ্যালো ইমরান?
ফোনটা হাত থেকে পরে গেলো, কিছু ভাবতে পারছি না।কি হচ্ছে আমার সাথে? আমার জন্য একটি অনাগত শিশু পৃথিবীর মুখ দেখবে না।এতোটা বোকা আমি কিছু বুঝতে পারিনি। না আর থাকতে পারছি না এখানে শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে না।একটা কাগজ নিয়ে বসলাম কি লিখবো ভেবে পাচ্ছি না, চোখের জলে ভিজে যাচ্ছে সব, কিছুতেই বন্ধ করতে পারছি না, ভিজে সবকিছু নষ্ট হয়ে যাচ্ছে,কোনো শব্দ লিখার শক্তি পাচ্ছিলাম না আমি, দেখতে দেখতে এই পৃষ্ঠাটি ভিজে গেলো নোনা জলে । আরেকটি পৃষ্ঠা নিয়ে লিখলাম নিজের অনাগত সন্তান নিয়ে ভালো থাকবেন। আর কিছু লিখতে পারলাম না। স্বপ্ন গুলো ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। হৃদয় টা পুড়ে যাচ্ছে, বজ্রপাত হচ্ছে আহত মনের মাঝে। হৃদয় ভাঙ্গার অভিযোগে কাকে অভিযুক্ত করবো আমি? এতো কষ্ট কেন হচ্ছে? আচ্ছা মন ভাঙ্গার , দগ্ধ হৃদয়ের কি এতো কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা আছে? ফিরে এসেছিলাম বাবা মায়ের কাছে। বাড়িটাও পাল্টানো হল আমাদের।
দুই বছর পর আমি এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। অনুষ্ঠান হচ্ছে, বন্ধুদের জোরাজুরিতে আমিও গানে অংশগ্রহণ করলাম। আমার নাম ডাকা হচ্ছে, বিয়ের দিন একবার শাড়ি পড়েছিলাম আর এখন পড়ছি।আমি আবার অতীতে ডুবে যাচ্ছি, বান্ধবীর কথায় বাস্তবে ফিরে আসলাম। স্টেজে উঠে চোখটা আটকে গিয়েছে কারন চোখের সামনে আমার অতীত বসে আছে। উনি আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে।পলক পড়ছে না এভাবে তাকিয়ে আছে।আমি গান গাইতে শুরু করলাম ওরা হৃদয়ের রং জানে না ওরা মনের গোপন চিনে না। প্রজাপতি ডানা ছুঁলো বিবাহ বাসরে , কেন সারা রাত জেগে বাড়ি ফিরি ভোরে? ওরা মনের গোপন চিনে না, ওরা আসল কারণ জানে না।( বাকিটা নিজ দায়িত্বে শুনে নিবেন) গান শেষ হতেই হাততালিতে ফেটে পড়লো। স্টেজ থেকে নেমে চলে আসছি, আমার বান্ধবী দৌড়ে এসে আমাকে বলছে ওই তোর দিকে ইমরান খান এভাবে তাকিয়ে ছিলো কেন? কোন ইমরান খান? এই ঢাবির ই এক্স ছিলো। ওহ।
তুই জানিস উনি একজনকে খুব ভালোবাসতো কিন্তু মেয়েটা ভালো ছিলো না, প্রতারণা করেছে,আস্ত ধোঁকাবাজ ছিলো। পেটে বাচ্চা আছে ছিলো কিন্তু জন্ম হ্ওয়ার পরেই মারা গেছে।পরে আরেকজনের সাথে পালাইছে। আচ্ছা আমার ভালো লাগছে না এগুলা শুনতে।যাই আমি আল্লাহ হাফেজ। গাড়িতে উঠার পর দেখছি ইমরান খান দৌড়ে আসছে, চিৎকার করে রিক্তা রিক্তা বলে ডাকছে ,গাড়ি থামাতে বলছে । আমি ড্রাইভার কে তাড়াতাড়ি যেতে বললাম, লুকিং গ্লাস দিয়ে দেখছি প্রানপণে দৌড়াচ্ছে সে। আমার ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসির রেখা স্পষ্ট হয়ে আছে। কিছু ভালোবাসাকে হৃদয়ে স্থান দিলেও জীবনে দিতে নেই।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত