তাওয়াক্কুল

তাওয়াক্কুল
বড় চাচীর বাচ্চা হবে দীর্ঘ নয় বছর পর। খুশিতে আত্মহারা হয়ে বড় চাচা এক ছাগল জবাই দিয়ে ফেলেছেন। সেই ছাগলের মাংস রান্না করে চালের আঠার রুটি করে ইউনিয়নের যত এতিম মিসকিন আছে সবাইকে দাওয়াত করে তিনি খাইয়েছেন। খাওয়ার শেষে ওদের প্রত্যেকের হাতে পঞ্চাশ টাকা করে দিয়ে বলেছেন,’আমার স্ত্রীর সন্তান হবে আমাদের বিয়ের নয় বছর পর। এরচেয়ে খুশির সংবাদ আমার কাছে আর কিছু নাই।তোমরা আমার স্ত্রীর জন্য দোয়া করবা। আমার সন্তান যদি সহি সালামতে পৃথিবীর আলো দেখে তবে তোমাদেরকে আমি গরু জবাই দিয়ে খাওয়াবো ইনশাআল্লা।’
এতিম আর মিসকিনেরা সেদিন খুশি মনে বাড়ি থেকে দাওয়াত খেয়ে পকেটে টাকা নিয়ে নিজেদের বাড়ি বাড়ি চলে গেল। যাওয়ার সময় শুকরিয়ায় চোখে জল এনে দোয়া করলো,’মাবূদ গো, তোমার এই বান্দা যে আমার মতো নাদান এক এতিমরে এতো বড় সম্মান দিয়ে তার বাড়িতে এনে দাওয়াত খাওয়ালো আবার খুশি হয়ে হাতে টাকাও দিলো তার মনের আশা তুমি পূরণ করো। দয়াল মাবূদ গো, তোমার ইব্রাহিম নবীর অভ্যাস ছিল ফকির মিসকিনরে সম্মান করে দাওয়াত করে খাওয়ানো, তোমার এই বান্দার অভ্যাসও তেমন।সে কোন ধনী মানুষ খুঁজে দাওয়াত করেনি। আমার মতন নাদানরে খুঁজে বের করে সম্মান দিয়েছে।ও মাবূদ, তোমার যে বান্দা এই এতিমরে সম্মান দিলো তারে তুমি নিজে সম্মান দিও।’
এভাবে প্রত্যেকজন এতিম আর মিসকিনেরা দোয়া করলো।কেউ শুনিয়ে,কেউ চুপিচুপি। বড় চাচাকে সেদিন দেখে মনে হলো জগতে তার মতো এমন সুখি মানুষ আর একটিও নেই। সন্ধ্যা বেলায় বড় চাচী যখন জলভরা চোখে জায়নামাজে বসে আল্লাহর মহিমা প্রকাশ করছিলো তখন বড় চাচা তার কাছে এসে ত্রিশ হাজার টাকায় গড়ানো সোনার চেইনটা বড় চাচীর গলায় পড়িয়ে দিয়ে বললেন,’ এ আমার উপহার। আল্লাহ তোমায় বিবি হাজেরার মতো কবুল করুন।’
বড় চাচী তখন দোয়া শেষ করে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন।বড় চাচা চাচীকে জড়িয়ে ধরে বললেন,’শান্ত হও।’
চাচী শান্ত হলেন না।প্রাণ ভরে অনেক্ষণ কাঁদার পর বড় চাচাকে জড়িয়ে ধরে বললেন,’যে জগতে কোন মেয়ে মানুষের সন্তান না হলে তাকে নিত্যদিন তার স্বামীর গঞ্জনা সয়তে হয়,কত অবহেলা কত অত্যাচার নেমে আসে সেই মেয়েটির উপর,আর আপনি সেখানে আমায় শুধু সান্ত্বনা আর অনুপ্রেরণাই দিয়ে গেছেন বছরের পর বছর। কোন কারণে যেন আমার একটুও মন খারাপ না হয় সেই চেষ্টায় করে গেছেন সব সময়। আমার কোন কাজে অসন্তোষ আসে এমন কিছুই করেননি কোনদিন আপনি।ও স্বামী, আল্লাহ আপনাকে এর উত্তম প্রতিদান দান করুন।’
বড় চাচা মৃদু হেসে বড় চাচীকে বুকে টেনে নিয়ে বললেন,’রাবেয়া,আমরা যদি আজীবন সন্তানহীন থাকতাম তবুও তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা এক বিন্দুও কমতো না কোনদিন।’ বড় চাচী নিজের চোখের জল আঁচলে মুছে বললেন,’আল্লাহ আপনার এই ভালোবাসা আরো বৃদ্ধি করুন।’ বড় চাচা বললেন,’আমীন।’ তারপর দিন যত যেতে লাগলো বড় চাচীর প্রতি বড় চাচার যত্ন নেয়া তত বাড়তে লাগলো। এমনকি ঘরের রান্না- বান্না থেকে শুরু করে আর যত গৃহস্থালির কাজ আছে সবকিছুই চাচা নিজের হাতে করতেন। মানুষ এতে অট্টহাসি হাসতো।বলতো,’এমন বেকুব জীবনে দেখিনি।’
চাচা এইসব কথা শুনে মোটেও মন খারাপ করতেন না। তিনি ধৈর্য্য ধারণ করে নিজেকেই নিজে বলতেন,’শোনো মতিন, নিজের ঘরের কাজ কেউ করলে সে ছোট হয় না।আর নিজের স্ত্রীকে ভালোবাসলেও কেউ বেকুব হয় না। বেকুব তো তারাই যারা নিজের ঘর সংসারের কাজ আর স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসাকে ভাবে বেকুবের কাজ!’ বড় চাচী একদিন রাতে চাচাকে বললেন,’আচ্ছা, আমাদের সন্তান যদি মেয়ে হয় তবে তুমি কী খুশি হবে?’ বড় চাচা আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠে বললেন,’আমার কী সে কপাল আছে! রাবেয়া, সত্যি সত্যি আমি যদি কোন কন্যা সন্তানের বাবা হতে পারতাম তবে আমি নিজেকে ঘোষণা করে দিতাম আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সফল মানুষদের একজন!’ বড় চাচী অবাক হয়ে বললেন,’কী অদ্ভুত কথা। যেখানে মানুষ মেয়েদের ভাবে অপয়া সেখানে আপনি বলছেন আপনার মেয়ে সন্তান হলেই আপনি সফল?’
বড় চাচা মৃদু হেসে বললেন,’রাবেয়া, তুমি কী জানো না আমার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলে গেছেন মেয়ে সন্তান তার পিতার জন্য জান্নাত?’ বড় চাচীর চোখ মুখ হঠাৎ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। তিনি বড় চাচার হাত টেনে নিয়ে তার দু ঠোঁটে চুমু খেতে খেতে বললেন,’আমার জান্নাত।’ চাচা বললেন,’আমার জান্নাত গমনের সহজ পথ।’ তারপর সেইদিন এসে গেল যেদিন বড় চাচীর পেটে অসম্ভব ব্যথা।রাত থেকে একটানা পানি ভেঙেছে চাচীর। গ্রামের সবচেয়ে অভিজ্ঞ ধাই ও বলছে, ‘সন্তান আছে উল্টা হয়ে।বলা যায় না কী হয়।গাছ-ফল দুইটাই নষ্ট হয়তে পারে। ভাগ্য ভালো হইলে একটা টিকতে পারে।’
সব আত্মীয় স্বজনেরা অস্হির হয়ে উঠলো। কেউ কেউ কান্নাকাটি করছে। কিন্তু বড় চাচা মোটেও কাঁদলেন না। তিনি বললেন,’সব আল্লাহর ইচ্ছা।তার হুকুম ছাড়া একটা গাছের পাতাও নড়ে না। আমি তার উপর ভরসা রাখি। আল্লাহ যা চান তাই হবে।’ সেদিনও সবাই চাচাকে বললো,’বেকুব।’ বড় চাচা নিজেকে নিজে বললেন,’মতিন, তুমি বেকুব না। বেকুব তো তারা যারা বিপদে আল্লাহর উপর ভরসা রাখতে পারে না।’ সবশেষে যখন সবাই নিরাশ হয়ে গেল একে একে তখন বড় চাচা সেজদায় পড়ে গেলেন। সেজদায় পড়ে বললেন,’আল্লাহ গো, তুমি যা করো তাই আমি মেনে নিবো। আমি তোমার এমন গোলাম যে কোনদিন কোনভাবেই কোন কারণে তোমার উপর নারাজ হবে না।’
চাচা সেজদায় লুটিয়ে পড়ে অজর ধারায় কাঁদছেন। চোখের জলে জায়নামাজ ভিজে চুপসে গেছে। চাচা শুধু বারবার একটি কথায় বলছেন,’আল্লাহ তুমি যা করো তাই মঙ্গল ময়। আমি তোমার উপর সর্বদায় রাজি।’ চাচা কাঁদছেন,আমরা কাঁদছি, যখন বাড়ির সবকজন মানুষ নিরুপায় তখন জমিনে এসে লুটিয়ে পড়লো পৃথিবীর নবীনতম একজন মানুষ,একটি কন্যা সন্তান।ওয়াও ওয়াও শব্দের কান্নায় নিস্তব্ধ বাড়িটি তখন কানায় কানায় ভরে উঠলো।বড় চাচা তখনও সেজদায়। চাচার কাছে দৌড়ে গিয়ে তার পিটে আলতো হাত বুলিয়ে আমি বললাম,’চাচা,কারোর কোন ক্ষতি হয়নি।চাচী সুস্থ আছেন।আর আপনি হয়েছেন কন্যা সন্তানের পিতা।’ চাচা সঙ্গে সঙ্গে সেজদা থেকে মাথা উঠিয়ে চিৎকার করে তিনবার বললেন,’
শুকর-
আলহামদুলিল্লাহ
আলহামদুলিল্লাহ
আলহামদুলিল্লাহ।’
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত