প্রত্যাবর্তন

প্রত্যাবর্তন
সাহেদের বাবা বড় বড় চোখ করে পাত্রীর দিকে তাকিয়ে আছেন। পাত্রীর আপাদমস্তক বোরকায় আবৃত, এমনকি মুখটা পর্যন্ত খোলা নেই। আরে বাবা পাত্রী দেখতে এসে যদি পাত্রীর মুখটাই না দেখা যায়, তবে পাত্রী দেখা কেন! আর পাত্রবেশী সাহেদের মুখটাও আশ্চর্যবোধক চিহ্নের মতো সোজা হয়ে আছে।
– ভাই সাহেব! আসলে আমার মেয়েটা পর্দা করে, পুরুষের সামনে মুখ দেখাতে মোটেই রাজি নয়, আর আমিও এটা চাই না। তবে ছেলের মা ভেতরের ঘরে গিয়ে একা মেয়েকে দেখতে পারেন। এছাড়া ছেলেও এক নজর দেখে নিতে পারে, তবে তার আগে আমাকে নিশ্চিত হতে হবে বিয়েটা হচ্ছে কি না।
– তাহলে ছেলের মা ছাড়া আমাদের আসার দরকার ছিল কী? আগে বললেই তো পারতেন।
– ব্যাপারটা সেই রকম নয়, কথা বলার জন্যেও তো আপনাদের আসার দরকার ছিল। তবে যে-কোনো প্রশ্ন থাকলে মেয়েকে জিজ্ঞেস করতে পারেন, সমস্যা নেই।
– আমার কোনো প্রশ্ন নেই, ছেলের মাকে আগে মেয়ে দেখান। যদি তার পছন্দ হয় তখন কথা বলা যাবে। মেয়ের মুখাবৃত চেহারা দেখে সাহেদের বাবার চোখ বড় বড় হয়ে গিয়েছিল। এখন মেয়ের উন্মুক্ত চেহারা দেখে সাহেদের মার চোখ বড় বড় হয়ে গিয়েছে। ও আমার আল্লাহ, একটি মেয়ে এত সুন্দর হয় কীভাবে! এ তো সাক্ষাৎ পরির বাচ্চা। এবার বিস্ময় কাটিয়ে সাহেদের মা মেয়েটিকে প্রশ্ন করতে থাকে,
– নাম কী তোমার মা?
– সুমাইয়া আফরিন।
– কীসে পড় তুমি?
– এবার অনার্স শেষ বর্ষে।
– তুমি জেনারেলে পড়াশোনা করেও বেশ কঠিন পর্দা করো দেখছি। তোমার যে রূপ এবং সৌন্দর্য, এর সঠিক ব্যবহার করে তুমি ইচ্ছে করলে মিস বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহণ করে জয়ী হতে পারতে।
– আল্লাহ তায়ালা মেয়েদের সৌন্দর্য দিয়েছেন প্রদর্শনের জন্য নয়, এটা শুধুই তার স্বামীর জন্য প্রদর্শনীর বিষয়। এছাড়া দুনিয়াবী কোনো প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে আমি জয়ী হতে চাই না। আমি শুধু জয়ী হতে চাই আল্লাহর নৈকট্য লাভে। কথাটা শুনে হৃদয়টা জুড়িয়ে গেল সাহেদের মা রাহেলা বেগমের। তিনি ইচ্ছে করেই এমন একটি উদ্ভট প্রশ্ন করেছেন, শুধু মেয়েটির প্রতিক্রিয়া জানার জন্য। আর মেয়েটির প্রশ্নের উত্তর শুনে তিনি যারপরনাই খুশি। সাহেদের মায়ের মুখে মেয়ের সৌন্দর্যের বর্নণা শুনে সাহেবদের বাবার চোখ আবার বড় বড় হয়েছে। মনে হয় লোকটার চোখ বড় বড় হওয়ার বাতিক আছে। এদিকে সাহেদ নিজেও মায়ের কথা শুনে মেয়ে না দেখেই বিয়ের জন্য রাজি হয়ে গেছে। যদিও বা সাহেদ পাত্র হিসেবে মেয়ের জন্য অনুপযুক্ত নয়। ভালো চাকরি করছে, ঢাকাতে তাদের নিজেস্ব বাড়ি। এছাড়া ছেলে হিসেবে সাহেদ মোটেই খারাপ নয়।
– বলছিলাম কী ভাই সাহেব, মেয়ে আমাদের পছন্দ হয়েছে। বিয়ের ব্যাপারে আমরা এবার ফাইনাল কথা বার্তা বলতে পারি।
– কোনো সমস্যা নেই, তবে ছেলে এবং মেয়ের মাঝে ব্যক্তিগত কিছু কথা থাকতে পারে। তাদেরকে একান্তে কথা বলতে দেওয়া উচিত।
– সেই একই রুমে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে তারা মুখোমুখি বসে আছে। পাত্রীর মুখ এখনো অনাবৃত নয়। এছাড়া বলা হয়েছিল তাদের একান্তে কথা বলতে দেওয়া হবে, কিন্তু এখানেও তারা একা নয়। মেয়ের বান্ধবী জানালার পাশে বসে আছে, মনে হচ্ছে সে কিছুই কানে শুনতে পায় না তার ধ্যান ধারণা ঐ নীল আকাশ পানে। এসব ক্ষেত্রে মেয়েদের লজ্জা পাওয়ার কথা, কিন্তু এখানে লজ্জা পাচ্ছে সাহেদ। মুখটা কেমন লজ্জায় লাল হয়ে আছে। কী দিয়ে শুরু করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। কিন্তু তার আগেই হঠাৎ কথা বলে ওঠে সুমাইয়া।
– বিয়ের ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞাসা করার ছিল।
– জি অবশ্যই, বলুন।
– আপনি কি নিয়মিত নামাজ পড়েন?
– জি আলহামদুলিল্লাহ্! নিয়মিত নামাজ পড়ি।
– তবে মুখে দাড়ি নেই কেন?
– আসলে…
– আমি কোনো অযুহাত শুনতে চাচ্ছি না। আল্লাহর হুকুম যদি থাকে আর যদি আমরা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হই, তাহলে অবশ্যই দাড়ি রাখতে হবে।
– আচ্ছা চেষ্টা করব।
– চেষ্টা নয়, এটা আমার প্রথম শর্ত।
-আচ্ছা ঠিক আছে, মেনে নিলাম ।
– তবে এটা ভাববেন না আপনার উপর আমি কোনো বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছি। দাড়ি রাখার গুরুত্ব সম্পর্কে হয়তো আপনাকে আমার বুঝিয়ে বলতে হবে না।
– জি অবশ্যই, সেটা আমি জানি।
– আমাকে দেখে যদি আপনার পছন্দ হয়, আরও কিছু শর্ত আছে আমার। তবে এক্ষেত্রে আপনি আপনার বাবা মায়ের সাথে আলাপ করে আমাকে জানাতে পারেন।
– আপনার শর্তগুলো আগে বলুন, আপনাকে না হয় পরেই দেখবো। বাবা মায়ের সাথেও পরে আলাপ করা যাবে।
– প্রথমত বিয়েতে বা বিয়ের পরবর্তী অনুষ্ঠানে আমি আমার মুখ প্রদর্শন করব না। এছাড়া বিয়ের পরে আপনাদের আত্মীয়স্বজনদের ভেতর মাহরাম ব্যতীত কারও সাথে দেখা করতে হলে আমি আমার পর্দা মেইনটেইন করব। এক্ষেত্রে কোনো জোর বা অনুরোধ করতে পারবেন না।
– এটা তো খুব ভালো কথা। এখানে জোর বা অনুরোধের কথা আসছে কেন? আর বিয়ে বা পরবর্তী অনুষ্ঠানে আপনার বিষয়টি আমি ম্যানেজ করে দিব।
– আরেকটি কথা, আমার অনার্স ফাইনাল ইয়ার চলছে। আমি অন্তত অনার্সটা শেষ করতে চাই।
– অবশ্যই, কেন নয়। আমি আপনাকে সার্বিক সহযোগিতা করব, কোনো সমস্যা নেই। দেখতে খারাপ হলেও মানুষটা আমি খারাপ নই।
– কে বলেছে আপনি দেখতে খারাপ। আপনি যথেষ্ট সুন্দর, আপনাকে আমার পছন্দ হয়েছে।
– কথাটা বলে, নিজেই লজ্জা পেয়ে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে সুমাইয়া। আবৃত চেহারা অবয়বের ভেতর ফুটে উঠেছে এক রক্তিম আভা।
– হা হা, আপনি বোধ হয় লজ্জা পেয়েছেন। এত লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। আচ্ছা আমি তাহলে যাই। আর কোনো প্রশ্ন থাকলে করতে পারেন।
– আমি তো আপনাকে দেখলাম, আপনি আমাকে দেখবেন না? না দেখেই বিয়ে করবেন?
– দেখতে হবে না, মায়ের মুখ থেকে আপনার যে সার্বিক সৌন্দর্যের বর্নণা পেয়েছি, তখনই আপনাকে আমি আমার কল্পনার মণিকোঠায় অঙ্কন করে নিয়েছি।
– থাক আর পাম দিতে হবে না, এক নজর দেখে আমাকে উদ্ধার করুন।
– মুখের নেকাবটা সরিয়ে নিয়েছে সুমাইয়া। নিষ্পলক তাকিয়ে আছে সাহেদ। মনে হচ্ছে মেয়েটি নেকাব সরিয়ে নেয়নি, পৃথিবী থেকে সরিয়ে নিয়েছে অন্ধকারাচ্ছন্ন কোনো অমাবস্যার রাত্রি। সেখান বিরাজ করছে কোনো ঝলমলে পৃথিবী। মানুষ এত সুন্দর হতে পারে! বিশ্বাসই হচ্ছে না তার, সে কোনো মানবীর সামনে বসে আছে। সাহেদকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে আবারও সুমাইয়ার মুখায়বে ফুটে উঠেছে লজ্জার রেখা।
– আপনার বোধ হয় আমাকে দেখা হয়েছে। আমি আবার মুখটা ঢেকে নিচ্ছি। আপনার কোনো প্রশ্ন থাকলে জিজ্ঞেস করতে পারেন?
– যদিও প্রশ্নটা অবান্তর, তারপরও জিজ্ঞেস করছি; আপনি কি কাউকে ভালোবাসেন?
– জি বাসি, আমি আল্লাহকে ভালোবাসি আর ভালোবাসি যারা আল্লাহকে ভালোবাসেন।
জি বাসি, কথটা শোনার পর মিলি সেকেন্ডের জন্য হৃৎপিণ্ড বন্ধ হয়ে গিয়েছিল সাহেদের। কিন্তু পরক্ষণেই যখন, সে আল্লাহকে ভালোবাসার কথা বলল তখন হয়তো হৃৎপিণ্ড সচল হয়েছিল। আসলে এমনটাই হওয়া উচিত। যে আল্লাহকে ভালোবাসলো, সে যেন পুরো পৃথিবীকেই ভালো বাসলো।
সাহেদের বাবার ইচ্ছে থাকলেও সাহেদ এবং সুমাইয়ার কথা বিবেচনা করে বিয়েতে কোনো অনাড়ম্বন অনুষ্ঠান হয়নি। খুব সাধারণভাবেই বিয়ের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। উল্লেখ করার মতো বিষয় হলো, যেখানে একজন সাধারণ গরিব মানুষের বিয়েতে আজকাল চার পাঁচ লাখ টাকা মহরানা ধরা হয়, সেখানে তাদের বিয়েতে মহরানা ধরা হয়েছে এক লাখ মাত্র এবং সেটা সে বিয়ে পড়ানোর সময়ই সাহেদ পরিশোধ করেছে। কারণ সাহেদ জানে মহরানা হলো স্ত্রীর হক এবং স্ত্রী বৈধ হবার উত্তম পন্থা।
স্বামীর সংসারে এসে সুমাইয়াকে খুব বেশি সমস্যায় পড়তে হয়নি। কারণ সাহেদ বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। শ্বশুর-শ্বাশুড়ি ছাড়া বাড়িতে কেউ নেই। পর্দা পালন করার জন্য একটি উত্তম পরিবার বলা যেতে পারে। কিন্তু পড়াশোনা বা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া নিয়ে সুমাইয়াকে বেশ বিপাকে পড়তে হচ্ছে। একে তো নতুন সংসার, শ্বশুর শ্বাশুড়ির খেদমত, এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় এখান থেকে অনেক দূর। আর দূর হলেও কোনো সমস্যা ছিল না, যদি না যাওয়া আসার পথটি মসৃণ হতো। মসৃণ এ কারণেই বলছি, সুমাইয়া কিছুদিন যাবৎ লক্ষ করছে তাকে কেউ ফলো করছে। অথচ সে পরিপূর্ণ পর্দা করেই বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা যাওয়া করে। রিকশার পেছন পেছন খুব ধীর গতিতে বাইক নিয়ে ফলো করে একটি ছেলে এবং রিকশা থেকে সে নেমে যাওয়ার পরেও বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশেই বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ছুটি হওয়া পর্যন্ত। কথাটা সাহেদকে বলি বলি করেও বলা হয়নি সুমাইয়ার। লোকটি তাকে ফলো করলেও আপত্তিকর কোনো কিছু এখন পর্যন্ত করেনি।
– জিল্লু ভাই, তুমি ওই বোরকা পরা মাইয়াটার জন্য পাগল হইলা ক্যান? কী এমনডা আছে ওই মাইয়াডার ভেতর?
– ওই ব্যাটা চুপ থাক। তুই কী বুঝবি ওই মাইয়ার ভেতর কী আছে। তুই তারে দেখছত? আমি দেখছি। সেদিন ছাদে বইসা বইসা সিগারেট টানতে ছিলাম তখন দেখলাম পাশের ছাদে একটা পরি নাইমা আইলো। তারের মধ্যে কাপড় শুকাইতে দিতাছে। বিশ্বাস কর কাইসা এমন সুন্দর মাইয়া মানুষ আমি জীবনেও দেখি নাই। পরে খবর লইয়া জানলাম ওইডা সাহেদের বউ। শালায় বিয়া করছে, কিন্তু কাউরে জানায় নাই। এরপর অনেকবার ছাদে গেছি আর একদিনও দেখি নাই। ওই কামের ব্যাটিটাই হুদা কাপড় রোদে দিতে আসে। এজন্য তো এখন খালি পেছন পেছন ঘুরি। কিন্তু ঘোরা ঘুরি আর ভাল্লাগতাছে না। এখন তুইলা লাইয়া যামু, তারপর খায়েস মিটাইয়া ছাইরা দিমু। এর জন্যই তোগো মাইক্রো নিয়া আইতে কইছি।
– ভাই আঙগো কিছু ভাগ দিবা না।
– আরে মজা করিছ সমস্যা নাই। আমার খায়েস পিটার পর।
– কিন্তু ভাই বোরকাওয়ালী তো আইতেছে না এখনো।
– আরে দাঁড়া, ভার্সিটিতে যাইতে দেখছি অবশ্যই ফিরবো।
এমনিতেই বিশ্ববিদ্যালয় ছুটির পর রিকশা পাওয়া যায় না। তার উপর আকাশের অবস্থা ভালো না, বৃষ্টি নামতে পারে যে-কোনো সময় । দেরি না করে সামনের দিকে এগিয়ে যায় সুমাইয়া, উদ্দেশ্য রিকশা পেলে বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিবে। কিন্তু চিন্তার বিষয় হচ্ছে অনেক দূর আসার পরেও রিকশা পাওয়া যায়নি। রাস্তাটা নীরব, মানুষজন তেমন একটা নেই। বোরকা দ্বারা নিজেকে আবৃত করে রাখলেও তার কেমন ভয় ভয় করছে। তার উপর চারিদিক অন্ধকার হয়ে আসছে। কখন কী হয় বলা মুশকিল।
সংকিত মন নিয়েই হাঁটছিল সুমাইয়া। কিন্তু হঠাৎ করেই এক‌টি রিকশা খুব দ্রুত তাকে অতিক্রম করে যায়, কিন্তু রিকশাওয়ালাকে ডাক দেওয়ার আগেই ঘটে যায় একটি দুর্ঘটনা। উঁচু স্টপার পার হবার সময় খুব জোরে ঝাঁকি খেয়ে রিকশায় বসা একটি বৃদ্ধা মহিলা মাটিতে পড়ে যায়। অথচ সে এটাকে খালি রিকশা মনে করেছিল। সাহনে যেতেই সুমাইয়া দেখতে পায় মহিলাটি রাস্তায় পড়ে গিয়ে যাচ্ছেতাইভাবে মাথা ফাটিয়ে বসে আছে। গলগল করে সেখান থেকে রক্ত বের হচ্ছে। রিকশাওয়ালা নিজের গামছা দিয়ে রক্ত বন্ধ করার চেষ্টা করছে, কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। আশেপাশে কোনো মানুষজন নেই, হয়তো বৃষ্টির আগাম বার্তা পেয়ে সবাই নিরাপদ স্থানে চলে গেছেন।
– ভাই গামছাটা আমার কাছে দিন। আমি রক্ত চেপে ধরছি। আপনি রিকশা ঘুরিয়ে হাসপালে যান, পেছনের বড় রাস্তায় একটি হাসপাতাল আছে। রিকশাওয়ালার সহযোগিতায় বৃদ্ধা মহিলাকে আবার রিকশায় বসানো হয়েছে। নিজের কাঁধের উপর মহিলার মাথা রেখে শক্ত করে চেপে ধরেছে কপাল। তবুও রক্তে ভিজে যাচ্ছে তার রোরকা।
– রিকশা এত জোরে চালাচ্ছিলেন কেন? একটু আস্তে চালাতে পারেন না?
কী করমু আপা, রিকশায় পর্দা নাই। বৃষ্টি আইবো ভাইবা একটু জোরেই চালাইতে ছিলাম, কিন্তু সামনের আইলেন খেয়াল করি নাই। তাই জোরে ঝাঁকি খাইয়া পইড়া গেছে খালাম্মা। আসলে ভুল হইয়া গেছে আমার । জরুরি বিভাগের একটি রুম পাশাপাশি শুয়ে আছে দুটি মানুষ। একজন সম্পূর্ণ বোরকা আবৃত এখনো, তবে তার বোরকাটি রক্তে রঞ্জিত। ওপর মানুষটির মাথায় ব্যান্ডেস করা। প্রথম মানুষটি থেকে রক্ত নেওয়া হচ্ছে, সে সেচ্ছায় রক্ত দিচ্ছে। এছাড়া নির্দিষ্ট গ্রুপের রক্ত হাসপাতালে পাওয়া যাচ্ছিল না। যখন সুমাইয়া জানতে পারে মহিলাটির রক্ত প্রয়োজন এবং রক্তের গ্রুপ A- তখন সে আর দ্বিতীয়বার চিন্তা করেনি রক্ত দেওয়ার জন্য।
এখন সুমাইয়ার পাশে দাঁড়িয়ে আছে তার স্বামী। সে-ই কল করে তাকে এখানে আসতে বলেছে। ঘটনার অকস্মিকতায় হয়তো সে বৃদ্ধা মহিলার পাশে দাঁড়িয়েছে, কিন্তু একা একটি মেয়ে মানুষ সবকিছু সামলে উঠতে পারবেনা। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে মহিলাটি নাকি সাহেদের পরিচিত। তাদের বাড়ির পাশেই নাকি তাদের বাসা। তার ছেলেকে কল দেওয়া হয়েছে, হয়তো কিছুক্ষণের ভেতর হাসপাতালে এসে পৌঁছবে। জিল্লু নামের ছেলেটি এখন তার মায়ের পাশে বসে আছে। ছেলেটিকে সুমাইয়ার চিনতে অসুবিধা হয়নি। এই সেই ছেলে, যে কিনা কয়েকদিন যাবৎ তাকে ফলো করছিল। হয়তো কোনো কু-মতলব ছিল, কিন্তু সেটা সুমাইয়া জানে না।
জিল্লুর চোখ ছলছল করছে জলে। হয়তো মেঘলা আকাশের মতো মূষলধারে বৃষ্টি নামবে। তবে কেউ জানে না এ চোখের জল মায়ের জন্য নয়, পাশের বিছানায় শুয়ে থাকা বোরক পরা মেয়েটার জন্য। এখানে আসার পর সে জানতে পেরেছে, তার মা অ্যাক্সিডেন্ট হওয়ার পর মেয়েটি তার মাকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছে। শুধু নিয়ে আসাই নয়, নিজের শরীরের রক্ত দিয়ে তার মাকে বিপদমুক্ত করেছে। অথচ তার যৌন লিপ্সা মিটানোর জন্য রাস্তায় মাইক্রো নিয়ে মেয়েটিকে তুলে নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করেছিলো সে। এখানে আসার পর মেয়েটির চোখ দেখেই সে বুঝতে পেরেছে, তাকে সে চিনে ফেলেছে। অথচ কিছুই বলেনি।
নিজের ভেতর কেমন এক অনুশোচনা বোধ হচ্ছে তার। যে অনুশোচনা বোধ তাকে সর্পের মতো দংশন করছে বারবার। প্রচণ্ড ভুল হয়ে গেছে তার, অবশ্যই মাফ চাইতে হবে। প্রয়োজনে মেয়েটির পা ধরে মাফ চাইবে, তবুও তার এ অনুশোচনা বোধ থেকে মুক্তি চাই। বসা থেকে দাঁড়িয়ে সুমাইয়ার বিছানার পাশে দাঁড়িয়েছে জিল্লু। চোখ সেই আগের মতো ছলছল করছে। কিছু একটা বলতে চাচ্ছে, কিন্তু বলতে পারছে না। ঠোঁট দুটো কাঁপছে অনবরত।
– বোন তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও। তোমার সাথে আমি বড় অন্যায় করে ফেলছি। হয়তো আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করবে না। তুমি আমাকে ক্ষমা করো বোন, আমি তোমার পায়ে পড়ি।
জিল্লুর এমন কাণ্ড দেখে খুবই বিস্মিত সাহেদ। কারণ আগাগোড়া সে কিছুই জানে না। সুমাইয়াও কিছুটা বিস্মিত! তবে এই সামান্য অপরাধের জন্য সে এভাবে ক্ষমা চাইবে কেন! সে তো তার কোনো ক্ষতি করেনি। শুধু কয়েকদিন ফলো করেছে মাত্র।
– ছিঃ ছিঃ! এভাবে বলছেন কেন? আর আপনি কী বা এত বড় অন্যায় করেছেন যে এভাবে ক্ষমা চাইতে হবে?
– তুমি জানো না বোন, আমি অনেক বড় অন্যায় করে ফেলছি। তুমি ক্ষমা না করলে যে আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করবেন না।
– এভাবে আর কান্না করবেন না প্লিজ। আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করবেন অবশ্যই, আর আমিও আপনাকে ক্ষমা করে দিলাম। আল্লাহ ক্ষমাশীল এবং দয়ালু। আল্লাহ আপনাকে হেদায়েত দান করুন।
বাইরে প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছে, সাথে বৃষ্টি হচ্ছে জিল্লুর ক্ষত বিক্ষত হৃদয়ে। আর সেই বৃষ্টির ফোটায় ধুয়ে মুছে যাচ্ছে জিল্লুর মনের যত পঙ্কিলতা। সেখানে গজিয়ে উঠছে এক নব পবিত্র উদ্যান। যে উদ্যানের দিশারী সামান্য এক বোরকা পরা মেয়ে।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত