বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ ৫ পেয়েও যখন পলিটেকনিক এ ভর্তি হলাম। তখন আমার ভালোবাসার মানুষটা আমাকে ছেড়ে চলে যায়। আমার অপরাধ ছিলো আমি বুয়েট, কুয়েট,মেডিকাল এর সিট কাপানো বাদ দিয়ে পলিটেকনিক এ ভর্তি হয়েছি। সে তার বয়ফ্রেন্ড কে অনেক উঁচুতে দেখতে চায়। আমি তার ইচ্ছেটা পূরণ করতে পারিনি। তাই সে আমার বৃত্তের বাইরে চলে যায়। এবং ঢাকার একটা নামি দামি কলেজে ভর্তি হয়ে যায়,আর আমিও বগুড়া নামক নতুন একটা শহরে চলে যাই।
ক্লাসের প্রথম দিনই সবার সাথে পরিচিত হলাম,খুব ভালো লাগল। আরো ভালো লাগল আমাদের সাথে যে বাহান্ন জন চান্স পেয়েছিল। সেখানে পঁয়তাল্লিশ জনই ছিল গোল্ডেন। তখন মনে হলো পলিটেকনিকে যে শুধু মধ্যমানের ছাত্র ভর্তি হয়। ভালো ছাত্র ভর্তি হয়না। এই ধারণাটা সম্পূর্ণ ভূল। যখন হোস্টেল এ থাকতাম তখন দেখতাম অনেকেই কলেজ থেকে যে টাকা পেত সেগুলো তাদের গার্লফ্রেন্ড এর পেছনেই খঁরচ করতো। কিন্তু আমি টাকা গুলো জমিয়ে রাখতাম।
আমাদের একজন স্যার একদিন কিছু কথা বলেছিল। যত ভালো ডিপার্টমেন্টেই পড় না কেনো। চাকরির বাজারে তোমাকে দৌড়াতে হবেই। ডিগ্রি অর্জন করা শেষ হলে নেমে পড়তে হবে চাকরি যুদ্ধে। যেই যুদ্ধে জয়ী হতে হলে তোমাকে প্রচুর পড়তে হবে এবং পাশাপাশি ঢাকায় থেকে তোমাকে চাকরির খোজ করতে হবে। ওনার কথা শুনেই আমি কলেজ জীবনের পাওয়া টাকা গুলো খুব কষ্ট করে জমিয়েছি। চারবছরে সবমিলিয়ে প্রায় সত্তর হাজার টাকার মতো জমিয়েছিলাম। চার বছরের পলিটেকনিক জীবনে অনেক কিছুই জেনেছি,অনেক কিছুই শিখেছি। মিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাদ পেয়েছি। অনেক বন্ধুরাই বলতো,তাদের বন্ধুরা নাকি তাদেরকে অপমান জনক অনেক কিছুই বলতো পলিটেকনিক এ ভর্তি হওয়া নিয়ে। তবে এই দিক থেকে আমার বন্ধুরা খুব ভালো ছিল। তারা কখনো আমাকে এসব বিষয় নিয়ে কোনো কথা বলেনি। ঢাবিতে পড়া এক বন্ধু শুধু একদিন বলেছিল। তুই চাইলেইতো অনায়াস এ পাবলিক ভার্সিটিতে ভালো একটা ডিপার্টমেন্ট নিয়ে পড়তে পারতি। এর বেশি কিছু কোনোদিন আমার বন্ধুরা আমাকে বলেনি।
ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ হওয়ার পর গাজীপুরে চলে যাই।কারণ গাজীপুরকে বলা হতো ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের প্রাণ কেন্দ্র। খুব অাশা ছিল ডুয়েট এ পড়ার তাই পরিবারের আর্থিক অবস্থা খারাপ থাকার পরেও নিজের জমানো টাকা গুলোকে সম্বল করে গাজীপুর চলে যাই। একবছর অক্লান্ত পরিশ্রম করার পরেও স্বপ্নের ডুয়েট এ জায়গা হলনা। তবে এই একবছর দিনরাত পড়াশোনা করার পরে ডুয়েট এ চান্স না পেলেও সরকারি চাকরি নামক সোনার হরিণের দেখা পেয়ে যাই। পিএসএসি নির্ধারিত নন ক্যাডার পদে সুপারিশ প্রাপ্ত হই। বড় ভাইয়েরা বলতো, ডুয়েট কোচিং কর। তুমি নিরাশ হবেনা। ডুয়েট কাউকে খালি হাতে ফেরায় না,যদি তুমি তোমার কাজটা ঠিকমত করতে পারো। সবাইকে অবাক করে দিয়ে মাত্র একুশ বছর বয়সে দ্বিতীয় শ্রেনীর চাকরি পেয়ে যাই। যেখানে অনার্স পাশ করে একুশ বছর বয়সে দ্বিতীয় শ্রেনীর চাকরি পাওয়া স্বপ্নেও সম্ভব না। আজ ছয় বছর পরে ভালোবাসার মানুষটার সাথে দেখা।
তানিয়া এখন অনার্স ফাইনাল ইয়ারে পড়ে। ঢাবিতেই চান্স পেয়েছে। তবে ডিপার্টমেন্ট টা ভালো পায়নি। কেমন আছো? ভালো আছি,তুমি কেমন আছো? ভালো। প্রায় ছয় বছর পরে দেখা। অনেক কিছুই বদলে গিয়েছে। তুমি আজ প্রতিষ্ঠিত। আমার সফলতার পেছনে তোমারও কিছুটা অবদান রয়েছে। কিভাবে? তোমার সাথে যদি আমার সম্পর্কটা থাকতো, তাহলে হয়তো কলেজে থাকতে বিশ্বব্যাংক, মেরিট লিস্ট থেকে যে টাকা গুলো পেতাম। সেগুলো জমাতে পারতাম না, তোমার পেছনেই খঁরচ করতে হতো। আর আমার পরিবারের সামর্থ্য ছিল না পড়াশোনা শেষ হওয়ার পরেও মাসের মাস খঁরচ দেওয়ার। অনেক ভালো যুক্তি দিলে। ভূলে গিয়েছো? জানিনা আমি।
ভোলার জন্য কি ছয় বছর যথেষ্ট ছিলো না? যথেষ্ট ছিলো কিনা জানিনা। তবে কিছু কিছু মানুষকে কখনো ভোলা যায়না। ঘৃণা করার জন্য হলেও মনে রাখতে হয়। এভাবে বলনা,প্লিজ। আমরা কি আগের মতো হতে পারিনা? আমি এখনো তোমার সেই আগের তানিয়াই আছি। তুমি ছাড়া আজ পর্যন্ত কোনো পুরষ আমাকে স্পর্শ করতে পারেনি। হয়তো তোমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম, তবে কারো সাথে সম্পর্কে জড়ায়নি। কখনো ভাবিওনি তোমাকে এভাবে আবার ফিরে পেতে মন চাইবে। তাহলে কি আমার জীবনের বদলে যাওয়াটাই আমাকে ফিরে পাবার কারণ। প্রতিষ্ঠিত বলেই শুধু ফিরে পেতে চাইছো? তুমি যা খুশি বলতে পারো,অপমান করতে পারো। তবে আমি তোমাকে এখন মন প্রাণ উজার করে কাছে পেতে চাই। এটা চিরন্তন সত্য।
এটা কখনো হবার নয়। জীবনে কখনো কাউকে ছোটো করে দেখবেনা,আর কোনো মানষের যোগ্যতা কে তো কখনোই নয়। আমি চলে আসি। তানিয়া আমার হাত ধরে ফেলে। আমার অনেক কষ্ট হবে তোমাকে ছাড়া থাকতে। তাহলে এই ছয়বছর কিভাবে ছিলে? আমি জানিনা,তোমাকে না দেখলে হয়তো সারাজীবনই থাকতে পারতাম। কিন্তু তোমাকে দেখার পর আমার ভিতরটা জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে তোমাকে কাছে না পাওয়ার যন্ত্রণায়। তানিয়ার হাতটা ছাড়িয়ে আমি চলে আসি। তাঁর বিষণ্ণ চেহারাটাও আমার চলে আসাটা আটকাতে পারেনি। পেছন থেকে শুধু শুনতে পাই। আমি অপেক্ষায় থাকবো। তুমি আসবে কোনো একদিন আমাকে ভালোবাসার জন্য।
আজ একমাস পর হঠাৎ করেই তানিয়ার কথা মনে হলো। আমি তো এতো নিষ্ঠুর ছিলাম না কখনো। হয়তো খুব কম সময়ের জন্য মেয়েটাকে ভালোবেসেছিলাম। তবে জীবনে তো ওই একজন মানুষকেই ভালোবেসেছিলাম। একটা ভূল করেছে হয়তো। কিন্তু সেটার জন্য তো সে এখন অনুতপ্ত। আমি যাব তানিয়ার কাছে। আমি জানি আমার জন্য সে দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বসে আছে। আমি তাঁর অপেক্ষার প্রহর শেষ করবো আমার ছয় বছরের জমানো সমস্ত ভালোবাসা দিয়ে।
গল্পের বিষয়:
গল্প