কালো মেয়ে

কালো মেয়ে
-“তুই আফরার জামাইটাকে দেখেছিস? অতো সুন্দর একটা ছেলে এরকম হাড়ির তলার কালিকে কি দেখে পছন্দ করল আল্লাহই জানেন!”
-“আরে বলিস না! বিয়ের দিন দৃশ্যটা দেখার মত ছিল। ছেলের নাকি শখ ছিল লাল বেনারসি পরিয়ে নিজের বউকে ঘরে তুলবে। লাল বেনারসিতে আফরাকে যা লাগছিল না! হাহাহা!”
মীরার কথা শুনে হেসে দিল উপস্থিত সবাই। অনেকদিন পর বান্ধবীরা এক হয়েছিলো একটু সময় কাটানোর জন্য। আফরার আসতে দেরি হওয়ায় তার অনুপস্থিতিতে এইসবই বলছিল সবাই। সৌভাগ্যবসত হোক কিংবা দুর্ভাগ্যবসত, আফরা রেস্তোরাঁয় ঢোকার সাথে কথাগুলো শুনতে পায়। এইটা নতুন কিছু না। সেই আরাফের সাথে বিয়ের পর থেকেই তাকে এইসব কথা শুনতে হচ্ছে। একটু খারাপ লাগলেও মুখে একটা মেকি হাসি টেনে বান্ধবীদের সামনে গেল। হাজার হোক, এতোদিন পর দেখা। সারাদিন হস্পিটালে খেটে এসে সময় পায় না কারো খোজ নেওয়ার। আজ একটু সময় কাটাতে ছুটি নিয়ে এসেছিলো সে।
মুখে হাসি রেখে সবার সাথেই কথা বলছে আফরা। ছোট থেকে সে এরকমই। মনের ভিতরে হাজার ঝড় বয়ে যাক,মুখে তা ফোটাবে না।খুব সুন্দর অভিনয় জানে সে। আসলে ছোট থেকে হাসিখুশি থাকার অভিনয় করতে করতে আজ সে পেশাদার অভিনেত্রী হয়ে গেছে। কোন নাটক-সিনেমাতে অভিনয় করে না সে। বাস্তবজীবনে অভিনয় করে। এইখানে না আছে কোন কাট, না আছে রিটেক আর না আছে প্যাক আপ। এই অভিনয় নাটক সিনেমার থেকেও অনেক কঠিন। সবার সাধ্য নেই এই অভিনয় করার। একঘন্টার মাথায় শরীর খারাপের অযুহাত দিয়ে বাড়িতে চলে আসে আফরা। শারীরিকভাবে অসুস্থ না হলেও মানসিকভাবে বেশ অসুস্থ হয়ে পড়ে সে। বাড়িতে কাউকেই বুঝতে দেয়নি তার অসুস্থতার কথা। হাসি মুখে নিজের দায়িত্ব সেরে রুমে এসে বসেছে আফরা।
আফরাকে দেখতে খারাপ বললে “সুন্দর” শব্দটাকে অসম্মান করা হবে। পটলচেরা চোখ, পাতলা ঠোঁট, মাথা ভর্তি চুল সবই আছে তার। দোষের মধ্যে এতোটুকুই যে ওর গায়ের রং চাপা। একটু বেশিই চাপা। কিন্তু এই নিয়ে কখনো ওর আফসোস ছিল না। গায়ের রং চাপা বলেই স্কুল, কলেজ কিংবা ভার্সিটিতে কখনো প্রেমপত্র কিংবা প্রেমের প্রস্তাব পায়নি আফরা। এতে অবশ্য ভালই হয়েছে! ওর চরিত্র নিয়ে না কেউ কথা বলতে পেরেছে, না সম্পর্কের সেই চিরপরিচিত ভিষণ যন্ত্রণা ওকে স্পর্শ করতে পেরেছে। উপরন্তু শিক্ষা জীবনের প্রতিটাস্তর এইসব উটকো চিন্তা থেকে মুক্ত থেকে খুব সহজেই পার করে এসেছে আফরা।
মেডিকেল কলেজে পড়ার সময় এক কাজিনের বিয়েতে পরিচয় হয় আরাফের সাথে। ওর গায়ের রঙের জন্য কখনো কোন ছেলে ওর দিকে দ্বিতীয়বার ফিরে না তাকালেও আরাফ ফিরে তাকিয়েছিল। একবার না, দুইবার না, বার বার ফিরে তাকিয়েছিল। কিন্তু কেন যে ফিরে তাকিয়েছে তা আজও জানে না আফরা। সে নিজেও হয়তো নিজের কালো রঙের পিছনের সৌন্দর্য্যটা খুঁজে পায়নি। হয়তো বা সমাজ তাকে খুঁজতে দেয়নি। বসে বসে আজকের কথাগুলো মনে করছিল আফরা। হঠাৎ কাধে কারো স্পর্শ পেয়ে পিছন ফিরে তাকালো। এইসব ভাবতে ভাবতে কখন যে আরাফ পিছনে এসে দাড়িয়েছে খেয়ালই করেনি। হাত ধরে আরাফকে নিজের পাশে বসায় আফরা। আরাফের কাধে মাথা রেখে দৃষ্টি শুণ্যে স্থাপন করল সে।
-“মন খারাপ কি নিয়ে?”
– ‘কই?না তো!”
-” কৈ তো জলে। তোমার মিথ্যা কথার মধ্যে তাকে কেন টানছো?”
এই কথার কোন জবাব দিল না আফরা। শুধু মাথা উঁচু করে আরাফের দিকে একঝলক মাত্র তাকিয়ে আগের অবস্থানে ফিরে আসল।
-” ফ্রেন্ডদের সাথে দেখা করতে গেছিলা না? সেখানে কিছু হয়েছে?”
-” আচ্ছা আরাফ, আমাকে বিয়ে কেন করলে?”
এই প্রশ্ন শোনার পর আরাফের বুঝতে বাকি থাকল না আর আফরার কি হয়েছে। আফরার মাথাটা নিজের কাধ থেকে তুলে ওর দিকে ঘুরে বসল আরাফ। দুই হাত আফরার দুই গালে রেখে প্রশ্ন করল,
-“তোমার ফ্রেন্ডরা কিছু বলেছে এই নিয়ে?”
-“আহা বলই না! তুমি কত সুন্দর! আমার মত কালো মেয়েকে কেন বিয়ে করলে? তোমার জন্য তো কত সুন্দর মেয়ে পেতে পারতে। নিজের জীবনটা কেন নষ্ট করলে?” এতক্ষণ ঠিক ছিল, কিন্তু শেষ কথাটা শুনে আরাফের বেশ রাগ হল। কিন্তু ও প্রকাশ করল না। কারাণ ও জানে কতটা কষ্ট না পেলে আফরা এ কথা বলবে না। তাই কোন প্রকার প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে আফরার কপালে ছোট্ট একটা আদর করে বলল,
-“নিজেকে কখন আয়নায় দেখেছ?”
-“রোজই দেখি।”
-” নিজের চোখ দুইটার দিকে কখন মনযোগ দিয়ে তাকিয়েছো? “
-“হাহ! কি এমন নতুন আছে? সবার যেমন হয়, তেমনই!”
-“হাহা! না।
সবাই তোমার এই কালো রঙটা পর্যন্ত পৌছাতে পেরেছে। কালো রঙটাকে পার করে তোমার ঐ চোখের মায়াতে নিজেকে বাধতে পারেনি। তোমার ঐ কালো রঙ পর্যন্তই সবাই পৌছোতে পেরেছে, বাপাশে ঠোঁটের নিচের ঐ কালো তিলটাতে নিজের নজর আটকাতে পারেনি। তোমার কালো রঙটা তাদের জন্য যথেষ্ট ছিল, তাই ভিতরের ঐ সাদা আফরাটাকে কেউ আবিষ্কার করতে পারেনি।” কথাটা শেষ করে আফরার কপালে নিজের উষ্ণপরশ এঁকে দিল আরাফ। আর আফরা তো আরাফের কথাগুলো শুনে আজকের পাওয়া সব কষ্ট দুফোটা চোখের জল আকারে বের করে দিল।
-“চা খাবে?” (আফরা)
-“উম্ম! হলে মন্দ হয় না।” (আরাফ)
-“দাড়াও। নিয়ে আসছি।” (আফরা)
আফরা চলে যাওয়ার পথে তাকিয়ে থেকে মুচকি একটা হাসি দেয় আরাফ। হ্যা, ভালবাসে সে এই মেয়েটাকে। হয়তো নিজের থেকেও বেশি।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত