সকালে বড় খালা প্রায় পনেরোটা কল দিলো। অসহ্য হয়ে ফোনটা খাটের নীচে রেখে দিলাম। তাও ভাইব্রেটের ঘষঘষ শব্দটা মনে হচ্ছে যেনো ব্রেনে কেউ ঘষতেছে। ফোনটা ধরলাম, এই হারামজাদা কই তুই এক্ষুনি বাসায় আয় বলেই খালা ফোন রেখে দিলেন। আমি জানি কেসটা কি, আসলে নিজে ইচ্ছে করেই এই বিপদটা কাঁধে নিয়েছিলাম। খালাকে বলেছিলাম আশিক ভাইয়াকে বিয়ে করায় দিবো এই বছরেই। এই বলে প্রায় দশ হাজার টাকা লুটে খেয়ে ফেলেছি। আমি আর কারো কাছে টাকা খুঁজতে পারিনা।
বড় খালার অনেক টাকা। খালু কৃষি অফিসার ছিলেন। রিটায়ার্টমেন্টের পর অনেক টাকা পেয়েছেন। এসব খালা বিভিন্ন কাজে ব্যয় করেন। তাদের একমাত্র সন্তান আশিক ভাই। উনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দশ বছর আগে ইংরেজী সাহিত্যে মাস্টার্স কমপ্লিট করেছেন। খুব গুছানো স্বভাবের মানুষ। আমার ভালো লাগে। যদিও আমার অনেক সিনিয়র তারপরেও একমাত্র আমার সাথেই সম্পর্কটা উনার একদম ফ্রেন্ডলি। এলাকার সিটি ব্যাংক অফিসার উনি। কিন্তু এতো কিছু ঠিকঠাক থাকতেও বিয়ে করতে উনি নারাজ। কতশত বল্লাম ভাই আমার আপন বান্ধবীকে আমি রাজী করাবো, ও অনেক কিউট। প্লিজ বিয়ে করে ফেলেন। উল্টো আমায় বলেন তর পছন্দ হলে বল তকে বিয়ে করায় দেই। আমি বলি, ছি! ভাই আমার বাচ্চারা বড় হয়ে কী ভাববে আপনাকে নিয়ে বলেন? উনি জাস্ট হাসে।
হালকা চোখেমুখে পানি দিয়ে, ব্রাশ করলাম। প্যান্টটা পরে খাটের নীচ থেকে শার্টটা বের করে ঝাড় দিয়ে ইচ্ছে মতো পারফিউম মেরে পরে নিলাম। মানিব্যাগটা খুঁজে পাচ্ছিনা। টেবিলের ড্রয়ারে ভাংতি কিছু টাকা ছিলো মিলিয়ে পঞ্চাশ টাকা হলো, পকেটে ঢুকালাম। বাইকটা বের করে স্টার্ট দিয়ে খালার বাসায় যাচ্ছি। কি বোঝ দেয়া যায় ভাবতেছি। গিয়ে দেখি আশিক ভাই রেডি হয়ে নাস্তা করতেছে অফিস যাবে। আমিও বসে নাস্তা সেরে নিলাম। খালাকে বললাম কি হইছে তোমার বলোতো? সকাল সকাল চিল্লানি! খালা উল্টো ধমক দিয়ে বললো, আমাকে মারার পাঁয়তারা করতেছিস তরা তাইনা? এই ফুফু খালাদের একটাই সমস্যা সুজা কথা তারা এমন আধ্যাত্মিক ভাবে উপস্থাপন করবে আপনি পাথর হলেও গলতে বাধ্য। আবার বলতেছেন, বুড়ো হয়ে গেছি একটা মাত্র ছেলে আমার, ভাবছিলাম ছেলের বউয়ের হাতে দুটো ভাত খাবো। নাতি নাতনির মুখ দেখবো। কিন্তু কী হলো? আমি এই আফসোস নিয়েই হয়তো মরবো। তদের আর কিছু করা লাগবেনা। আমি মরলে তরা আমার এই স্বরাজ নিয়ে এমনি থাকিস। বলেই কান্না। বড় ভাইও উঠে চলে গেছে। আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম। এখন কিছু করতেই হবে।
আশিক ভাইকে ফোন দিলাম। অফিস শেষে একটা রেস্টোরেন্টে আসতে বললাম। রাত নয়টা বাজে। আশিক ভাই আর আমি বসে আছি। আশিক ভাইকে আজ ইচ্ছে মতো বকলাম। সিরিয়াস আমার খালার জন্য আজ কষ্ট লেগেছিলো। শেষে বাধ্য হয়ে আশিক ভাইকে বললাম, ভাই আপনার কি ইন্দ্রিয় কোন সমস্যা? গোপন অসুখ? ভাই মেবি রাগ করছে। অন্য কেউ হলে আমায় হয়তো থাপ্পড় মেরে বসতো। ভাই জাস্ট উঠে যাওয়ার সময় বললো পরশু আমরা রাজশাহী যাবো। রেডি থাকিস। উফ! যাক বাবা এবার বোধহয় কাজ হয়েছে।কষ্টের ভালোবাসার গল্প কাহিনী
খালারে ফোন দিয়ে বললাম, খালা একটা মেয়ে দেখতে রাজশাহী যাচ্ছি একেবারে ভাইকে নিয়ে। বলছিলামনা সব ঠিক করে ফেলবো? চাপাটা আন্দাজের উপর ভরসা করে মেরে দিলাম। খালার কাছ থেকে আরো কিছু টাকা নিয়ে কিছু কেনাকাটা করে ফেললাম। আজকে সেই পরশু, রাত দশটার বাসের টিকিট কাটলাম। খুব ঠান্ডা পরেছে সিলেটে। গুটিসুটি মেরে বসে আছি কাউন্টারে। ভাই বাইরে সিগেরেট ফুঁকছে। গাড়ি চলে এসেছে। আমি জানালার পাশে উঠে বসলাম। ভাই পাশেই বসা। এই দুই ঘন্টায় বড়জোর দশটা শব্দ উচ্চারণ করছে আমার সাথে। আমিই বকবক করে যাচ্ছি। আজকে একেবারেই নিরব হয়ে আছে আশিক ভাই। জিজ্ঞেস করলাম, ভাই আমরা রাজশাহী নেমে কোথায় যাবো? উনি বললেন, সাটিয়াঝুড়ি নামের একটা গ্রামে।
ঘুমিয়ে পরছিলাম উঠে দেখি একটা হাইওয়ে রেস্টোরেন্টে যাত্রাবিরতি। ফজরের আজান হচ্ছে। নেমে গিয়ে ফ্রেশ হলাম। গরম গরম পরটা ভাজি আর চা খেলাম দুজনে। পাখির কিঁচিঁরমিঁচিঁর শব্দ ভালোই লাগছে। হালকা আলো ফোটে সূর্য উঠছে। জায়গাটা আহামরি উন্নত না কিন্তু যথেষ্ট প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর। আর এক ঘন্টা লাগবে রাজশাহী পৌছাতে। গাড়িতে আবার উঠে বসলাম। জানালার পাশে আশিক ভাই উকি দিয়ে তাকিয়ে আছে আমি জানালার পাশে হওয়ায় সিট তুলে সুজা করে দেখতেছে। আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বলতেছে ঐযে গ্রামটা দেখছিস ঐ গ্রামটাতে আমরা যাবো, তবে শহর হয়ে। এই প্রথম ভাই নিজ থেকে কথা বলছে। আমরা পৌছে গেলাম। সাড়ে সাতটা বাজে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রুয়েট দুটো পাশাপাশিই। আশিক ভাই আমাকে দেখাচ্ছে। আমরা একটা ফুলের দোকানে গেলাম, পেপার মোড়ানো দুটো ফুলের তোড়া কিনলাম।
আমার হেব্বি লাগছে ব্যাপারগুলো। একটা অটোরিকশা নিলাম পদ্মাপার যাবো। কতো সুন্দর নগরী। রাজশাহীর প্রেমে পরে গেছি একদম। আমরা একটা নৌকা করে নদীর ওপারে গেলাম। অনেক হেটে ছোট একটা বাজার থেকে আবার একটা রিকশা নিলাম। আশিক ভাই পকেট থেকে বের করে এই প্রথম উনি মাস্ক পরলেন। ব্যাপারটা কেমন যেন ঠেকলো। আমি বললাম হঠাৎ মাস্ক পরলেন কেনো? উনি বললেন, অনেক পরিচিত লোক আছে, খামোখাই কথা বলবে তাই। সেটাও ঠিক! উনি এমনি সেমি বোবা। মনে মনে বললাম।
গ্রামটা এতো সুন্দর বলে ব্যাখ্যা করতে পারবোনা। কিছু কিছু পুরানো ঐতিহ্য তারা ধরে রেখেছে। পুরানো দালান। গোয়ালারা দুধ নিয়ে বাজারে যাওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি। শেষমেশ আমরা একটা গোরস্থানের কাছে এসে নামলাম। ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে জুতো খুলে গোরস্থানের ভেতর যেতে বললেন। আমি এযাবৎ এখন পুরোপুরি তবদা লেগে গেলাম। তাও ঢুকলাম ভেতরে। দুটো পুরোনো কবর। গাছ লতাপাতায় একদম কিছু বুঝা যায়না। ফুলের তোরা দুটো দুই কবরে রেখে উঠে এসে ডুকরে কেঁদে ফেললেন আশিক ভাই। একদম হাউমাউ করে কান্না। একটা মানুষ অনেক কষ্ট অভিমান অভিযোগ এক করে জমিয়ে যখন কাঁদে ওরকম কান্না। আমায় জড়িয়ে ধরে কাঁদতেছেন। আমি যেন উনার কান্নার ভাষা সব কিছু বুঝে ফেলতেছি। আমিও কাঁদতেছি। আমারও খুব কষ্ট হচ্ছে কেনো যেনো। আমরা কবর জিয়ারত করলাম। শেষে আশিক ভাই ছোট একটা কবর দেখিয়ে বললেন, এটা আমার ছেলের কবর। আর পাশেরটা ছেলের মায়ের। আমি এরকম কিছু শুনবো কল্পনাও করিনি। ওখান থেকে বের হয়ে আমরা পদ্মাপারে এসে বসলাম তারপর আশিক ভাই শুরু করলেন।
প্রায় পনেরো বছর আগে আমি এই নগরীতে আসি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো হল আমি পাইনি তখন। পরে এখানে সেখানে ঘুরে, আবাসিক হোটেলে থেকে ক্লাস করতাম। অনেক কষ্ট করতাম আমি। ঠিকঠাক খাবার কপালে জুটে নাই। পরে একটা ফ্রেন্ডের মাধ্যমে এই গ্রামের মাতবর বাড়িতে আমি লজিং মাষ্টার হয়ে থাকার সুযোগ পাই। এই সুবাদে এই বাড়ির ছোট ছোটকা যারা তাদেরকে আমি পড়াতাম।
একদিন হঠাৎ এই ঘরের বড় মেয়ে ফারহানা সবার সাথে পড়তে আসলো। ও তখন রাজশাহী কলেজে পড়তো। আমি নিয়মিত পড়াতে লাগলাম। বিশ্বাস কর ভাই গুনাক্ষরেও আমি অন্য কোন চোখে ওকে দেখিনি। ও ছিলো খুব নম্র ভদ্র এবং লাজুক। আমি তাকে শুধু পড়াতাম। একদিন বাড়িতে পিকনিকের আয়োজন হয়। সেদিন ফারহানা শাড়ি পরেছিলো।
সেদিন প্রথম দেখেছিলাম আর ঐটাই শেষ দেখা ছিলো। এতো মায়াবী এত গোছানো আর এতো সুন্দর মেয়ে আমি আর আজঅবধি দেখিনি। আমি সেদিন রান্না করেছিলাম কোন বাবুর্চি ছিলোনা। কলেজে থাকতেই মেসে থেকে টুকটাক রান্না পারতাম। আর সেদিন এতোজনের রান্না আমি কীভাবে রেঁদেছিলাম নিজেও জানিনা। ফারহানা আমাকে হেল্প করেছিলো। কয়েকবার চোখে চোখ পরা, লাজুক হাসি, হাতে হাতে হালকা স্পর্শ ইত্যাদি ইত্যাদিই ছিলো আমাদের দুজনের প্রেমে পরার কারন। সে নিজ থেকেই আমাকে সেদিন একটা চিরকুটে লিখে দিয়েছিলো “আপনাকে ভালোবাসি”।
তারপর আর কি! জমিয়ে প্রেম। সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে ঘুরাঘুরি। আমাদের ক্যাম্পাসে ওরে সবাই ভাবি বলেই ডাকতো। একদিন দেখি অনেক লোক বাড়িতে আসছে ওর বিয়ের কথা বলতে। আমি সেদিন আর টিকতে পারেনি। সেদিনই আমি ওকে ক্যাম্পাসে নিয়ে একটা হলে বিয়ের আয়োজন করি। সবাই অনেক আনন্দ করেছিলো সেদিন। এই বিশ্ববিদ্যালয় স্বাক্ষী।
আমাদের বাসর রাত লুকিয়ে বাড়িতেই হয়েছিলো। এ কথাটা বলে আশিক ভাই লজ্জা পেয়ে গেলেন। আমি ধমক দিয়ে বললাম। ধুর, ভাই ইশ! আগে বাড়ান তো। তারপর এভাবেই চলতে লাগলো। সবাইকে অনেক কষ্টে মানিয়েছিলো ফারহানা । ইন্টার পরীক্ষার পর বিয়ে করবে এটা বলে। হঠাৎ একদিন চিঠি আসলো বাড়ি থেকে বাবা অসুস্থ। ফারহানা কে কয়েকটাদিন অপেক্ষা করতে বললাম। কাঁদতেছিলো, কপালে একটা চুমু খেয়ে আমি চলে আসলাম। বাবাকে নিয়ে প্রায় দুই মাস আমি কীভাবে ছিলাম মাকে জিজ্ঞেস করিস। শেষমেশ বাবা চলে গেলেন। ফারহানাকে চিঠি লিখেছিলাম কয়েকবার, কোন উত্তর আসেনি। বাবার রিটায়ার্টমেন্টের টাকা তুলা জায়গা জমি ঠিকঠাক ইত্যাদি সামলাতে আমার একটা বছর কিভাবে গেলো নিজেও টের পাইনি। এর মধ্যে এতো লম্বা জার্নি করার সময় হয়নি আর।
আবার এক বছর পর ফিরলাম সেই নগরে। এলাকার সবাই কেমন করে যেন তাকাচ্ছিলো। সবাই কানাকানি করতে লাগলো আমায় দেখে। বাড়িতে ঢুকতেই আমাকে কয়েকজন বেধে ফেলে। আমাকে একটা গুদাম ঘরে রেখে অনেক মেরেছিলো তারা। এতটুকু বুঝতে পেরেছিলাম যে তারা হয়তো বুঝে গেছে। পরে সকালে কাজের মাসি আমাকে খাবার দিতে এসে বলেছিলো। ফারহানা দিদির একটা ফুটফুটে ছেলে হয়েছিলো।
একেবারে আপনের মতো। আমিতো খুশিতে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলাম। সব আঘাত ভূলে গেছি। আমি বলেছিলাম আমার ছেলে কোথায়? ফারহানা কেমন আছে? কাজের মাসি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন ফারহানা দিদিমণির মা আপনার ছেলেকে গলা টিপে মেরে ফেলেছে। আর ফারহানা দিদিমণি পুরা বোবা হইয়া গেছেন। উনারে সবাই অনেক মারছে বাচ্চা নষ্ট করার লাইগা। আমি সেদিন এতো জোরে চিৎকার করেছিলাম। এই আকাশ স্বাক্ষী। এখানে এসে আশিক ভাই কিছু থামলেন। রুমাল বের করে চোখটা মুছলেন।