ডিভোর্স হওয়ার প্রায় আড়াই বছর পর শতভাগ বুঝতে পারলাম, এই পৃথিবীতে সবকিছু ভুলে সুখে থাকা গেলেও অদিতিকে ভুলে আমার পক্ষে সুখে থাকা সম্ভব না, কোনভাবেই না। ওকে ছাড়া আমার একেকটি দিন যেনো একেকটি বছরের মতো লাগে, সারাদিন অফিস, মিটিং, বন্ধু, সহকর্মী, আত্মীয় সবকিছু নিয়ে ব্যস্ততা শেষে রাত আড়াটা তিনটায় ঘরে ফিরলেও ভোর হওয়া পর্যন্ত আমার একলা লাগে। ছেলেটাকে আমার ভাগে পেয়েছি ঠিকই কিন্তু ওকে দেখলে আমার রাগ হয়, ও আমার সাথে আছে, ওর মা নেই কেন?
আমাদের ডিভোর্স হবার পর থেকে রেহানার সাথে আমার সখ্যতা গড়ে উঠে, ও আমার আগের অফিসের কলিগ, পরিবারের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বিয়েটা আর করেনি, আমার সবকিছু জেনেই সে আমার ব্যাপারে আগ্রহী। আমিও কিছুটা দূর্বল হয়ে পড়েছিলাম কিন্তু বিয়ের ব্যাপারে সম্মতি দিতে পারিনি। যদিও সে অসম্ভব সুন্দরী, অদিতির চাইতে শত সহস্র গুন সুন্দরী, বিনয়ী, ভদ্র এবং শান্ত। তাছাড়া ঠিক যে কারণগুলোর জন্য আমি অদিতিকে ডিভোর্স দিয়েছিলাম তার কিছুই রেহানার ভেতরে নেই। তবুও ওকে বিয়ের ব্যাপারে পিছিয়ে আসছি, কেন? কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখলাম রেহানার ভেতরে আমি অদিতিকে খুঁজতাম কিন্তু পেতাম না। অথচ অদিতির ব্যবহারে অতিষ্ঠ হয়েই আমি ওকে ডিভোর্স দেয়ার সিদ্ধান্ত নেই।
মিটিংয়ের সময় কল কেটে দিলে বার বার কল দিতো, যদি বলতাম মুরগি খাবো রান্না করতো মাছ, ঘুরতে যেতে চাইলে ক্লান্তি দেখাতো আবার আমি যখন ব্যস্ত তখন ঘুরতে না নেয়ার কারণে তুমুল ঝগড়া করতো, অফিসে যাবার সময় তার পছন্দ করা পোশাক পরে যেতেই আমি বাধ্য, অন্যটা যদি পরতে চেয়েছি তো সেদিন আমি ঘরের খাবার কিছুই ভাগে পাইনি। আমার কথার বিপরীতে হাটাই ছিলো তার ধ্যান, জ্ঞান, চিন্তা, চেতনা সবকিছু। সংসার করতে গেলে অপরপক্ষের সুবিধা অসুবিধাও যে বিবেচনা করতে হয় এই বিষয়টা আমি কোনভাবেই ওকে বুঝিয়ে উঠতে পারিনি। অসহ্য রকমের জেদি আর বদমেজাজি একটা মেয়ে অদিতি। পৃথিবীর সবকিছু তার নিজের আয়ত্তে রাখা চাই। এমন চিন্তা চেতনার মানুষের সাথে আর যাইহোক সারাজীবন এক সাথে থাকা যায় না।
তাই সাহস করে ডিভোর্সের সিদ্ধান্তটা নেই, ভেবেছিলাম ওর তরফ থেকে অনেক ঝামেলা পোহাতে হবে কিন্তু না, আমার উপর এতো এতো অধিকার খাটালেও ডিভোর্সের সময় কোন আপত্তি করেনি। চুপচাপ সিদ্ধান্তটা মেনে চলে গেলো। যাবার সময় বলেছিলো, “একদিন আমার এই বদমেজাজি স্বভাবটাকেই খুব মিস করবে।” সত্যিই তাই, রেহানা ভীষণ বাধ্য মেয়ে। ওর এই বাধ্যতা আমার কাছে ন্যাকামি মনে হচ্ছিলো, হয়তো আমাকে পাবার জন্য নাটক করছে। একজন মানুষ আমাকে বিয়ে করতে চাইছে অথচ আমার ব্যাপারে তার কোন জেদ নেই, আমি যা বলছি তাই মেনে নিচ্ছে! ভালোলাগেনি ব্যাপারগুলো। আমার আজকাল কিছুই ভালোলাগে না অদিতিকে ছাড়া। রেহানাকে জানালাম, “যেভাবেই হোক অদিতিকে আমার ফিরে পেতেই হবে।” ছেলেকে বললাম,
– মায়ের কাছে যাবি?
– না।
– কেন? মাকে দেখতে ইচ্ছে করে না?
– না।
– মা’কে দেখতে ইচ্ছে করে না!
– মা তো আমাকে ছেড়ে চলে গেছে।
– কোথায় গেছে প্রতি সপ্তাহেইতো মায়ের সাথে দেখা করিস।
– আর করবো না।
-কেন?
– দেখা করে চলে যায় কেন?
– এবার আসলে আর যেতে দিবিনা। বলবি, আমাদের সাথে এসে থাকতে।
– মা আসবে না।
– কেন?
– সিয়াম আঙ্কেলের সাথে থাকে।
সিয়াম সম্পর্কে আমার কিছু জানা নেই। তবে কি ও অন্য কারও সাথে…আমার উপর দেখানো অধিকারগুলো মাত্র আড়াই বছরে ভুলে গেলো, আমাকে ভুলে গেলো! ডিভোর্স হয়েছে বলেই কি সবকিছু ভুলে যেতে হবে? কেমন একরোখা স্বার্থবাদী চিন্তা আমার মাথার ভেতরটা নষ্ট করে দিচ্ছে। মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে দ্রুত অদিতিকে ফোন দিলাম, একের পর এক কল দিচ্ছি। প্রায় ত্রিশ বার কল দেয়ার পর ওপাশ থেকে সাড়া মিললো,
– এমন অসভ্যের মতো কল দিচ্ছেন কেন বার বার?
– দিয়েছি বেশ করেছি, তুমিওতো দিতে।
– দিতাম বলেইতো ছেড়ে দিয়েছেন।
– ফোন ধরছিলে না কেন?
– এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করার মতো সম্পর্কটা আমাদের মাঝে এখন আর নেই। জরুরি কথা থাকলে বলুন।
– দেখা করতে চাই।
– সম্ভব না।
– তুমি কি অন্য কারও সাথে রিলেশনে আছো?
– অপ্রাসঙ্গিক কথা বলছেন, আমি রাখছি।
– রাখবেইতো, সিয়াম আছে না।
– হ্যাঁ আছে, তো?
– সাত বছরের অধিকারবোধ মাত্র আড়াই বছরে ভুলে গেলে!
– হ্যাঁ, গিয়েছি।
– তুমি কি আমৃত্যু এমন ঠ্যাটামো করবে? সরাসরি উত্তর দিতে পারো না?
– না পারিনা। রাখছি। লাইন কেটে যায়। শাশুড়ি মা’কে কল দিলাম, কোনরকম ভণিতা ছাড়াই বললাম,
– অদিতিকে আমি ফেরত চাই।
– আমার মেয়ে কি ফেলনা, ইচ্ছে হলো ডিভোর্স দিলে, ইচ্ছে হলো ফিরিয়ে নিলে। আর কক্ষনো কল করবে না। আমরা ওর দ্বিতীয় বিয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছি।
আমি আর কথা বলার সুযোগ পাই নি। তবে কি অদিতি সারাজীবনের জন্য হারিয়ে গেলো! কিছুই বুঝতে পারছি না। ওর সাথে দেখা করার কোন উপায় নেই কারণ ও চায় না। ছেলেটাও মাকে ডাকতে আগ্রহী নয়। আড়াই বছর আগে আমাদের বিচ্ছেদ হলেও মনে হচ্ছে আজই আমি ওকে হারালাম। যেভাবেই হোক ওকে আমার ফিরে পেতে হবে।
পরের দিন ভোরে চলে গেলাম ওদের বাড়িতে। সবাই ঘুমাচ্ছে, আমি কলিং বেল চাপছি। ভদ্রতা সভ্যতা ভুলে অনবরত বেল চাপছি। দরজা খুললো অদিতির বাবা। অতিরিক্ত ভদ্র সভ্য এই বাবা চোখ কচলাতে কচলাতে আমার দিকে তাকিয়ে কিছুটা অবাক হলেন কিন্তু তাড়িয়ে দিতে চাইলেন না, শাশুড়ি মা হলে নিশ্চিত তাড়িয়ে দিতেন। যাইহোক, বাবা বললেন,
– নাতির কিছু হইছে?
– না। আমার হয়েছে।
– কি?
– অদিতি কোথায়?
– ও তো হাসপাতালে।
– কেন?
– ওর বন্ধু, সিয়ামের খুব অসুখ। তাই..
– কোন হাসপাতাল?
– ওই যে, তোমাদের বাসার কাছেই যে হাসপাতালটা.. কি যেনো নাম…!
– বুঝতে পেরেছি, আসছি বাবা হাসপাতালে চলে যাই, সিয়াম নামের কোন রোগীর সন্ধান পেলাম না, আমাকে মিথ্যে বলা হয়েছে। হতাশ হয়ে করিডোরে দাঁড়িয়ে, হঠাৎ দেখি অদিতি গেইট দিয়ে ঢুকছে। ছুটে গেলাম ওর কাছে, পথ আগলে বললাম,
– আই লাভ ইউ। আই মিস ইউ। তোমার যা খুশি করো কিন্তু তুমি ফিরে আসো, ভুল করেছি।
– তোমার চাওয়া মতো আমি তোমায় স্বাধীনতা দিয়েছি, ছেলেটাকেও দিয়ে দিয়েছি, আজ বলছো ফিরে যেতে! তা তো আর সম্ভব নয়!
– কেন নয়?
– তোমার উপর থেকে আমার অধিকারবোধটা হারিয়ে গেছে। তোমাকে নিয়ে করা ভাবনাগুলো আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। যেদিন প্রথম তুমি মুক্তি চেয়েছিলে সেদিন অধিকারবোধ থেকে অনেক কষ্ট পেয়েছিলাম কিন্তু মুক্তি দিতে চাইনা বলার সাহসটুকু হয় নি। কারণ, যে চলে যেতে চায় তার উপর অধিকার খাটানো যায় না।
– ক্ষমা করে দাও। তোমাকে ছাড়া থাকা সম্ভব না।
– রেহানাতো খুব ভালো মেয়ে। সুন্দরী, ভদ্র। ওকে কেন বিয়ে করছো না?
– আমার তোমাকেই লাগবে।
– আমার একলা থাকার দিনগুলোতেতো আমি তোমাকে পাই নি।
– সবসময় নিজের জায়গাতেই সঠিক থাকলে, আমার কথা ভাবোই নি কোনদিন।
– ভেবেছি বলেইতো কান্না চেপে হাসিমুখে ডিভোর্স দিয়ে এসেছি।
– ডিভোর্স দিতে পেরেছো কিন্তু আপোষ করতে পারো নি।
– তোমার কেন মনে হচ্ছে আমি এখন আপোষ করবো?
– আপোষ করতে হবে না। যা খুশি করো শুধু আমাকে আবার বিয়ে করো।
– সম্ভব না।
– অদিতি..
– সিয়ামের ব্লাড লাগবে। আমার তাড়া আছে।
– সিয়ামকে ভালোবাসো?
– যেদিন থেকে তোমাকে ছেড়েছি সেদিন থেকে আমি নিজেকে ছাড়া আর কাউকে ভালোবাসি না, কাউকে ভালোবাসবো না।
আর প্লিজ, তুমি সভ্য মানুষ সভ্য থাকো, অসভ্যতা তোমার সাজে না। অদিতি চলে গেলো। এটুকু নিশ্চিত হলাম ও কারও সাথে সম্পর্কে নেই আর যাবেও না। জেদি মেয়েতো, নিজের জেদ ঠিক ধরে রাখবে। অপলক তাকিয়ে রইলাম একবার ফিরে তাকাবে এই ভেবে। কিন্তু না, ফিরে তাকালো না। আর কোনদিন ফিরে তাকায় নি, ফিরে আসে নি। ওর ভালোবাসা আর কেউ পাবে না ভেবেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলাম। ছেলেটাকে ওর কাছে ফেরত পাঠালাম, আমি জানি ও আমাদের ছেলেকে খুব ভালোবাসে, ওর কাছে থাকলে ছেলেটা বেশি ভালো থাকবে। আমাকে গ্রহণ করতে না পারলেও ছেলেকে অস্বীকার করেনি, ভালোবেসে ঠিকই আগলে নিলো বুকে। বছর তিনেক পর সাইপ্রাসের মিটিংয়ে থাকাকালীন হোয়াটস এ্যাপে একটা ক্ষুদে বার্তা এলো…
– কি করো? আমি বার্তা সিন করে মিটিং এ মন দিলাম, আবারও ক্ষুদে বার্তা..
– উত্তর দিচ্ছো না যে।
এরপর একের পর এক বার্তা আসতে শুরু করেছে। সেগুলো দেখে আমার হার্টবিট বেড়ে যাচ্ছে। হাত পা কাঁপছে। এসি রুমে বসেও কপাল বেয়ে ঘাম ঝড়ছে। কোন রেসপন্স না পেয়ে এবার আর বার্তা নয়, সরাসরি কল আসছে। আনন্দে মিটিংয়ে বসে কেঁদে ফেললাম, বললাম, “আমাকে এক্ষুনি দেশে যেতে হবে।
গল্পের বিষয়:
গল্প