ইন্টারে পড়ুয়া ছাত্রীর বাবা নাকি খাদ্য অধিদপ্তরের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। তাই কোনোরকম বাছ-বিচার না করেই বন্ধুর অফার করা টিউশনে রাজি হয়ে গেলাম। ছাত্রীর মায়ের সাথে আমার বন্ধুর ফেবুতে পরিচয়। লকডাউনের কারণে দূরবর্তী চারটা টিউশন অফ ছিলো। তাই মার্চ মাসের ২০ তারিখ থেকেই ছাত্রীকে পড়াতে গেলাম। শহরের আলিশান এক বিল্ডিংয়ের ২য় তলায় ছাত্রীদের ফ্লাট। গেটে ঢুকতেই করোনার ‘ফার্স্ট এইড কিট’ দেখতে পেলাম। সুরক্ষা নিয়ম মেনে ভিতরে ঢুকতেই দারোয়ান অসহায় দৃষ্টিতে বললেন,” দো’তলায় পড়াতে যাও ভালো কথা, বাঁশ খেলে একাই খেয়ও; সাথে আমাকে আবার বাঁশ দিও না!”
দারোয়ানের কথা পাত্তা দিলাম না। অন্য টিউটররা যে এই টিউশনিটা পাওয়ার জন্য দারোয়ানকে ঘুষ দিয়ে রেখেছেন তা বুঝতে আমার বাকি রইল না। ছাত্রীর মা আমার আসার কথা দারোয়ানকে আগে থেকেই বলে রেখেছেন। যেন কোনো জেরা না করেন। কতটা সম্মান আমার! ভাবা যায় এগ্লা! পরিচয় পর্বের আগেই ছাত্রী আমার দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,”শুনেছি আপনার সবগুলো টিউশনেই বিবাহযোগ্যা কন্যা আছে! আমাকে পড়ালে অন্য মেয়েদের বিশেষ করে অতি সুন্দরী মেয়েদের বাদ দিতে হবে। প্রয়োজনে টাকা বাড়িয়ে দেওয়া হবে!” ছাত্রীর বাচনভঙ্গির মধ্যে কিছুটা রহস্যের গন্ধ পেলাম। এ যেন ‘আমারও পরানও যাহা চায়’। সাত-পাঁচ না ভেবেই ছাত্রীর কথায় রাজি হয়ে গেলাম। মনে মনে ইউনুস দোয়া পড়তে লাগলাম ও বন্ধুকে ধন্যবাদ দিলাম এই ভেবে যে, ‘A Friend is Need in a Friend Indeed’
আসলে সেরা চার এইচএসসি পড়ুয়া ‘পূর্ণিমা সুন্দরী’ ছাত্রীদের ১৮ই মার্চ থেকে পড়াই না। মনের কথা মনেই রেখে নতুন ছাত্রীর সাথে ভাব নিলাম। ছাত্রীও মহা খুশি। এগার পদের নাস্তা নিয়ে এসে ছাত্রীর মা রচনা ব্যানার্জীর মতো করে বললেন,’আমার পরী মনিকে সকাল, বিকাল ও রাতে দু’ ঘন্টা করে প্রতিদিন মোট ছয়ঘন্টা পড়াতে হবে।’ হাতের মুঠোয় পাঁচ হাজার টাকা গুজে দিয়ে বললেন,’টাকাটা তোমার যাতায়াত খরচ!’ ‘কিন্তু আন্টি, আমি তো হেঁটেই আসি। ২০ মিনিটের পথ।’ ‘তাতে সমস্যা কি? আমি তোমার মায়ের মতোই!’ বলেই ভিতরে কাচ্চি বিরিয়ানি আনার জন্য রওয়ানা করলেন। আমি অনেক অনুনয়-বিনয় করে সেই যাত্রায় পেট ফাঁটার নিশ্চিত সম্ভবনা থেকে রক্ষা পেলাম!
পড়ানোর এক সপ্তাহ অতিক্রান্ত হলো। ছাত্রীর কথায় শুক্রবারও বাদ দেইনি। ১ম তিনদিন রাজকীয় নাস্তা দিলেও আমার বারণে নাস্তা দেওয়া বন্ধ হলো। নাস্তা খাওয়ার সময় ছাত্রী এমন করে তাকিয়ে থাকে যেন আমি লজ্জায় মুখে নাস্তা তুলতে না পারি। প্রতিদিন ছয়ঘন্টা করে পড়াচ্ছি। আরও কিছু টিউশনি থাকায় সময় ম্যানেজ করা খুবই কষ্টসাধ্য বিষয় ছিলো। তবুও ছাত্রীকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে উচ্চতর গণিত, পদার্থ, রসায়ন, আইসিটি ও ইংরেজি রুটিন মাফিক পড়াতে লাগলাম। এভাবে টানা এক মাসে ছাত্রীর প্রস্তুতি আশানুরূপ হলো। এপ্রিল মাসের ১৫ তারিখ ছাত্রীর বাসায় মা-বাবার তলব পড়লো। ভাবলাম বেতন দেওয়া হবে। কিন্তু নাহ! আন্টি মা-বাবাকে অবাক করে দিয়ে খাদ্য অধিদপ্তরের সহকারী পরিদর্শক হিসেবে লকডাউনের পরে আমাকে জয়েন করার জন্য প্রস্তাব করলেন। এবং খুশিতে অশ্রুজলে ভেসে যাওয়া মায়ের হাতে ২০০০০ টাকা দিয়ে বললেন,”এই সামান্য সম্মানীটুকুন রাখুন। সামনে আরও চমক বাকী আছে!’ আমরা তিনজনই আকাশ থেকে পড়লাম! বিনা ঘুষে সরকারি চাকরির প্রস্তাবের কৃতজ্ঞতাস্বরুপ ইশারায় মাকে টিউশনির টাকাটা আন্টির হাতে ফেরত দিতে বললাম। অনেক জোরাজুরি করার পরে মা-বাবা আন্টির হাতে টাকাগুলো গুজে দিতে সক্ষম হলেন।
আন্টি নাছোড়বান্দা! তিনি হুঙ্কার দিয়ে বললেন,”ঠিক আছে। তবে কথা দিতে হবে, ইদের পরে জুন মাসের ১ম সপ্তাহে স্যারের সকল পাওনা ইদ বোনাসসহ বুঝে নিতে হবে।” ছাত্রীকে নিজের হবু অর্ধাঙ্গীনি ভেবে খুবই লজ্জা পাচ্ছিলাম। আমরা তিনজনই কথা দিলাম। এতোদিন পড়শীরা যে ছাত্রীর পরিবার সম্পর্কে নেতিবাচক কথা বলতো তা সর্বৈব মিথ্যা মনে হলো। আসলে পরশ্রীকাতরতার জন্যই এমন ভালো ও মানবিক পরিবারকে সহজেই যে ‘প্রতারক পরিবার’ বানানো যায়, তা আমার বুঝতে বাকি রইল না!
মে মাসের ২৪ তারিখ পর্যন্ত ছাত্রীকে ৭ ঘন্টা করে মনের মাধুরী মিশিয়ে পড়ালাম। ছাত্রীর সিলেবাস খুবই সুন্দর করে শেষ করলাম। মা-বাবা সমগ্র রোজার মাস ছাত্রীদের দোয়া করার পিছনে ব্যয় করলেন। এমন ভালো মানুষ তারা জীবনের প্রথম দেখেছেন। অথচ দীর্ঘদিন ধরে আমি চমকের আশায় বসে রইলাম। নাহ, ছাত্রীর পরিবার আমাকে এখনো নতুন কোনো চমক দেয় নি। এই দুই মাসে ছাত্রী আমার প্রতি যততটা না সিরিয়াস ছিলো, তার চেয়ে বেশি সিরিয়াস ছিলো সিলেবাস কমপ্লিট করায়। কিন্তু আক্ষেপ, আংকেলকে আজও দেখলাম না! জুনের দুই তারিখ বেতন আনার জন্য ছাত্রীর বাসার উদ্দেশ্য রওয়ানা হলাম। গেটেই দারোয়ান আমাকে থামিয়ে দিলো। বললো, ছাত্রীরা পাঁচদিন আগেই বাসা ছেড়ে চলে গেছেন। কোথায় গেছেন তা কেউই বলতে পারে না। বিল্ডিংয়ের ম্যানেজারও না। বন্ধুকে কল দিলাম। সে থানায় গেছে প্রতারণার মামলা করতে। ছাত্রীর মা তার থেকে ৫০০০ টাকা ধার নিয়েছিলো।
আমি বার বার মূর্ছা যাচ্ছিলাম। দারোয়ান আমার চোখেমুখে পানি দিয়ে জ্ঞান ফেরাচ্ছেন। বিশ্বাস করেন রাসেল ভাই, দারোয়ান আংকেল সবচেয়ে বড় চমক দিয়ে আমার হাতে একটা চিরকুট ধরিয়ে দিলেন! চিরকুটে ছাত্রী গোটা গোটা অক্ষরে লিখেছে,” ভালো থাকবেন চাচাজান। নিজের মেয়ের মতো পড়িয়ে সম্পূর্ণ সিলেবাস শেষ করিয়ে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।”
গল্পের বিষয়:
গল্প