দ্বিতীয়া

দ্বিতীয়া
– আপনার বয়স কত?
– বায়োডেটাতে তো লেখা ছিল। বিয়াল্লিশ।
– জ্বি, ছিল। ওটা আপনার সার্টিফিকেটের এজ? নাকি অরিজিনাল?
– অরিজিনাল।
– আমি অবশ্য আরেকটু কম চাচ্ছিলাম।
লোকটার মাথায় বিশাল টাক। ইয়া ভুড়ি। বুকের পাকা লোম দেখা যাচ্ছে। বৌ মারা গেছে। চার ছেলেমেয়ে। দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। সে চায় কীনা কচি বৌ। আজব! এদেশের পুরুষমানুষরা নিজেদেরকে কী ভাবে?
– কেন? আপনার বয়স কত?
– আটান্ন।
– তবু কম চান?
– জ্বি, মানে কম হলে ভালো হয় আর কি। না হলেও চলবে। লতা ভেতরে ভেতরে রাগে ফুঁসছে। তবে মুখে সে কিছুই বলল না। লোকটা এবার নরম সুরে কথা বলছে।
– আপনি চাকরি করেন, এটা ভালো। খুব ভালো।
– কেন?
– মেয়েদের স্বাবলম্বী হওয়াটা জরুরি। তাছাড়া এটা একটা বিরাট এ্যাডভান্টেজ। আমি শিঘ্রী রিটায়ার করব। বোঝেনইতো।
লোকটা তো বিরাট লোভী! বিয়ের পর সে নির্ঘাত লতার সব টাকাপয়সা নিয়ে নিবে। এই লোককে বিয়ে করা কি ঠিক হবে?
– আপনার তো ডায়াবেটিস আছে।
– জ্বি, আছে।
– তাহলেতো আপনার সুগার লেভেল ঠিক রাখতেই আপনার বৌয়ের জান বেরিয়ে যাবে।
লতা তার মেজো খালা এবং বড় ভায়ের উপর ভীষণ বিরক্ত। লতার আপত্তি থাকা সত্ত্বেও তারা একটার পর একটা বিয়ের সম্বন্ধ আনতেই আছে। বাধ্য হয়ে আজ সে আবার এসেছে আরেক পাত্রের সাথে দেখা করতে। লোকটা পুলিশ অফিসার। বৌ তাকে তালাক দিয়ে চলে গেছে। দুই ছেলে আছে। তারা থাকে মায়ের সাথে। নির্ঝঞ্জাট সংসার। লতা আরামে থাকবে।
– আমার মা ধার্মিক মেয়ে পছন্দ করেন। আপনি নিয়মিত নামাজ পড়েন তো?
– জ্বি।
– বিয়ের পর বোরখা পরতে হবে। আমার মায়ের দেখাশোনা করতে হবে।
– জ্বি, অবশ্যই।
– আর একটা কথা। বিয়ের পর কিন্তু আপনি আর চাকরি করতে পারবেন না। আল্লাহ দিলে আমার কোনকিছুর অভাব নেই। আপনার কোন অসুবিধা হবে না।
– একথা তো আপনি আগে বলেননি।
– কেন? চাকরি ছাড়তে আপনার আপত্তি আছে?
– জ্বি, অবশ্যই। ধরুন বিয়ের পর আপনার সাথে আমার বনিবনা হলোনা। তখন আমি চলব কীভাবে?
লোকটা একটু ক্ষুন্ন হলো। এতটা স্ট্রেইট ফরোয়ার্ড কথা বোধহয় সে আশা করেনি।
– আপনার আগের স্ত্রীর মোবাইল নাম্বার আপনার কাছে আছে?
– জ্বি, আছে। কেন বলুন তো?
– কথা বলব। বলে জানব, কেন তিনি আপনাকে ডিভোর্স দিয়েছেন।
আজ তৃতীয় পাত্রের সামনে বসে আছে লতা। রেস্টুরেন্টে বেশ ভীড়। এই লোকটা ফুড অফিসার। অঢেল টাকাপয়সা। সেইই স্ত্রীকে তালাক দিয়েছে। বৌ দেয়নি। এক ছেলে এক মেয়ে রেখে বৌ চলে গেছে বাপের বাড়ি। কফি খেতে খেতে কথা হচ্ছিল। একপর্যায়ে লোকটা আসল কথা বলেই ফেললো।
– আপনার বাচ্চা কার কাছে থাকবে?
– আপনার বাচ্চারা কার কাছে থাকে?
– এটা কেমন প্রশ্ন হলো?
লতার খুব রাগ হচ্ছিল। বাবারা দ্বিতীয় বিয়ে করলেও সন্তান কাছে রাখতে পারবে। কিন্তু মেয়েরা পারবে না। সন্তানকে রেখে স্বামীর ঘরে যেতে হবে। কেন? তারা মেয়ে বলে? লতা খুব হতাশ হলো। সে ভেবেছিল, এই লোকটার যেহেতু টাকার অভাব নেই, তাই সে হয়তো লতার মেয়েকে সাথে রাখতে রাজী হবে। লতা আড়চোখে লোকটাকে একবার দেখে নিল। ইনি জয়নুল সাহেব। একটা বেসরকারি কলেজের ফিজিক্সের শিক্ষক। লোকটা মনে হয় কথা কম বলে। সেই থেকে মাথা নীচু করে বসে আছে। মনে হচ্ছে, কী বলবে, সে ঠিক বুঝতে পারছে না।
– দেখুন, আমার মেয়েরা আমার খুব ক্লোজ। বিয়েটা করতে চাচ্ছি নিতান্ত বাধ্য হয়ে। দু’বছর আগে এ্যাক্সিডেন্টে আমার স্ত্রী মারা গেছেন। নাহলে..।
– মেয়েরা রাজি?
– আগে রাজি ছিল না। এখন রাজি।
– মেয়েরা কতবড়?
– বড়টা ক্লাস সেভেনে পড়ে। ছোটটা থ্রিতে। আপনার আর কিছু জানার থাকলে এখনই জিজ্ঞেস করুন। প্লিজ।
– আমার সম্পর্কে আপনার কিছু জানার নেই?
– জ্বি না। আমার যা জানার ছিল, আমি জেনে নিয়েছি।
– কার কাছ থেকে জেনেছেন?
– সেটা বলতে চাচ্ছি না। তবে বিশ্বস্ত লোকের কাছেই জেনেছি। বোঝেনই তো। মা মরা দু’টো মেয়ে আমার। যার তার হাতে তো ওদেরকে তুলে দিতে পারিনা।
– আপনার কেন মনে হচ্ছে, ওরা আমার কাছে ভালো থাকবে?
– আমার ইনটিউশন তাই বলছে। অবশ্য মানুষের প্রেডিকশন সব সময় ঠিক হয়না।
লোকটাকে লতার বেশ পছন্দ হয়েছে। কারণ সে লতা সম্পর্কে তেমন কিছুই জানতে চায়নি। নিজের কথাই শুধু বলার চেষ্টা করেছে, যাতে লতা তাকে পছন্দ করে। লোকটার স্ত্রী যেহেতু হঠাৎ মারা গেছে, সেহেতু প্রিয় মানুষ হারানোর কষ্ট সে জানে। তাই সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্য তার দিক থেকে আন্তরিক চেষ্টা থাকবে। ফলে লোকটার সাথে মানিয়ে চলা সহজ হবে।
তাছাড়া জয়নুলের ডিভোর্স হয়নি। ডিভোর্স হলে তার সাথে অবধারিতভাবে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা জড়িত থাকে। লতার নিজের বেলাতেও তাই ঘটেছে। যেদিন লতা প্রথম জানতে পারে যে, তার স্বামী পরকীয়া করছে, সেদিন থেকে ডিভোর্স পর্যন্ত প্রতিটা দিন তার চরম অশান্তিতে কেটেছে। সেকারণে শেষমেষ যেদিন ওর ডিভোর্স হয়েই গেল, সেদিন ও একটুও কাঁদেনি। বরং নিজেকে ওর নির্ভার লাগছিল। মনে হচ্ছিল, বুকের উপর থেকে ভীষণ কষ্টের একটা ভারি পাথর সরে গেল। লতার বাবা মারা গেছেন। বড় ভাই চাকরি করে শিক্ষা বোর্ডে। মা থাকে তার সাথে। আরেক ভাই ঢাকায় থাকে। লতার ছোটবোনের বিয়ে হয়েছে সাতক্ষীরা। মেয়ে দোয়াকে নিয়ে লতা থাকতো ওর মায়ের ঘরে। লতার ভাবী মনে মনে বিরক্ত। ঝামেলা কে চায়? আমাদের সমাজে সব অদ্ভুত নিয়ম। ছেলেরা দিব্যি বাবার বাড়িতে থাকতে পারবে। মেয়েরা পারবে না। কেন? তারা কী বাবামার সন্তান নয়?
লতার মা এবং ভাইয়েরা এ বিয়েতে তেমন খুশি হলোনা। কারণ লতা সরকারি কলেজের শিক্ষক হয়ে বিয়ে করছে বেসরকারি কলেজের শিক্ষককে। মেয়েকে সাথে রাখতে পারবেনা, এটা জানার পরেও লতা বিয়েটা করলো অনেক ভেবেচিন্তে। লতা খুব ভালো করেই জানে যে, তার মা মারা গেলে তার ভাইয়েরা তাকে দেখবে না। তখন মেয়েকে নিয়ে লতা যাবে কোথায়? আলাদা বাসায় দোয়াকে একা রেখে সে কলেজ করবে কীভাবে? স্বামীর বাড়িতে তার নিজের জায়গা শক্ত হলে একসময় সে মেয়েকে নিয়ে আসবে। বাসরঘরে বসে ঘরের চারদিকে তাকিয়ে লতা দেখলো, ঘর খুব নোংরা। ফার্নিচারে ধুলা জমে আছে। দেয়ালে ঝুল। জানালার পর্দা ময়লা। খাটের উল্টোদিকে পলি আর জয়নুলের বিয়ের একটা বাঁধানো ছবি ঝুলছে। সেটাতেও ময়লা লেগে আছে। একে একে আত্মীয়রা সবাই এসে নতুন বৌয়ের সাথে দেখা করে যাচ্ছে। ক’জন প্রতিবেশীও এসেছে। কিন্তু মেয়েদুটো তার কাছে আসছে না। ছোট মেয়ে মনি দরজার পর্দার পিছনে দাঁড়িয়ে লুকিয়ে একবার তাকে দেখে গেল। বাসরঘরে ঢুকে জয়নুল লতার দিকে তাকালো।
– বুঝতে পারছি, মেয়ের জন্য তোমার খুব মন খারাপ লাগছে। সম্ভব হলে ওকে আমি সাথে নিয়ে আসতাম। আমার মা রাজি না। আসার সময় দোয়ার জন্য লতার খুব কষ্ট হচ্ছিল। দু’জনে জড়াজড়ি করে হাউমাউ করে কেঁদেছে। সারাপথ সে চোখের পানি মুছেছে।
– কেন?
– ওটা শোভন দেখায় না। তাছাড়া মার ধারণা, ওকে আনলে তুমি ওকে নিয়েই ব্যস্ত থাকবে। মায়া-মনির দেখাশোনা ঠিকমতো করবে না।
– শুধু মায়ের ধারণা?
আগে যে লতা দোয়াকে রেখে কোথাও যায়নি, এমনটা নয়। যখন সে এমফিল করছিল, তখন মাঝে মাঝেই দোয়াকে রেখে সে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে গিয়ে থাকতো। কাজ হয়ে গেলেই আবার চলে আসতো। তখন দোয়া বুঝতো, মা কাজে গেছে। কাজ হয়ে গেলেই আবার চলে আসবে। এখন তো তা হবেনা।
বদলি না হওয়া পর্যন্তই লতা মেয়ের সাথে থাকতে পারবে। প্রতি রবিবার ভোরবেলা রওনা দিয়ে গিয়ে কলেজ করে বাবার বাড়ি যাবে। আবার বৃহস্পতিবার কলেজ করে বিকেলে শ্বশুরবাড়ি ফিরে আসবে। বদলি হয়ে স্থায়ীভাবে শ্বশুরবাড়ি চলে এলেই তার বাবারবাড়ি আর তেমন যাওয়া হবেনা। তখন দোয়ার সাথেও আর নিয়মিত দেখা হবেনা।
লতা মনে মনে খুব চাচ্ছে, বদলি হওয়ার আগেই যদি সে কোনভাবে এ বাড়ির সবার মন জয় করতে পারে, তাহলে হয়তো সে দোয়াকে তার কাছে আনতে পারবে। কিন্তু কীভাবে? সে রাতদিন ভাবছে। বিয়ের পরেরদিন সকালবেলা নাস্তার পর লতা মায়া আর মনিকে নিজের ঘরে ডাকলো।
– আমাকে তোমাদের পছন্দ হবেনা, এটাই স্বাভাবিক। পৃথিবীর কোন বাচ্চা তার সৎমাকে পছন্দ করেনা। করতে পারেনা। তবে তোমাদের বাবার কোন দোষ নেই। তোমাদের মা বেঁচে থাকলে সে আমাকে আনতো না। মেয়েরা চুপ। তারা লতার মতলব বোঝার চেষ্টা করছে।
– আমি খুব অসহায়। আমার থাকার কোন জায়গা নেই। তাই এসেছি। তোমরা দয়া করে আমাকে এ বাড়িতে একটু থাকতে দিও। কথা দিচ্ছি, আমি তোমাদেরকে কোন কষ্ট দিবনা। মেয়েরা গম্ভীর মুখে লতাকে দেখছে। ওদের চোখেমুখে সন্দেহ। লতা ওর হাতে ধরে রাখা বাক্সটা খুললো।
– এগুলো সব তোমাদের মায়ের গয়না। আমি আর কখনো এগুলো পরব না। আলমারিতে তুলে রেখে দিচ্ছি। এগুলো তোমাদের। তোমার মায়ের সব শাড়ি যেমন আছে, তেমনি থাকবে। তোমরা বড় হলে পরবে। কেমন? মেয়েরা লতার কথা শুনে খুব অবাক হলো। মনি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। মায়া ওকে সামান্য ধাক্কা দিয়ে থামিয়ে দিল।
– এখন শোন মায়েরা। তোমরা আজ আমার একটা কাজ করে দেবে।
– কী কাজ?
– তোমাদের দু’জনের পুরাতন বই-খাতা, যেগুলা তোমাদের আর লাগেনা, সেগুলা বেছে আলাদা করে দেবে। আমি তোমাদের ঘর পরিষ্কার করব। ঠিকআছে? কাজের মেয়েকে সাথে নিয়ে লতা গোটা বাড়ি ঝেড়ে মুছে পরিষ্কার করলো। বাথরুমগুলো খুব ভালো করে পরিষ্কার করলো। অপ্রয়োজনীয় সব জিনিস ফেলে দিয়ে বাড়ি সুন্দর করে গুছিয়ে ফেললো। দুপুরে খাওয়ার পর লতা স্বামীর বিছানায় না শুয়ে ছোট গেস্টরুমটাতে শুলো। তারপর দুই মেয়েকে ডাকলো।
– তোমাদের পুরনো যত এ্যালবাম আছে, সব নিয়ে এসো। আজ আমরা ছবি দেখব। তোমরা আমাকে চিনিয়ে দেবে কে কোনটা। কেমন? মনি খুশি হয়ে দৌড় দিল। ছোট-বড় মিলিয়ে গোটা ছ’য়েক এ্যালবাম নিয়ে এলো। মনি মহা উৎসাহে ছবি দেখাতে লাগলো।
– এটা মা। এটা ছোট খালা। এটা নানী। এটা মেজ ফুপি….!
কয়েকদিন পর জয়নুলকে সাথে নিয়ে লতা বাজার থেকে কিছু জিনিস কিনে আনলো। চারটা বেডশিটের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর চাদরটা পেতে দিল শ্বাশুড়ির বিছানায়। বাচ্চাদের ঘরে গাঢ় গোলাপী চাদরটা দিল। গেস্টরুমে দিল এ্যাপলিকের চাদর। আর নিজের ঘরে পাতলো হালকা রঙেরটা। সব ঘরে, টয়লেটের সামনে, দরজার বাইরে নতুন পাপোষ দিল। পুরাতন পর্দা বদলে নতুন পর্দা কিনলো। বাচ্চাদের ঘরের জন্য একটা কাঠের বুকশেলফ আনলো।
আর একদিন একা বাজারে গিয়ে লতা কিছু ছবি বাঁধাই করতে দিল। সেখানে পলির কলেজে পড়ার সময়কার একটা সাদাকালো ছবি আছে। খুব সুন্দর। সেটাকে বড় করে একটা সুন্দর ফ্রেমে বাঁধাতে দিয়েছে। ছবিটা সে মেয়েদের ঘরে টানাবে। আর ওদের চারজনের ফ্যামিলি ফটোটা রাখবে বসার ঘরে।
লতা সেদিন একটা বেতের দোলনা কিনে আনলো। বারান্দায় দোলনাটা ঝুলিয়ে দেবার পর মেয়েরা মহাখুশি! রোজ দুপুরে লতা মনিকে নিয়ে গেস্টরুমে শোয়। গল্প করে। নানান কথার মধ্যে দিয়ে মেয়েদের পছন্দ, মানসিকতা বোঝার চেষ্টা করে। ওদের প্রিয় খাবার কী কী, তা জেনে নিয়ে সেগুলো রান্না করে। মাঝে মাঝে কিনেও আনে। বাঁধানো ছবি পেয়ে মেয়েরা খুব খুশি হলো। বেশি আদর পায় বলে বাচ্চারা এমনিতেই নানারবাড়ির খুব ভক্ত হয়। আর মা-মরা বাচ্চাদের নানার বাড়ির প্রতি টান আরও বেশি থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। তার উপর পলির কবর আছে ওদের নানার বাড়িতে।
– শেষ কবে গেছিলে?
– অনেকদিন আগে।
– মাকে দেখতে না গেলে মা মন খারাপ করবে না?
– বাবা সময় পায়না।
– বেশ। সামনে শুক্রবার তোমরা যাবে। আমি তোমাদের বাবাকে বলে দেব।
লতা সকালবেলা বড় একটা কেক বানিয়েছে। কেকটা ছোট ছোট টুকরা করে সে একটা প্লাস্টিকের বক্সে ভরে একটা বড় ব্যাগে রাখলো। ব্যাগটা মায়াকে দেখালো।
– এখানে তোমার নানীর জন্য একটা শাড়ি, কিছু ফল, ডায়াসল্ট বিস্কিট, কেক আর কিছু চকলেট আছে। ব্যাগটা তোমার নানির হাতে দেবে। কেমন? আস্তে আস্তে এই পরিবারের লোকেদের সাথে লতার ঘনিষ্ঠতা যত বাড়তে লাগলো, দোয়ার জন্য লতার কষ্ট তত বেশি হতে লাগলো। সে রাতদিন মনে মনে শুধু এই প্রার্থনাই করতে লাগলো যে, দোয়াকে যেন সে এ বাড়িতে আনার অনুমতি পায়।
লতা শ্বাশুড়ির খুব সেবা করে। রোজ ভোরবেলা উঠে আগে শ্বাশুড়িকে চা আর টোস্ট বিস্কিট দেয়। তারপর সে রান্না বসায়। বাচ্চাদের জন্য রোজ নতুন নতুন টিফিন বানিয়ে দেয়। সন্ধ্যাবেলা দুই মেয়েকে পড়ায়। ছুটির দিনগুলোতেতে শ্বাশুড়িকে যত্ন করে গোসল করিয়ে দেয়। চুলে তেল দিয়ে দেয়। আঁচড়ে দেয়। শ্বাশুড়ির কাছে রান্না শেখে। মাঝে মাঝে দুই ননদ ও ওদের বাচ্চাদের জন্য খাবার, কাপড়চোপড় জয়নুলের হাত দিয়ে পাঠায়। জয়নুল খুব খুশি। তার পরিবারের জন্য লতার এতটা আন্তরিকতা সে আশা করেনি। লতার বদলি হয়েছে। তবে সে দোয়াকে তার কাছে আনার অনুমতি পায়নি। রোজ অনেকবার সে লুকিয়ে মেয়ের সাথে কথা বলে। আর মেয়েকে সান্ত্বনা দেয় এই বলে যে, সে খুব তাড়াতাড়ি তার কাছে যাবে। প্রতিটা মুহূর্ত সে দোয়াকে মিস করে। মেয়েকে ছেড়ে থাকতে তার খুব কষ্ট হয়। কিন্তু কিছু করতে পারেনা। কিছুদিন পর একদিন হঠাৎ শ্বাশুড়ি খুব অসুস্থ হয়ে পড়লেন। গ্যাস্ট্রিকের কারণে তার বুকে-পিঠে অসম্ভব ব্যথা। অস্বস্তি। দম ফেলতেও কষ্ট। হাতপা ছেড়ে দিয়ে সে বিছানায় পড়ে গেল।
– আমার ছেলেকে ডাকো। আমার কেমন যেন লাগছে।
– খবর দিয়েছি মা। আসছে। আপনি একটু শান্ত হোন।
লতা তাকে গ্যাসের লিকুইড সিরাপ দিয়েছে। তবু কাজ হচ্ছে না। সে তাড়াতাড়ি মাথায় পানি ঢালছে। ডাক্তারকে খবর দেয়া হয়েছে। এখনও আসেনি। মায়া আর মনি দাদির হাতে-পায়ে তেল মালিশ করছে। রাতে মনিকে মায়ার ঘরে পাঠিয়ে লতা শ্বাশুড়ির কাছে শুলো। বলা যায়না, রাতে আবার অসুস্থ্য হয়ে গেলে বিপদ! প্রায় সারারাতই লতা জেগে থেকে শ্বাশুড়ির খেয়াল রাখলো। ধরে ধরে নিয়ে গিয়ে টয়লেট করিয়ে আনলো। মাথায় বাম লাগিয়ে দিয়ে ঘুম পাড়ালো। ভোরবেলা লতা উঠে যাচ্ছিল। শ্বাশুড়ি তাকে ডাকলেন।
– বৌমা শোন।
– জ্বি মা। বলেন।
– তুমি তোমার মেয়েটাকে নিয়ে এসো। আমার কোন আপত্তি নেই। খুশিতে লতা কেঁদে ফেললো। কলেজে গিয়ে সে মাকে ফোন করলো।
– মা, দোয়া কোথায়?
– বাইরে খেলছে। আমি তোর দাদার বাড়ি এসেছি। ধান তুলতে। চার-পাঁচদিন পর ফিরে যাব। কেন?
– মা, একটা ভালো খবর আছে।
– কী খবর?
– আমার শ্বাশুড়ি দোয়াকে নিয়ে আসতে বলেছে।
– তাই নাকি? অনুমতি দিল?
– হ্যাঁ। আমি সামনে সপ্তাহে যেয়ে ওকে নিয়ে আসব।
– জামাই রাজী তো?
– হ্যাঁ মা। সেও রাজি।
সেদিন দুপুরবেলা সেলাই মেশিনে বসে লতা দোয়ার জন্য একটা ফ্রক বানাচ্ছিল। সুতি নরম কাপড়ের। পরে আরাম পাবে। ঠিক তখনই তার মোবাইলটা বেজে উঠল।
– লতা, তাড়াতাড়ি রেডি হও। আমরা তোমার দাদার বাড়ি যাব।
– হঠাৎ? কেন?
জয়নুল তাকে পরিষ্কার করে কিছুই বলল না। বাসার সামনে মাইক্রো এসে থামলো। জয়নুল তাকে একরকম জোর করেই গাড়িতে তুললো।
– কার কী হয়েছে, বলবে তো? মার শরীর খারাপ?
– না। দোয়া একটু অসুস্থ। জ্বর। আগে চল। গেলেই সব জানতে পারবে।
লতার মন বলছিল, ভয়ানক কিছু হয়েছে৷ সারাপথ জয়নুল গম্ভীর হয়ে থাকলো। লতাকে ফোন করতেও দিলনা। দাদার বাড়ি পৌঁছে লতা দেখলো, দোয়াকে কাফন পরিয়ে খাটিয়ায় শুইয়ে রাখা হয়েছে। সাঁতার জানতো না। পুকুরে ডুবে সাত বছরের মেয়েটা মারা গেছে। লতা চিৎকার করে কেঁদে উঠল। সে তখন পাগলপ্রায়। তার বিলাপ করে কান্না দেখে গ্রামের লোকেরাও চোখের পানি মুছছে। জয়নুলের খুব অনুশোচনা হচ্ছিল। মায়ের কথা না শুনে মেয়েটাকে লতার সাথে নিয়ে এলে হয়তো এমনটা ঘটতো না। আমাদের সমাজ খুব নিষ্ঠুর। সব অমানবিক নিয়মগুলো করে রেখেছে মেয়েদের জন্য। নানা নিয়মের বেড়াজালে বেঁধে সমাজ তাদেরকে দূর্বল করে রাখে।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত