অদৃশ্য মায়াজাল

অদৃশ্য মায়াজাল
আমি তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। রাফসান ভাইয়ের সাথে হুট করেই আমার পরিচয় হয়েছিল ডিপার্টমেন্ট এর এক অনুষ্ঠানে। সেদিন তিনি নীল পাঞ্জাবীর সাথে সাদা পাজামা পরে অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেছিল । সাথে ছিল হাফসা আপু। রাফসান ভাইয়ের বান্ধবী। অদ্ভুত হলেও হাফসা আপু সেদিন রাফসান ভাইয়ের সাথে মিল রেখে নীল শাড়ি পড়েছিল ।সেদিনই আমি আঁচ করেছিলাম তাদের মধ্যে খুব ভালো একটি সম্পর্ক আছে। হয়তো বন্ধুত্বের চেয়েও বেশি কিছু । তার কদিন পর রাফসান ভাই তার রুমে আমায় ডেকেছিল। রাজনীতি করার সুবাদে তার সাথে আমার ভাব হতে বেশি সময় লাগেনি। প্রাণখোলে কথা বলতাম তাদের সাথে । আমি দুবছরের জুনিয়র হলেও খুব ভালোভাবে মিশতে পেরেছিলাম । বিহেভিয়ার, এটিটিউড নতুন করে রপ্ত করেছিলাম তাদের কাছ থেকে । সম্ভবত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর এটাই ছিল আমার প্রথম শিক্ষা।
রাফসান ভাইয়ের থেকে আরেকটা জিনিস বেশ ভালোভাবে শিখেছিলাম , টার্গেট । তিনি সবসময় বলতো, -“সৌরভ, টার্গেটে কখনো অপশন রাখবি না। টার্গেট শুধুমাত্র টার্গেটই থাকবে। টার্গেটে অপশন থাকলে কখনও সেখানে হান্ড্রেড পার্সেন্ট কনসেন্ট্রেশন দেওয়া যায় না। যে কারনে সফলতার কাছে গিয়েও ব্যর্থ হতে হয়। ” সিগারেট টানতে টানতে এই উপদেশমালা এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্য কান দিয়ে বের করে দিতাম আমি। গায়ে মাখানোর সময় পেতাম না তখন ।ইচ্ছে করতো না, দমিয়ে রাখতাম।কথাগুলো উপলব্ধি করতে আমার বেশ সময় নিয়েছিল ।
আস্তে আস্তে বুঝতে পারি রাত দিন এক করে পড়াশোনা করে রাফসান ভাই। হাফসা আপুও কম কিসে! বিসিএসের জন্য দুজনই মরিয়া হয়ে পড়েছে ! বিবিএ শেষ না হতেই তাদের পড়াশোনা এরকম সিরিয়াস কাণ্ড দেখে আমি হতবাক হয়ে যেতাম মাঝে মাঝে । অন্তত এতটা সিরিয়াসে কাউকে পড়তে আমি দেখিনি তখন পর্যন্ত।
সবে দ্বিতীয় বর্ষে পদার্পণ করেছি তখন । একদিন ক্লাসের মধ্যে একটি অপ্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে একজন সিনিয়র শিক্ষকের সাথে আমার কথা কাটাকাটি হয়। আমি এখনও ভেবে পায় না সেদিন আমার কি হয়েছিল ! একথা – ওকথার মাধ্যমে বিষয়টি ধীরেধীরে জটিল হচ্ছিলো। একসময় বিরক্ত হয়ে স্যার ক্লাস থেকে আমায় বের করে দেয়। ঘটনাটি পুরো বিশ্ববিদ্যালয় ছড়তে খুব বেশি সময় লাগেনি। তার পরদিন কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে -“শিক্ষকের সাথে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রের অসদাচরণ” শিরোনামে খবরটি প্রকাশিত হয়েছিল। সাথে পাশাপাশি স্যার ও আমার দুজনের ছবি ছাপা হয়। বিষয়টি যে আমার হাতের বাইরে চলে গেছে তা বুঝতে আমার একটুও অসুবিধে হলো না। রাফসান ভাই তখন তার মায়ের চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে ছিল। তাই একটু বেশি অস্বস্তি অনুভব করেছিলাম ।
সেদিন দুপুরে প্রচণ্ড রোদের মধ্যে কেন্দ্রীয় ক্রিকেট মাঠে আমাকে তিনঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রেখেছিল হাফসা আপু। শাস্তিটি আমার জন্য মোটেও কষ্টদায়ক হতো না যদি না আপুর চোখের অশ্রুধারার বাঁধ না ভাঙ্গতো। আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে, আমাকে কাঠখোট্টা রোদে দাঁড় করিয়ে রাখার পুরোটা সময় আপু কেঁদে ভাসিয়েছিল। আমি প্রচণ্ড বিস্মিত হয়েছিলাম সেদিন। নীরব ক্রন্দনে অশ্রুগুলো রোদের আলোই ঝলমল করছিল। সেদিন প্রথম বারের মতো উপলব্ধি করেছিলাম রক্তের বন্ধনহীন কারও জন্য অশ্রু ফেলাটাই নিঃস্বার্থতা। এই স্বার্থহীন অশ্রুগুলো কখনোই মূল্যহীন নই , হতে দেওয়া যায় না । বরং স্বার্থতার আড়ালেই মূল্যহীনতা গড়ে উঠে । সাদা পৃথিবীর সবকিছুরই যদি স্বার্থতা থাকতো তবে ভালোবাসা নামের কোনো অনুভূতি থাকতো না। সেদিন আপু আমার সাথে শুধু একটি কথাই বলেছিল, – “স্যারকে স্যরি বলবি । আমার সাথে আয়।” আপুর পিছুপিছু স্যারের রুমে গিয়ে স্যরি বলেছিলাম। আপুও মাথা নিচু করে বারবার আমার হয়ে স্যারের কাছে ক্ষমা চেয়েছিল এবং অনুরোধ করেছিল বিষয়টি সমাধান করে দিতে।
ফেরার সময় আমার সাথে একটা কথাও না বলে চোখ মুছতে মুছতে বাসায় চলে গিয়েছিল আপু। সেদিন সত্যি সত্যি আমার উপলব্ধি গুলো ছেয়ে গিয়েছিল অনুভূতির আড়ালে। প্রত্যক্ষ অনুধাবনে আমার মস্তিষ্ক বেশ বিকম্পিত হয়েছিল সে শিক্ষায় ।প্রকৃতপক্ষে আপু যখন বারবার মাথা নত করে আমার হয়ে স্যারের কাছে ক্ষমা চাচ্ছিল আমার তখন মড়ে যেতে ইচ্ছে হয়েছিল। আমার জন্য আপুকে অপদস্থ হতে হয়েছিল, ভাবনাটা এখনও ভীষণভাবে পীড়া দেয় আমায়। এখনও বিষয়টি ভাবলে কাতর হয়ে উঠি । বস্তত বিষয়টি বহিষ্কার পর্যন্ত চলে গিয়েছিল যা কি আমার নিজেরও ধারনার বাইরে ছিল। সে যাত্রাই বেঁচে গেলেও আপুর কাছ থেকে ক্ষমা পেতে আমার বেগ পেতে হয়েছিল বেশ। রাগ যুক্তি দিয়ে ভাঙ্গানো যায়, কিন্ত অভিমান যুক্তির দ্বার দাড়ে না। সেদিনের অধিকারবোধে আপুর মাঝে আমি আমার অভিভাবকত্বকে আবিষ্কার করেছিলাম।
এমবিও শেষে যখন রাফসান ভাই ডিপার্টমেন্টের সর্বোচ্চ সিজিপিএ নিয়ে বের হলো, আমি মোটেও অবাক হয়নি তখন। আমি ধরেই নিয়েছিলাম রাফসান ভাই প্রথম হবে আর হাফসা আপু তৃতীয়। তাই বিচলিত হবার কারন ছিল না । সেদিন সন্ধায় রাফসান ভাইয়ের বাসায় গিয়ে উঠলাম। তাদের দুতলা বাসাটার নিচ তলায় রাফসান ভাই তার মাকে নিয়ে থাকতেন। বছর তিনেক আগে তার বাবা গত হয়েছে। উপর তলাটা ভাড়া দেওয়া ছিল এক দম্পতির কাছে । দম্পতি বললে ভুল হবে। একটি আস্ত পরিবার। সে দম্পতির তিন মেয়ে অবন্তি, আইশা, আইমা নিয়ে তাদের পরিবার। বড় মেয়ে অবন্তি আমার এক বছরের জুনিয়র ছিল। দেখতে বেশ ভালো। আমার সাথে তার ভাব মাত্র শুরু হয়েছে তখন । মূলত অবন্তির জন্যই ঘনঘন রাফসান ভাইয়ের বাসায় আমার হানা দেওয়া ।ব্যাপারটা ভালোভাবেই বুঝতো রাফসান ভাই।
সেদিন সন্ধায় রাফসান ভাইয়ের বাসায় গেলে আন্টি আমায় দেখে অনেক খুশি হয়েছিল। নিমিষে কিছু একটা মনে হতেই মুখটা গম্ভীর করার ভাব করে ধমকে বললো -” হ্যাঁ রে সৌরভ, তুই নাকি ইদানীং অবন্তির সাথে লাইন মারার চেষ্টা করছিস ?” আমি প্রচণ্ড আশ্চর্য হবার ভান করে বললাম “অবন্তিটা কে ?” আন্টি যেন আকাশ থেকে পড়লো আমার কথায় । চোখ রাঙ্গিয়ে বলেছিল -“ন্যাকা , কিছু জানে না! ” আমি সশব্দে হেসেছিলাম তখন। সেদিন আন্টির সাথে আমার কথোপকথন আমায় অনেক আলোচিত করেছিল।কিছু আচরণ একজন ব্যক্তিকে পরিবারে আসন করে দেয়, আপন করে নেয়। নয়তো সে হারিয়ে যায়। পরিবারের সাথে সম্পর্ক গুলো কখনোই ছিন্ন হয় না। সেটা হোক নিজের পরিবার বা অন্যের। মনের কোণে ঘাপটি মেরে বসে থাকে জীবনের প্রতিটি স্মৃতি । এই যে এতবছর পরও আমি তাদের কথা লিখছি , তাদের কথা ভাবছি !
কিভাবে জানি না, রাফসান ভাই আর হাফসা আপুর কাছে আমি অনেক বিশ্বস্ত হয়ে গিয়েছিলাম । সম্ভবত আমার প্রতি তারা সদয় ছিল বলেই সেটা সম্ভব হয়েছিল। আমার যেকোনো প্রয়োজনে সবার আগে তাদের বলতাম। আমার টাকার দরকার হলেও হাফসা আপুকে ফোন করে বলতাম- ” এতদিনের মধ্যে আমার এত টাকা প্রয়োজন ।” আপু কখন, কিভাবে তা জোগাড় করবে তা একদমই শুনতে চাইতাম না আমি। পরে দেখা যেত আপু ঠিক সময়ের মধ্যেই তা দিয়ে দিয়েছে ।এখন এই বিষয়গুলো ভাবলে বড় আশ্চর্য হই আমি। তারা আমাকে কতটা প্রশ্রয় দিয়েছিল তখন ! অন্য কেউ কি এরকম করতো ? সময় খুব তাড়াতাড়ি অতিবাহিত হয়। কিন্ত আমাদের সম্পর্কের ভাটা পড়েনি। কয়েকবছর পর আমাদের সবাইকে অবাক করে দিয়ে রাফসান ভাই প্রশাসনে ক্যাডার হয়ে গেল আর হাফসা আপু কাস্টমসে ! দুজনে একসাথে ক্যাডারভুক্ত হওয়াটা আমার কল্পনার বাইরে ছিল! তাও প্রথম চান্সে !
সেদিন সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছিলাম সম্ভবত আমিই । খুশিতে রাফসান ভাইয়ের ঘাড়ে চরে বসেছিলাম। এখন সেসব কথা মনে হলে দারুণ হাসি পায় আমার। গ্লানিকর হাসি। তার দুমাস পরই রাফসান ভাই আর হাফসা আপুর ঘটা করে বিয়ে হয়েছিল। দুইপ্রান্তের কিছু অনুভূতির একত্রিত হয়েছে ! সাথে কিছু দায়িত্ববোধ ও অদৃশ্য মায়াজালে আমি!
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত