-শিহাব কালতো ছুটি। কালকে তুমি উত্তরের রুমটা খালি করে দিবে?
-কেন, হটাৎ উত্তরের রুম খালি করতে হবে কেন?
-আমি ভাবছি আম্মাকে সবসময়ের জন্য আমাদের কাছে এনে রাখবো।
-মা কয়েক দিনের জন্য আসবেন । উনি তোমার সাথে এই রুমে থাকলেই হয় । আমি না হয় সেই কয়দিন গেস্ট রুমে থাকবো ।
-শিহাব তুমি মনে হয় ভাল করে আমার কথা শুননি । আমি বলেছি আম্মাকে আমি সবসময়ের জন্য আমাদের কাছে এনে রাখবো । এইবার শিহাব মোবাইলের স্কিন থেকে মুখ তুলে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললো – সেকি! আম্মা আমাদের এখানে এসে কি ভাবে থাকবেন? এই বাসায় তো শুধু তুমি আর আমি থাকিনা ।আমার বাবা,মাও থাকেন ।
-বাবা ,মা থাকলে কি হয়েছে শিহাব ? তুমি একটু বাবা মাকে বুঝিয়ে বল না । ভাইয়ারা আজকে সবাই মিলে ঠিক করেছে আম্মাকে বৃদ্ধা আশ্রমে দিয়ে আসবে । আম্মা থাকলে নাকি ওদের অনেক অসুবিধা হয় । আম্মাকে দেখার জন্য আলাদা মানুষ লাগে । ওরা আম্মার জন্য সবাই এক সাথে বেড়াতে যেতে পারেনা । আম্মা তো একা একা চলাফেরা করতে পারেনা । আমি কিছুতেই এটা মানতে পারছিনা ।
আমার কথায় শিহাব মুখ কুঁচকে বলল – তোমার তিন ভাই অমানুষ হয়েছে । তাই নিজের মাকে নিজেদের কাছে রাখতে চাইছে না । কিন্তু আমিতো তোমার ভাইদের মতো না । এখন আমি যদি আম্মাকে এই বাড়ীতে আনতে বলি আর বাবা, মা যদি সেটা ভাল ভাবে না নিয়ে অন্য ভাবে নেয় ? যদি ভাবে ছেলের কাছে আছে তাই ছেলের বউয়ের ইচ্ছাতে উনাদের থাকতে হবে ? আর তাছাড়া আত্মীয়রা কি বলবে? এইভাবে আমাদের সমাজে মেয়ের শশুর বাড়ীতে এসে কেউ থাকে? তুমি বরং ভাইয়াদেরকে বল একজন মানুষ রেখে দিতে আম্মার কাজের জন্য । আমি মাসে মাসে টাকা দিয়ে দিব । মেয়ে হিসেবে এর থেকে বেশি আর তুমি কি করতে পারো ? শিহাবের কথা শুনে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম ।
-কি বললে তুমি শিহাব? আমার আম্মাকে শুধু টাকা পাঠালেই আমার দায়িত্ব শেষ !
– রিমা শুন তোমার আম্মার দেখাশুনা করার দায়িত্ব তোমার ভাইদের তোমার না ।
– শিহাব এই হাদিস তুমি কোথায় পেয়েছ ?
যে বাবা মাকে শুধু ছেলেদের দেখতে হবে? আমাদের ধর্মে তো এমন কোন কথা নেই । কোরআন শরিফে বহুবার বলা হয়েছে তোমরা তোমাদের বাবা মায়ের প্রতি ভাল ব্যবহার কর ,তাদের প্রতি তোমাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন কর । সবজায়গায় তো সন্তান শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে । আর সন্তান বলতে তো ছেলে মেয়ে দুই জনকেই বুঝায় । কোথাও তো বলা হয়নি মেয়েদের বিয়ে হয়ে যাবে তাই বাবা মায়ের প্রতি মেয়েদের কোন দায়িত্ব থাকবে না । মায়ের পায়ের নিচে বেহেস্ত কি শুধু ছেলেদের ? মেয়েদের না ? শিহাব তোমার মা যেমন তোমাকে দশমাস পেটে ধরেছে ঠিক তেমনি আমার আম্মাও আমাকে দশ মাস পেটে ধরেছে । তুমি হতে মা যেমন কষ্ট পেয়েছে।
আমি হতেও আমার আম্মা কষ্ট পেয়েছে । তুমি তো ঠিকই তোমার দায়িত্ব পালন করছ । কিন্তু আমি ? হ্যাঁআমি মানি মেয়েদের বিয়ে হয়ে অন্যর বাড়ি যেতে হয় আর ছেলেরা বাবা মায়ের কাছে থাকে । তাই আমাদের সমাজ এই নিয়ম করেছে যে বাবা মায়ের প্রতি শুধু ছেলেদের দায়িত্ব । আর তাই কোন ছেলে মায়ের দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করলে সেই মাকে হয় রাস্তায় পড়ে থাকতে হয় । না হয় বৃদ্ধা আশ্রমে যেতে হয় । শিহাব তুমি জানো আব্বা মারা যাবার পরে আম্মা আমাদের চার ভাই বোনকে কতো কষ্ট করে বড় করেছে । সেই সব আমার তিন ভাই ভুলে গেছে । কিন্তু আমি ভুলতে পারি নাই । আমার তিন ভাই বেহেস্ত পেতে চায় না । কিন্তু আমি যে বড্ড লোভী । আমি যে আমার বেহেস্তকে কাজের মানুষের ভরসায় ছেড়ে দিতে চাই না ।
তোমার মনে আছে আমাদের বড় মেয়ে হবার পরে মায়ের কষ্ট হবে ভেবে আমি আমার চাকরি ছেড়ে দিয়েছি । আমি কি কোনদিন তোমার বাবা মায়ের সাথে কোন খারাপ ব্যবহার করেছি ? আমি চেষ্টা করেছি আমার কোন কাজে যেন কখনো উনারা কষ্ট না পায় । তোমার বাবা মাকে আমি দেখে রাখতে পারি আর তুমি আমার আম্মাকে তোমার বাসায় এনে রাখতে চাইছ না !! বলছ সমাজ কি বলবে ? শিহাব ভুলে যেও না তোমার ও কিন্তু দুই মেয়ে । আমি কাঁদতে কাঁদতে বারান্দায় চলে গেলাম । শিহাব রাগ করে রুম থেকে বের হয়ে গেল । অনেক রাত পর্যন্ত আমি আমার মেয়েদের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে কাঁদলাম । ভাবলাম আমি এখন যেমন ইচ্ছা থাকার পরেও আমার আম্মার প্রতি কোন দায়িত্ব পালন করতে পারছিনা । ঠিক তেমনি আমার মেয়েরাও হয়তো চাইলেও একসময় আমার জন্য কিছু করতে পারবেনা ।
সকালে আমার মেয়েদের চেঁচামেচিতে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল । তাকিয়ে দেখি আমার মেয়েরা ভাল জামা কাপড় পরে রেডি হয়ে আছে । বুঝতে পারলাম ছুটির দিন তাই শিহাব ওদের নিয়ে বাহিরে যাবে । আমাকে উঠতে দেখে মেয়েরা হইহই করে বলতে লাগলো – মা তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নেও । আমরা সবাই রেডি । দাদু, দিদাও রেডি । এই সময় শিহাব রুমে ঢুকেই বলল – এই যে, রিমা কিছুক্ষন পরেই গাড়ি চলে আসবে । আমার বন্ধু রনির গাড়িটা চেয়েছি ওর কাছে । তুমি দেরি না করে রেডি হয়ে যাও । আমি বললাম- কোথাও যাবো না । এই সময় মা রুমের দরজায় দাড়িয়ে বললেন বউমা কি হল ? তোমার শ্বশুর আর আমি সেই কখন থেকে রেডি । আমি দাঁড়িয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললাম – মা আমার শরীরটা ভাল নেই আপনারা যান ।
-ওমা , কি বলে এই মেয়ে ! তুমি না গেলে তোমার আম্মার ব্যাগ কে ঘুছিয়ে আনবে ? আমি বাবা ঐ সব পারবোনা । আমি শুধু আমার বোনটিকে ধরে আনতে যাচ্ছি । মায়ের কথা শুনে আমি মাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলাম । শিহাব আমার দিকে তাকিয়ে বলল – স্যরি রিমা । আমি ভুল ছিলাম । তোমার কথা ঠিক মায়ের পায়ের নিচে শুধু ছেলেদের না মেয়েদেরও বেহেস্ত । কালরাতে তোমার বলা কথাগুলো শুনে প্রথমে রাগ হলেও পরে ভেবে দেখালাম তুমি ভুল কিছু বলনি । পরে বাবা মায়ের কাছে গিয়ে সব বললাম । শুনে মা বাবা দুইজনেই একবাক্য রাজি হয়ে গেল । এখন কান্নাকাটি থামিয়ে চল। দেরি হয়ে যাচ্ছে তো । বিকালের মধ্য আবার ফিরতে হবে ।
গল্পের বিষয়:
গল্প