মিনুর হাতে আলমারির চাবির গোছা দিয়েছি।এ নিয়ে আম্মা ভীষণ রাগ। অবশ্য এ চাবি আগে আম্মার হাতেই ছিল। যখন যা প্রয়োজন হতো আম্মাকে বললেই বের করে দিতেন। কিন্তু আম্মার বয়স হওয়ার কারণে অনেক কিছুই তার স্মরণ থাকে না।শরীরও দূর্বল।তাই আম্মা চাবির গোছা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,’তোর কাছে রাখ এটা। আমি বাবা আর সংসার টানতে পারি না।’ আমি কদিন এই গোছা পকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়িয়ে দেখি এইসব আলমারির চাবি একটা আলাদা বোঝা। এই বোঝা নিয়ে বাইরে হাঁটতে কষ্ট হয়। আমার কেন জানি মনে হয় এই চাবির গোছাটা ঘরের মেয়েদের শাড়ির আঁচলের গিঁটেই বেশ মানায়। তাই ঘরে ফিরে এক রাতে মিনুকে বললাম,’মিনু, তোমায় একটা বোঝা বয়তে হবে আজ থেকে!’ মিনু বেশ অবাক হয়ে আমার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকালো। তারপর বললো,’কিসের বোঝা?’
আমি মৃদু হেসে পকেট থেকে চাবির গোছাটা বের করে হাতের মুঠোয় নিয়ে ওর সামনে মেলে ধরে বললাম,’এই যে এটা।’ মিনু বড় কাতর স্বরে বললো,’এতো বড় বোঝা কী করে আমি বয়বো?’আমি হেসে বললাম,’তুমি নয় তোমার শাড়ির আঁচলের গিঁট বয়বে। তুমি শুধু পাহাড়া দিবে কেমন!’ মিনু খানিক ভেবে বললো,’আচ্ছা।’ আমি মিনুর শাড়ির আঁচলের গিঁটে চাবির গোছা খানা বেঁধে দিলাম। এই গোছা বাঁধা শাড়ি পরে যখন মিনু ঘরের ভেতর হাঁটে তখন একটা চাবির সাথে আরেকটি চাবির আঘাত প্রাপ্তির কারণে এক অদ্ভুত শব্দ হয়। সেই শব্দ শুনতেও বেশ লাগে!
মিনুর কাছে চাবি দেয়ার পর আম্মা যদিও সরাসরি আমায় কিছু বলেননি কিন্তু নানান ইশারায় তার রাগ প্রকাশ পাচ্ছিল। একদিন আম্মার সেই অভিমান ভাঙাতে আম্মাকে আমি বললাম,’আম্মা, আপনি যদি অসুস্থ না হতেন আর আমার কাছে এই চাবির গোছা তুলে না দিতেন তবে কোনদিন আমি মিনুর হাতে চাবির গোছা তুলে দিতাম না। আম্মা,একটা সংসারে ঘরের ভেতরের কাজের দায়িত্বটা মেয়েরাই খুব ভালো করে গুছিয়ে করতে পারে। এমনকি চাবির গোছাও ঠিক তাদের শাড়ির আঁচলের গিঁটেই মানায়। আব্বা যখন বেঁচে ছিলেন তখন এই চাবি তো আপনার হাতেই থাকতো।আপনিই গোনে গোনে আব্বাকে টাকা পয়সা দিতেন যখন যা প্রয়োজন হতো। এখন আমার সংসার চালাতে যা প্রয়োজন হবে তা আপনিই আমায় গোনে দিবেন। শুধু চাবিটা থাকবে মিনুর কাছে।যেন কোথাও হারিয়ে না যায় সেই চাবি।সে চাবির গোছা পাহাড়া দিবে।’ কথাগুলো শোনে আম্মার মধ্যে তেমন একটা পরিবর্তন দেখা গেল না। তিনি কিছুটা রাগ রেখেই বললেন,’তোদের সংসার তোরাই ভালো বুঝিস কীভাবে চালাবি। আমি আর বাঁচবো কদিন রে বাবা!’ আম্মার রাগের কারণটা আমি স্পষ্ট বুঝতে পারি।আম্মা হয়তোবা মিনুকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। তিনি ভাবছেন মিনু যদি আলমারি থেকে কিছু টাকা-পয়সা সরিয়ে ফেলে!
মিনু অবশ্য এসবের কিছুই বুঝতে পারলো না। আমি আসলে তাকে কিছুই বুঝতে দেইনি। এরপর একদিন ঘটলো এক অপ্রত্যাশিত ঘটনা। বাজারে যাবো তাই মিনুকে বললাম আলমারি থেকে কিছু টাকা নিয়ে আসতে।মিনু আলমারি থেকে টাকা আনতে গিয়ে আলমারি খুলে চিৎকার করে উঠলো।তার চিৎকার শুনে আমি আর আম্মা দৌড়ে কাছে গেলাম।মিনু আমাদের দেখে প্রায় কেঁদে ফেললো।তার চোখে মুখে স্পষ্ট আতঙ্কের ছাপ। আমি বললাম,’কী হয়েছে মিনু?’ মিনু কান্নাভেজা গলায় বললো,’আলমারির কোথাও টাকাগুলো নাই।’ প্রায় পাঁচ লাখ টাকা আলমারি থেকে উধাও।অথচ তালা ঠিক টাক ভাবেই লাগানো ছিল।চাবিও মিনুর আঁচলের গিঁটে বাঁধা। তবে টাকাগুলো উধাও হলো কীভাবে! অবশেষে দেখা গেল তালা খুলে টাকা কেউ নেয়নি।টাকা নিয়েছে আলমারির নিচের তক্তায় ধারালো কিছু দিয়ে গর্ত করে। কিন্তু কীভাবে কখন কে এই কাজ করলো তার কোন লক্ষণ সনাক্ত করা গেলো না।
সে রাতে আমাদের কারোর চোখেই একফোঁটা ঘুম নেই। আমি মিনুকে মোটেও অবিশ্বাস করতে পারি না কারণ সে মিথ্যুক নয়। আমাদের বিয়ের চার বছরেও তার কাছ থেকে এমন কোন ব্যবহার পাইনি যাতে তাকে অবিশ্বাস করা যায়। কিন্তু আমার ভয় হচ্ছিল আম্মাকে নিয়ে। তিনি তো মিনুর প্রতি এমনিতেই রাগ, এখন না জানি কী বলে বসেন! যদি তিনি সরাসরি ইঙ্গিত করেন মিনুকেই। যদি বলেন,মিনুই টাকাটা চুরি করেছে অন্য রকম কৌশলে!মিনুও বোধহয় এমনটাই ভাবছে। আমাকেও কেমন ভয় করছে সে।রাত ভর সে বালিশে মুখ চেপে কেঁদেছে। আমিও ভেবে পাচ্ছিলাম না টাকাটা কীভাবে উধাও হয়ে যেতে পারে আলমারি থেকে! কিন্তু কিছুই আর মাথায় আসছিল না।
আম্মা সে রাতে কিছুই বললেন না মিনুকে। আমাকেও না। মিনুর রান্নাবান্না করার অবস্থা নেই। শরীর খুব খারাপ হয়ে গেছে। আম্মা নিজেই তখন অসুস্থ শরীর নিয়ে রান্নাবান্না করলেন। তারপর আমাদের ডেকে জোর করে খাওয়ালেন।আম্মাও খেলেন। তারপর মাঝরাতে তিনি লম্বা নামাজে বসে গেলেন। নামাজ শেষে অনেক্ষণ ধরে তিনি দোয়া করলেন। দোয়া শেষ করে আমাদের পাশে এসে আমার আর মিনুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে সে রাতে প্রথম কথা বললেন তিনি। আম্মা বললেন,’বিশ্বাস পৃথিবীর সবচেয়ে দামী বস্তু বাবা।যার বিশ্বাস নাই সে কোনদিন মুসলমান হতে পারে না। মিনুর প্রতি আমার কোন রাগ নাই।
আগে সামান্য রাগ ছিল তোমার উপর। আমি ভেবেছিলাম অপরিপক্ক কারোর হাতে তুমি চাবির গোছা তুলে দিয়েছো। সে হয়তোবা এর সঠিক মূল্য দিতে জানবে না। কিন্তু আমার ধারণা ছিল ভুল। বৌমা এর যথার্থ হেফাজত করেছে।চাবি সর্বক্ষণ তার আঁচলের গিঁটেই বাঁধা থাকতো। আমি দেখেছি সে ভুলেও এই চাবি কোথাও খুলে রাখতো না। তবুও আমাদের ঘরে চুরি হয়েছে। আলমারির তক্তা কেটে টাকা চুরি করেছে চোরেরা তালা খুলে নয়। হয়তোবা রাতে ভুলে আমরা দরজা জানালা খুলে রেখেছিলাম যা দিয়ে তারা ঘরে ঢুকতে পেরেছিল।এটা তো মিনুর একার ভুল না আমাদের সবার ভুল।অথবা এই ঘরের কারোর ভুলই না,আল্লার ইচ্ছা।এটা আমাদের তাক্বদীর।তাক্বদীরের উপর তো মানুষের কোন হাত নাই।যে টাকা আলমারিতে ছিল সেই টাকা উপার্জনের সুযোগ আল্লাই করে দিয়েছিলেন।
যেহেতু আমাদের টাকা চুরি হয়ে গেছে আল্লাহ আবার হয়তোবা এই টাকা উপার্জনের সুযোগ করে দিবেন।অথবা এর চেয়ে বেশি উপার্জনের সুযোগ করে দিবেন।আর না দিলেও তার উপর সন্তুষ্ট থাকতে হবে।সবর করতে হবে। আল্লাহ তো সবর কারীদেরই সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেন। ভালোবাসেন!’ আম্মার এই কথাগুলো শোনে মিনু হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। কেঁদে উঠলাম আমিও। এই অতগুলো টাকা হারানোর পরেও আমাদের আর দুঃখ লাগছে না মোটেও। মনে হচ্ছে, যা যাওয়ার তা তো চলেই যাবে।শত পাহাড়া দিয়েও তা ধরে রাখার কোন সুযোগ নেই।
গল্পের বিষয়:
গল্প