জামাল আঙ্কেল

জামাল আঙ্কেল
আগে আমাদের পাশের ফ্ল্যাটের নতুন ভাড়াটিয়া জামাল সাহেবকে আমি জামাল ভাই বলে ডাকতাম। তার একটাই কারণ ছিল, তার হরিণ শাবকের মতো সুন্দরী স্ত্রী। সুচিত্রা সেনের মতো এমন কাউকে ভাবি বলে ডাকার সুযোগ হাতছাড়া করব এতটা বোকা আমি নই।
এজন্য অবশ্য ঝামেলায়ও পড়া লাগত। আমার বাবাও জামাল সাহেবকে ভাই বলে ডাকতেন। বাপ ছেলে এক লোককে ভাই বলে ডাকছি ব্যাপারটা কেমন হয়ে গেল না! কিন্তু লক ডাউন শুরু হতেই সব গড়বড় হয়ে গেল। করোনা কালীন ছুটিতে ইউনিভার্সিটি বন্ধ থাকায় রাজশাহী থেকে জামাল সাহেবের বড় মেয়ে বাসায় আসল। মেয়ে তো নয় যেন একটা আগুনের গোলা। দেখলেই বুকের মধ্যে কেমন দাবানল লেগে যায়। আমার জানা মতে জামাল সাহেবের একটাই মেয়ে ছিল। আদিবা, পাঁচ বছরের। আমাকে দেখলেই কিউট কিউট করে আঙ্কেল ডাকত। আমিও গাল টেনে আদর করে চকলেট কিনে দিতাম। বঙ্গোপসাগরে যেমন হঠাৎ হঠাৎ করে নতুন দ্বীপ জেগে উঠে তেমন করে হঠাৎ কই থেকে যেন জামাল সাহেবের আনিশা নামের একটা মেয়ে উদিত হয়ে গেল। আর উদিত হয়েই আমার সব হিসেবের খাতা এলোমেলো করে দিল। বুকে আম্পান নামক ঝড় বইয়ে দিয়ে গেল।
জ্যাকুলিন ফার্নান্দেজের মতো একটা মেয়ে আমাকে আঙ্কেল আঙ্কেল বলে ডাকছে ভাবলেই আমার গা গুলিয়ে যায়। রাতে একশ তিন ডিগ্রি জ্বরে ঘুম ভেঙে যায়। যাইহোক কয়েকদিনের মধ্যে লজ্জা-শরমের সব মাথা খেয়ে জামাল ভাইকে আমি জামাল আঙ্কেল বলে ডাকা শুরু করলাম। তার স্ত্রীকে আন্টি ডাকতে শুরু করে দিলাম। আন্টি অবশ্য একদিন জিজ্ঞেসও করেছিল, তুমি না আগে আমাকে ভাবি ডাকতা, হঠাৎ আন্টি ডাকা শুরু করলা যে। আসলে আন্টি আপনি তো আমাকে অনেক আদর করেন, একদম মায়ের মতন, তাই ভেবে দেখলাম এমন মাতৃ মমতা যার মনে তাকে আন্টি ডাকাই উচিত। আরো ভুজুংভাজুং বলে আমি কোনোক্রমে সেদিন সেখান থেকে কেটে পড়লাম।
আমি আনিশাদের বাসায় ঘনঘন যাওয়া শুরু করলাম। জামাল আঙ্কেলের সাথে কথা বলি, আন্টির সাথে বলি, আদিবার সাথে বলি; কিন্তু আনিশার দেখা আর পাই না। হঠাৎ হঠাৎ কই থেকে যেন আসে। এসে আমাকে দেখলেই থমকে যায়। আমাজনের এখানে সেখানে যেমন কয়দিন পর পর আগুন জ্বলে উঠে তেমনি আনিশাকে দেখা মাত্রই আমার বুকেও অমন সর্বনাশা-বিধ্বংসী আগুন দাউদাউ করে জ্বলতে আরম্ভ করে। এখন আমি প্রায় সারাদিনই আনিশাদের বাসায় পড়ে থাকি। শুধু দুপুরে খাওয়া আর রাতে ঘুমাবার সময় একবার করে বাসায় আসি। মাঝেমধ্যে দুপুরেও খেতে আসি না। আন্টি একবার বললেই উনাদের সাথে বসে পড়ি। ছুঁচা বললে বলুক। প্রেম করতে হলেই কতকিছু শুনতে হয়, আর গোটা একটা ফ্যামিলিকে পটাতে হলে তো এসব একটু-আধটু শুনা লাগবেই।
আদিবার সাথে আমার খুব খাতির হয়ে গেছে। এখন একমাত্র আমিই ওর সার্বক্ষণিক খেলার সাথী। আর আমিও সুযোগ বুঝে ও-কে আরো বেশী চকলেট দেয়ার লোভ দেখিয়ে আমাকে ভাইয়া বলে ডাকতে শিখিয়ে দিয়েছি। মেয়ে কাজের আছে। আমাকে দেখলেই অনিক ভাইয়া ভাইয়া বলে অস্থির করে ফেলে। ওর আপুর সামনে আরো বেশী করে ডাকে। আঙ্কেল আন্টিও এখন অনিক বলতেই পাগল। আনিশাদের বাসায় কাঁথা সেলানোর একটা সুঁই থেকে শুরু করে পা মোছার পাপোশ যা-ই লাগুক আমি এখন জানি। এমনকি সেদিন দুপুরে কী রান্না করবে আন্টি সেটা পর্যন্ত আমাকে জিজ্ঞেস করে ফেলল।
আনিশাও এখন মাঝেমধ্যে আমার সাথে কথা বলে। চোখাচোখি হয়। চোখ তো নয় যেন দুইটা বিটিভি। একদম নিবিড়-শান্ত-সুন্দর, কোনো অশান্তি নেই সেখানে। আন্টিও সেদিন আমার মায়ের কাছে গিয়ে আমার সুনাম করে আসল। বলল, আপনার ছেলেটা একটা সোনার টুকরা। ওর মতো কাজের ছেলে এই পাড়াতে আর একটাও নেই। আন্টির কথা শুনে আমার মা বেশ অবাক হয়ে গেল। আর হওয়ারই কথা। যে ছেলেকে রান্না ঘরের উপরের তাক থেকে মরিচের গুঁড়ার ডিব্বাটা একটু নামিয়ে দিতে বললে দেয় না, সেই ছেলেকে কেউ বলছে কাজের ছেলে! আন্টি আর মায়ের কথা শুনে বুঝলাম কাজ আমার হয়ে গেছে। ছোট বোনটাকে তো আগেই হাত করেছি। আঙ্কেল তো আমাকে সবসময়ই পছন্দ করে। আন্টিও এখন আমার দিকে। আর আনিশাও কবুল কবুল ভাব। এখন আমার শুধু মুখ ফোঁটে ভালোবাসার কথাটা বলা বাকী।
দুইদিন আগের কথা। আঙ্কেল সকাল বেলায় আমাকে ফোন করে ডাকলেন। আমি পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছিলাম। ফোন পাওয়ার সাথে সাথেই কোনোক্রমে হাতে ব্রাশ নিয়েই ছুটে গেলাম। বাসায় যেতেই আঙ্কেল জানালেন তাদের নাকি পাঁচ-সাত কেজি মিষ্টি লাগবে। আমার পরিচিত এক ছোট ভাই আছে অনলাইনে মিষ্টির ব্যবসা করে। তাই আমাকে বলা। আমি আর দেরি করলাম না। তাড়াতাড়ি ছোট ভাইয়ের অফিসে ছুটে গেলাম। কিন্তু উত্তেজনায় টাকা নিতেই ভুলে গেছি। আর এছাড়া মিষ্টির টাকা চাওয়াও যাবে না। নিজের হবু শ্বশুরের কাছে সামান্য এই কয়টা মিষ্টির টাকা চাওয়া যায় আপনারই বলুন? কিন্তু আনিশাদের হঠাৎ এত মিষ্টির দরকার পড়ল কী জন্য! আরে ওদের না কোন চাচাতো বোন এবার এসএসসি দিল। গোল্ডেন এ+ পাইছে বোধহয়। ঐ চাচার বাসায় পাঠাবে।
ছোট ভাইকে বাসার নিচে দাঁড় করিয়ে গেলাম। আঙ্কেল টাকা দিলে তো দিলই। আর না দিলে আমি বাসা থেকে এনে দিব। গিয়ে কলিং বেল বাজাতেই আনিশা এসে দরজা খুলে দিল। আমার দুই হাতে মিষ্টি দেখে গালে পড়ে থাকা চুলগুলো সরাতে সরাতে যে একটা হাসি দিল, উফফফফফ! দিল টুট গ্যায়া। হাসি বিনিময় পর্ব শেষে আমাকে বলল, ‘ভিতরে এসে বসো।’ আনিশা আজকে আমাকে তুমি করে বলল। এ তো মেঘ না চাইতেই জল। না, শুধু জল না, পুরো আস্তো একটা জলের ট্যাংকি। উত্তেজনায় আমার হাঁটু কাঁপছে। আঙ্কেল এসে আমার সামনে বসলেন। এটা-সেটা বললেন কতক্ষণ। তারপর কথার এক ফাঁকে আমি জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, ‘আঙ্কেল এত মিষ্টি কী জন্য?’
-মিষ্টি?
-জি আঙ্কেল..
-ওহ্! দেখ তোমাকে বলতেই ভুলে গেছি। আজকাল এত ভুলো মন হয়েছে।
-হ্যাঁ…এখন তো ভুলবেনই, আঙ্কেল! বয়স তো আর কম হলো না। আফটার অল আপনার বিয়ের উপযুক্ত একটা মেয়ে আছে।
-রাইট, একদম ঠিক ধরেছ। আমিও সেটাই বলছিলাম।
-মানে?
-মানে? আসলে অনিক, তুমি তো আমার ছেলের মতোই। ঘরের ছেলে বলা যায়।
-ছেলের মতো কী বলছেন, আঙ্কেল! আমি তো আপনার ছেলেই।
-সে আমি জানি। এজন্যই শুধু তোমাকে বলছি। আর কাউকে বলিনি।
-এত ইতস্ততা করার দরকার নেই, আঙ্কেল। বলে ফেলেন।
-আসলে..আজ রাতে আনিশার বিয়ে। এভাবে হুট করে কিছু করা আমাদের প্ল্যান ছিল না। ছেলে আমারিকা থাকে।
গত মাসেই দেশে আসার কথা ছিল। কিন্তু লক ডাউনে আটকা পড়ে গেল। ওরা কিছুতেই আর দেরি করতে চাচ্ছে না। আজ রাতে অনলাইনে বিয়ের কাজটা সেরে ফেলতে চাচ্ছে। সবকিছু ঠিক হয়ে গেলে দেশে এসেই অনুষ্ঠান করে আনিশাকে তুলে নিয়ে যাবে। আঙ্কেলের কথা শুনে আমি কিছু বলব দূর থাক নড়চড় করার শক্তিও পাচ্ছিলাম না। আমার বুকের ভেতর দিয়ে ছিয়াশি কিলোমিটার বেগে কালবৈশাখী ঝড় বয়ে যাচ্ছে। কোনোক্রমে উঠে হাঁটতে শুরু করলাম। আঙ্কেল আমাকে ডাকলেন।
-জি, আঙ্কেল..
-তুমি কিন্তু আজ রাতে অবশ্যই থাকবে। আনিশার তো কোনো বড় ভাই নেই। তুমি তো আমাদের ছেলের মতোই।
আমি শুধু ঘারটা কোনোক্রমে কাত করালাম। হ্যাঁ নাকি না কোনটা বললাম কিছুই বুঝা গেল না। তবে মনে মনে বললাম, ‘ছেলের মতো হতে যাব ক্যান! ব্যাটা, ক জামাইয়ের মতো। আমার কী বাপ-মা কম পড়ছে? শ্বশুর শ্বাশুড়ির না একটু অভাব।’ আমি আবার পা বাড়াচ্ছি আঙ্কেল তখন আবার আমায় ডেকে বললেন, ‘আর শুনো, মিষ্টির টাকাটা রাতে যখন আসবে তখন নিয়ে যেও। আমার আবার ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে হবে।’ মিষ্টির কথা শুনেই আমার গলা বেয়ে টক একটা ঢেকুর বেরিয়ে গেল। মনে হচ্ছে এখুনি বমি করে পুরো ঘর ভাসিয়ে দিব।
জামাল আঙ্কেল দরজা লাগিয়ে দিলেন। আমি বাইরে এসে দাঁড়ালাম। কী করব এখন? বাসায় যাব? বাসায় গেলেই তো আমার ফেস দেখলে মা সব বুঝে ফেলবে। নিচে যাব? নিচে গেলেই তো ছোট ভাই মিষ্টির টাকার জন্য ধরবে। নাহ্! এরকম কখনো আর করা যাবে না। যাকে তাকে আঙ্কেল ডাকা যাবে না। এই ভাই রূপী আঙ্কেলগুলা খুব ভয়ংকর। কাল থেকেই জামাল আঙ্কেলকে আবার জামাল ভাই ডাকার প্র্যাকটিস করতে হবে।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত