আমার যখন প্রথম প্রেম হয় তখন আমি মাত্র পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ি। আমাদের এলাকার এক ভাইয়াকে প্রচুর পছন্দ করতাম। ভাইয়াটাও আমায় অনেক আদর করতেন। আমাকে দেখলেই গাল টেনে দিয়ে চকলেট কিনে দিতেন। আমি খুব লজ্জা পেতাম। এরপরে আমার পি.এচ.সি এর পর ছুটিতে আমি দশদিনের জন্য নানুবাড়ি চলে গেলাম। আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে আমি সেবার জীবনে প্রথমবারের মতো নানুবাড়িতে যেতে অমত জানিয়ে ছিলাম। আরেহ্ প্রেমটাও তো প্রথম ছিলো। সেবার মা আমায় একপ্রকার জোড় করেই নানুবাড়িতে নিয়ে গেছিলেন। কিন্তু সেখানে যাওয়ার পর সময় যেন আর কাটতেই চায় না। আর কাটবেও বা কিকরে আশিক ভাইয়াকে দেখা ছাড়া তো আমার দিনই শুরু হতো না।
পুরো দশদিন বাদে আমি যখন বাড়িতে ফিরলাম তখন আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম পুরো এলাকাজুড়ে লাইটিং করা। আমি আরো অবাক হয়ে গেলাম যখন দেখলাম লাইটিং এর উৎসস্থল আশিক ভাইয়াদের বাড়ি। কিছুক্ষণ পরেই জানতে পারলাম আমি ফেরার আগের দিনই আশিক ভাইয়ার বিয়ে হয়ে গেছে। এটা শোনার সাথে সাথে আমি ডিপ্রেশনে চলে গেলাম। একদিকে আশিক ভাইয়ার বাড়িতে সাউন্ডবক্সে গান বাজছে আর অন্যদিকে আমার ছোট্ট হৃদয় ভেঙেচুড়ে যাচ্ছে। আমি তখন একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিলাম। এ জীবনকালে আমি আর কখনো কারো প্রেমে পড়বো না। এরপর আমি যথাসম্ভব আশিক ভাইকে এড়িয়ে চলতাম। আশিক ভাই গাল টানতে আসলে আমি দৌড়ে সেখান থেকে চলে আসতাম। আশিক ভাইয়ার বউকে দেখলেই মনের মধ্যে একটা সতীন সতীন ক্যারেক্টার উঁকি দিতো।
এরপর কেটে গেলো কয়েকটা বছর। তখন আমি সদ্য নবম শ্রেণীতে উঠেছি। ততদিনে আশিক ভাইয়ার প্রতি সব প্রেমও আমার উবে গেছে। যখনি মনে পড়তো এই মানুষটাকে নিয়ে একসময় কত আজগুবি চিন্তা করেছি তখনি মনে হয় কেউ যেন আমার মাথায় খঞ্জনি বাজাচ্ছে। এখন আর আশিক ভাইয়ার বউকে দেখে সতীন সতীন ক্যারেক্টার জাগে না। এখন আশিক ভাইয়ার বউ আর আমার মধ্যে পারফেক্ট ননদ আর ভাবীর সম্পর্ক। ঐ সময়টাতে আমার দ্বিতীয় প্রেম হয়। আমার নেয়া কঠিন সিদ্ধান্ত আমি ভেঙে ফেলি। আমাদের স্কুলের সামনে প্রায়ই দেখতাম একটা ছেলে বাইক নিয়ে বসে থাকতো।
কি যে ভালো লাগতো ছেলেটাকে। তাকে দেখলেই আমার বুকের মধ্যে কে যেন হাতুড়ি পেটাতো। আমি তখন রোজ নিয়ম করে স্কুলে যেতাম। ঝড়, বৃষ্টি কিছুই আমাকে আটকাতে পারে না। আমার মা-বাবা তো বটেই আমার বান্ধবীরা পর্যন্ত অবাক হয়ে যেতো আমার প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার ক্ষমতা দেখে। আসলে ওরা তো কেউ জানতো না ওসব স্কুলে টিস্কুল কিছু না সব ঐ বাইকওয়ালাকে দেখার ধান্দা।
আমি মাঝেমধ্যে ছেলেটার দিকে আড়চোখে তাকাতাম। সেও তাকাতো। আমি লজ্জা পেতাম। আহা! একেই বুঝি প্রেম বলে। কিন্তু আমার প্রেমে এক বালতি জল ঢেলে দিয়ে সেই ছেলে একদিন আমারই এক বান্ধবীকে প্রপোজ করে বসলো। রাগে দুঃখে আমি আবার কঠিন সিদ্ধান্ত নিলাম। যা হওয়ার হয়েছে। আমি আর প্রেমে পড়ছি না। সব ছেলে এক। কেউ মন বোঝে না।
কিন্তু আমার নেয়া দিদ্ধান্ত এবারো সফল হলো না। কলেজে ওঠার পর আমি তৃতীয় বারের মতো প্রেমে পড়লাম এক সিনিয়রের। ছেলেটা ছিল আমাদের কলেজের ক্রাশ বয়। প্রত্যেকটা মেয়ে তার নাম বলতে অজ্ঞান। আমি ভাবলাম এবার যা করার আমাকেই করতে হবে। আগেভাগে তাকে প্রপোজ করতে হবে। বাড়িতে তখন এক খালাতো ভাই বেড়াতে এসেছিল। তাকে জানালাম আমার তৃতীয় প্রেমের কথা। সে সব শুনে আশ্বাস দিলো যদি আমাদের প্রেম টা হয়েই যায় তবে সে আমাদের পুরো সাপোর্ট করবে। পরেরদিন সে আমাকে তার বাইকে করে কলেজে নিয়ে গেলো। আমার ক্রাশ বয় তখন কলেজের সামনে দাঁড়ানো ছিল। আমাদের দেখেই সে এক অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমাদের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। এরপর তার অদ্ভুত চাহনি বদলে গিয়ে মুগ্ধ চাহনিতে পরিবর্তিত হলো। এরপর থেকে দেখতাম সে রোজ কলেজ গেটে দাঁড়িয়ে থাকতো। আমার ভাইটা যখন আমাকে নামিয়ে দিতো তখন সেও আমার পিছু পিছু কলেজে ঢুকতো। এরপর দেখলাম আমার টিউশনে জায়গাতেও সে গিয়ে হাজির। একদিন তো আমার পিছু পিছু আমার বাড়ি অবধি চলে এলো। আমার বান্ধবীরা বলতো, তোর কপাল খুলেছে, কলেজের ক্রাশ বয় তোর প্রেমে পড়েছে।
আমি কিছু বলতাম না। শুধু হাসতাম। এরপর একদিন আমার জীবনের চরম বিষ্ময়ের দিন উপস্থিত হলো। আমি কলেজে ঢুকতেই ক্রাশ বয় আমার হাতে একটা চিঠি ধরিয়ে দিয়ে গেলো। আমার তখন যে কি অবস্থা তা লিখে প্রকাশ করা যাবে না। সারাটাদিন আমার কাটলো ভয় ভয় মন আর অপেক্ষা নিয়ে। ভেবেছিলাম একেবারে বাড়ি ফিরেই চিঠিটা পড়বো। ছুটি শেষে যখন বাড়ি ফিরছিলাম তখন সে আমার সামনে এসে করুণ চোখে তাকিয়ে”প্লিজ একটু দেখো” বলেই চলে গেলো।
আমি বাড়িতে ফিরে রুমের দরজা লক করে কাঁপাকাঁপা হাতে তার চিঠিটা খুললাম। কিন্তু চিঠি পড়ে আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। তাতে লেখা ছিল, আমি বুঝতে পারছি না আসলে কিকরে শুরু করবো। জীবনে কখনো কাউকে এতোটা ভালো লাগেনি। কিন্তু প্রথম যেদিন তোমার সাথে একটা ছেলেকে দেখলাম সেদিনই সবকিছু কেমন যেন ওলট পালট হয়ে গেছে।সারাদিন রাত শুধু তাকে দেখার প্রতীক্ষা। আসলে আমার কোনো মেয়েকে ভাল লাগেনা। তোমার সাথে যে ছেলেটাকে দেখেছিলাম তাকে আমি প্রচন্ডরকম ভালবেসে ফেলেছি। কিন্তু কিছুদিন হলো তাকে আর তোমার সাথে দেখছি না। ওকে একটু বলে দিও যেন আমার সাথে যোগাযোগ করে। নিচে আমার ফোন নম্বর দিয়ে দিচ্ছি।
এরপর আমি আর কক্ষনো সজ্ঞানে সেই ক্রাশ বয়ের সামনাসামনি হয়নি। আমার জীবনে আমি তখন তৃতীয় বারের মতো আবার সেই কঠিন সিদ্ধান্ত টা নিয়ে ফেলেছি। আর কখনো কারো প্রেমে আমি পড়ছি না, না মানে না। সব ছেলে এক। মনটা কেউই বোঝে না।
এরপরে দিনগুলি ভালোই কেটেছে। মাঝে অনেকগুলো বছর চলে গেছে। এখন আমি ভার্সিটির ক্লাসরুমে বসে আছি। আজ আমাদের অনার্স সেকেন্ড ইয়ারের প্রথম ক্লাস। শুনেছি আজ একজন নতুন টিচার জয়েন করেছেন। প্রথম ক্লাস তারই। কিছুক্ষণ পরেই তিনি ক্লাসরুমে প্রবেশ করলেন। এরপর আমি যেটা টের পেলাম তা হচ্ছে আমার নেয়া কঠিন সিদ্ধান্ত আবার ভেঙে যাচ্ছে। আহা! কি সুন্দর দেখতে মানুষটা। এর প্রেমে পড়াই যায়। একে দেখেই তো বোঝা যাচ্ছে সে মন বুঝতে পারবে। সব ছেলে আসলে এক না।
গল্পের বিষয়:
গল্প