লজিং মাস্টার

লজিং মাস্টার
স্টুডেন্টের বাসায় এসে বিপদে পড়েছি। বিপদ হচ্ছে সামনে অনেক খাবার কিন্তু খেতে পারছিনা। আন্টিদের সামনে খাইতে কেমন যেন লজ্জা লাগে আমার। ছাত্রীর মা উপদেশ নিচ্ছে মেয়েকে নিয়ে কি করা যায়। সাইন্স থেকে ৩.৯৪ রেজাল্ট দিয়ে না ভালো কোন কলেজে চান্স পাবে, না জীবনের কোন গতি হবে। কি করা যায় বাবা? লজ্জা ভেঙে মিষ্টি একটা মুখে নিতে নিতে বললাম- এটা কোন ব্যাপারনা আন্টি। রেজাল্ট যে খুব খারাপ হয়েছে তাও না। ইন্টারে ঠিকমতো পড়লেই হবে।
-ঠিকমতো পড়লে তো হবে। ওতো বাসায় পড়তেই চায় না। একটা কথা ভেবেছি বাবা। আমি মুখ তুলে জিজ্ঞাসা করলাম কি কথা আন্টি?
-তুমিতো মেসেই থাকো। আর আমাদের চিলেকোঠা টা খালি। যদি আমাদের এখানে চলে আসতা, একটা ভালো মেন্টর পেতো মেয়েটা। পড়াশোনা ভালো হতো। ওতো তোমাকে খুব মানে। মিষ্টি ছেড়ে আপেল মুখে নিতে নিতে বললাম- আন্টি ভালোই হয়। কিন্তু মেসে মিল সিস্টেমে খাওয়া হয়, খাবারের ঝামেলা নেই। এখানে একা একা খাওয়াটা ঝামেলা হয়ে যাবে যে? আন্টি মুখটা কালো করে বললো- কষ্ট পেলাম বাবা। থাকার দায়িত্ব নিয়ে খাবারের দায়িত্ব নিবো না তা তেমন কথা? এসব নিয়ে চিন্তা করো না। তুমি না বললেও আমি এটা করতাম। তোমাকে ভরসা করি আমি।
আমাকে ভরসা করার কারন তার মেয়েকে আমি যা পড়াতাম একমাত্র সে বিষয় গুলোতেই সে এ+ পেয়েছে। ব্যাপারটায় খুশী হয়েছি কিন্তু তার চেয়ে বেশী অবাক হয়েছি। ছাত্রীকে ফিজিক্স কেমিস্ট্রি পড়াতাম। এই দুইটায় এ+ পেয়েছে। বাকি গুলোতে এ- আর বি গ্রেড। অথচ কেমিস্ট্রি পরীক্ষার আগের দিনও ছাত্রীকে সোডিয়ামের পারমানবিক সংখ্যা কতো জিজ্ঞাসা করেছি, উত্তর দিতে পারেনি। ছাত্রীকে একা ডাকলাম। ফ্রিতে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা যার কারনে হয়েছে তার সাথে একান্তে কথা বলা আমার কর্তব্য। ছাত্রী আসলো, এসে আমাকে সালাম করলো। হাতে একটা মিষ্টি দিয়ে বললাম মিষ্টি খাও তিথী। হাসিমুখে উত্তর দিলো ভাইয়া আমি মিষ্টি খাইনা। তার সমস্যা হচ্ছে বাসায় আন্টি আঙ্কেলের সামনে আমাকে স্যার ডাকে আর উনারা না থাকলে ভাইয়া ডাকে। বেশ কয়েকবার সতর্ক করেছি আন্টি আঙ্কেল শুনলে উল্টাপাল্টা ভাববে। আর তার ভাইয়া ডাকে কেমন যেন একটা সন্দেহের টান থাকে। কিন্তু শুনেনা।
বললাম ফিজিক্সে না হলেও কেমিস্ট্রিতে ফেইল করবা এটা আমি নিশ্চিত ছিলাম। কিন্তু দুইটাতেই এ+ কিভাবে পেলা?
তিথী মিষ্টি না খেয়েও একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে বললো ভাইয়া সিয়াম আমাকে পরীক্ষার আগের রাতে সাজেশন দিয়েছিলো। ওখান থেকে সব কমন পড়েছে। তাই পেয়ে গেছি। আপনাকে না বলেছিলাম আমার ফিজিক্স কেমিস্ট্রি এক্সাম ভালো হয়েছে? উত্তরে বললাম হ্যা বলেছিলা। খারাপ স্টুডেন্টরা কখনো খারাপ পরীক্ষা দেয়না। কিছু লিখতে পারা মানেই তাদের পরীক্ষা ভালো হয়েছে। তো ভাবিনি আসলেই ভালো দিয়েছো। অবশ্য শেষের কথা গুলো বলেছি মনেমনে। সরাসরি বললে ছাত্রী কষ্ট পেতো। তবে এটা সত্য, পরীক্ষা খারাপ হলে ভালো স্টুডেন্টদের হয়। তারা পড়াশোনা করে, তাদের ক্ষেত্রে কমন আনকমনের বিষয় থাকে। আর খারাপদের জন্য সবিই কমন। বিসমিল্লাহ বলে খাতা ভরতি লিখতে পারা মানেই তাদের পরীক্ষা ভালো হয়েছে। বললাম তিথী একটা চিলেকোঠায় থাকার খুব ইচ্ছে ছিলো আমার। কত খুঁজেছি কিন্তু পাইনি। তোমার কারনে সে ব্যবস্থা হলো। বলো ট্রিট হিসেবে কি চাও?
প্রশ্ন কমন পড়েছে তার। তাড়াতাড়ি লিখার মতো উত্তর দিলো- ভাইয়া আমার কিচ্ছু লাগবেনা। আপনি চিলেকোঠায় আসলে সিয়ামকে আপনার বাসায় নিয়মিত আসতে দিয়েন তাহলেই হবে! কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেলাম। সিয়াম আমার বন্ধু আর তিথীর প্রেমিক। তিথীকে sscর আগে বাসায় ফোন হাতে নিতে দিতোনা। প্রেম করতে সিয়ামের কষ্ট হতো। তাই বন্ধু তিথীকে বুদ্ধি দিলো বাসায় যেন বলে – কোচিংয়ে সবার সাথে তেমন পড়া বুঝিনা। কোচিং-এর সজিব স্যার বাসায় এসে পড়ালে ভালো হতো খুব। মেয়ের পড়াশোনার ক্ষেত্রে টাকা পয়সা খরচ করার দিকে তিথীর মা হাতেম তাই পর্যায়ের। কোন কিপ্টেমি নাই। তখন থেকে শিক্ষক নয় বরং তিথী সিয়ামের প্রেম পত্রের এদিক সেদিক করতে হতো আমার। ছাত্রীর এমন কথা শুনে একটা থাপ্পড় দেওয়া উচিৎ আমার। কিন্তু তা না করে বললাম আচ্ছা তা দেখা যাবে। এসব নিয়ে চিন্তা করোনা। শত হইলেও সিয়াম আমার ভালো বন্ধু।
চিলেকোঠায় উঠার পর থেকে বাসায় থাকতে আমার ভয় লাগে। সিয়াম খুব যন্ত্রনা দিচ্ছে। ক্লাস করে, কোচিংয়ে সময় দিয়ে প্রতিদিন রাত করে বাসায় ফিরি। সিয়াম এর মধ্যে একবার বলেছেও আমি যেন তিথীর মাকে বলি আমার সাথে এক বন্ধু থাকবে, তাকে যেন উঠাই। ফ্রি বাসা হারাতে চাইনা তার মধ্যে বড়কথা হচ্ছে মান সম্মান। তিথীর মা ভরসা করে। ভরসার জায়গা একবার হারিয়ে ফেললে চিরজীবন কালপ্রিট হয়ে থাকতে হবে। কোচিংয়ে বসে আছি, সিয়াম এসে বললো চল তর বাসায় যাই। আমি বললাম আজ সারাদিন কিছু খাইনি- কাচ্চি আনা। একসাথে খাই, তারপর বাসায় যাই। সিয়ামকে কাচ্চি আনাতে দিয়ে আমি কোচিং থেকে বের হয়ে গেলাম। ফোনের পর ফোন দিচ্ছে ধরছিনা। ছাদে পায়চারি করছি পাশের ছাদ থেকে একজন বললো ভাই কি নতুন ভাড়াটিয়া? বললাম না ভাই। আমি এ বাসার লজিং মাস্টার। থাকি খাই আর বাড়িওয়ালার মেয়েকে পড়াই। লোকটি বললো আপনার কোন রুমমেট আছে?
– নাতো ভাই। এখানে আমি একা ব্যাচেলর। বাদ বাকি সবাই ফ্যামিলি সহো থাকে। জিজ্ঞাসা করলাম আপনারা কয়জন থাকেন? রাতে খুব বোরিং লাগে। আপনাদের সাথে কার্ড খেলতে পারলে ভালো লাগতো।
– ভাই আমাদের বাসাতেও কোন ব্যাচেলর নাই। আমি বাড়িওয়ালার ছেলে।
কথার মাঝখানে সিয়াম মেসেজ দিলো – ‘এইটা কোন কাজ করলি? তিথীর সাথে দেখা করেই চলে আসতাম জাস্ট।’
রিপ্লাই দিলাম আরেহ জরুরী কাজ পরে গেছে। আমি বাসাতেই আছি। তুই আয়। সিয়াম কাচ্চি আনবে কিন্তু কোক আনবেনা। এটা আমি জানি। ও যে ত্যাড়া আবার কোক আনতে বললে নিচে যাবেনা। এই সুযোগে একটা কোক নিয়ে আসা যায়। কোক নিয়ে এসে দেখি বাসায় হুলস্থল কারবার। লোকজন জমে গেছে। সিয়ামকে নিচে গ্যারেজে বেধে রেখেছে। আন্টি পিটাচ্ছে, আর বলছে থানায় খবর দে। চোরের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করবো আজকে। অবস্থা না বুঝে জিজ্ঞাসা করলাম কি হইছে আন্টি?
আরেহ সজিব বইলোনা এই চোর ছাদে উঠে তোমার রুমে উঁকি দিচ্ছিলো। প্রায় নাকি আসে। ভাগ্য ভালো তিথী তখন ছাদে গিয়েছিলো! আর আমাদের পাশের বাসার বাড়িওয়ালার ছেলেটাও দেখে ফেলেছিলো। না হয় এ চোর সব নিয়ে যেত! তিথীকে জিজ্ঞাসা করলাম কি ব্যাপার তিথী? তিথী থতমত খেয়ে বললো- স্যার ছাদে কাপড় দিতে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি এই লোকটা আপনার রুমের তালা খোলার চেষ্টা করছে। ওম্নেই পাশের বাসার ভাইয়া চোর চোর বলে চিল্লানি দিয়েছে, আমিও ধরে ফেলেছি। আস্তে করে বললাম কি ধরতে গিয়ে যে চোর ধরেছো তা আমি ভালো করেই জানি!
তিথী শুনেও না শোনার ভান করে চিল্লাইয়া বললো- আম্মা এত অল্প মাইরে হবেনা। চোরটাকে আরো পিটাও। স্যার আপনিও একটু মারেন প্লিজ! আমি কিছু বলার আগেই আন্টি আরো দু-একটা চড় থাপ্পড় দিয়ে ফেললো। থানায় ফোন দিচ্ছে আমি আটকিয়ে বললাম আন্টি থাক। এমন ছ্যাচড়া চোরদের থানায় দিয়ে লাভ নাই। আমার উপর ছেড়ে দেন, কোচিংয়ে নিয়ে পোলাপানের কাছ শক্ত ডলানি দিয়ে ছেড়ে দেই। সিয়ামকে নিয়ে বের হলাম। বেচারার অবস্থা খারাপ। চেহারার দিকে তাকানো যাচ্ছে না। জিজ্ঞাসা করলাম কাচ্চি কি নিয়ে গেছিলি? মন খারাপ করে উত্তর দিলো – হ নিছিলাম। তিথীকে দিলাম খাইতে, ওম্নেতেই পাশের বাসার ছাদ থেকে চোর চোর বলে চিল্লানি দিলো।
বললাম থাক বাদ দে। একটা বাজে দিন ছিলো। আমার হাতে তখনো কোকের বোতল। খালি পেটে কোক খাওয়া ঠিক হবেনা। আবার কাচ্চির দোকানে গেলাম। আমি খাচ্ছি, সিয়াম খাচ্ছে না। শুধু হাত দিয়ে নেড়ে যাচ্ছে। দোস্ত তিথী এটা কোন কাজ করলো? আমাকে এভাবে চোর বানিয়ে দিলো? মেয়ে মানুষ আসলেই সুবিধাবাদিরে। খুব খারাপ।
বললাম মন খারাপ করিস না। বাচ্চা মেয়ে বুঝেনাই কি করতে কি করবে। আমি তোকে আবার বাসায় নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিবো। মুখে দাড়ি লাগিয়ে আমার বন্ধুর পরিচয় দিয়ে! সিয়াম কাচ্চির প্লেটে জিদ করে থাপ্পড় দিয়ে বললো অসম্ভব। বাসায় যাওয়া তো দূরের কথা ওই কালপ্রিটের সাথে আর একদিনও না। তুই একটা কাজ করতে পারবি?
– কি?
– পড়ানোর সময় নিয়ম করে ওরে চড়াইতে পারবি?
কোকের বোতলে চুমুক দিতে দিতে বললাম ব্যাপারনা, কালকেই সোডিয়ামের পারমানবিক সংখ্যা আবার জিজ্ঞাসা করবো। তারপর অন্তত পাঁচটা চড় দিবো। সিয়াম ভরসা পেলো। কাচ্চি খাচ্ছে। আর আমি ভাবছি এমন সুন্দর গালে চড় দিলে দাগ পড়ে যাবে। বিচ্ছিরি দেখাবে। চড় দেওয়া যাবেনা। না পারলে বুঝিয়ে দিবো, বলবো সোডিয়ামের পারমানবিক সংখ্যা ১১। শত হলেও তিথীর মা আমাকে ভরসা করে!
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত