রবীন্দ্রনাথ কিংবা দেবতা

রবীন্দ্রনাথ কিংবা দেবতা
স্বপ্নে দেখলাম এক অপরিচিতার পরনে হালকা তামাটে রঙের শাড়ি,কনুই অবধি হাতাওয়ালা লম্বা ব্লাউজ, চুল গুলো কোমর ছুঁয়েছে, কোমরটা বেশ সরু। সরু কোমরে সোনার বিছা, মোমের আলোতেও তা চকচক করছে। তার দু হাতের তালুতে লাল টকটকে রক্তের মত গোল রঙা একখানা বৃত্ত, হয়তো সেটা মেহেদী কিংবা রক্তের ছাপ। আচ্ছা রক্তের ছাপ হতে পারে এমনটা কেন মনে হলো আমার? না, ওটা মেহেদীর রঙই হবে। দু পা জুড়ে তার ঘন আলতার বাহার । পা দুখানি দোলা মাত্রই সিঁদুর রঙা জীবন্ত পদ্ম মনে হয় তা।মেয়েটার মুখ একদিনও দেখিনি। চোখ দুটো কেমন এক অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়েই গানের তালে নেচে চলেছে। দূর থেকে মেয়েলি চিকন গলায় ভেসে আসছে, মম চিত্তে নিতি নৃত্যে কে যে নাচে তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ। নাচে জন্ম নাচে মৃত্যু পাছে পাছে, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ।
নাহ! আর ঘুম আসছে না। ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকিয়ে দেখলাম ঘড়িতে এখন দুইটা সাইত্রিশ। অদ্ভুতভাবে গতরাতেও একই সময়ে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল একই স্বপ্ন দেখে! কে এই মেয়ে? রবীন্দ্রসংগীতের তালে তালে তার চোখ দুটোও কি অদ্ভুতভাবে নেচে চলে! মুখ বাদে গোটা শরীরের দেখা মিলল স্বপ্নে, কেবল মুখটা দেখাতেই যেন তার যত আপত্তি!
নাহ, আজ আর ঘুম আসবে না। বেলকনিতে রাখা চেয়ারটায় বসে সিগারেট ধরিয়ে চোখ বুজতেই ইয়াসমিনের মুখটা ভেসে উঠল! আকস্মিক ধাক্কায় সঙ্গে সঙ্গে চোখ খুলে নিলাম। টানা তিনটে বছর যে মুখ কল্পনায়, স্বপ্নে আসেনি, সেই মুখটা আজ কেন চোখে ভাসছে! এই মুখটা যেন স্বপ্নে দেখি এমন আকুতি নিয়ে কতশত রাতে ঘুমাতে গেলাম, অথচ একটা দিনও দেখা মিলল না। ইয়াসমিনের মুখটা দেখার লোভে আবার চোখ বুজে নিলাম। চোখ মেললাম সকাল সাতটা একুশে। নাহ, অভিমানী মুখখানা আর দেখা দিল না। ঝটপট গোসল সেরে, গত রাতে এনে রাখা বেকারির বাসি রুটি চিনির পানিতে ভিজিয়ে খেয়ে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলাম অফিসের উদ্দেশ্যে। পথ আটকালেন বাড়িওয়ালা মন্টু ঘোষ। ভদ্রলোক বড্ড ঠান্ডা স্বভাবের মানুষ, নরম মন হওয়ায় ভাড়াটিয়াদের ভাড়ার জন্য কখনোই চাপ দেন না৷ অবশ্য ভাড়াটিয়া বলতে আমি সহ মোট তিনজনের বাস উনার বিশাল বাড়িতে। মন্টু ঘোষ স্বভাবমতো হেসে বললেন, অফিস যাচ্ছো বাবা?
-জ্বি, অফিসেই যাই। একটা বিষয়ে তোমার বুদ্ধি লাগে যে, আমি সিদ্ধান্তে আসতে পারছি না একটু সময় হবে?
-হ্যাঁ কাকা, সময় হবে না কেন? অফিসের মেলা দেরি, বলুন আপনি। এক ভদ্রলোক কাল এসেছিলেন নিচতলার দুটো ঘর ভাড়া নিতে। সমস্যা হচ্ছে উনি ঘর ভাড়া চাচ্ছেন গানের স্কুল করবেন এখানে। তোমার কাকিমা একবাক্যে আমাকে না করে দিয়েছেন৷ আমি বুঝে উঠতে পারছি না কী করব৷
-কাকিমা টিভিতে, ক্যাসেটে তো গান শোনেন। আপত্তি কেন হলো বুঝতে পারছি না। আমার মত চাইলে আমি একবাক্যে বলব আপনার ভাড়া দেয়া উচিত। মন্টু ঘোষ খানিকক্ষণ কী যেন ভেবে আবার হেসে বললেন, আচ্ছা তুমি অফিসে যাও বাবা। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি থাকায় রাস্তাঘাটে মানুষের সংখ্যাটা বড্ড কমে গেছে হুট করেই, লোকাল বাসগুলো এই বিকেলেও বেশ ফাঁকা। অফিসে শরীর, মগজের তাবৎ শক্তি ঢেলে দিয়ে ক্লান্ত মাথাটা বাসের জানালায় ঠেস দিয়েছি। আড়চোখে জানালার গ্লাস ছুঁয়ে পড়তে থাকা বৃষ্টির ফোঁটা দেখতে দেখতে মনে পড়ল, এমনি এক বৃষ্টির দিকে আমার ডান কাঁধে ইয়াসমিন মাথা এলিয়ে দিয়ে আমার মুখের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলেছিল, তোমাকে এমন শান্ত বর্ষায় একদিন আমি দুম করেই চুমু খেয়ে বসব, রাগ করবে?
ইয়াসমিনের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে জানান দিয়েছিলাম আমি এমন বর্ষার অপেক্ষায় থাকব ব্যাকুল হয়ে। ইয়াসমিন আমার ওমন জবাবে আমার ডান বাহুটা শক্ত করে জাপ্টে ধরে ওর চ্যাপ্টা নাকখানি বার দুয়েক আমার বাহুতে ঘষে নিয়ে ওর লজ্জার জানান দিয়েছিল সেদিন। ইয়াসমিন ছিল ম্যাথমেটিকস এর ছাত্রী, বয়সে আমার চেয়েও দু বছরের বড়। আমি ছিলাম বাংলার ছাত্র। ইয়াসমিনের ছোটো ভাইটাকে পড়াতে যেতাম, বয়সে বড় হওয়ায় আর টাকা-পয়সার অদৃশ্য স্তরে ওদের সাথে আমার গ্যাপটা ছিল সাহারা মরুভূমির মতো বিশাল চওড়া। আমি যেখানে ত্রিশ টাকায় সারাদিন পার করতে চাইতাম সেখানে ওরা তিন হাজার টাকা খরচ করে রেস্তোরাঁয় যেয়ে কব্জি ডুবিয়ে খেয়ে আসত। আমি দেখতে হ্যাংলা, কালো, রেজাল্ট ছিল টেনেটুনে সেকেন্ড ক্লাস।
আমাকে পছন্দ করার মতো একটা কারণ আমি নিজেই দেখাতে পারব না সেখানে ইয়াসমিনের যে আমাকে ভালো লাগবে সেটা আকাশকুসুম চিন্তার সামিল ছিল। আমি প্রায়ই আড়চোখে ইয়াসমিনকে দেখতাম। চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য কিংবা অতিমানবীয় সৌন্দর্য একটা সময় পর পানসে ঠেকে, আবেদন জাগায় না। তবে সাধাসিধে সৌন্দর্য উপেক্ষা করার শক্তি মানুষের থাকে না। ইয়াসমিনকে প্রথম সাক্ষাতে মনে হবে, আচ্ছা চলে আরকি। তারপর যতবার সাক্ষাৎ হবে ততবারই মনে হবে, সি ইজ সামথিং এলস। এক দুপুরে পড়াতে গিয়ে দেখি বাড়িসুদ্ধ মানুষ বেড়াতে গিয়েছে কেবল ইয়াসমিন বাদে। আমি বেরিয়ে আসতে যাচ্ছিলাম কিন্তু ইয়াসমিন আসতে দেয়নি। দুজনের মাঝে এক বিঘত দূরত্ব রেখে, চোখে চোখ রেখে চোয়াল শক্ত করে সে বলেছিল, মুহিব সাহেব, আপনাকে আমি চাই, খুব করেই চাই, দেবেন আপনাকে?
আমি সেদিন কোনো জবাব না দিলেও সপ্তাহ দুয়েক পর এক চিরকুটে লিখে জানিয়েছিলাম, আমার দেহযষ্ঠি শিরা-উপশিরা, রক্তকণিকা আর বুকের বাঁ পাশের নরম জায়গাখানি চাহিবামাত্র আপনাকে লিখে দিতে বাধিত হইব আমি।
ঘোর কাটল হেলপারের ডাকে, বাস মিরপুর দুইয়ে চলে এসেছে। বাসায় ফেরার পথে পাবদা মাছ, ধনেপাতা, টমেটো কিনে নিয়েই ফিরলাম। কদিন ধরে আলসেমি করে রান্না করছিলাম না, শেষ কবে ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত পেটভরে খেয়েছি সেটাও ভুলে গিয়েছি। বেকারির রুটি, বিস্কুট আর হোটেলের তেলতেলে পারাটায় ভাতের শান্তি মেলে না।
বাসায় গেটের সামনে আসতেই দেখলাম নিচতলার গানের স্কুল দেয়া ভাড়াটিয়া চলে এসেছে। আমাকে দেখেই একগাল হেসে বলল, আমি বরুণ, নতুন ভাড়াটিয়া। জবাবে আমি জোর করে যতটা পারা যায় ততটা কৃত্রিম হাসি হেসে বললাম, আমি মুহিব, চিলেকোঠায় থাকি। চল্লিশ পেরোনো বরুণ সাহেব তার গানের স্কুলে সুযোগ করে যাবার আমন্ত্রণ জানালেন, আমি যাব, অবশ্যই যাব, এমন জোর একখানা উত্তর মাথা ঝাঁকিয়ে দিয়েই সিঁড়ি মাড়িয়ে চিলেকোঠায় উঠে এলাম। আ্যশট্রে ভরতি সিগারেটের ফিল্টার, ফ্লোরজুড়ে সিগারেটের ছাই আর ঘরের গুমোট গন্ধ হুট করে নাকে আসতেই গা গোলাতে শুরু করল। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে এই গন্ধ এতদিন নাকে আসেনি আমার, এতদিন অফিস বন্ধ থাকায় বাইরের হাওয়া নাকে না আসার কারণেই ঘরের গুমোট গন্ধটা নাকও সয়ে নিয়েছিল দিব্যি! অথচ আমি? আমি তো আমার ইয়াসমিনের অনুপস্থিতি, তাকে হারানোর শোকটুকুও আজও সয়ে নিতে পারলাম না!
নাহ, গন্ধটা আর সহ্য করতে না পেরে দ্রুত হাতে ঘরখানা ঝাড়ু দিয়ে নিয়ে ব্যস্ত হাতে রান্নাঘরে গিয়ে ভাত চড়িয়ে দিয়ে মাছ কাটতে বসে গেলাম। পুরোনো পত্রিকা বিছিয়ে মাছ কেটে নিলাম রান্নাঘরেই। আমার মতো বাউন্ডুলে স্বভাবের মানুষটা আজ মাছ কাটে, ভাত রাঁধে! এও সম্ভব? মাঝেমধ্যে নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে বসি। হ্যাঁ সম্ভব, সম্ভব হয়েছে ইয়াসমিনের জন্যই। একদিন দুপুরে ইয়াসমিন আমার আগের বাসায় এসে হাজির! ক্লান্ত মুখ নিয়ে দরজায় দাঁড়িয়েই বলেছিল, পেটভরে ভাত খেতে এসেছি, ভাত খাওয়াবে? আমি তখন বাইরের হোটেলে খাই, ইয়াসমিনের ওমন আবদারে আমি সেদিন কী ভেবে যেন চট করেই বলেছিলাম আমি রান্না করে খাওয়াব তাকে। ব্যাস, সেই থেকে শুরু। ইয়াসমিন বটি কিনে এনে দিল, মাছ কাটা শেখাল। সেই থেকে আমি মাছ কাটতে পরি, নুন-তেল-হলুদের মিশ্রণে বেশ রাঁধতে পারি। আচ্ছা ইয়াসমিনের সেই বটিটা যেন কোথায় রেখেছি? ইদানীং চোখে পড়ে না, মনেও না।
সকাল সকাল ঘুম ভেঙে গেল কারো সুমধুর গানের সুরে। আহ! কত মায়া দিয়ে কেউ একজন গেয়ে চলেছে –
“তুই ফেলে এসেছিস কারে, মন, মন রে আমার। তাই জনম গেল, শান্তি পেলি না রে মন, মন রে আমার। যে পথ দিয়ে চলে এলি সে পথ এখন ভুলে গেলি– কেমন করে ফিরবি তাহার দ্বারে মন, মন রে আমার”। এত দরদ দিয়েও কোনো মেয়ে গাইতে পারে? কে গাইলো এত দরদ দিয়ে? চটিটা পায়ে দিয়ে দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নিচতলায় নেমে এলাম। গানের স্কুলের জানালায় চোখ রাখতেই দেখা গেল তেইশ-চব্বিশ পেরোনো এক যুবতী চোখ বুজে হারমোনিয়ামের সুরের তালে পৃথিবীর তাবৎ দরদ ঢেলে দিয়ে রবীন্দ্র গেয়ে চলেছে। যুবতীর জাদু করা গলায় আমি কখন যে ডুবে গিয়েছিলাম টেরই পাইনি, ঘোর কাটল কেউ একজন কাঁধে হাত রাখায়।
পেছন ফিরে দেখলাম এক মধ্যবয়স্ক পুরুষ হাসিমুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমাকে কোনো প্রশ্নের সুযোগ না দিয়েই তিনি বললেন, “আমি কিশোর, এই গানের স্কুলের শিক্ষক, আপনি বাইরে কেন? ভেতরে চলুন”। না বাসিমুখ নিয়ে, অফিসের তাড়া থাকায় আর ভেতরে যাওয়া হয়নি। পরে একসময় যাব এমন আশ্বাস দিয়ে কেটে পড়লাম ওখান থেকে। সন্ধ্যায় অফিস সেরে ঘরে ফিরেই বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম, জ্বরজ্বর ভাব হওয়ায় ওঠার শক্তিটুকুও পাচ্ছি না৷ কেমন যেন এক বিচ্ছিরি অবসাদ অনুভব হচ্ছে। হুট করেই নাকে ধূপের গন্ধ এলো, আশেপাশে কেউ ধূপ জ্বালাচ্ছে। তবে এই চিলোকোঠায় তো আমি ছাড়া কেউ থাকে না আর, তবে কে জ্বালাচ্ছে? না, উঠে বাইরে যেতেও ইচ্ছে করছে না। চোখ বুজে নিয়েছিলাম, হঠাৎ করেই কানে এলো সকালের সেই যুবতীর গলা৷ ঝরঝরে গলায় গেয়ে চলেছেঃ- “আমি ফুল তুলিতে এলেম বনে– জানি নে, আমার কী ছিল মনে।
এ তো ফুল তোলা নয়, বুঝি নে কী মনে হয়, জল ভরে যায় দু নয়নে” নাহ, এবার তো দেখতেই হয় ছাদে হচ্ছেটা কী। নিজের ওপর জোরজবরদস্তি করে বিছানা ছেড়ে দরজা মেলতেই দেখলাম কেউ একজন ছাদের এককোনায় দাঁড়িয়ে আছে। আমি দরজার বাইরে পা বাড়াতেই টের পেলাম আমার মাথা ঘোরাচ্ছে, চোখে অন্ধকার । তারপর আর কিছু মনে নেই। ঘুম ভাঙল সকালের দিকে। ঘুম ভাঙতেই দেখলাম সেই যুবতী আমার মাথার কাছে চেয়ার পেতে বসে আছে। আমাকে চোখ মেলতে দেখেই স্মিত হেসে বলল, কি যে দুশ্চিন্তায় ফেলেছিলেন আপনি! ভাগ্যিস আমি ছাদেই ছিলাম, নয়তো ওভাবেই বাইরে পড়ে থাকতেন। কাল রাতে তো জ্বরে আপনার গায়ে আগুন ধরতেই বাকি ছিল কেবল! এখন অবশ্য জ্বর নেমে গেছে। কেমন লাগছে এখন? আমি কোনমতে শোয়া থেকে উঠে বসে সিগারেটের প্যাকেট হাতে নিয়ে ইশারায় তার পারমিশন নিয়ে সিগারেট জ্বালিয়ে বললাম, প্রশ্ন তো একগাদা করলেন, কোনটার উত্তর দেব?
-দুটোর উত্তর দিন আপাতত । এক, আপনার নামটা জানা হয়নি। দুই, দুধ গরম করে দেব নাকি কড়া করে লিকার চা? আমি মুহিব, চা হলেই হবে। আপনার নামটা?
– আমি তোপা, নিচের গানের স্কুলের নতুন শিক্ষিকা। আপনি আরাম করে সিগারেট টানুন, আমি চা করে নিয়ে আসি। আচ্ছা চিনি সম্ভবত দেড় থেকে দুই চামচ, তাই তো? আমি অবাক না হবার ভান ধরে ফর্মাল গলায় বললাম, হ্যাঁ দিতে পারেন, সমস্যা নেই। তোপা তার প্রশ্নের উত্তর পেয়েই আমার ঘিঞ্চি রান্নাঘরে ঢুকে গেল চা বানাতে। মেয়েটার সাথে আজই প্রথম কথা, পরিচয়। অথচ কতটা সহজ! কতটা সাবলীল! আমি চায়ে অল্প চিনি খাই সেটাও কী করে যেন জেনে গেল!
সময় গড়াতেই আমি তোপাকে একজন ম্যাজিশিয়ান রূপে আবিষ্কার করতে থাকলাম। যে কি না আমার খুঁতখুঁতে স্বভাব, আমি তরকারিতে নুন বেশি খাই, বাসের জানালার জানালার পাশের সিট ছাড়া বসি না, চকচকে শার্ট ছাড়া বাইরে বের হই না – এ সমস্ত সব খবর সে নিজে থেকেই আন্দাজ করে বলে দিতে থাকল৷ যে মানুষগুলো মুগ্ধ করার ক্ষমতা রাখে আমরা তাদের কাছে বারবার ছুটে যাই, তাদের সঙ্গের লোভে থাকি। আমার বেলাতেও এই নিয়মের ব্যতিক্রম হলো না।
জ্বরে সেদিন সন্ধ্যায় মাথা ঘুরে পড়ে যাবার পর সেই যে তোপার সাথে আমার একটা বোঝাপড়া শুরু হলো, তোপা রোজ সন্ধ্যায় ছাদে আসতে শুরু করলো, সেটা রোজ নিয়ম মেনে চলতে থাকল। এর মাঝে তোপাদের গানের স্কুলে ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি হয়েছে বেশ, তোপার স্কুলের ব্যস্ততা বাড়লেও সেটাকে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করিয়ে আমাকে কখনো অবহেলা করেনি, এড়িয়ে যায়নি, বন্ধুত্বের খাতিরে হোক বা অন্য কোনো কিছুর খাতিরে তোপা নিজের চেয়েও যে আমাকে বেশি গুরুত্ব দেয় সেটা আমি দিন দিন টের পেতে শুরু করেছি। অফিস থেকে ফিরে দেখি তোপা ভাত তরকারি রেঁধে নিজে খেয়ে আমার জন্যও ঢেকে রেখে গিয়েছে। এটা আজকাল প্রতিদিনই ঘটছে। তোপাকে বারবার মানা করা সত্ত্বেও সে কোনো বারণ মানতে রাজি না৷ সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গানের স্কুলের জানালায় উঁকি দিতেই দেখা গেল তোপা হারমোনিয়াম নিয়ে বাচ্চাদের গান শিখিয়ে চলেছে, বাসন্তী রঙা শাড়িতে তোপাকে ঠিক কেমন লাগছে সেই বর্ননা দেবার ক্ষমতা উপরওয়ালা আমাকে দেননি বলেই কেবল ফ্যালফ্যাল করে তোপার দিকে তাকিয়ে রইলাম। তোপা আমাকে দেখেই ঠোঁট টিপে হেসে ইশারায় জানালো সে ক্লাস শেষ করিয়েই উপরে আসছে।
সিঁড়ি মাড়িয়ে উপরে উঠতে উঠতে নিজেকে প্রশ্ন করলাম, তোপার কাছে আমি চাই কী? কেন নানা ছুতো ধরে তোপাকে কেবল কাছাকাছি রাখতে চাইছি আমি? ইয়াসমিনকে কেন ভুলতে বসেছি? শেষ দুটো মাসে তোপা যতটা কাছে এসেছে, বা আমি কাছে টেনেছি ঠিক ততটাই দূরে কেন ইয়াসমিনকে সরিয়ে দিলাম? তোপা আমার কে? বন্ধু? না, উত্তর পাচ্ছি না। নিজেকে প্রশ্ন করে যখন উত্তর আসে না, উত্তরের আশায় অন্যর দিকে চেয়ে থাকতে হয় তখন মানুষ অসহায় হয়ে পড়ে, সাংঘাতিক রকমের অসহায়। আমিও আজকাল অসহায় হয়ে পড়েছি, ভীষণ অসহায়৷
ঘরে ঢুকে খাটের উপর ধপাস করে বসে পড়লাম , কেমন এক অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে যেন। বোঝানোর মতো না। মাথার ওপরের সিলিং ফ্যানটাও যেন বড্ড ক্লান্ত ঘুরতে ঘুরতে। ভ্যাপসা গরম অনুভূত হচ্ছে, দরদরিয়ে গা ঘেমে চলেছে। কেন এমন হচ্ছে হুট করেই? দরজায় দুটো টোকা পড়ল, তোপা এসেছে। দরজা মেলতেই তোপা ভ্রু কুঁচকে বলল, তুমি এত ঘামছো কেন? কেমন যেন বিমর্ষ লাগছে তোমায়। কী হয়েছে?
-বুঝতে পারছি না কী হয়েছে, তবে শান্তি পাচ্ছি না কেন জানি। তোপা কেমন অদ্ভুতভাবে খানিকক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে ফিক করে হেসে ফেলে বলল, তুমি গ্রীষ্মের আকাশের মতো কিংবা রবীন্দ্রের গানের তালের মতো। এক কঠিন সুন্দর তুমি, ঠিকঠাক বোঝা যায় না তোমায়।
-ঠিকঠক না বুঝতে পারাটাই উচিত। বুঝে ফেললেই সর্বনাশ। তোমাকে বুঝে ফেলে কি যে সর্বনাশ হয়েছে সে কেবল আমিই জানি। তোপা চোখ বড়বড় করে, আমার দিকে খানিকটা এগিয়ে এসে নিচু গলায় বলল, কী সর্বনাশ হলো তোমার শুনি?
– তা বলা যাবে না। আচ্ছা আমাকে এক গ্লাস শরবত করে দেবে? খুব বেশি চিনি দিয়ে, মুখটা একদম মিঠে হয়ে যাবে এমন করে। দেবে?
তোপা যন্ত্রের মতো রান্নাঘরের দিকে চলে গেল তার প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে। মেয়েটা রাগ হলে ঠিক ইয়াসমিনের মতো নিষ্পাপ ঠেকে। রান্নাঘর থেকে চিরচেনায় গলায়, দরদ মাখানো সুরে ভেসে আসছে “আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে দেখতে আমি পাই নি। তোমায় দেখতে আমি পাই নি। বাহির-পানে চোখ মেলেছি, আমার হৃদয়-পানে চাই নি। আমার সকল ভালোবাসায় ,সকল আঘাত সকল আশায় তুমি ছিলে আমার কাছে, তোমার কাছে যাই নি” চোখ বুজে তোপার জাদুকরা গলার সুরে ঝিম মেরে বসে ছিলাম। মুখের সাথে ঠান্ডা কিছুর স্পর্শে চোখ মেলে দেখলাম তোপা শরবতের ঠান্ডা গ্লাস আমার মুখের সাথে চেপে ধরে আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি করে হাসছে।
আমিও ফিক করে হেসে দিয়ে শরবতের গ্লাস হাতে নিয়েই এক নিশ্বাসে পুরো শরবত শেষ করে ফেললাম। তোপা চেয়ার ছেড়ে বিছানায় এসে আমার পাশে বসে মাথা নিচু করে বলল, ইয়াসমিন তো একখন্ড অতীত কেবল৷ অতীত সাদা কাগজে লাল কালির দাগ কেবল, মোছা যায় না। তোমাকেও মুছতে বলবো না। আমি তোমার সঙ্গ চাই সারাক্ষণ, একবেলার বদলে তিনবেলা রাঁধতে চাই তোমার ঘরে। বিজ্ঞাপন দিয়ে রাঁধুনি খোঁজার বদলে স্বজনপ্রীতি করে পোস্টটা আমায় দিলে নিয়ম করে সকাল-সন্ধ্যা রবীন্দ্র শোনাব ফ্রিতেই। দেবে পোস্টটা আমায়? বিচ্ছিরি রকমের অবসাদ, গা ঘামা সব যেন মুহূর্তেই আমায় ছেড়ে পালালো। ফুরফুরে এক হাওয়া বয়ে গেল মনের বাঁক দিয়ে। বিছানা ছেড়ে সোজা আলনার কাছে গিয়ে শার্ট বদলে নিতে নিতে তোপাকে বললাম, বাজার কী লাগবে বলো, অফসিয়িয়ালি দুজন মানুষের সংসার শুরু হচ্ছে যে।
তোপা আমার খুব কাছে এসে নরম গলায় বলল, কটা পুঁটি, ধনেপাতা আর মসুরির ডাল হলেই চলবে। দুজনের সংসারে এর চেয়ে বেশি কী চাই বলো? অগোছালো জীবনটা কেমন যেন হুট করেই গুছিয়ে গেল। তোপা আর আমি ছুটির দিনে একসাথে সিনেমা দেখতে যাই, পার্কে আঙুলে আঙুল ছুঁয়ে হাঁটি। দুবেলা তোপা ভাত রাঁধে, আমি তরকারি কাটি আর তোপার জাদু করা গলায় রবীন্দ্র শুনি। তবে বিপত্তি বাধল অন্য জায়গায়। তোপাকে বিয়ের কথা বললেই তোপা কেমন যেন এড়িয়ে যায়। একদিন শক্ত করেই তোপাকে বললাম, তুমি বিয়ের কথা তুললে এড়িয়ে যাও কেন? পালাও কেন?
তোপা সেদিন উত্তর দেয়নি। উত্তরটা পেলাম আজ বিকেলে৷ ঘরে বসে অফিসের ফাইল চেক করছিলাম , বরুণ সাহেব আমাকে এসে বললেন আমি যেন একবার নিচতলা থেকে ঘুরি আসি। আমি কৌতূহল নিয়ে গানের স্কুলের জানালায় চোখ রাখতেই দেখলাম, কিশোর নামের লোকটা তোপাকে পেছন দিক থেকে জাপ্টে ধরে আছে, তার হাতটা সাপের মতো তোপার কোমর পেঁচিয়ে রেখেছে। ঐ মুহূর্তে আমার গোটা দুনিয়া ঘুরতে শুরু করেছে, আমার গা ঘামছে, তোপার শরীরটা আগুনে পুড়িয়ে মারতে ইচ্ছে করছে। অনেকক্ষণ খোঁজাখুঁজি করার পর ইয়াসমিনের কিনে দেয়া বটিটা খুঁজে পেলাম আলমারিতে, জং ধরেছে বটিটা বেশ। বালু দিয়ে ঘষেঘষে বটিটার আগের রূপ ফিরিয়ে আনলাম। দরজায় দুটো টোকা পড়েছে, মানে তোপা এসেছে। দরজা খুলতেই তোপা হাসিহাসি মুখ করে বলল, এমন ঘামছো কেন তুমি? মুখ এত লাল হলো কেন?
উত্তর না দিয়ে রান্নাঘর থেকে দু কাপ লিকার চা নিয়ে এলাম৷ তোপার দিকে কালো কাপটা এগিয়ে দিয়ে যতটা জোর করে হাসা যায় ততটা কৃত্রিম হাসি হেসে বললাম, চা খাও, চা খেতে খেতে কথা বলি। তোপা কয়েক চুমুক দিতেই বলল তার কেমন যেন লাগছে। মিনিট পাঁচেক যেতে না যেতেই তোপা জ্ঞান হারলো। এই মহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষাতেই ছিলাম আমি। ফ্লোরে পুরোনো পত্রিকা বিছিয়ে নিলাম, চটের বস্তা দুটো খাটের কোণায় এনে রাখলাম। তোপাকে খাট থেকে নামি ফ্লোরে শুয়ে দিলাম, ইয়াসমিনের দেয়া বটিটা খাটের তলা থেকে বের করে নিলাম। তোপার গলায় বটিটা ধরতে যাব এমন সময় পেছন থেকে খুব জোরে কে যেন লাথি মারল। মাথা উল্টে পড়ে গেলাম। বরুণ, কিশোর সহ আরো দুজন আমার ঘরে চলে এসেছে! সবাই রিভলবার আমার দিকে তাক করে রেখেছে। অদ্ভুতভাবে তোপা জেগে উঠেছে, তোপা খিলিখিলিয়ে হেসে চেয়ারটা টেনে চেয়ারে পা তুলে বসে বলল, বটিটা ফেলে দাও মুহিব। আমি বটিটা আরো শক্ত করে চেপে ধরলাম, আমার গা ঘামছে, গা কাঁপছে। কিশোর ধমক দিয়ে আমাকে বটি ফেলে দিতে বলল, আমি ফেললাম না৷ কিশোর ফাঁকা গুলি ছুড়তেই আমি বটিটা ফেলে দিলাম। বরুণ সহ আরো কয়েজন এসে আমাকে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে নিচে নিয়ে এলো। বাড়িওয়ালা মন্টু ঘোষের সাথে বরুণরা হ্যান্ডশেক করল। মানে! বাড়িওয়ালা এদের সাথেই ছিল।
একটা বদ্ধ ঘরের চেয়ারে আমাকে বসানো হয়েছে। মাথার ওপর একশো ওয়াটের একটা বাল্ব জলছে। আমার সামনের চেয়ারে তোপা এসে বসেছে, তোপার দুই পাশে দাঁড়িয়ে আছে কিশোর আর বরুণ। তোপা আমার চোখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, তোমার নাম মুহিব, বাড়ি বগুড়া, বাংলার ছাত্র ছিলে। তোমার মা ছিলেন অসম্ভব রকমের রূপবতী মহিলা, তিনি অন্য একজনের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন, তুমি সেই পুরুষের সাথে তোমার মাকে খুব অন্তরঙ্গ অবস্থায় দেখতে পাও, তারপর থেকে মায়ের কাছ থেকে দূরে দূরে থাকো। তোমার মা একদিন সেই পুরুষের সাথে চলে যায় তোমার বাবাকে ফেলে। ঘরে ধূপ জ্বলছিল, ধূপের আগুন বিছানায় ঢেলে দিয়ে তোমার বাবা অজ্ঞান হবার ইনজেকশন নেন৷ তারপর সেই আগুনে তোমার বাবা পুড়ে মরেন। তোমার বাবা ছিল সাইকোসিস পেশেন্ট, উনি নিজের জীবনটাকে কখনোই ভালোবাসেননি, নিজেকে আঘাত করে উনি আনন্দ পেতেন৷ আমি যা যা বললাম সব ঠিক বলেছি তো? তোপার চোখে চোখ রাখার সাহস হলো না আর, চোখ নামিয়ে নিয়ে কেবল মাথা ঝাঁকিয়ে জানান দিলাম তোপার কথা সত্য৷
তোপা পানির গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলল, তুমি তোমার বাবার মতো সাইকোসিস হয়েছো আর সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হচ্ছে তোমার নিউরোসিস সমস্যাও আছে ৷ নিউরোসিস প্রব্লেম ফেস করা মানুষ জানে নিজের মানসিক অসুখটা কোথায়, তবুও সে সেই অসুখটা যত্নে পোষে। তবে উনি রাগ করতেন না৷ আর তুমি? তুমি প্রচণ্ড রাগী একজন মানুষ, যার রাগের কাছে, ক্রোশের কাছে পৃথিবীর সব কিছু তুচ্ছ। তুমি সাইকোলোজির ভাষায় আ্যংজাইটি ডিজওর্ডারে ভুগছো৷ তুমি ভেবেছিলে তোমার মায়ের মতো ইয়াসমিনও তোমাকে ফেলে অন্য পুরুষের সাথে চলে যাবে, তাই তাকে তার ছেলে বন্ধুদের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দাও, যোগাযোগ করতে নিষেধ করে দাও। যেদিন দেখলে সে তার এক ছেলে বন্ধুর সাথে রিক্সায় ঘুরছে, সিনেমা দেখতে গেছে সেদিনই তাকে বাসায় ডেকে মেরে ফেললে! তাই না?
আমি কোনো উত্তর দিতে পারলাম না, আমার কেমন যেন গা ঘামছে, নাকে ধূপের গন্ধ আসছে। আমি তোপার কথার জবাব দিলাম না, আমার মাথা ঘোরাতে শুরু করেছে। তোপা গ্লাসের সমস্ত পানি আমার মুখে ছুড়ে দিয়ে চেঁচিয়ে বলল, উত্তর দে বললাম, শুয়োরের বাচ্চা, উত্তর দে। তোরে ঐ বটি দিয়েই কুপিয়ে মেরে ফেলব নাহলে।
তোপার এমন কথায় আমি নিজের রাগ সংবরণ করতে পারলাম না। চেঁচিয়ে বললাম, হ্যাঁ মারছি ওরে আমি, বেশ করেছি। সুমনের সাথে রেস্টুরেন্টে খেতে যায়! বারবার বলেছি ওর লাইফে আমি ছাড়া কোনো ছেলে থাকবে না, থাকবে না, থাকবে না। তবুও কেন? কেন সুমনের সাথে গা ঘেষে রিক্সায় চড়তে হবে, কেন সিনেমা হলে যেতে হবে, ও আমার, শুধু আমার। কারো সাথে কথা বলতেও পারবে না, কেবল আমার সাথে কথা বলবে। তোপা হো হো করে হেসে উঠল। হাসি থামিয়ে বলল, এটাই চাচ্ছিলাম তো। আচ্ছা ইয়াসমিনের ডেডবডি কোথায়? কোথায় রেখেছিস?
– আমার আগের বাসার পেছনে যে পুকুর আছে, বস্তায় ভরে ওখানে ফেলে দিয়েছিলাম। তোপা কিশোর আর বরুণকে ইশারায় বের করে দিয়ে চেয়ার টেনে আমার কাছাকাছি বসল। সিগারেট ধরিয়ে কয়েক টান দিয়ে বলল, তোমাকে ধরার জন্য রবীন্দ্রসংগীত চর্চার স্কুল খুললাম, সিগারেট ছাড়লাম, পুরোদস্তুর রবীন্দ্র প্রেমী হয়ে উঠলাম। কারণ তুমি রবীন্দ্রর এক পাগল ভক্ত, নিজেকে সেভাবেই হাজির করলাম তোমার সামনে। পাক্কা ছয় মাসের প্ল্যান। তোমাকে সবাই সন্দেহর বাইরে রেখেছিল কারণ তোমার সাথে ইয়াসমিনের সম্পর্ক ছিল সেটা কেউ জানত না। তবে তোমার আগের বাসার দারোয়ানকে জেরা করতেই সে তোমাদের সম্পর্কের কথা বলে দিল। টাকা দিয়েও মুখ বন্ধ করতে পারলে না।আমরা জানতাম তোমার দুর্বল জায়গা কোথায়, তাই বরুণ সাহেবকে দিয়ে তোমাকে সেদিন বিকেলে নিচে এনেছিলাম আমার আর কিশোরের ঘনিষ্ঠতা দেখাতে। ও হ্যাঁ, সে আমার প্রেমিক। তোমাকে বলা হয়নি।
তুমি সাইকোসিস পেশেন্ট আবার নিউরোসিস পেশেন্টও। আ্যংজাইটি ডিসওর্ডার আছে, পুরোনো তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে, চোখের সামনে বাবার মৃত্যু দেখেছ তাই ইয়াসমিনকে নিয়েও ভয়ে ছিলে। আর তোমার রাগ উঠলে তো দুনিয়া ভুলে যাও, তাই রাগ সামলাতে না পেরে মেয়েটাকে মেরে দিলে। লাশটাও কেউ পায়নি। তবে কী জানো, ভালোবাসলে স্পেস দিতে হয়, ভালোবাসা মানে ভালোবাসার মানুষটার হাতে, পায়ে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা না। বেঁচে থাকতে গেলে স্বামী, বন্ধু, বাবা, মা সবার দরকার পড়ে। নিজেকে প্রেমিক ভাবতে পারোনি তুমি, দেবতা ভেবেছ, প্রভু ভেবেছ। তুমি রাগটুকুন, আর তোমার সাইকোলোজিক্যাল প্রব্লেম বাদ দিলে ভালো প্রেমিক হতে পারতে। যাইহোক, কিছু করার নেই। আইনের হাতে নিজেকে ছেড়ে দাও এবার।
আমি এতক্ষণ কেবল মাথা নিচু করে শুনে যাচ্ছিলাম। কিছু বলিনি। মনে হচ্ছে শেষবারের মতো তোপার গলায় দু লাইন রবীন্দ্র না শুনলে আমি তেষ্টায় মরে যাব ফাঁসি হবার আগেই। মাথা নিচু করেই বললাম, দু লাইন রবীন্দ্র ভিক্ষে
দেবে আমায়? শেষবারের মতো? তোপা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে সেলের বাইরে যেতে যেতে নিচু গলায় গেয়ে
চলেছে – “ভালোবেসে সখী নিভৃতে যতনে আমার নামটি লিখো, তোমার মনের মন্দিরে”।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত