টাকা

টাকা
“ নাশতা তো করে যাও? ভাত তো কোনো দোষ করেনি! ”
“ তুই রান্না করছিস তুই খা। অসহ্য লাগে তোকে এখন। ”
জুবায়েরের এরকম আচরণের কারণটা হলো পাঁচ লাখ টাকা লাগবে। জুবায়েরের এক বন্ধু তুষারের থেকে ধার নিয়ে ব্যবসায় নেমেছিল। পুরো টাকাই লস হয়ে গেছে। টাকা নেওয়ার সময় কথা দিয়েছিল জুবায়ের। সময় মত টাকা না দিতে পারলে তুষার যা চাইবে তাই দিবে সে। টাকা শোধ করার সময় আছে আর মাত্র চার দিন। কোথাও টাকা পাচ্ছে না জুবায়ের।
“ আমাকে গালাগালি করছো কেন? আমাকে গালাগালি করলে কি টাকা পেয়ে যাবে? “
“ তুই কোন দেশের রানি হইছিস তোকে গালাগালি করে যাবে না! বসে বসে খাওয়া ছাড়া তো আর কিছু পারিস না। বললাম বাপের বাড়ি থাইকা দুয়েক লাখ টাকা এনে দে। তাও পারবি না। স্বামীর বিপদের দিনে স্ত্রী একটু সাহায্য করে না? “
“ তুমি তো জানো আমাদের অবস্থা। পারলে বাবা দিয়ে দিত। আমি বাবার সাথে আলাপ করেছি না? “
“ হ আলাপ করেই তোর দায়িত্ব খালাস। আমি পুরুষ মানুষ। সব আমাকেই দেখতে হবে! ” এই বিষয় নিয়ে আর কথা বাড়াল না জাকিয়া। রাতেও খায়নি জুবায়ের। এখন বাজে সকাল এগারটা।
“ তোমার প্রিয় কৈ মাছ রান্না করেছি। ভাত খেয়ে নাও। ভাত না খেলে যদি টাকা আসত। তাহলে খাওয়ার জন্য বলতাম না। না খেলে তো টাকা আসবে না, তাই না? খেয়ে নাও! “
“ তুই আমার সামনে থেকে যা। নাহয় মারধর করতে পারি। মেজাজ খারাপ আছে! ”
“ আমাকে মারধর করলে তুমি শান্তি পাবে? টাকা আসবে? যদি টাকা আসে তাহলে মারো সমস্যা নাই। “
“ এত বেশি কথা বলিস কেন? কি মনে হয় আমি তোকে মারতে পারব না? এই দেখ পারি কি না! “
বলেই জাকিয়ার গালে একটা থাপ্পড় মারল জুবায়ের। নরম গালে শক্ত হাতের থাপ্পড় পড়তেই আঙুলের দাগ হয়ে গেছে। চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছে নিচ্ছে নিজের চোখের পানি। দালানকোঠার এই একটাই বিশেষ বিষয়। সুখে থাকলেও আশেপাশের মানুষ টের পায় না। দুঃখেও থাকলেও না। গ্রামে এরকম একটা থাপ্পড়ের শব্দে দশ বাড়ির লোকজন এক হয়ে যেত। জাকিয়া নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করল, কাল রাত থেকে আমিও কিচ্ছু খাইনি জুবায়ের। আমার খুব খিদে পেয়েছে।
‘ তোরে খাইতে মানা করছে কে? না কি মুখে সেলাই করা? ‘
‘ তুমি না খেলে আমি খাই? ’
‘ নতুন বউয়ের মত কথাবার্তা কইস না। তুই আর নতুন নাই। ‘
‘ তুমি কি আমাকে না খেয়ে থাকতে বলছো? ‘
‘ এতই কীরা তোর। না খেয়ে থাকতে চাচ্ছিস তো থাক। ‘
কালকে এক খুশির সংবাদ শুনেছে জাকিয়া। ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল। প্রেগন্যান্সি টেস্ট করিয়েছিল, ডাক্তার ফোন করে জানিয়েছে টেস্ট পজিটিভ। এরকম খুশির একটা সংবাদ জুবায়েরকে দেওয়ার মত কোনো পরিবেশই হচ্ছে না। এখন থেকে যদি সে না খায়। নিজের তো অসুবিধে হবেই। পেটের বাচ্চারও অসুবিধে হবে। বাচ্চার কথা ভেবে সে জুবায়েরকে রেখেই খেয়ে নিয়েছে। জুবায়ের হাসতে হাসতে বলল, এই তোর ভালোবাসা! জাকিয়া কোনো উত্তর দিতে পারল না। ভালোমতো খেয়ে নিল আগে। এর মাঝে আবার জুবায়ের বলল, বিয়ের সময় মেয়েদের গহনা দেয় মায়েরা। তোর মা তোকে কী দিছে? একটা কম্বল আর আলমারি। আজকাল এসব কেউ দেয়? সোনা রুপা দিলে আজকে কাজে লাগত না? এই কথারও কোনো জবাব নেই জাকিয়ার কাছে। কথা সত্য। মা বিয়ের সময় সোনা রূপা দিলে আজকে কাজে লাগত। সামার্থ থাকলে সব মায়েরাই দেয়। জাকিয়ার মাও দিত। উনার সামার্থ নেই তাই দোয়া ছাড়া কিছুই দেয়নি। এখন জাকিয়ার মনে হচ্ছে সেই দোয়াতেও মনে হয় কমতি ছিল!
“ আমি যাচ্ছি তুষারের কাছে। দেখি কিছু একটা হয় কিনা। এর তুই খা। পেট ভইরা খা! কিন্তু দয়া কইরা ন্যাকা কান্না করিস না। ন্যাকা কান্না দেখতে আমার ভালো লাগে না। ” তুষারের অফিস জয়দেবপুর। সে ল্যান্ড মানে জমির ব্যবসা করে। জমি বুঝে ভালো। কোন জায়গার দশ একর জমির দশ বছর পরে কত মূল্য দাঁড়াবে সেটা তুষারের চেয়ে ভালো দুয়েকজন জানে এই বাংলাদেশে। অফিসে ঢুকেই তুষারের পায়ে পড়ে গেল জুবায়ের। লাভ হয়নি। পা সরিয়ে নিয়ে বলল, বস চেয়ারে, কথাবার্তা বলি।
‘ আমার কাছে পঞ্চাশ হাজার টাকা আছে। তাও ঘরের জিনিসপত্র বিক্রির টাকা। আমাকে মাফ করে দে দোস্ত! ‘
‘ টক লাইক অ্যা ম্যান জুবায়ের! ব্যবসায়ে শুধু ডিল হয়, মাফ-টাফের কিছু নাই। তুই টাকা দিতে পারবি না? “
“ নাহ! “
“ আমি ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে কথাবার্তা বলতে পছন্দ করি না। যা বলি সরাসরি।
টাকা দিতে না পারলে তোর বউকে আমার কাছে রেখে যাবি। এক রাত থাকবে। পাঁচ লাখ টাকা মওকুফ হয়ে যাবে! ” জুবায়ের আর কিছু বলতে পারল না। ফিরে গেল বাসায়। সন্ধ্যার দিকে বাসায় গিয়ে দেখল জাকিয়া খাচ্ছে। ডাক্তার ফোন দিয়ে বলেছে সময়মত খেয়ে নিতে। নাহলে বাচ্চার সমস্যা হবে। জাকিয়া বলল, হাতমুখ ধুয়ে নাও। ভাত দিচ্ছি। জাকিয়ার খুব কাছাকাছি গিয়ে জুবায়ের বলল, আমার জন্য একটা রাত তুই তুষারের সাথে কাটাতে পারবি? জাকিয়া স্তব্ধ হয়ে গেল কথাটা শুনে! ঋণে পড়ে জুবায়েরের ব্যবহার কিছুটা ক্ষীণ হয়েছে কিন্তু এরকম একটা কথা জুবায়ের বলতে পারবে ভাবেনি সে!
‘ তুমি আমাকে এক্ষুণি ছাদ থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করতে বলো। আমি তাই করব। কিন্তু ওরকম প্রস্তাব দিয়ো না। পরে তুমিও আমাকে ভালোবেসে কাছে টানবে না। অপবিত্র মনে করবে। আমিও বিবেকের তাড়নায় ধুঁকে ধুঁকে মরব! ‘ জাকিয়ার কথা শুনেনি সে। চারদিন পরে সে জাকিয়াকে নিয়ে তুষারের অফিসে হাজির। তুষারের হাতে জাকিয়াকে তুলে দিয়ে জুবায়ের চলে গেছে। সকালে এসে নিয়ে যাবে। এই একটা রাতের জন্য জাকিয়া আর তাঁর স্ত্রী না। তুষারের প্রেমিকা।
অফিসে থাকার জন্য একটা কক্ষ আছে। জানালা একটা। অ্যাডজাস্ট বাথরুম। দামি একটা খাট। আলমারি ফ্রিজ সবই আছে। জাকিয়া কান্না করছে। জুবায়ের তাঁকে পাছ লাখ টাকার জন্য অন্য ছেলের হাতে ফেলে রেখে চলে গেছে এর জন্য না। এই তুষার তাঁর প্রাক্তন প্রেমিক ছিল! বিয়ের কথা তুষার বলতেই সে আঙুল সোজা করে বলেছিল, তুই একটা রিকশাচালকের ছেলে! তোর সাথে প্রেম করেছি ওটাই বেশি আবার বিয়ে! নিজের বুদ্ধি কাজিয়ে লাগিয়ে পরে ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে বাজারের আশেপাশে জায়গা কিনতে থাকে। ঐ জায়গাগুলোতে কখনো লাভ ছাড়া ক্ষতি হয় না। কয়েক বছরে ভাগ্য পাল্টে গেছে তুষারের।
“ কান্না করছো কেন জাকিয়া? তোমাকে আমি ছুঁয়েও দেখব না! তাছাড়া তোমার সাথে রাত কাটানোর উদ্দেশ্য আমি জুবায়েরকে টাকা দেইনি। ব্যবসার ভালোর জন্যই দিয়েছিলাম। যেহেতু টাকাটা ফেরত দিতে পারেনি। তাই ভাবলাম তোমার সাথে একটা রাত দুঃখ সুখের গল্প করি। তা বলো কেমন আছো? ” জাকিয়া কোনো কথা বলতে পারছে না। খুব ইচ্ছে করছে পালিয়ে যেতে। কিন্তু তাও সম্ভব না। পালিয়ে গেলে জুবায়ের বাসায় ঢুকতে দেবে না। তুষার আবার বলল, এত বেশি কান্না করলে পেটের বাচ্চার নাভি শক্ত হবে না! এবার জাকিয়ার কান্না থামল। আশ্চর্য হয়ে গেছে সে! পেটের বাচ্চার কথা তুষার কীভাবে জানলো? সে বাচ্চার কথা জুবায়েরকেও বলেনি। একমাত্র ডাক্তার আর সে ছাড়া কেউই জানে না! তাছাড়া এমনও না যে তাঁর শারিরীক পরিবর্তন হয়েছে। দশ বারো দিনে তেমন কোনো শারীরিক পরিবর্তন আসে না।
“ পেটের বাচ্চার কথা তুমি জানো কীভাবে? “
“ ঐ ডাক্তার স্ত্রী! তোমার কথা বলেছিলাম। চেনে তোমাকে। তাই তোমার এই খবরটা আমাকে জানিয়েছে। বাদ দাও এসব। কী খাবে? “
“ কিছু না! ”
“ দুনিয়াটা বড় অদ্ভুত জাকিয়া। মানুষের বিশ্বাস বলতে কিচ্ছু নেই। সারারাত আমি তোমার কাছেও ঘেঁষবো না। তাও দেখবে জুবায়ের তোমাকে অন্য
চোখে দেখবে! ” ঠিক তাই হলো। সকালে জাকিয়াকে নিতে আসলো জুবায়ের। রিকশায় বসে আছে দুজন। দুজনের মধ্যে কোনো কথা হচ্ছে না। বাসায় আসতেই জুবায়ের বলল, গোসল করে নাও।
‘ কেন? ‘
‘ কচি খুকী তুমি? নাদান বাচ্চা? কিচ্ছু বুঝো না? ‘
পাঁচ লাখ টাকার বোঝা মাথা থেকে নামল জুবায়েরের। কমপক্ষে সে হিসাব করে জাকিয়ার সাথে ভালো করে কথা বলবে। এমনটাই আশা করেছিল জাকিয়া। কিন্তু তুষারের কথাই সত্যি হলো। জাকিয়া বাথরুমের দরজা লাগিয়ে চিৎকার দিয়ে কান্না করে দুঃখ কম করার চেষ্টা করছে। মানুষ বলে কান্না করলে দুঃখ কম হয়।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত