শুকনো পাতা

শুকনো পাতা
আমাদের বাসায় নতুন একটা কাজের মেয়ে রাখা হয়েছে। ড্রাইভার মোখলেস তাদের গ্রাম থেকে নিয়ে এসেছে। মেয়েটার বয়স অল্প। দেখতেও খুব সুন্দর। তবে রান্নায় পটু, যেহেতু বাসায় আমি আর মা থাকি তাই রান্না করতেও মেয়েটির তেমন কষ্ট হয়না। তবে বুঝতে পারি মেয়েটি বেশ ভীতু। আমাকে দেখলেই কেমন ভীতু চোখে তাকায়। যখন খাবার টেবিলে বসি তখন সে খুবই ভীতু অবস্থায় থাকে। হয়তো ভাবে খাবার ভালো হয়নি বা তরকারি ভালো হয়নি এই নিয়ে তাকে বকাঝকা করব। একদিন তরকারিতে একটু লবণ কম হওয়ার কারণে মা ওকে ডাকলো। মুন্নী অনেকটা ভীতু চোখে মায়ের দিকে তাকালো, বলল…
-ম্যাডাম কিছু হইছে।
–আজকে কি তরকারিতে লবণ কম দিয়েছো নাকি?
-ভুল অইয়া গেছে ম্যাডাম, মাফ কইরা দেন।
কাঁপা কাঁপা গলায় বলল মুন্নী। মা বেশ অবাক হলেন। তাকেতো বকা দেওয়া হয়নি! সে অমনি মাফ চেয়ে বসলো! মুন্নীর দিকে তাকিয়ে দেখি ওর চোখ ছলছল করছে।এই বুঝি কেঁদে দিবে। ইসস কি সরল মন মেয়েটার৷ মা বোধহয় কিছুটা আঁচ করতে পেরেছে যে মুন্নী ভয় পেয়েছে, তাই আর কিছু বললনা। খাওয়া শেষ করে মুন্নীকে ডাকলো। মুন্নী একটু দেরি করে আম্মার রুমে আসলো। ওর হাতে ছোট ব্যাগ, আমি আর আম্মা রীতিমত অবাক হলাম। আম্মা বলল…
–এ কি ব্যাগ নিয়ে আসলে কেন?
-আমার রান্না মনে অয় খারাপ অইছে, বাইর কইরা দিবেন।
–এমন কেন মনে হইলো।
-আমগো গেরামের আজগরের বাইত্তে রানতে গিয়া নুন কম অইতো মাজেমইধ্যে, আমরে বকতো মেলা। একদিন মারছিলো। হ্যার মেলা রাগ। মুন্নীর কথায় কোন জড়তা নেই। এক নিঃশ্বাসে বলে ফেলল কথা গুলো৷ এই কথাগুলো নিতান্তই কষ্টকর অথচ মেয়েটা হরবর করে বলে দিলো৷ হয়তো মানুষের বকা খেতে খেতে অভ্যাস হয়ে গেছে। ওর হরবর করে কথা গ্রাম্য কথাগুলো কি অদ্ভুত শোনায়। আম্মা আবার বলল….
–তোমার মা কি করে?
-মা মইরা গেছে।
–তোমার বাবা?
-আব্বায় নতুন বিয়া করছে, নতুন মায় আমরে দেখতে পারেনা। কেমন কেমন করে, খালি কাম করায়।
–কেন তোমার বাবা কিছু বলেনা?
-আব্বায়ও বকে, তারপর ই আজগরের বাইত্তে কামে দিলো৷
–তোমার কষ্ট হয়না?
-আগে অইতো এহন অয়না, অভ্যাস অইয়া গেছে।
–আচ্ছা তোমায় যদি এখন আমি বের করে দেই কোথায় যাবে? মুন্নী এবার চোখ তুলে বড়বড় করে তাকালো৷ সে হয়তো ভেবেই নিয়েছে তাকে বের করে দিবে। ওর চোখে পানি টলমল করছে৷ কি সহজ সরল ভাবনা। আম্মা বলল
–বলো যদি বের করে দেই তখন?
-মুখলেস বাইরে কমু আমারে গেরামে রাইখখা আইতে। আজগরের বাইত্তে আবার কাম করুম।
–সে যদি আবার বকে? আবার যদি মারে?
মুন্নী আর কিছু বলেনা। মাথা নিচু করে থাকে। আম্মার দিকে তাকিয়ে দেখি মুখ কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। ছোট মেয়েটার এই সহজসরল কথাগুলো হয়তো লেগেছে খুব। আম্মা বলল….
-যাও ঘরে গিয়ে ব্যাগ রাখো।
–কবে যাইমুগা?
-পাগলি মেয়ে, তোমার যতদিন ইচ্ছে এই বাসায় থাকো কোথাও যেতে হবেনা৷
মুন্নী আবার চোখ তুলে তাকায়। আম্মা হাসি মুখে বলে দেয় ওর ঘরে যেতে। মুন্নি মাথা নেড়ে ব্যাগ নিয়ে চলে যায়। আমি অবাক চোখে তাকিয়ে থাকি। বিস্ময় যেন কাটতেই চায়না। কি অবলীলায় সবগুলো কথাই বলে দিলো। অভাব, অনাদরে অল্প বয়সেই মেয়েটেই কত ম্যাচিউরড হয়ে গেছে। সেদিন সন্ধ্যায় মুন্নীকে বললাম চা বানাতে। সে বলল….
-ভাইজান আমি চা বানাইতে পারিনা।
–সে কি শিখিসনি?
মুন্নী মাথা নেড়ে জবাব দিলো সে পারেনা। সে বোধহয় ভেবেই নিয়েছে আমি তাকে এখন বকা দিব। আমি মুন্নীকে কাছে ডেকে বললাম….
–আমায় ভয় পাস কেন?
-আজগরে মারতো হ্যার বাইত্তে কাম করনের সময়।
–আচ্ছা বাদ দে ওসব। লেখাপড়া জানিস?
-টু’তে উঠছিলাম, তারপর মা’য় মরলো, আব্বায় বিয়া করলো। আমি স্কুলে যাইনাই।
–দেখি স্বরবর্ণ, আর ব্যাঞ্জনবর্ণ গুলো বলতো?
আমায় অবাক করে মুন্নী একদম ফটাফট সব বলে দিলো। বাহ! কোন জড়তা-সংকোচ নেই। একদম ঠোঠস্ত বলে দিলো। আমি বললাম….
–লেখাপড়া করবি?
-কেমনে?
–শোন এককাজ করবি, রোজ সন্ধ্যায় আমার রুমে আসবি আমি তোকে পড়াব। আর মাকে বলে তোকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিব।
-কাম করব কেডায়?
–সেটা আম্মা বুঝবে, কি আসবি তো পড়তে? পড়া না পারলে কিন্তু কান ধরিয়ে রাখব? মুন্নী অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। আমি ওকে বললাম….
–বোস এখানে, টিভি দেখবি? চা বানাতে হবে না। আয় টিভি দেখ।
মুন্নী কিছু বললনা। ছলছল নয়নে তাকালো। একটা অপরিচিত বাড়িতে কাজ করতে এসে এতটা ভালোবাসা সে আশা করেনি৷ এই অভাব, অনাদরে থাকা মানুষ গুলো সত্যিই কেমন জানি৷ একটু ভালোবাসা, আদর, ভালো ব্যবহার পেলেই কেঁদে দেয়। চোখ দিয়ে পানি বের করে৷ মুন্নী আমার বিছানায় বসলো, খুবই সতর্ক ভাবে। হয়তো ভেবেছে একটু উনিশ বিশ হলেই তাকে বকা দিব। আমার হাসি পেল। টিভি অন করলাম। মুন্নী হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছে টিভি দেখায় মনোযোগ দিলো। মুন্নীকে স্কুলে ভর্তি করানোর সব কাজ আম্মা নিজেই করলো। আম্মারও ইচ্ছে ছিল ওকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিবে। এত ছোট মেয়ে দিয়ে বাসার কাজ করানোর কোন মানেই হয়না। আর তাছাড়া আম্মাও বাসায় একা একা থাকে। মুন্নী থাকলে অন্তত বাসাটা খালি খালি লাগবেনা। একদিন বিকেলে বাসায় এসে অবাক হলাম। ড্রয়িখ রুমে সোফায় বসে আম্মা আর মুন্নী টিভি দেখছে। দুজনেই হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে। টিভিতে কার্টুন চলছে, মটু-পাতলু নাকি টম এন্ড জেরি সেটা বোঝা গেলনা। আমায় দেখে আম্মা বলল….
–যাতো আমাদের জন্য চা বানিয়ে নিয়ে আয়। আর আজ থেকে তুই সব রান্না করবি বুঝলি কাজের বেডা বজলু রুবেল। হা হা… হি হি…! বলেই আম্মা হাসতে থাকলো। বজলু রুবেল শুনে মুন্নীও জোড়ে হাসা হাসা শুরু করলো। ওদের হাসি যেন থামছেনা। এইতো কয়েকদিন আগেও মেয়েটির মুখে হাসি ছিলনা। ছিলনা চঞ্চলতা, অথচ আজ? আমি আর কিছু বললামনা, মুচকি হেসে চা বানাতে গেলাম। কি অদ্ভুত! মা আমায় কাজের ছেলে বজলু রুবেল বানিয়ে দিলো? যাইহোক এতকিছুর পর যে মুন্নীর মুখে হাসি ফুটেছে এই বা কম কিসে!
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত