ইন্টারে থাকাকালীন হোসেন নামের আরেকটা ছেলে আমার সাথে হোটেলে কাজ করতো। কাস্টমারদের খাবার দেওয়ার পর ৫ টাকা ১০ টাকা করে যা জুটতো তা জমিয়ে পাঠিয়ে দিতো বোনের জন্য। খুব ভালো লাগতো ছেলেটার এই কাহিনী দেখে। আমার পরিবারে বাবা-মা বলতে কেউ ছিলো না। তাই টাকার এতো বেশি প্রয়োজন না থাকায় ছেলেটাকে দিয়ে দিতাম।
দৈনিকের বেতনের টাকা দিয়েই আমার কোন মতোন চলে যেতো। ছেলেটা আমার থেকে টাকা নিতে চাইতো না। তাও জোর করে দিতাম। দিনভর কাজ করে রাতে একটু সুজোগ থাকতো পড়ার। দুজন মিলে ভালোভাবেই ইন্টারমিডিয়েটটা পার করলাম। ছেলেটার বাবা-মা মারা গিয়েছিল এক সাপ্তাহের ব্যবধানে। তাই তার বোন অনুকে একটা ছাত্রী হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করতে হতো। বোনের খরচটা বহন করতে ছেলেটার বেশ কষ্টই করতো হতো। তাই যতটুকু পারতাম, নিজের থেকেও কিছু দিতাম।
ইন্টারমিডিয়েট পার করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য অনেক কষ্ট করে পড়াশোনা করতে হলো। রাত জেগে পড়াশোনা করার কারণে দিনের বেলায় মাঝেমাঝে ঝিমাতে হতো। এ নিয়ে মালিকের কাছে অনেক গালাগালিও খেতে হয়েছে।
সেবার হোসেনের চান্স হয়ে গেলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু আমি হতাশা হয়ে পড়ালেখা ছেড়ে দেবো ভেবেছিলাম। কিন্তু হোসেন আমার সমবয়সী হয়েও আমাকে মানুষিক ভাবে অনেক শক্ত করে তুলেছে। পরবর্তীতে অবশ্য আমার চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন ইউনিটে চান্স হয়ে গেছে। আমি চলে আসলাম চট্রগ্রামে আর হোসেন ঢাকাতেই থেকে গেলো। এভাবে অনেকগুলো বছর পার হলো। হোসেনের সাথেও আর কোন যোগাযোগ হয়নি।
সেদিন সকালবেলা হলের সামনে গাছতলায় কোন একটা কারণে মন খারাপ করে বসেছিলাম। তখনই দেখি কেউ একজন আমার দিকে এগিয়ে আসছে। চেহারা তখনও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিলোনা। আস্তে আস্তে এগিয়ে আসলে। কখনো কল্পনাও করিনি হোসেন নামের সেই বন্ধুটা এতোদূর থেকে আমার কাছ আসবে। তার বুকে বুক মিলিয়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম। চোখ দিয়ে আমার দুফোঁটা জলও গড়িয়ে পড়লো তার কাধে।
হ্যাঁ ; সে হোসেন এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রধানমন্ত্রীর স্বর্ণপদক পেয়েছে। আর তার সেই ছোট্ট বোন অনু; সেও এবার ঢাকা মেডিকেল কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। যার জন্য এই হোসেন; হোটেলে কাজ করে জমানো টাকা গুলো পাঠাতো। সত্যিই তাদের এই ভালোবাসার কোন নাম নেই।
গল্পের বিষয়:
গল্প