বাবা মার শখ আহ্লাদ

বাবা মার শখ আহ্লাদ
সাত সকালে আম্মার হাত ধরে আব্বা ছাদের উপর বসে আছেন। আম্মার চুলের খোঁপায় ফুল গাঁথা।আম্মা আব্বার গায়ে খানিক হেলাল দিয়ে গুণগুণ করে রবীন্দ্র সংগীত গাইছেন। এই দৃশ্যটা দেখে আমার কাছে দৌড়ে এলো মিতু।মিতু আমার স্ত্রী।মিতু হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,’তোমার বাপ-মা এমন নির্লজ্জ কেন?’
মিতুর কথা শুনে আমি চমকে উঠলাম। হঠাৎ এমন কী হলো যার কারণে এত বড় কথা বলছে মিতু।ভেতরে প্রবল অস্হিরতা অথচ বাইরে শান্ত আছি এমন একটা ভাব করে বললাম,’কী হয়েছে বল তো।’ মিতু অট্টহাসি দিয়ে বললো,’কী না হয়েছে। তোমার বাপ মার বুড়ো বয়সে মনে প্রেম জেগেছে।ছাদে গিয়ে দেখে এসো কীভাবে দুজন জড়াজড়ি করে বসে আছে। ছিঃ ছিঃ ছিঃ!’ মিতুর কথা শুনে আর ছাদে যাওয়ার ইচ্ছে হলো না আমার।কী লজ্জার কথা। বাসায় ছেলে আর ছেলের বউ আছে।নাতী-নাতনী আছে। যেকোনো সময় ওদের কেউ ছাদে উঠতে পারে। আব্বা আম্মার কী মোটেও উচিত হয়েছে এই কাজটা?
এর কদিন পর আমরা সবাই মিলে বেড়াতে যাবো মিতুর বোনের বাড়িতে। মিতুর বোনের ছেলে বাচ্চা হয়েছে। এই উপলক্ষে ওদের বাড়িতে বিশাল আয়োজন। আমাদের সাথে যাবে আব্বা আম্মা। কিন্তু আম্মা এমন এক কাজ করেছেন যা দেখে আমার মনটাই খারাপ হয়ে গেল। আম্মা রঙিন একটা শাড়ি কুচি করে পড়েছেন।কী বিশ্রী কান্ড!
মিতু তখন আমার একটা হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল আড়ালে। তারপর ফিসফিস করে বললো,’আম্মাকে তুমি বলো এই শাড়িটা খুলে একটা সাদামাটা শাড়ি পড়তে। ওখানে কত লোক থাকবে!তারা দেখে কী ভাববে তখন!’ আমি ভাবলাম মিতু তো মোটেও মন্দ বলেনি কথাটা। ওখানে মিতুদের কত আত্মীয় স্বজন আসবে।তারা দেখে তো মন্দই বলবে আম্মাকে। আমি আব্বার সামনে থেকে আম্মাকে ডেকে নিয়ে বললাম,’আম্মা, আপনি এটা কী পড়েছেন? এমন রঙিন শাড়ি এই বয়সে কেউ পড়ে!’
আম্মা সঙ্গে সঙ্গে প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন,’আমি পড়তে চাইনি।তোর আব্বা বললেন পড়তে। না পড়লে মানেনই না।কী করবো বল!’ আম্মার চোখ কেমন জলে ভরে উঠছে। নিশ্চিত তিনি অপমান বোধ করছেন। কিন্তু আমি আম্মার মুখের দিকে না তাকিয়ে বললাম,’অদ্ভুত কান্ড! আব্বা কী বোকা নাকি?(মনে মনে বললাম, বুড়ো বয়সে ভীমরতি) আমরা যখন বাড়ি থেকে বের হবো তখন দেখা গেল আম্মা রঙিন শাড়িটা পাল্টে হাল্কা রঙের একটা সুতি শাড়ি পড়েছেন। এই শাড়িতে আম্মাকে দেখে আব্বা আম্মাকে ডেকে একটু আড়ালে নিয়ে গিয়ে বললেন,’ওই শাড়িটা কী হলো মাজেদা?’ আম্মা বললেন,’আমি আগেই বলেছিলাম ওইসব রঙিন কাপড় আমার মতন বুড়ির জন্য না।’বলে আম্মা লজ্জায় অথবা অপমান বোধে কেঁদে ফেললেন।
আব্বা তখন বললেন,’এ নিয়ে তোমায় কেউ কিছু বলেছে মাজেদা?’ আম্মা খানিক সময় চুপ থেকে বললেন,’নয়ন বলেছে ওখানে তো তার শশুর বাড়ির কত আত্মীয় স্বজন থাকবে।তারা আমায় দেখে মন্দ বলবে না? তাছাড়া এটা তো সত্যিই। আমার কী এই বয়সে এমন শাড়ি পড়ে কারোর বাড়িতে যাওয়া ভালো দেখায়!’ আব্বা তখন কপট রাগ নিয়ে বললেন,’কোথাও যেতে হবে না আমাদের।আমরা বেড়াতে যাবো না।’ আব্বা এসে সরাসরি জানিয়ে দিলেন আমাদের।’তোমরা চলে যাও।আমরা দুজন যাবো না।’ আব্বা হঠাৎ না বলায় আমি আর মিতু খানিক ঘাবড়ে গেলাম। তবুও বললাম,’হঠাৎ কী হলো আব্বা!একটু আগে আপনি আর আম্মা রেডি হলেন আর এখন বলছেন যাবেন না?’
আব্বা একটা অট্টহাসি দিয়ে খানিক সময় থামলেন। তারপর একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস টেনে বললেন,’বাবারে, যখন আমাদের বয়স কম ছিল তখন তোমাদের নিয়ে আমরা ব্যস্ত। তোমাদের লালন পালন করা, নানান আবদার আহ্লাদ পূরণ। নতুন নতুন জামা কাপড় কিনে দেয়া ,তোমাদের পড়াশোনা করানো, সংসার গোছানো, চাকরি বাকরি
আরো কত কী! এইসব করতে করতেই তো আমাদের বয়সটা চলে গেছে। এই বয়সটা কার জন্য গিয়েছে?
তোমাদের জন্য । তোমাদের ভবিষ্যত গড়তে। আচ্ছা আমরাও তো মানুষ না? আমাদেরও তো শখ আহ্লাদ হয় একটা সুন্দর কাপড় পড়ার। কিছু সুন্দর মুহূর্ত কাটাবার! নাকি আমাদের জন্য এসব কিছুই করতে নেই?আমরা কী শুধু জনমভর আনন্দ আহ্লাদ থেকে খারিজ হয়েই থাকবো? এই দুনিয়াটা বুঝি আমাদের জন্য শুধুই সাদামাটা!’
আব্বার কথাগুলো শুনে আম্মা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেছেন। মিতুর চোখ দুটোও কেমন ছলছল করে উঠছে। আমার নিজেরও ভীষণ কান্না পেয়ে বসছে। নিজেকে কেমন নিজের কাছে মস্ত অপরাধী মনে হচ্ছে। আব্বা যে কথাগুলো বলেছেন এ তো চিরন্তন সত্য কথা।আমরা সন্তানেরা আজীবন শুধু নিজের চিন্তাটাই করে যাই নিজেরা। নিজেদের যা ভালো লাগে তাই শুধু কাউকে করতে দেখতে পছন্দ করি। আমাদের পছন্দের বাইরের কিছু দেখলেই আমাদের বিরক্তি আসে।বাবা মাকে পর্যন্ত আমাদের পছন্দের বাইরের কিছু করতে দিতে চাই না।অথচ আমরা তো এমনও ভাবতে পারতাম যে স্বামী- স্ত্রীর মধ্যে ভালোবাসা কিংবা খুনসুটি করার নির্ধারিত কোন বয়স নেই। তাদের এই ভালোবাসা কিংবা খুনসুটিতে হস্তক্ষেপ করারও কোন অধিকার নেই আমাদের। সারা জীবন যারা আমাদের ভবিষ্যৎ গড়তে গিয়ে তাদের নিজেদের জীবনটা সাদামাটা করে কাটিয়ে দিলো তাদের জীবনটা শেষ সময়ে একটু রঙিন হোক। রঙিন হোক তাদের শেষ সময়ের মুহুর্ত গুলোও।
আমি আর মিতু দুজন মিলে আব্বা আম্মার পায়ে পড়ে বসে আছি। কেঁদে কেটে আমাদের ভুলের জন্য আমরা মাফ চাইছি।আমরা জানি,আব্বা আম্মা আমাদের নিশ্চিত ক্ষমা করে দিবেন। কারণ পৃথিবীতে একমাত্র বাবা মা-ই তার সন্তানকে ক্ষমা করার অসীম ক্ষমতা নিয়েই জন্মান।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত