ইঁচড়েপাকা

ইঁচড়েপাকা
‘আই লাভ ইউ।’ ম্যাসেজটা দিয়েই স্যারকে ব্লক করে দিলাম। দুবোন হাসতে হাসতে কুটিকুটি হয়ে যাচ্ছি। আম্মু পাশের রুম থেকে চিল্লাচ্ছে এত জোরে হাসির শব্দ শুনে। কোনমতে হাসির বিরতি টেনে দুইবোন গবেষণা করতে লাগলাম ম্যাসেজটা দেখার পর স্যারের রিঅ্যাকশনটা কি হতে পারে। এরকম ফাজলামো এই প্রথমবার না। বাড়ির বড় মেয়েদের নাকি হতে হয় শান্ত, ভদ্র, ধৈর্যশীল। কিন্তু আমার মতো অশান্ত, চঞ্চল, উশৃংখল মেয়ে আমাদের পাড়াতে আর একটিও নেই। চলাফেরা যেমন ছেলেদের ধাঁচের তেমনি বাঁদরামিতে সেরা। পাড়া রেকর্ড তো হয়েই গেছে আর কিছুদিন পর বিশ্ব রেকর্ড হবে। আমি নয়না। মায়ের কাছে আমি মানে একটা যন্ত্রণা। আর পাড়ার ছেলেদের কাছে ইঁচড়েপাকা। আর আন্টিদের কাছে ‘কি বাঁদর মেয়েরা বাবা’। একেকজনের কাছ থেকে একেক খেতাব প্রাপ্ত হয়েছি। তবে এই খেতাবগুলো অর্জন করতে কম কষ্ট করতে হয়নি আমাকে।
এইতো গত পরশুর ঘটনা, স্কুল থেকে ফেরার সময় নতুন একটা চেহারা দেখলাম। ছেলেটা বেশ সুন্দর। দোকান থেকে কিছু একটা কিনছে। আমিও দোকানে গিয়ে ছেলেটাকে পাত্তা না দিয়ে কয়েকটি চিপস, চকলেটসহ আরো কিছু নিলাম। দোকানী টাকা চাওয়ার ভঙ্গিতে আমার দিকে তাকালে আমি ছেলেটাকে দেখিয়ে দিয়ে ‘এই ভাইয়া টাকা দিবে’ বলেই ভোঁদৌড়। দূরে গিয়ে পেছনে তাকাতেই দেখি বেচারা ভ্যাঁবলাকান্তের মতো এখনো আমার পথপানে চেয়ে আছে। এরকম ঘটনা পাড়ার ভাইয়াদের সাথে অহরহই ঘটে। এজন্য তারা আমার থেকে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে চলে। আসলে তারা আমাকে ভয় পায়। আমি যেমন সবার আতঙ্ক, সবার ক্ষতিকারক, তেমনি পরোপকারী, উপকারীও বটে। সবাই আমাকে এড়িয়ে যেমন চলে আবার ভালোও তেমন বাসে।
এই যেমন, আরেকদিন শুনলাম ফার্স্ট ইয়ারের( কলেজ আর আমাদের স্কুল পাশাপাশি) নীলা আপু আর আদিব ভাইয়ার প্রেমটা ঝুলে আছে, হবে হবে বলেও হচ্ছে না। দুজন দুজনকে পছন্দ করে অথচ কেউ কাউকে বলার সাহস পাচ্ছে না। নিলাম ঝুঁকি। আদিব ভাইয়ার নাম করে সুন্দর করে একটা প্রেমপত্র লিখে নীলা আপুর বইয়ের ভাঁজে রেখে চলে এলাম। যেহেতু মনের কথা ছেলেদেরই আগে বলতে হয় তাই আপু’কেই চিঠিখানা দিলাম। এরপর আপু চিঠিটা দেখবে, পড়বে, প্রত্যুত্তর লিখবে এভাবেই, ব্যস। শুনেছি তাদের প্রেমটা এখন মাখোমাখো।
এভাবে ক্লাসে কতজনের জোড়া লাগিয়ে দিয়েছি। আবার ব্রেকাপও করিয়ে দিয়েছি চিঠিতে ইচ্ছেমতো বকাবকি করে!
আমার একটা বিশেষত্বের কথা শেয়ার না করলেই নয়। বাচ্চাদের মতো করে কথা বলা, কারো ভাবভঙ্গি আর গলার স্বর নকল করাতে বেশ পটু আমি। আমার কাজিন ইরা আপুর বয়ফ্রেন্ডের সাথে কতই না কথা বলেছি আপুর স্বর নকল করে! গাধারটা টেরই পায়নি। আপুকে কতবার যে লজ্জায় ফেলে দিয়েছি গিফট চেয়ে তার হিসেব অগণিত। এরপর বাসায় এসে আমাকে ইচ্ছেমতো ধোলাই।
ছেলেরা মেয়েদের ইভটিজিং করে, অথচ আমিই কিনা সেই ছেলেদের ইভটিজিং করেছি। স্কুলে যাওয়া আসার পথে কলেজের ভাইয়াদের দেখে শিটি মেরেছি। কখনো আবার মাঝ রাস্তায় বান্ধবীদের নিয়ে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে প্রপোজও করেছি। ফুচকা বা ঝালমুড়ি খাওয়ার সময় ছেলেদের পাশ দিয়ে যেতে দেখলেই হাত দিয়ে বাতাস নেয়ার ভঙ্গিতে বলেছি, ‘উফ ঝাল, উফ ঝাল’। এভাবেই তাদের কাছে আমি ইঁচড়েপাকা হয়েছি। আমি স্কুলের বাহিরে যেমন গুন্ডী, স্কুলের ভেততেও তাই। আমার দুহাত যে কত ছেলের গাল ছুঁয়েছে তার হিসেব নেই। আই মিন আমার হাতের থাপ্পড় খায়নি এমন কেউ নেই বললেই চলে। আমাদের মিজান স্যার, আমরা তাকে ব্ল্যাক ডায়মন্ড বলে ডাকি। নামটা অবশ্য আমারই দেয়া। আমাকে দেখলেই তার কুচকুচে কালো মুখটা আরো কুচকুচে করে ফেলেন। তাকে হাজারটা প্রশ্ন করে বিব্রত করি। আর যেদিন আমি ক্লাসে না থাকি সেদিন নাকি তিনি বড় বাঁচা বেঁচে যান।
কাউকে শুধু শুধু বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলতে ভীষণ ভালো লাগে আমার। যাহোক এবার আন্টিদের কথা বলি। যারাই পাড়াতে নতুন এসেছে তাদেরকেই নাজেহাল করেছি। কখনো নিজেকে তাদের ছেলের গফ হিসেবে পরিচয় দেয়া, কখনো বা বউ হিসেবে, হনহন করে ভেতরে ঢুকে গিয়ে আন্টির পা ধরে সালাম করে বসে গল্প করা, চা বানিয়ে খাওয়া, বৈয়ামের সব আঁচার খেয়ে ফেলা। একজন মানুষকে বিরক্তির চরম পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে চলে আসার সময় বলে আসেছি, ‘আন্টি আপনার ছেলেকে আমি চিনিই না’। আমি তো শুধুমাত্র আমার উপস্থিতি জানান দিতে এসেছি এই যে, আপনার পাড়ায় একজন ইঁচড়েপাকার বসবাস।
এদিকে আমার এসএসসি টেস্ট পরীক্ষার সময়ও ঘনিয়ে এলো। বাবার আহ্লাদে যেমন এতটা ত্যাঁদড় হয়েছি তেমনি বাবার আদেশেই সামান্য পড়াশোনায় মনোযোগী হলাম। একজন টিউটরও রাখা হলো আমার জন্য। আমার স্যার হলেন জাহাঙ্গীরনগরের স্টুডেন্ট। বাবার কড়া আদেশ পড়াশোনায় ফাঁকিবাজ তার বাঁদর মেয়েটাকে ভালো করে টাইট দিতে হবে যেন ‘এপ্লাস’ মিস না হয়। বেশ কয়েকদিনে স্যারের কড়া নজরদারিতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠলাম। শারিরীক অত্যাচার না করলেও মানসিক অত্যাচারে আমাকে ভাঁজা ভাঁজা করে ফেলেছেন। অসহ্য হয়ে বাবাকে বললাম, টিউটর পছন্দ হয়নি, চেঞ্জ করতে হবে। বাবা বুঝে নিলেন স্যারের সাথে আমার বাঁদরামি গুলো পেরে উঠছে না। সুবিধা করতে পারছিনা বলেই একথা বলছি। বাবা বেশ খুশি হয়ে তার বেতন বাড়িয়ে দিলেন। আমার ভয়ে পাড়ার সবাই আৎকে থাকে। আর সেই আমাকে এইভাবে, নাহ আর নিতে পারছিনা। ভাবলাম কোনমতে পরীক্ষাটা দিই। তারপর বোঝাব মজা। আমাকে যতটা না জ্বালিয়েছে তারচেয়ে দ্বিগুণ জ্বালাবো।
পরীক্ষাটা শেষ হলো। এইবার আমাকে ঠ্যাকায় কে? ‘আই লাভ ইউ’ লিখে ব্লক করে দেয়ার পর ভাবলাম ব্লক’ই যদি করি তবে স্যারকে জব্দ করবো কিভাবে। তাছাড়া স্যার জানেও না আইডিটা আমার। আনব্লক করে কথা বলতে বলতে বেশ জমে উঠেছে খেলাটা। এত কঠিন স্যারও আমার ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেছেন ভেবে বিজয়ীর হাসি হাসছি। যখনই মনে হলো প্রেমটা বোধহয় হয়েই গেলো স্যার প্রপোজ করলেই তার বোকামীটা প্রকাশ করবো। কিন্তু সেখানেই ঘটলো অঘটন। স্যার ম্যাসেজ দিলেন, ‘কি ভেবেছ নয়না, আমি তোমাকে চিনতে পারবো না? কতবড় বেয়াদব মেয়ে তুমি, স্যারকে মুরগী বানাতে আসো। তোমার পাড়ার ছেলেদের মতো আমার সাথেও পেরে উঠবে ভেবেছ?’ ম্যাসেজটা দেখার পর আমি যেন বরফে পরিনত হয়েছি। সাথে সাথে ব্লক করে দিলাম তাকে। স্যার যদি বাবাকে বলে দেয় তবে কি হবে? ভাবলাম এ যাত্রায় বেঁচে গেলে আর দুষ্টুমি করবো না। নাহ, বাবার দিক থেকে আর কোনো সাজাপ্রাপ্ত হলাম না।
বেশ কিছুদিন পর শুনলাম পাড়ায় এক নতুন ভাড়াটে এসেছে। ভাবলাম আমার পরিচয়টা দিয়ে আসি। অনেকদিন হলো কোনো আন্টির পেছনে লাগি না। এদিকে স্যারের ঘটনার জন্য তওবা করেছিলাম সেটা ভুলেই গেছি। গেলাম তাদের বাসায়। কলিং বেল চাপতেই খুব সুন্দর একজন অভিজাত নারী দরজা খুলে দিলেন। মহিলাকে দেখেই খুব পছন্দ হলো আমার। তার সতর্ক দুই চোখ আমার আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে তিনি খুব স্মার্ট। আমিও টের পেয়ে সতর্ক হয়ে উঠেছি। খুব মেপেঝেপে কথা বলতে হবে মনে হচ্ছে। বললাম, ‘বাইরেই দাঁড় করিয়ে রাখবেন আন্টি? ভেতরে ঢুকতে দিবেন না?’ খুব শান্ত ভঙ্গিতে বললেন, হ্যাঁ এসো, এসো। ভেতরে এসো।’ বললাম, ‘বরণ না করলে কিভাবে যাব। আমি আপনার ছেলের বউ।’ ‘ও হ্যাঁ, বলো কিভাবে বরণ করলে তুমি খুশি হবে?’
তার আচরণে আমি বেশ অবাক। বললাম, ‘কিছু ধান আর ঘাস দিয়ে বরণ করতে হয়, এটাও জানেন না?’ আমার কথামতো তিনি আমাকে বরণ করে ভেতরে নিয়ে এলেন। তিনি আমাকে বসিয়ে রেখে চা করতে গেলেন। মনে হচ্ছে ইচ্ছে করে বাঘের ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেছি। মনে মনে আরো সতর্ক হলাম। এবার যা বলার আমাকেই শুধু বলতে হবে তাকে কিছু বলার সুযোগই দেয়া যাবে না। উনি এসেই বললেন, ‘আমার ছেলে বলেছে তোমার কথা, তুমি আসবে।’ বললাম, ‘মানে?’ ‘বারেহ একথার মানে বুঝতে পারছ না। তাহলে সংসার করবে কি করে।’ এবার আমার ভেতরে ভয় ঢুকিয়ে দিচ্ছেন এই মহিলা। বললাম, ‘আজ তাহলে যাই আন্টি, আরেকদিন আসবো। ‘ ‘ওমা যাবে কেন। এটাই তো তোমার আপন ঠিকানা। চলে গেলে হবে?’ ‘আম্মু আব্বুকে বলে আসিনি তো আন্টি। তাদেরকে বলে বিদায় নিয়ে একেবারে চলে আসবো।’ ‘আচ্ছা চলে যাবে যখন একটু বসো কথা বলি একটা।’
আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করছি নিজের চেহারার ভয়টা বুঝতে না দেয়ার। বললাম, ‘আচ্ছা বলুন।’ উনি আমার কানের কাছে এগিয়ে এসে বললেন, ‘আমার কোনো ছেলে নেই। একটিমাত্র মেয়ের মা আমি।’ ভেতরে ভয় বিস্ময় চেপে রেখে কোনরকমে বললাম, ‘সরি আন্টি। ভুল বাড়িতে চলে এসেছি তাহলে। আমি যাই।’ সামনে পা বাড়াতেই দেখলাম বাঘ। আমার দিকে থাবা হেনেছে। আমার শরীর স্থির হয়ে গেলো যেন একটা বরফ কুন্ডে পরিনত হচ্ছি। আমার সেই স্যার। সে এখানে কেন। এটা তবে স্যারের বাসা? যদি তাই হবে তাহলে আন্টিই না কেন মিথ্যে বললো। পা যেন আটকে গেছে। মাথাটাও ঘুরছে। পড়ে যাবো মনে হচ্ছে। নাহ আর প্রেশার নিতে পারছি নাহ।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত