toমাদেরকে একটা মজার ঘটনার কথা বলবো আজকে। কালকে সন্ধ্যায় আমার আর মায়ের সাথে কী হয়েছিল সেই গল্প। আমার বয়স বারো, আর আমি মেয়ে। আমার মায়ের বয়স চৌত্রিশ হলেও আমি কিন্তু এখনই প্রায় মায়ের সমান লম্বা।
কালকে বিকেলে মা আমাকে লন্ডনে নিয়ে গিয়েছিল ডেন্টিস্টের কাছে। ডেন্টিস্ট আমার পেছনের দাঁতে ফুটো খুঁজে বের করলো, বেশি ব্যথা না দিয়ে ফুটো ফিল-আপও করে দিলো। তারপর আমি আর মা গেলাম একটা ক্যাফেতে, আমি নিলাম একটা বানানা-স্প্লিট, আর মা নিলো কফি। আমরা যখন যাবার জন্যে উঠলাম তখন প্রায় ছ’টা বাজে, এদিকে ক্যাফে থেকে বেরুতেই শুরু হলো বৃষ্টি।
“ট্যাক্সি দরকার একটা,” মা বললো। আমরা সাধারণ হ্যাট, কোট পরে ছিলাম, এদিকে বৃষ্টিও ঝাঁপিয়ে এল।
“ক্যাফেতে ফিরে গিয়ে বৃষ্টি থামার অপেক্ষা করলে হয়না?” বললাম আমি। আরেকটা বানানা-স্প্লিটের মতলব কষছিলাম আসলে, চমৎকার ছিল স্বাদটা।
“বৃষ্টি থামবে না। আমাদের বাড়ি যাওয়া দরকার।“
আমরা ফুটপাথে বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে যখন ট্যাক্সি খুঁজছিলাম, অনেক ট্যাক্সিরই দেখা মিলছিল কিন্তু সবগুলোতেই যাত্রী ছিল।
“আহারে! যদি একটা গাড়ি থাকতো, আর ড্রাইভারও…”, মা বললো।
ঠিক এই সময় লোকটা এগিয়ে এল আমাদের দিকে। ছোট একটা মানুষ আর বেশ বয়স্কও। সত্তরেরও উপরে হবে হয়তো বয়স। নাকের নিচে তার সাদা গোঁফ, সাদা ঝোপের মতো ভুরু, আর কুঁচকানো গোলাপি মুখ। ভদ্রলোক এগিয়ে এসে হ্যাট ছুঁয়ে সামান্য অভিবাদন করে মাকে বললেন, “মাফ করবেন, অনুগ্রহ করে বিরক্ত হবেন না…”
ভদ্রলোকের হাতে ছিল একটা ছাতি, আর সেটা তিনি মাথার অনেক উপরে ধরে ছিলেন উঁচু করে।
“জ্বি?” মা উত্তর দিল, বেশ দূরত্ব বজায় রেখে, ঠাণ্ডা স্বরে।
“আমি ভাবছিলাম আপনার কাছে সামান্য একটু সাহায্য পাবো কিনা। খুবই সামান্য একটু সাহায্য দরকার।“
আমি দেখলাম মা কেমন সন্দেহ নিয়ে তাকালো ভদ্রলোকের দিকে। আমার মা বেশ সন্দেহপ্রবণ, বিশেষ করে দু’টো জিনিসের ব্যাপারে – অপরিচিত লোক আর সেদ্ধ ডিম। যখন মা সেদ্ধ ডিমের উপরটা কেটে চামচ দিয়ে খুঁচিয়ে দেখে, মনে হয় ঠিক ওর ভেতরে ঠিক একটা ইঁদুর বা আর কিছু লুকিয়ে আছে, এখনই লাফ দিয়ে বেরিয়ে আসবে!
অপরিচিত মানুষের ব্যাপারে মায়ের চিরকালীন বক্তব্য হলো, “যত বেশি ভদ্র, ততই সন্দেহজনক”। এই বুড়ো লোকটা অনেক বেশি ভদ্র আচরণ করছিলেন, তাঁর ভাষা ছিল মার্জিত, পোশাক রুচিসম্মত। একেবারেই নিপাট ভদ্রলোক একজন, এটা বুঝতে পারছিলাম কারণ ওঁর জুতো।
‘মানুষকে চেনার উপায় হলো তার জুতো’, এটাও মায়েরই আরেকটা পছন্দের কথা। এই লোকটা পরে ছিলেন চমৎকার খয়েরি জুতো।
“ব্যাপারটা হয়েছে কী, আমি একটু ঝামেলায় পড়েছি,“ ভদ্রলোক বলতে থাকেন। “বেশি না, নিশ্চিন্ত থাকুন। তেমন কিছুই না আসলে। কিন্তু আমার একটু সাহায্য বড়ই প্রয়োজন। দেখুন ম্যাডাম, আমার মতো বুড়ো মানুষেরা আসলে বেশ ভুলো মনের হয়ে পড়ে…”
মা থুতনি উঁচু করে, নাক বেয়ে, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করছিলো, ভদ্রলোকের দিকে। এটা হলো মায়ের ভয়ঙ্কর দৃষ্টিগুলোর একটা, এই শীতল-নাক-চাহনিটা। অধিকাংশ মানুষই এই দৃষ্টির সামনে পড়লে কেঁচো হয়ে যায়। একবার আমি নিজে আমার স্কুলের হেডমিস্ট্রেসকে মায়ের এই দৃষ্টির সামনে বোকার মতো তোতলাতে শুরু করতে দেখেছিলাম। কিন্তু এই ছোট্ট লোকটা, ছাতার নিচে কিন্তু নিরুত্তাপ দাঁড়িয়ে ছিলেন মায়ের ঐ শীতল-নাক দৃষ্টির সামনে, চোখের পলক না ফেলে।
উনি স্মিত হেসে বললেন, “বিশ্বাস করুন, প্লিজ। আমি ঠিক অমন নই যে রাস্তাঘাটে ভদ্রমহিলাদেরকে থামিয়ে আমার ঝামেলার কাহিনি শোনাই।“
“আমিও আশা করি তা না,“ মা বলল।
মায়ের কথার ধরণে আমার আসলে বেশ লজ্জাই লাগছিল। আমি মাকে বলতে চাইছিলাম, “ ওহ! মা, লোকটা ভীষণ বুড়ো, আর উনি ভদ্র আর মিষ্টভাষী। আর নিশ্চয়ই উনি কোন বড় রকমের ঝামেলায় পড়েছেন। অতটা রূঢ় না হলেও হয়তো চলে,” কিন্তু মুখে আমি কিছুই বললাম না।
ছোট্ট লোকটা ওঁর ছাতা এক হাত থেকে অন্য হাতে নিলেন, “ এর আগে আসলে কখনো ভুলি নাই।“
“কী ভোলেন নাই?” আমার মা কড়াভাবে জিজ্ঞেস করলো।
“আমার ওয়ালেট। আমি নিশ্চয়ই আমার অন্য জ্যাকেটের পকেটে ফেলে এসেছি। কী হাস্যকর ব্যাপার দেখুন।“
“আপনি কি এখন আমার কাছে টাকা চাচ্ছেন?”
“ছি, ছি! তা কেন?!” ভদ্রলোক প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন। “খোদা না করে কখনো তা করতে হয়!”
“তাহলে? কী চাচ্ছেন আসলে আপনি? যা বলবার তাড়াতাড়ি বলুন। আমরা বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে গেলাম দাঁড়িয়ে দঁড়িয়ে।“
“জি, দেখছি তো। আর সে জন্যেই আপনাদেরকে আমার ছাতাটা অফার করছিলাম। আপনাদেরকে রক্ষা করতো বৃষ্টি থেকে… শুধু যদি… শুধু…”
“শুধু কী?”
“শুধু যদি বিনিময়ে আমাকে একটা পাউণ্ড দিতেন বাড়ি ফেরার ট্যাক্সি ভাড়া হিসেবে।“
মা সন্দেহভরে তাকালো, “আপনার কাছে যদি টাকা নাই থাকে একদম, তবে এখানে পৌঁছুলেন কী করে আগে?”
“হেঁটে,“ জবাব দিলেন ভদ্রলোক। “প্রতিদিনই আসলে হাঁটি আমি। তারপর একটা ট্যাক্সি ডেকে বাড়ি ফিরে যাই। এটাই রুটিন আমার, বছরের প্রতিটা দিন।“
“বেশ তবে হেঁটেই ফিরছেন না কেন?”
“ওহ! পারলে তাই করতাম, সত্যি। কিন্তু পারবো না আসলে, এই বুড়ো হাড়ে আবার অতটা পথ হাঁটা সইবে না আমার। ইতিমধ্যেই অনেক বেশি দূরে চলে এসেছি।“
মা নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। একটু নরম হয়ে এসেছিল ইতিমধ্যেই, দেখতে পাচ্ছিলাম আমি। আর এই রকম বৃষ্টিতে একটা ছাতা পেয়ে যাবার ব্যাপারটা আকর্ষণীয় নিঃসন্দেহে।
“এটা একটা চমৎকার ছাতা”, বুড়ো লোকটাও বুঝেছিল তা।
“হুম, দেখেছি তা।“
“সিল্কের।”
“হ্যাঁ, তাও দেখতে পাচ্ছি।“
“তাহলে নিন না কেন ম্যাডাম। আমার কিনতে লেগেছিল ২০ পাউণ্ড। কিন্তু সেটা মোটেও ব্যাপার না, যতক্ষণ আমি বাড়ি ফিরে আমার বুড়ো পা দুখানা জুরোতে পারছি।“
আমি দেখলাম, মা ব্যাগের মুখ খুলবে কিনা ভাবছে। মা খেয়াল করলো যে আমি তাকে খেয়াল করছি। আমিও তাকে সেই বিখ্যাত শীতল-নাক-চাহনির আমার নিজের ভার্শনটা দিচ্ছিলাম কিনা। আর মা বুঝতে পারছিলো আমি ঠিক কী ভাবছি। আমি ভাবছিলাম, “দেখ মা, তোমার মোটেও উচিত হবে না এই বুড়ো ক্লান্ত মানুষটার অসহায়ত্বের ফায়দা নেয়া।“
মা একটু ভেবে আমার দিকে ফিরে তাকালো। তারপর ছোট্ট মানুষটাকে বললো, “আমার মনে হয় না আপনার থেকে ২০ পাউণ্ড দামের একটা সিল্কের ছাতা এভাবে নেয়া ঠিক হবে। আমি বরং আপনাকে আপনার পুরো ট্যাক্সির ভাড়াটা দিয়ে দেই, সেটাই উচিত।“
“না, না, না!”, চেঁচিয়ে উঠল প্রায় ভদ্রলোক। “এমনটা প্রশ্নেরও বাইরে! আমি ভাবতেই পারি না অমন! হাজার বছরেও না! আমি আপনার কাছ থেকে এমনি এমনি টাকা নিতে পারিনা! আপনি প্লিজ ছাতাটা নিন, আর নিজেকে আর মেয়েটাকে বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা করুন।“
মা ভদ্রলোককে আড়াল করে আমার দিকে বিজয়ীর দৃষ্টিতে তাকালো, আমি ঠিক বুঝছিলাম মনে মনে বললো, “দেখেছিস? তুই ভুল ভাবছিলি, লোকটা চায় আমি ছাতাটা নেই।“
এবার মা পার্স থেকে এক পাউণ্ড বের করে দিল লোকটাকে। ভদ্রলোক সেটা নিয়ে ছাতাটা বাড়িয়ে দিলেন মায়ের দিকে। টাকাটা পকেটে ভরে, টুপি ছুঁয়ে, চট করে সামান্য সামনে ঝুঁকে সৌজন্য দেখিয়ে, “ধন্যবাদ, অনেক ধন্যবাদ ম্যা’ম,” বলেই চলে গেলেন।
“ছাতার নিচে আয়, বৃষ্টি থেকে,” মা বললো আমাকে। “আমরা বেশ ভাগ্যবান বুঝলি। আমার এরকম সিল্কের ছাতা ছিল না, আর এটা আমাদের পক্ষে বিলাসিতা করে কেনাও সম্ভব না।“
“ওনার সাথে এত খারাপ আচরণ করছিলে কেন শুরুতে?” আমি প্রশ্ন করি।
“নিশ্চিত হতে চাইছিলাম, যে লোকটা ঠক নয়। আর হলামও তো। ভারি অমায়িক ভদ্রলোক,“ মা বললো। “আমার ভালো লাগছে যে ওনাকে সাহায্য করতে পেরেছি।“
“হ্যাঁ, মা।”
“সত্যিকারের একজন ভদ্রলোক। বড়লোকও, না হলে এমন সিল্কের ছাতা থাকে? আমি অবাক হবো না যদি দেখি উনি কোন নামকরা উপাধিরও অধিকারী। মনে কর, স্যার হেনরি গোল্ডসওয়ার্থ, বা অমন নামের কোন বিশিষ্ট মানুষ।“
“হুঁ, মা।“
“এটা তোর জন্যেও বেশ ভালো একটা শিক্ষা হলো। কখনো তাড়াহুড়ো করতে নেই। সবসময় মানুষকে বুঝতে খানিক সময় নিবি, তাহলে আর কখনো ভুল হবেনা।“
“ঐ যে দেখ, ঐ যে যাচ্ছে ভদ্রলোক।“
“কোথায়?”
“ঐতো, রাস্তা পার হচ্ছে। মা, দেখ ভদ্রলোকের মনে হয় প্রচণ্ড তাড়া আছে!“
আমরা দুইজনে ছোট্ট মানুষটাকে ট্রাফিক বাঁচিয়ে, দ্রুত রাস্তা পার হয়ে যেতে লক্ষ্য করি। ওপাড়ে গিয়ে বাঁয়ে মোড় ঘুরে দ্রুত হাঁটতে থাকে ভদ্রলোক।
“আমার তো ওনাকে দেখে খুব একটা ক্লান্ত লাগছে না মা, তোমার কি লাগছে?”
মা উত্তর দেয় না।
“ওনাকে দেখে ট্যাক্সি নেবার ইচ্ছা আছে বলেও মনে হচ্ছে না।“
মা বেশ শক্ত আর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রাস্তার ওপাড়ে ছোট্ট মানুষটার কার্যকলাপ দেখতে থাকে। আমরা তাকে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলাম, আর অনেক তাড়ায় মনে হচ্ছিল তাকে। অনেকটা সৈনিকের মতো মার্চ করে, অন্য পথচারীদেরকে অতিক্রম করে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছিলো লোকটা।
“কিছু একটার তালে আছে এই লোক”, মা জলদ-গম্ভীর গলায় বলে।
“কিন্তু কী, মা?”
“আমি জানি না, কিন্তু দাঁড়া, বের করে ছাড়ছি। আয় আমার সাথে,” আমার হাত ধরে টান দিল মা। আমরা রাস্তা পেরিয়ে বাঁয়ে মোড় নিয়ে ছুটলাম লোকটার পিছু পিছু।
“দেখতে পাস ওকে?” মা জিজ্ঞেস করে।
“হ্যাঁ, ঐতো! পরের রাস্তায় ডানে মোড় ঘুরছে।“ আমরাও ডানে মোড় নেই। ছোটখাট বুড়ো লোকটা এখন আমাদের ২০ গজ সামনে। কিন্তু প্রায় খরগোশের মতো ক্ষিপ্র গতিতে এগুচ্ছে তখনো, আমাদেরকে পুরো হিমশিম খেতে হয় তাল রাখতে গিয়ে। এদিকে বৃষ্টি নামে আগের চেয়েও তোড়ে, আমি দেখতে পাই লোকটার হ্যাটের কানা থেকে পানি ঝরছে।
“করছেটা কী এই লোকটা?” মা জানতে চায় নিজের মনে।
“যদি ঘুরে তাকিয়ে আমাদেরকে দেখে ফেলে মা?”
“কিছুই যায় আসে না। মিথ্যা বলেছে সে আমাদেরকে। বলেছে হাঁটার মতো শক্তি অবশিষ্ট নেই আর। আর দেখ এখন, এখন কেমন দৌড়ে চলেছে! ব্যাটা এক নম্বরের মিথ্যুক! জোচ্চোর একটা!”
“মানে উনি কোন নামকরা উপাধিধারী বিশিষ্ট ব্যক্তি নন বলছো?”
“চুপ কর্।”
পরের মোড়ে ছোট্ট লোকটা ডানে ঘুরে আবার। তারপর বাঁয়ে। ফের ডানে।
“আমি এত সহজে হাল ছাড়ছি না!” মা বলে।
“যাহ! হারিয়ে গেল তো!” আমি বলি। “কোথায় গেল?”
“ঐ দরজা দিয়ে ঢুকেছে! দেখেছি আমি। ঐ বাড়িটায়। হায় খোদা! এতো দেখি একটা পাব!”
হুঁ, রীতিমতো পাব একটা। বড় বড় লাল অক্ষরে সামনেই লেখা – রক্তিম সিংহ।
“তুমিও নিশ্চয়ই ভেতরে যাবে না, মা?”
“নাহ! বাইরে থেকেই দেখবো, দাঁড়া।“
পাবের সামনের দিকে একটা বিশাল কাঁচের জানালা, আর ভেতরে কিছুটা বাষ্প থাক্লেও, আমরা কাছে দাঁড়িয়ে ভালোই দেখতে পাচ্ছিলাম ভেতরটা, দুইজনে কাছাকাছি দাঁড়িয়ে খুঁজছিলাম লোকটাকে। আমি মায়ের হাত ধরে ছিলাম শক্ত করে, আর বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটাগুলো আমাদের ছাতার উপরে ছপছপ আওয়াজ তুলে পড়ছিল জোরেশোরে।
“ঐ যে, দেখো,” আমি বলি, “ঐখানে।”
ভেতরটা আবছা হয়ে ছিল মানুষের ভিড়ে আর সিগারেটের ধোঁয়ায়, আর আমাদের ছোটখাটো বুড়ো লোকটা ঠিক তার মাঝে দাঁড়িয়ে ছিল হ্যাট-কোট ছাড়া, আর ভিড় ঠেলে আগাচ্ছিল বারের দিকে। বারের কাছে পৌঁছে, দুই হাত বারের উপরে রেখে বারম্যানের সাথে কথা বলছিল। আমি দেখলাম তার ঠোঁট নড়ছে, অর্ডার দিচ্ছিল বারম্যানকে। বারম্যান খানিক্ষণের জন্যে সরে গিয়ে পরক্ষণেই ফিরে আসলো একটা বড় মগ কানায় কানায় ভর্তি হালকা বাদামি তরলে পূর্ণ করে। ছোট্ট লোকটা সেই এক পাউণ্ডটা এবার রাখলো কাউণ্টারে।
“ঐটা আমার পাউণ্ড!” মা হিসহিস করে বলে উঠলো আমার পাশ থেকে। “লোকটার সাহস কত!”
“গ্লাসের ভেতরে কী?” আমি জিজ্ঞেস করি।
“হুইস্কি।”
বারম্যান কিন্তু পাউণ্ড নিয়ে কোন খুচরা ফেরত দিল না। “প্রায় ট্রেবল হুইস্কি হবে”, মা বললো।
“ট্রেবল কী, মা?”
“সাধারণ মাপের তিনগুণ”।
লোকটা মগ উঠিয়ে ঠোঁটের কাছে ধরলো, তারপর আস্তে করে কাত করলো, আরো কাত করলো, আরো উঁচু করে কাত করলো… আরো… আর দ্রুত সবটুকু হুইস্কি চোঁ চোঁ করে সাবড়ে দিল এক দীর্ঘ ঢোঁকে।
“এটা বেশ দামী ড্রিঙ্ক হলো কিন্তু!” বললাম আমি।
“কী আজব!” মা বললো। “ভেবে দেখ্, পুরো এক পাউণ্ড দিয়ে এক ঢোঁকে অতগুলো হুইস্কি গেলা!”
“এক পাউণ্ডের বেশি দাম, মা। ছাতাটাতো সিল্কের, পুরো কুড়ি পাউণ্ড দাম”।
“হুম, তা ঠিক! লোকটা পাগল!”
ছোটখাটো লোকটা এদিকে বারের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল খালি মগটা হাতে। হাসছিলো লোকটা এখন, আর তার গোলাপী মুখে তৃপ্তির একটা স্বর্ণালি আভা ছড়িয়ে পড়ছিল। আমি তাকে তার জিভ বের করে সাদা গোঁফ চাটতে দেখলাম, যেন সেই অমূল্য হুইস্কির শেষ বিন্দুটাও খুঁজে ফিরছে।
এবার ধীরে ধীরে বার থেকে ঘুরে, আবার ভিড় ঠেলে দরজার কাছে হ্যাট-কোট রাখার জায়গায় ফিরে গেল সে। তারপর হ্যাট চাপালো মাথায়, কোটটা পরলো। আর তারপর…
তারপর জগত-সংসারের প্রতি চরম একটা উদাসীন ভাব নিয়ে, কারো মনে কোন সন্দেহের উদ্রেক না করে, সুন্দর একটা ছাতা উঠিয়ে নিল কোট র্যাকে রাখা অনেকগুলো ভেজা ছাতার থেকে, আর বেরিয়ে পড়লো আবার!
“দেখলি?! দেখলি তুই, কী করলো??!”
“শশশশ! এইদিকেই আসছে!”
আমরা আমাদের ছাতা নিচু করে নিজেদের মুখ ঢেকে ফেললাম। আর ছাতার তল দিয়ে দেখতে থাকলাম আর কী করে লোকটা। কিন্তু আমাদের দিকে বিন্দুমাত্রে না তাকিয়ে, নতুন ছাতা খুলে, মাথার উপরে ধরে যে পথে এসেছিল সেই পথে দ্রুত রওনা হয়ে পড়লো লোকটা।
“এবার করবেটা কী?” মা ভাবে।
“বাহ!” আমি বলি, “অসাধারণ!”
আমরা লোকটাকে ফলো করে প্রধাণ সড়কে চলে আসি, যেখানে প্রথম দেখা হয়েছিল। এবং দেখলাম প্রায় কোন জঞ্ঝাট ছাড়াই, এবার লোকটা তার নতুন ছাতাটা আরেকটা পাউণ্ডের বিনিময়ে হাতবদল করে নিলো, এবার একজন লম্বা, পাতলা লোকের সাথে, যার কিনা গায়ে কোন কোট বা মাথায় হ্যাটও ছিল না! আর যেই না কাজ হাসিল হলো, অমনি ছুট লাগালো উল্টো দিকে, আর নিমিষেই হারিয়ে গেল ভিড়ের মাঝে!
“দেখলি? লোকটা কী ভীষণ চালাক?” মা বললো। “কখনো একই পাবে দুইবার যায় না!”
“কিন্তু পুরো রাত জুড়েই এইটা করতে থাকতে পারবে এই লোকটা।“ আমি ফোড়ন কাটি।
“হুম, অবশ্যই! …
কিন্তু আমি ভাবছি, নিশ্চয়ই পাগলের মতো দোয়া করে বৃষ্টির দিনের জন্যে।“