আজ আষাঢ়ের প্রথম দিন। আকাশ মেঘলা থাকার কথা কিন্তু আকাশ মেঘলা না। প্রচন্ড রোদের তাপ। মাঝে মাঝে মৃদু বাতাস বইছে। কিছুক্ষন আগে ওহাব সাহেবের চাকরীটা চলে গেল। ওহাবের চাকরীটা চলে যাবে এটা জানা কথা। প্রতিদিন দেরি করে অফিসে আসলে চাকরী থাকার কথা না। অবশ্য এই নিয়ে ওহাব সাহেবের কোন আফসোস নেই। এবার একটু অবসর পাওয়া গেছে। অনেক দিন দূরে কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয়না। ঘোরা-ঘুরির শখটা ওহাব সাহেবের ছোট বেলার। এখন দুপুর একটা একুশ বাজে। ওহাব সাহেব পার্কের দিকে রওনা হলেন। ওহাব সাহেব কোন দিন এই পার্কটিতে আসেননি। যদিও এই পার্কটা তার অফিস যাবার পথে পরে। পার্কে ঢুকেই ওহাব পূব দিকের বেঞ্চটাতে বসলেন। আর তার চিন্তার ডানা মেলা শুরু করল। শেষ কবে তিনি পার্কে এসেছিলেন এখন আর মনে করতে পারেন না। একটু আবছা আবছা মনে আছে পার্কে একটা ছোট ছেলের সাথে দেখা হয়েছিল। আর কিছু মনে নেই। কি ঘটেছিল সেই দিন। তাও মনে নেই। হয়তো হবে কোন বাদাম কিংবা ঝালমুড়ি বিক্রেতা। স্মৃতির পাতায় অনেক ময়লা জমে গেছে। বয়স যে হয়েছে তার প্রমান পাওয়া যাচ্ছে। একটি কাক কিছুক্ষন ডাকা ডাকি করল। আজ কাকের ডাকও তেমন মন্দ লাগছেনা। কাকের বৈঙ্গানিক নাম করভাস এসপ্ল্যানডেনস্ । যাক কিছুটা মনে আছে। স্মৃতি শক্তিটা যে একেবারে হারিয়ে যায়নি সেটা ভেবে ওহাব সাহেবের আনন্দ হচ্ছে।
কিছুক্ষন পর পেছন থেকে চিৎকার শুনে ঘুরে দেখেন এক জন যুবক মাটিতে পরে আছে আর তাকে ঘিরে কয়েক জন টোকাই ধরনের ছেলে হাসাহাসি করতেছে। ওহাব সাহেব সেদিকে কান দিলেন না। এমন ঘটনা তো হরহামেশাই ঘটে। এটা আর এমনকি। কিন্তু তার কানে ভেসে আসছিল টোকাই ধরনের ছেলেগুলোর কথা।
-কিরে হালার পুত তোর বাড়ি কৈ? কথা কছনা ক্যা? দেইখা তো মনে হয় বড়লোকের পোলা।
উত্তর নাপেয়ে আরেক জন কইলো সোজা আঙ্গুলে ঘি উঠবেনা। মাইর দেওন লাগবো। ঐপাশে অনেক বাস আছে। ভাই এরে সাইডে লইয়া চলেন।
এবার অনেকটা আস্তে আস্তে শোনা গেল, আমারে ছেড়ে দেন ভাই, আমিতো কিছু করি নাই।
-কিছু করছ নাই তয় ঐ মাগি গুলানের সাথে তোর কি?
ভাই আমি কিছু জানি না। আমারে ছাইড়া দেন। আমার কাছে কোন টাকা পয়সা নেই থাকলে আপনাদের দিয়ে দিতাম। ভাই মাফ কইরা দেন।
কথা শেষ হবার সাথে সাথে ধুপধাপ শব্দ হতে লাগল। এবার ওহাব সাহেব উঠে আসলেন। প্রথমেই টোকাই গুলানের একটা ঝাড়ি দিতেই সব সুরসুর করে সরে গেল। আর যারা তামাশা দেখার আশায় এসেছিল তারাও হতাশ হয়ে চলে গেল। এখন ঘাসের উপর শুধু একটি ছেলে শুয়ে আছে। তার মুখটা দেখা যাচ্ছে না। ছেলেটি যেই মুখ ঘুরিয়ে তাকাল তখনই ওহাব সাহেব চমকে উঠলেন। এত সুন্দর ছেলে তিনি জীবনেও দেখেন নি। মেয়েদের রূপের কথা তিনি জানেন। কিন্তু ছেলে মানুষের যে এত রূপ থাকতে পারে একে না দেখলে তিনি বিশ্বাস করতেন না। উজ্জল ফরসা রঙ। চোখগুলো অনেক বড়। মাটিতে পড়ে আছে বলে হাইট আন্দাজ করতে পারলেননা। গালের নিচে একটু জায়গা মনে হয় কেটে গেছে। সেখানে লাল রক্ত জমাট বেঁধে আছে।চুলগুলো উস্কসুস্ক কিন্তু রূক্ষ নয়। পরনে একটি জিন্স ও একটা সাদা শার্ট। সাদা শার্টের কলারের কাছে রক্তের দাগ।
তিনি ছেলেটির কাছে গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলেন তোমার নাম কি? তাতে ছেলেটি কোন উত্তর দিলেন না। কিন্তু ওহাব সাহেবের তার জন্য এক ধরনের মায়া অনুভব করছে। তিনি তাকে হাত ধরে তুলে নিয়ে গেলেন। ছেলেটিকে দেখে মনে হয় অনেক দিন ধরে কিছু খায়নি। তাই প্রথমে তাকে একটি হোটেলে নিয়ে গেলেন। সে হাত মুখ ধুয়ে তার সামনের চেয়ারে বসল। ছেলেটি দুই প্লেট খিচুরি খুব তৃপ্তি নিয়ে খেল। বিকেলের দিকে তাকে নিয়ে ওহাব সাহেব হাটাহাটি শুরু করলেন। এমনিতে তিনি সারা দিন হেটেই চলাফেরা করেন। প্রথমে তিনি গেলেন পুরাতন বইয়ের দোকানে। বিকেলের এই সময়টা তিনি পুরাতন বই এর দোকানে কাটান। এই সময়টুকু তার আনন্দেই কাটে। তিনি কতগুলো অনুবাদ গ্রন্থ নারাচারা করছিলেন। কয়েকটা বইও কিনলেন। হটাত তিনি দেখতে পেলেন ছেলেটি কিছু পুরাতন বই দেখছে কিন্তু সবই ইংরেজী বই। ওহাব সাহেব কিছুটা অবাক হলেন। ছেলেটা তাহলে পড়াশুনা জানে। শুধু জানেনা ভালই জানে।
ওহাব সাহেব কে একটু চিন্তিত মনে হচ্ছে। ছেলেটা যে ভাল ঘরের এতে কোন সন্দেহ নেই। সন্ধের সময় ওহাব সাহেব ইসহাকের চায়ের দোকানে যায় তাস খেলার জন্য আজ আর যেতে ইচ্ছে করেনা। ইসহাকের দোকনের পিছনে একটু ছোট ঘর আছে সেখানে সন্ধের সময় সবাই তাস খেলতে আসে। সন্ধের পর থেকে আট-নয়টা পর্যন্ত সেখানে ওহাবের সময়টা ভালই কাটে। নয় বছর থেকে এই নিয়মই চলে আসছে। আজ তার সাথে যে ছেলেটি আছে তার সমন্ধে তিনি কিছুই জানেননা। কেন জানি তার উপর কেমন একটা মায়া জমে গেছে। একে আর ফেলে রেখে যেতে পারছেন না।
আজ কয়েকদিন থেকে ওহাবের সাথে ছেলেটি আছে। এর মাঝে ছেলেটি কোন কথা বলেনি। কোন কথা জিজ্ঞেস করলে মাথা নাড়িয়ে হ্যা,না জবাব দিয়েছে। তাতে অবশ্য ওহাবের কোন সমস্যা নেই। এর মাঝে ওহাব ছেলেটির জন্য একটি পাঞ্জাবী কিনে দিয়েছে। সবুজ রংয়ের । ছেলেটির একটি নামও দিয়েছে ওহাব সাহেব। চঞ্চল। যদিও ছেলেটি মটেই চঞ্চল নয় তার পরও এই নামটাই তাকে মানিয়েছে ভাল। ওহাবের চাকরীটা চলে যাবার পর তার হাতে অনেক সময়। সকাল সকাল তাই ওহাব সাহেব ও চঞ্চল বেড়িয়ে পরে। সারা দিন রাস্তা রাস্তা ঘুরা-ঘুরি করে আর সন্ধায় বাসায় ফেরে। ওহাব সাহেব এই কয়দিনে তার প্রায় সব বন্ধুদের বাসায় গেছে। চঞ্চলকে বাসায় নিয়ে আসার পর অবশ্য বাসার সবাই প্রথমে অনেক বিরক্ত হয়েছে। এখন অবশ্য কেউ কিছু বলেনা। চঞ্চলের থাকার যায়গা হয়েছে বাড়ির বারান্দায় একটি ছোট চকির উপর। চকিতে সব সময় একটা মশারী খাটানো থাকে। চঞ্চল যেটুকু সময় থাকে এই মশারীর ভেতর থাকে। বাকিটা সময় ওহাব সাহেবের সাথে হাটাহাটি করে।
একদিন সকালে ওহাব সাহেব দেখেন চঞ্চল বাজার থেকে ফিরছে। হাতে বাজারের ব্যাগ। কি ব্যাপার ওহাব তার স্ত্রী সান্তাকে জিজ্ঞেস করতেই বলল সারাদিন বসে বসে খাবে নাকি? একটু কাজ কর্ম করে খাক।এতে আমাদের একটু সুবিধা হয় কি।
ওহাব সাহেব অবাক হয়ে বললেন তুমি তো জাননা ছেলেটা কোন ঘরের। একটা ভাল ঘরের ও তো হতে পারে। তাছাড়া তারই বা বাজারে যাবার প্রয়োজন পড়ল কেন?
এমন সময় ওহাবের মেয়ে জেসমিন হাজির।সে তাদের কথা শুনছিল। কলেজে যাবার জন্য এখন বাহির হয়েছে। শান্তা চঞ্চলকে বলল তুমি একটু জেসমিন কে নিয়ে যাও তো। কিছুদিন হল কয়েকটি ছেলে পাড়ার মোড়ে জেসমিনকে বিরক্ত করছে। জেসমিন বের হতেই চঞ্চল তার পিছে পিছে বের হয়ে গেল। জেসমিনের থেকে চঞ্চল কিছুটা দূরে দূরে হাটছে। আজ মোড়ে অবশ্য কেউ কিছু বলেনি। যদিও কয়েকটি ছেলে চায়ের দোকানে বসে চা খাচ্ছিল।
চঞ্চল জেসমিনের থেকে দূরে দূরে থাকছে। মশারীর ভিতর এ থেকে সারা দিন বই পড়ে। ওহাব সাহেবের অনেক বই আছে। এই কয়দিনে অনেকগুলো বই সে শেষ করে ফেলেছে। ওহাবের যে চাকরী নেই তা এখন বাসার সবাই জানে। তাই তাকে আর সাকালে বের হয়ে সারা দিন হাটাহাটি করতে হয়না। সকাল হলে একটু হাটাহাটি করে পত্রিকা নিয়ে পড়তে বসে। তাতে অনেকটা সময় কাটানো যায়।ওহাবের অনেক দিনের ইচ্ছা একটা খামার করবেন। চঞ্চলকে নিয়ে তিনি গ্রামের বাড়ী দিনাজপুর থেকে ঘুরে আসলেন। তার মাথায় এখন একটাই চিন্তা খামার করা। মাছের খামার। তার জন্য তিনি পড়াশুনা শুরু করে দিয়েছেন। এই কাজটা ওহাব সাহেব যে ভাল পারবেন এটা তিনি বিশ্বাস করেন। ওহাব সাহেবের দাদার চারটা পুকুর ছিল। সবগুলোই বিশাল বিশাল। যখন সেখানে মাছ ধরা হত তখন আশেপাশের গ্রাম থেকে অনেক মানুষ এসে জড় হত। তার একটা কারন সবার ধারনা ছিল একটা বিশাল আকারের মাছ নিশ্চই উঠবে। সেই ছোট বেলার দাদার হাত ধরে দেখা স্বপ্নটা এবার বাস্তব করতে চান। সাথে চঞ্চল আছে তাতে একটু ভরসা। চঞ্চল ইদানিং একটু একটু করে কথা বলা শুরু করেছে। তাই দিয়ে কাজ চালানো যাবে।তাছাড়া সে কাজের ছেলে বটে। যেকোন দ্বায়িত্ব তাকে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকা যায়।
চঞ্চল যে কথা বলা শুরু করেছে এটা প্রথম শান্তা ওহাব সাহেবের কানে দেয়। চঞ্চল নাকি জেসমিনের সাথে ফুসফুস করে কথা কয়। দোষটা চঞ্চলের নয় জেসমিন তাকে জিজ্ঞস করল তুমি সারাদিন মশারির মধ্যে থাক কেন? চঞ্চল কোন উত্তর না দেয়াতে জেসমিন এমন রেগে গেল যে চঞ্চল কথা বলতে বাধ্য হল। বলল-সারা দিন বসে কোন কাজ নাইতো তাই। মশারীর ভেতর থাকার একটা সুবিধে আশেপাশে কি হচ্ছে না হচ্ছে সে সম্পর্কে কোন চিন্তা থাকেনা। সেই থেকে চঞ্চলের সাথে তার মাঝে মাঝে কথা হয়।
ওহাব সাহেবের শরীরটা আজ কয়েকদিন থেকে ভাল যাচ্ছেনা। প্রতিদিন সকালে বমি হচ্ছে আর বমির সাথে তাজা রক্ত। বমি হবার কিছুন পর শরীরটা দূর্বল বোধ করে। ওহাব সাহেবের মনে চিন্তার ছাপ পরে। একদিন সকালে জেসমিন দেখে ওহাব সাহেবের সাদা পাঞ্জাবীতে রক্তের দাগ। সেটা দেখে সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়। তাকে ধরে বিছানায় নিয়ে মাথায় পানি ঢালার পর তার জ্ঞান ফেরে। সপ্তাহ খানেকের মধ্যে ওহাব সাহেবের শরীরের অবস্থা আরো খারাপ হয়ে যায়। তিনি বিছানা থেকে উঠতে পারেন না। সবার চোখে মুখেই দূশ্চীন্তার ছাপ। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হল। ডাক্তার কোন আশার কথা বলতে পারলেন না। আষাঢ়ের ১৭ তারিখে ওহাব সাহেবের মৃত্যু হয়। মারা যাবার আগে ওহাব সাহেব চঞ্চলের হাত ধরে বলেন যেন তার মেয়েকে সে বিয়ে করেন।
ওহাবের মৃত্যুর পর দুই দিন পার হয়েছে। কিন্তু চঞ্চলের দেখা নেই। এমনিতে সে খুব একটা বাহিরে যেত না। জেসমিন মনের অজান্তে চঞ্চলের জন্য অপো করে। চঞ্চল আর ফিরে আসেনা। ধারনা করা হল সে আর কোন দিন ফিরে আসবেনা। জেসমিন যথারিতি আবার তার কাসে মন দিল। চঞ্চল সমন্ধে জেসমিন অনেক খোজখবর করেছে। কিন্তু কোন আশার আলো দেখতে পারেনি। বড় রাস্তার ধারে যে বড় পুকুরটা আছে সেখানে নাকি চঞ্চলের একজোড়া জুতা পাওয়া গিয়েছিল। জেসমিন এখনও স্বপ্ন দেখে চঞ্চল একদিন ফিরে আসবে। তার বাবার দেয়া কথা রাখবে।