একটা চাপা আর্তনাদে আয়াতের ঘুম ভেঙে গেলো। ঘুম থেকে জেগে জোড়ে জোড়ে নিঃশ্বাস নিচ্ছে, হাপাচ্ছে, ঘেমে গেছে মনে হয় কেউ প্রানটা ধরে নিয়ে যাচ্ছিলো।
পাশের টেবিলে রাখা পানির গ্লাসটা নিয়ে ঢক ঢক করে পুরোটা খেয়ে ফেললো। মনে হয় একটু সস্তি পেলো। ঘরে ডিমলাইট জ্বলছিলো তাই মৃদু আলোয় ঘরের সব কিছুই প্রায় দেখা যাচ্ছিলো। ঘরের চারিদিকে চোখ বোলালো নাহ কিছু নেই। তাহলে কে এমন আকুতি ভরা আর্তনাদ দিলো? বিছানার অপর পাশটায় তাকিয়ে দেখে নিশীথিনী গভির ঘুমে আছে। তাহলে কানের কাছে এত জোড়ে কে চিৎকার দিলো? মনে হয় চিৎকারটা খুব পরিচিতো! আর্তনাদের স্বরে আয়াতের হৃদয়টা যেনো ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে। আয়াত ভাবছে আচ্ছা এত জোড়ে চিৎকার কি নিশীথিনী শোনে নি যে, এমন বেঘোরে ঘুমিয়ে আছে? হতে পারে আমার মনের ভুল। ঘুম আর আসবে না। যাই রিডিং রুমে গিয়ে কিছুক্ষন বই পড়ি। মনটা ভালো হয়ে যাবে। আয়াত রিডিং রুমে গিয়ে লাইট অন করবে এমন সময় রুমের একটা কোনায় চোখ আটকে গেলো কিছু একটা জ্বলছে। না ঠিক জ্বলছে না জোনাকি পোকা যেমন চমকিয়ে আলো দেয় তেমন চমকাচ্ছে। কিন্তু মনে হয় কয়েকশ জোনাকি পোকা এক ঝাকে বসে আছে। আর আকারটা দেখলে মনে হয় কোন #বই। আয়াত লাইট অন না করেই আলোময় বইটার দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে। আলোময় বইটায় হাত নিতে যাবে তখনই রিডিং রুম এর লাইট অন হয়ে গেলো।
আয়াতের যেনো ধ্যান ভাঙলো। আলোটা অদৃশ্য হয়ে গেলো। কিন্তু বইটা ঠিকই রয়ে গেলো। পিছনে ফিরে দেখে নিশীথিনী লাইট জ্বালিয়ে হাসি হাসি মুখ করে আয়াতকে বললো।
নিশীথিনীঃ বিছানায় তোমাকে দেখলাম না। ভাবলাম ওয়াশরুমে , সেখানেও না দেখে বুঝলাম পড়ার রুমে আছো! কিন্তু অন্ধকারে কি পড়ছিলে?
আয়াত কি উত্তর দিবে ঠিক ভেবে পায় না। একবার ভাবে স্বপ্ন আর বইটার কথা বলবো? আবার ভাবে না থাক শুধু শুধু টেনশন দিয়ে কি লাভ? নিজের চিন্তাটাকে আড়াল করে বললো
আয়াতঃ কিছুনা! এমনিই ভালো লাগছিলো না তাই ভাবলাম একটা বই নিয়ে পড়ি।
নিশীঃ আয়াত! রাত তিনটা বাজেও তোমার বই পড়া লাগবে? পাগলামো বন্ধ করো। চলো ঘুমাবে!
নিশী আয়াতের হাত ধরে রুমে নিয়ে গেলো। আয়াত শুয়ে পড়লো। নিশী নিজের মাথাটা আয়াতের বুকে রাখলো। আয়াত কোন কথা বলছে না। কারন যতবারই নিশী আয়াতের বুকে মাথা রাখে আয়াতের খুব অসস্তি লাগে। কেনো যেনো ওর মনে হয় নিশী ভুল জায়গায় মাথা রাখছে। আয়াতের বুকটা যেনো অন্য কারো জন্য। অথচ নিশী তার বিবাহিতা স্ত্রী। হ্যা মাত্র তিনমাস হয়েছে ওদের বিয়ের। কিছুক্ষনের মধ্যে নিশী ঘুমিয়ে পড়ে। আয়াত নিশীর মাথাটা বালিশে রেখে নিজেও ঘুমিয়ে পড়ে।
সকালে আয়াত অফিসে চলে যায় আর নিশী ঘরে টুকিটাকি কাজ করতে গিয়ে ঘরে তনয়ার একটা ছবি পায়। ছবিটা দেখে রাগে নিশীর গা জ্বলতে থাকে। ছবিটা নিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে গ্যাসের চুলার উপর ছবিটা রেখে চুলা জ্বালিয়ে দেয়। পাশ থেকে আয়াতের মা সেটা দেখে বলে ছবি পোড়ালে কি মানুষটার অস্তিত্ব পোড়াতে পারবে? তার অস্তিত্ব হয়তো এখনো পৃথিবীতে আছে!
আয়াতের মায়ের কথা শুনে নিশী তার দিকে তাকিয়ে রহস্যময়ী একটা হাসি দিয়ে ছবিটার পুড়ে নিঃশেষ হওয়া পর্যন্ত তাকিয়ে থাকে। আর ঠোঁটের কোনায় ছড়িয়ে থাকে এক অজানা রহস্যময়ী হাসি। তারপর আয়াতের মা কে বলে?
নিশীঃ মা প্লিজ আমার সামনে তনয়ার নাম নিয়েছেন ঠিক আছে! কিন্তু আয়াতের সামনে তনয়ার নামটা নিবেন না। আপনারা জানেন এতে ক্ষতিটা আয়াতেরই হবে।;
আয়াতের মাঃ জানিরে মা! কিন্তু কি জানিস সত্যি কত দিন লুকানো যায়। একদিন না একদিন আয়াত সব জেনে যাবে তখন কি করবি?
নিশীঃ মা তখনকার বিষয় না হয় তখনই দেখা যাবে। এখন আয়াত আমার জীবনের সাথে জড়িত আর আমি চাই না আয়াতের মুখে আমি ছাড়া অন্য কারো নাম থাকুক। তারপর নিশী সেখান থেকে চলে গেলো।
বিকেল বেলা সবাই বাগানে বসে নাস্তা করছিলো আর গল্প করছিলো। তখন আয়াতের বাবা চা আর বেগুনী খেতে খেতে বললেন যতই বেগুনীই খাই তনয়ার মত সুস্বাদু বেগুনী বানাতে কেউ পারবে না। তনয়া নামটা শুনে সবাই থমকে যায়। সাথে সাথে আয়াত জিগেস করে
আয়াতঃ কে তনয়া?
আয়াতের এমন প্রশ্নের উত্তর দিতে সবাই একটু থতমত খেয়ে গেলো। কিন্তু নিশী সাথে সাথে কথা ঘুরিয়ে বললো ।
নিশীঃ আর বলো না আয়াত! বাবার এক বন্ধুর মেয়ের নাম তনয়া! সে নাকি খুব ভালো রাধুনী। সেখানে বাবা একদিন বেগুনী খেয়েছিলেন। সেই থেকে তার প্রসংশা করছে।
আয়াতঃ ওহ।
সবাই যেনো সস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।
কিন্তু আয়াত মনে মনে ভাবছে কে এই তনয়া? মেয়েটার নাম শুনলেই মনটা কেমন যেনো করে ওঠে। মনে হয় আমার হৃদয়ের সাথে নামটা মিশে আছে। মিশে আছে আমার নিঃশ্বাসে। কিন্তু একটা নাম কিভাবে নিঃশ্বাসের সাথে মিশতে পারে? নাকি নামের অস্তিত্ব আছে আমার জীবনে? কেন যেনো নামটা শুনলেই অন্য কিছু ভাবতে পারি না।
রাতের বেলা খাবার খেয়ে আয়াত রুমে ডুকে পুরো অবাক। কারন রুমটা সুন্দর করে সাজানো ছিলো। আয়াতের কেমন যেনো অসস্তি লাগছিলো। কারন আয়াত বুঝতে পারছে নিশী রুমটা এমন কেন সাজিয়েছে? আয়াত রুমের ভিতরে ডুকে বিছানার পাশ থেকে মোবাইলটা নিয়ে যেই বের হতে যাবে অমনি নিশী আয়াতকে পিছন থেকে আষ্টে পিষ্টে জড়িয়ে ধরলো। আয়াতের নিজের মাঝের পৌরষত্বটা জেগে উঠলেও নিজের মনের ভিতর এক অপরাধ বোধ কাজ করছিলো। তাই নিশীকে নিজের থেকে সরিয়ে বললো
আয়াতঃ কি করছো নিশী! মাথা ঠিক আছে তোমার?
নিশীঃ আয়াত আর কত দিন আমায় দূরে রাখবে ? আমি আমার অধিকার চাই।
আয়াত মৃদু হেসে নিশীকে বললো
আয়াতঃ আমি তো জানতাম বাঙালি মেয়েরা এসব বিষয় নিজে থেকে কখনো বলে না।
নিশীঃ (অনেকটা লজ্জা পেয়ে) তো এখন সময় পাল্টেছে।
আয়াতঃ ওহ!
নিশীঃ আয়াত আমার জানামতে তোমার জীবনে আমি ছাড়া অন্য কেউ তো নাই। তবে কেন আমাকে দূরে দূরে রাখো? কেন আমাকে নিজের করে নিতে পারো না? কেন ভালোবাসো না আমায়?
আয়াতঃ আমি তো বললাম নিশী আমি সেটা নিজেও জানি না। কেন আমি নিজেকে তোমার কাছে দিতে পারি না? তাই তো বললাম আমার সময় দরকার।
নিশীঃ বিয়ের তিন মাস হয়ে গেছে আয়াত। তোমার এখনো সময় চাই। নাকি অন্য কোন প্রবলেম?
আয়াতঃ মানে?
নিশীঃ আয়াত আর ইউ গে? (দুষ্টমি করে)
আয়াতঃ হোয়াট! কি বলছো নিশী পাগলের মত কথা? দেখো এমন বাজে কথা একদম বলবা না। আমি একদম পারফেক্ট সুস্থ একটা ছেলে। ওসব ইয়ে আমি না বলে দিলাম হুমমম। (কথাগুলো এ নিঃশ্বাসে বলে দিলো) আর তোমার এমন কেন মনে হলো?
নিশীঃ (দুষ্টমি করে) না মনে হবার কোন কারন তো নাই! একটা সুন্দরি মেয়ে তোমার কাছে নিজেকে বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত অথচ তোমার ভিতর কোন ফিলিংস নাই।
আয়াতঃ জাস্ট সেটাপ। আমি ঐ সব ছেলেদের মত না যারা মেয়ে দেখলে হুশ থাকে না। আমি মেয়েদের প্রচন্ড সম্মান করি। আর তোমার কাছে নিজের পৌরোষত্ব দেখানোর কোন দরকার নাই। আমি বলেছি আমার কিছু সময় দরকার। কারন যখনই আমি তোমার কাছে যেতে নেই আমার কেমন যেনো অসস্তি লাগে। মনে হয় কেউ বারন করছে তোমার কাছে না যেতে! কেউ আমায় আটকে রেখেছে। কেমন যেনো একটা অনুভুতি হয়! আই এ্যাম স্যরি। কথাটা বলে আয়াত রুম থেকে বের হয়ে যায়। নিশী আনমনে বিছানার এক কোনে বসে কিছুক্ষন কান্না করে। আর বলে
নিশীঃ সব কিছুর জন্য তুই দায়ী তনয়া!
কি দরকার ছিলো এত ভালো হবার!
দেখ তোর কারনে আজ আমার জীবনটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
আয়াত রিডিং রুমে গিয়ে অনেকক্ষন অফিসের কাজ করে। কতক্ষন তার ঠিক নাই। হঠাৎ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে রাত প্রায় দুটো বাজে। কিন্তু ঘুম আসছে না। ভাবলো একটা বই পড়বে। একটা বই নিয়ে পড়তে শুরু করে। আয়াত বইটা পড়ছে কিন্তু ওর মনে হচ্ছে কেউ একজন ওর পাশে বসে ওর কাঁধে মাথা রেখে আছে। কিন্তু কই কাউকে তো দেখছি না। কিন্তু অনুভব হচ্ছে তেমনই। যেনো কেউ আয়াতের কাঁধে মাথা রেখে পরশ শান্তিতে চোখ বন্ধ করে রয়েছে। মনে হয় সে আয়াতের সাথে বই পড়তে চাইছে বা চাইছে আয়াত তাকে বই গুলো পড়ে শোনাক। তার নিঃশ্বাসের অনুভুতিগুলো আয়াতের ঘারে লাগছে। আয়াতের গাঁ ভয়ে শিউরে ওঠার কথা? কিন্তু না আয়াতের একটুও ভয় করছে না। বরং অনুভুতিটা ওর ভিষন ভালো লাগছে। খুব পরিচিতো কারো অস্তিত্ব টের পাচ্ছে। মন চাইছে এমন করেই আয়াত থাকুক।
আয়াত নিজের হাতের বইটা রেখে একটা কবিতার বই পড়া শুরু করলো। এবার মনে মনে না পড়ে একটু জোড়ে জোড়ে পড়ছে যেনো কেউ কবিতা শুনতে খুব পছন্দ করে বলে তার জন্য কবিতা আবৃতি করছে
আমার এ বনের পথে
কাননে ফুল ফোটাতে
ভুলে কেউ করতো না গো
কোন দিন আসা-যাওয়া।
সেদিন ফাগুন-প্রাতে
অরুণের উদয়ের-সাথে
সহসা দিল দেখা
উদাসী দক্ষিনা হাওয়া।—-
বুকে মোর চরন ফেলে
বধুঁ মোর আজকে এলে
আজি যে ভরা সুখে
কেবলই পরাণ কাঁদে।
#লেখাঃ_সুফিয়া_কামাল
কবিতাটি শেষ করে আয়াতের চোখ আবার বুক সেলফ এর সেই কোনায় যায় যেখানে সেই বইটি আবার আলোকময় হয়ে উঠেছে। আয়াত মনে মনে ভাবছে না আজ এ বইটি পড়বোই পড়বো। আয়াত বুক সেলফ এর কাছে গিয়ে বইটি হাতে নেয়। নিজের অজান্তেই আয়াত বলে ফেলে
আয়াতঃ বাহ! কি সুন্দর বই। বইটির নাম
#বই
#লেখাঃ_তনয়া_আয়াত_হাসান।।
বইটির লেখকের নাম দেখে আয়াত যেনো বড়সড় ধাক্কা খেলো।
গল্পের বিষয়:
গল্প