এক চিলতে হাসি

এক চিলতে হাসি
আমার স্বামী তার মায়ের বয়সী এক মহিলার সাথে অবৈধ, অনৈতিক কাজ করতে গিয়ে ধরা পড়ে। সেই এলাকার লোকজন ধরে আমার স্বামীকে সেই মহিলার সাথে বিয়ে পড়িয়ে দেয়। স্বামীর এমন একটি খবর পাওয়ার পর কোনো স্ত্রী স্বাভাবিক থাকতে পারবে কিনা আমার জানা নেই। আমাদের বাড়ি নওগাঁ। বাবা ছিলেন তখন প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক। ২০১৪ সাল, আমি সবেমাত্র ক্লাস এইটে উঠেছি। বাবা মায়ের ধারণা ও হিসেব মতে তখন আমার বয়স ছিল তেরো বছর। আমার এক বছরের ছোট আরেকটি বোন রয়েছে। সে পড়তো ক্লাস সেভেনে। তখন বাবার কাছে আমার বিয়ের জন্য একটি প্রস্তাব আসে। ছেলে একই গ্রামের। বাবা সরাসরি না করে দিলেন, “আমার মেয়ে অনেক ছোট। এত ছোট মেয়েকে বিয়ে দেব না। সে এখন লেখাপড়া করছে।”
প্রথমে বিয়ের কথা শুনে খুব ভয় পেয়েছিলাম। কিন্তু বাবা যখন না করে দিলেন তখন খুব খুশি হয়েছি। কিন্তু যে লোক প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলেন, তিনি ঘন ঘন বাবার সাথে যোগাযোগ করতে লাগলেন। ঐ লোকটিকে দেখলেই আমার মনে অজানা ভয় এসে ভীড় করত। এই বুঝি আমাকে অন্ধকার কূপে ফেলে দেয়া হবে। বাবা দুয়েকদিন পর পরই ঐ লোকের বক্তব্য মায়ের কাছে পেশ করতেন। আমি কখনো পাশের ঘর থেকে কখনো বা মায়ের মুখে সেই অজানা ভয়ের আভাস পেতাম। গা ছমছম করা ভয়। আমাদের এলাকায় যৌতুকের প্রচলন রয়েছে। ছেলেকে মোটা অঙ্কের যৌতুক প্রদান করা হয়। আমাদের এলাকার ঘুনে ধরা সমাজে কথিত ধারণা হলো, ছেলেকে যৌতুক প্রদান করা হলে মেয়ে সুখে থাকবে।
যার সাথে আমার বিয়ের কথা হয়েছিল সেই ছেলেটার বাবা বৃদ্ধ। ছেলেটার পুলিশে চাকরি হবার চেষ্টা চলছে। কিন্তু সেখানে ঘুষ প্রয়োজন। কিন্তু ছেলে বা তার বাবার কাছে ঘুষের সমপরিমাণ টাকা নেই। সেজন্যই ছেলেকে বিয়ে করানোর চিন্তা আসে মনে। যাতে করে যৌতুকের টাকায় ছেলের পুলিশে চাকরি হয়। আর সেই পাত্রী হিসেবে আমাকে তারা পছন্দ করেছে। কিন্তু বাবা কিছুতেই রাজী হচ্ছেন না। ঘটক ও ছেলে পক্ষের লোক বাবাকে প্রতিনিয়ত বুঝাতেন। “মাস্টার মশাই, আপনার দুটো মেয়ে প্রায় সমবয়সী। একই সাথে তারা বেড়ে উঠছে। আপনার বড় মেয়ে সুন্দর হলেও একটু খাটো। আর ছোট মেয়ে লম্বায় বড় হয়ে যাচ্ছে। পরবর্তীতে বড় মেয়েকে দেখতে আসলে ছেলে পক্ষ ছোট মেয়েকে পছন্দ করবে। তাছাড়া দুটো মেয়েকে প্রায় একই সময়ে বিয়ে দিতে কষ্ট হবে আপনার। তার চেয়ে ভালো এখনি বিয়ে দিয়ে দিন।”
এত কঠিন যুক্তির মারপ্যাচে বাবা একদিন রাজী হয়ে ওদের কথা দিয়ে দিলেন। আমার মতামত জানার কোনো প্রয়োজন মনে করলেন না। যখন আমি বেঁকে বসেছি বিয়ে করব না। তখন সেই যুক্তিগুলো পরিবার থেকে আমাকে বুঝানো হতো। আমি বড় মেয়ে, আমি না বুঝলে কে বুঝবে? যাই হোক, অনেকাংশে অনেক পরিবারেই মেয়ের কোনো মতামতের মূল্য দেয়া হয় না। আমার বেলায়ও তেমনটাই ঘটেছিল। আমার বিয়ের দিন ধার্য্য করা হলো নভেম্বরের ১৬ তারিখ, ২০১৪ ইংরেজী বর্ষে। যখন একটি কিশোরী মেয়ে স্বামী, সংসার জীবন সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই ঠিক সে সময়টাতে আমাকে অজানার উদ্দেশ্যে রওনা হতে হয়। বাবা মা ছেড়ে অন্য অচেনা পরিবারে সংসার সাজানোর চেষ্টা।
আমার স্বামী যে চরিত্রহীন তা আমি কয়েকটা দিনেই বুঝতে পারি। আমাকে মন থেকে পছন্দ করে বিয়ে করেনি। বিয়ে তো করেছে যৌতুকের টাকার জন্য। যা দিয়ে পুলিশের চাকরি হবে। ছোট একটি মেয়ে আমি, অচেনা মানুষটাকে আপন করতে সময় লাগবে এটাই স্বাভাবিক। ভালোবাসা নয় এক প্রকার অত্যাচার করছিল আমার উপর। কয়েকদিন পর ট্রেনিং এ চলে যাবে, আমি কেন বাবার বাড়ি থাকব? এই কয়েকটা দিন স্বামীর সাথে একই ঘরে থাকতে হবে। আমি ছোট ছিলাম, বিয়ে হয়েছে এখন নাকি বড় হয়ে গেছি। বাধ্য হয়ে থাকতে হতো একই সাথে।
তারপরও যখন দেখতাম আপন ভাবীর সাথে দৃষ্টিকটু আচরণ, রং ঢং করত তাই আমার স্বামীর চরিত্র সম্পর্কে অনেক ধারণা জন্মায়। আরো পরিষ্কার হয় একদিন রাতে। আমার ভাসুর কাজে আটকা পড়ায় সেদিন বাড়ি আসবে না। আমার স্বামী সারারাত ভাবীর ঘরে ছিল। আমি দু’বার ডাকতে গিয়েছিলাম। বলেছে, তুমি ঘরে যাও। আমি ভাবীর সাথে কথা বলছি, পরে আসব। পরে আসব বলে সে রাতে আর ঘরে আসেনি।
বাবা মায়ের কাছে এই ঘটনা বলার পর তারা আমার কথা বিশ্বাস করেনি। তাদের বক্তব্য হলো, আমাকে যেন স্বামীর সাথে একই ঘরে থাকতে না হয় সেজন্য আমি মিথ্যে বলছি। রাতে শুয়ে শুয়ে কান্না করতাম। আর আমার পাশের বালিশে শুয়ে আমার স্বামী অন্য মেয়ের সাথে ফোনে কথা বলে। পৃথিবীর কোনো মেয়ে এমনটি সহ্য করবে কিনা আমার জানা নেই। আমি সহ্য বরেছি, কারণ আমার বাবা মা আমার কথাকে মূল্যায়ন করে না কখনো। আমার শ্বশুর যখন মারা গেলেন তখন আমার স্বামীর পুলিশের চাকরী হয়ে গেছে। আড়াই মাসের সন্তান যখন আমার পেটে তখন আমার চিন্তার অন্ত নেই। কেউ ভাবেনি আমি গর্ভবতী হবো। সাত কিংবা আটদিন আমাকে আমার স্বামী টেনেছিল তার বাহুডোরে। সাত আটদিনের জন্য কোনো পদ্ধতিই অবলম্বন করেনি। আমি ছোট মানুষ, আমি কি এতকিছু বুঝি?
আমার পেটে বাচ্চার বয়স যখন সাড়ে চার মাস তখন ভাবীর এক বোন আসে আমার শ্বশুর বাড়িতে। জানিনা কেমন বোন। আমার স্বামী ও ঐ মেয়েটিকে এক ঘরে কথা বলতে দিয়ে ভাবী বাইরে ঘুরে বেড়ায়। আমাকে দেখে আমার স্বামী ঘরের দরজা লাগিয়ে দেয়। ভিতরে দুইজন ছেলে-মেয়ে। দরজা বন্ধ ভিতর থেকে। ঘন্টা পার হয়ে গেছে। এ কেমন মানষিক টর্চার? কে সহ্য করবে? আমি ভাবীকে জিজ্ঞেস করেছি এসব কী? তিনি জোরে আমার স্বামীকে শুনিয়ে জবাব দেয়, “এসব কী মানে? তারা কী কু কাজ করে বেড়াচ্ছে নাকি? অপবাদ দেয়ার তো মানে হয় না।” আমার স্বামী এসব শুনে ঘরের দরজা খুলে বের হলেন। উঠোন থেকে বাঁশ নিয়ে আমার হাতে জোরে আঘাত করে। যে হাতের ব্যথা এক সপ্তাহে ঠিক হয়নি। আর আমার বাড়িতে জানানো হয় আমি টিউবওয়েলে পানি আনতে গিয়ে পড়ে গেছি।
আমার সুন্দর ফুটফুটে একটি মেয়ে সন্তান হয়। যদিও মৃত্যুর কাছ থেকে ফিরে এসেছি আমি। দুটি হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল আমাকে, কম বয়সে বাচ্চা নেয়ার জন্য। আমার মেয়ের নাম রাখি আমি রোকেয়া। সনিয়ার মেয়ে রোকেয়া। এত কষ্টের পর মেয়েটিকে পেয়ে সব কষ্ট ভুলে একটু সুখ খোঁজার চেষ্টা করছিলাম। আর এই সুখটা আমার কপালে সইল না। স্বামী অপকর্ম করতে গিয়ে ধরা পড়েছে। বিয়ে করেছে তার মায়ের বয়সী এক মহিলাকে। যে নাকি কাদের ব্যাচেলরদের জন্য ভাত রান্না করত। এই অপকর্মের জন্য তার চাকরিটাও চলে গেছে।
এখন ২০১৯ সাল। আমার মেয়ের বয়স চার বছর। আমি শ্বশুর বাড়ি থেকে চলে এসেছিলাম ঐ ঘটনার পরে। শুনেছি আমার স্বামী ঐ মহিলাকে নিয়ে গার্মেন্টসে চাকরি করে। আমার বিয়ের দেনমোহরের টাকা বাকি ছিল। বাবা ঐ ঘটনার পর টাকা চাওয়ায় সে বলেছে তার কাছে কোনো টাকা নেই। তার কিছু ফসলি জমি ছিল, আমার মেয়ের নামে রেজিস্ট্রি করে দিয়েছে। তাতেও দেনমোহরের পুরো টাকা পরিশোধ হয়নি। মাঝেমধ্যেই আমাকে ফোন দিয়ে হুমকি দেয়, সে তার মেয়েকে নিয়ে যাবে। কিন্তু আমি আমার নাড়িছেঁড়া মেয়েটাকে এত ভালোবাসি যে আমি আমার মেয়ে ছাড়া থাকতে পারব না। আমি তাকে ডিভোর্সও দিতে পারিনা। এক উকিল পরামর্শ সরূপ বলেছে আমি যদি তাকে ডিভোর্স দেই তাহলে আইন অনুযায়ী যে কোনো সময় সে মেয়েটাকে নিয়ে যেতে পারবে। কিন্তু আমি মেয়েটাকে হারাতে চাইনা।
বাবা অনেকবার আমার কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। এখনো মাঝেমধ্যেই ক্ষমা চান। আমি বহু আগেই বাবাকে ক্ষমা করে দিয়েছি। বাবা তো, জন্ম দিয়ে দুনিয়া দেখিয়েছেন। তাকে ক্ষমা না করি কীভাবে? আমি এখন আর বাবার সামনে কান্না করিনা, গোপনে কাঁদি। পাছে বাবা যদি কষ্ট পায়, সেজন্য। ছোট বোনটার বিয়ে হয়েছে, সে এখন সুখে আছে। আমিও তো আমার মেয়েটাকে নিয়ে সুখী হতে চেয়েছি। এক উকিল বলেছে আমার স্বামীর বিরুদ্ধে অন্য ধারায় মামলা করলে তিন মাস পর থেকে আর মেয়ের দাবী নিয়ে আসতে পারবে না। বাবাকে বলেছি উকিলের সাথে বিস্তারিত কথা বলার জন্য।
সাত আটদিন তো স্বামীর আদর সোহাগ পেয়েছি। বাকি জীবনে আমি স্বামী সংসার চাই না। শুধু আমার মেয়েটাকে না হারিয়ে সারাজীবন সাথে নিয়ে বাঁচতে চাই। রাতের গভীরে চোখের জলে বালিস ভিজলেও ঠোটের কোণে এক চিলতে হাসির রেখা ফুটে উঠুক।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত