চড় মেরে পাঁচ আঙুল বসিয়ে দিলাম তিথির গালে। তাকে মেরে নিজের মনে আজ শান্তি অনুভব করলাম। তিথিকে কখনো জোরে কাঁদতে দেখিনি।আজও সে কাঁদলো না। কাঁদলেও হয়তো তা আমার চোখে পড়েনি। কারণ তাকে মারার পরেই বন্ধুদের ফোনের কারণে বেরিয়ে পড়লাম। রিকশায় উঠে ভাবছি, ইস! যদি আরো দুই একটা ভালো করে দিতে পারতাম তাহলে হয়তো আরেকটু শান্তি পেতাম। আজকের আড্ডাটাও বেশ জমলো। তিথিকে মারার মজাটা আজ বন্ধুদের সাথে ভাগাভাগি করে সেলিব্রেট করলাম। আনন্দ করতে করতে অনেক রাতও হয়ে গেলো। এরি মধ্যে তিথিও অনেক বার ফোন করলো। এতো বার ফোন করছিলো যে ফোন রিসিভ করেই ‘কুত্তার বাচ্চা ফোন দিবিনা’ বলে কেটে দিলাম। গালি দিয়েও আজ মনে একটা আনন্দ অনুভব করতে লাগলাম।
রাত দশটা।এবার ফেরার পালা। সারা রাস্তায় খোঁজাখুঁজি করেও একটা রিকশা পেলাম না। কিছুদূর হাটার পরেই এক মামাকে দেখলাম রিকশা নিয়ে বসে আছে। তাকে বললাম ওই মামা,জাইবা? কই জাইবেন স্যার? ব্লক ৫,লালমাটিয়ার উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে। জ্বি স্যার জাইমু। ভাড়া কত? ভাড়া স্যার আইজ আর বেশি রাহুম না।আফনে আমারে ৭০ টাকার জায়গায় ভাড়া ৪০ টাকা দিলেই আমি খুশি। রিকশায় উঠে পড়লাম। যেতে যেতে খেয়াল করলাম রিকশাওয়ালা মামার ফোন আসলো। স্যার আমার বৌ ফোন করছে,আফনে যদি অনুমতি দেন তই ফোনডা দইরা এট্টু কতা কইতাম। রিকশাওয়ালা মামার অসহায় চাহনি দেখে বললাম আচ্ছা কথা বলো।
রিকশারওয়ালা মামা কথা শেষ করে আবার রিকশা চালানো শুরু করলো। তবে রিকশাওয়ালা মামাকে এবার একটু বেশি হাসিখুশী মনে হলো। তাই জিজ্ঞেস করলাম কি মামা ব্যাপার কি, তুমি মনে হয় বেশি হাসাখুশিতে, কারণ কি? স্যার আজ রাইত বারোটার ফর আমার বৌ এর জন্মদিন। বৌডারে গতবারও কিছু দিতে ফারি নাই। তাই এইবার এক খান শাড়ি দিমু। শাড়ি স্যার আমি পছন্দ কইরাও রাখছি কন্তু ৪০ টাকা এহনো বেমিল তাই আফনের কাছ থেইকা ৪০ টাকা নিয়াই বৌ এর লাইগা শাড়িডা নিমু। ওহ! তোমাদের বিয়ের বয়স কত বছর হলো? জে স্যার, বিয়ের আজ ১১ বছর হলো।
আমি অবাক হয়ে রিকশাওয়ালা মামার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। একটা বিবাহিত জীবন ১১ বছর পার হলো অথচ ভালোবাসার কোন কমতি এখনো নেই। রিকশাওয়ালা মামাকে আবারো জিজ্ঞেস করলাম তোমার পরিবারে আর কে কে আছে? জ্বি স্যার আমরা জামাই বৌ দুইজন আর আমাগো একটা পোলা আছে। ওহ! তোমার বৌ আর ছেলে কি করে? স্যার বৌ রে আমি দুগা ভাত রান্না করা ছাড়া আর কিছু করতে দেই নাই। ও তার পুরো পরিবার ছাইড়া আমার কাছে চইলা আইছে। আমি কি করে তারে বাইরে কোন কাজ করতে দেই কন? আমার বাবা মাও ছোড বেলাই মইরা গেছে। বাবা মা ছাড়ার কষ্ট আমি বুঝি ভাইজান। আর ছেলে আমার এবার কেলাস ফোরে পড়ে।
রিকশাওয়ালার কথা আমি আর নিতে পারলাম না। মনে মনে ভাবলাম ঠিকই তো,একটা মেয়ে তার বাবা মাকে ছেড়ে চলে আসে। উনিশ বিশ বছরের বাবা মায়ের মায়া মমতা ছেড়ে তাকে স্বামীর কাছে চলে আসতে হয় আশ্রয়ের জন্য।অথচ আমরা ছেলেরা নানা ভাবে স্ত্রীর উপর অত্যাচার করে থাকি। আমরা তো মানুষ,ভুল আমাদের হতেই পারে। তাই বলে কি তাদের উপর এমন ভাবে অত্যাচার করবো? এবার রিকশাওয়ালা মামাকে বললাম চলো আগে মার্কেটে যাই। তোমার পছন্দ করা শাড়ি আগে কিনবো তারপর আমি অন্য রিকশায় করে আমার বাসা পৌছাবো। তাছাড়া রাতও হয়ে যাচ্ছে। পরে তো তুমি আর মার্কেট খোলা পাবে না। স্যার আফনে অন্য রিকশা দিয়া গেলে আমি তো আর ৪০ টাকাও ফামুনা। বৌ এর জন্য তো আর শাড়িও কিনা হবে না।
হুম তোমার টাকা দিয়ে শাড়ি কিনতে হবে না। আজ আমি তোমাকে বকশিস হিসেবে একটা শাড়ির দাম দেবো।
চলে গেলাম মার্কেটে। সেখান থেকে দুটো শাড়ি কিনলাম। একটা শাড়ি রিকশাওয়ালা মামার বৌ এর জন্য আরেকটা তিথির জন্য। রিকশাওয়ালা মামাকে বড় দেখে একটা কেক আর তার ছেলের জন্য কিছু টাকা হাতে দিয়ে আমি বাসায় চলে আসলাম। আজ প্রথম মনে হলো আমি তিথির দিকে তাকাতে পারছিনা। তারপরও তিথির হাতে শাড়িটা দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে শুরু করলাম। আজ আমারো বুক ভিজলো তিথির চোখের জলে।
গল্পের বিষয়:
গল্প