অভিনয়

অভিনয়
এতদিন টই টই করে ঘুরে বেড়ানোই ছিল চয়নের কাজ৷ কিন্তু এখন থেকে এটা আর সম্ভব নয়। পড়াশোনা শেষ হয়েছে বছর খানেক হতে চললো। চাকরি বাকরি করার কথা সে ভাবেনি। বাবা তো আছেনই! হঠাৎ বাবা মারা গেলেন তার। মায়ের শরীরটাও ভালো না। ছোট বোনের বিয়ের বয়স হয়েছে। এবার আর বসে থাকার সুযোগ নেই। কিছু তো একটা করতেই হবে।
প্রায় চার-পাঁচ মাস চেষ্টা করেও সে চাকরি জোগাড় করতে পারলো না। হাঁপিয়ে উঠল সে। হঠাৎ তার মনে পড়ল বাল্যবন্ধু ইফতি এর কথা। ভালোই সম্পর্ক ছিল দুজনের। স্কুল পর্যন্ত একসাথেই পড়েছিল। পরবর্তীতে সে ভালো কলেজে ভর্তি হয়। আর ওখান থেকে বিদেশি ডিগ্রির জন্য লন্ডনে পাড়ি জমায়। তবে এখন দেশে ফিরে এসেছে। খুব বেশি কথা না হলেও মাঝেমাঝে ফেইসবুকে কথা হয় দুজনের। বর্তমানে রাজশাহী থাকে চয়ন। একটা কারখানার মালিক সে। সে নিশ্চয় তার একটা গতি করতে পারবে। এই ভেবে চয়ন চলে আসে বন্ধুর সাথে দেখা করতে রাজশাহী। সরাসরি তার অফিসেই দেখা করতে যায়।
বেশকিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর ইফতির সাক্ষাত পেল চয়ন। সে লক্ষ্য করলো, ইফতির মাঝে বেশ পরিবর্তন এসেছে। চালচলন, পোশাক-আশাক, কথাবার্তা সবকিছুই আগের সাথে কোনো মিল নেই। ইফতি দেখতে সুর্দশন একজন পুরুষ। এখন আগের চেয়েও ভালো লাগছে! কথায় কথায় চয়ন চট্রগ্রাম থেকে হুট করে এখানে আসার কারণ কি তাকে জানালো। সবটা শুনে ইফতি কিছুক্ষণ নীরব থেকে কিছু একটা ভেবে বলল, একটা কাজ আমি দিতেই পারি তোকে। তবে তুই করবি কিনা জানিনা।
-এই মুহুর্তে এক কাজ আমার ভীষণ প্রয়োজন। প্লিজ আমাকে হেল্প কর। মোটামুটি বেতনের একটা কাজ হলেও চলবে।
-মোটামুটি নয়, ভালোই বেতন পাবি।
অফিস থেকে ফেরার পথে চয়নকে নিয়ে বাসায় ফিরেছে ইফতি। বেশ বড়সড় একটা বাংলোতে থাকে সে৷ শ্বশুর বাড়ি থেকেই দেওয়া এটি। দেখতে মনেহচ্ছে বিদেশের কোনো বাড়ি! তার অফিসও শ্বশুশের দেওয়া। ইফতির শ্বশুর মশাই বেশ বড়লোক। যার একমাত্র মেয়ে আমেনার সাথে ইফতির বিয়ে দেন তিনি। লন্ডনে আমেনার পুরো পরিবার ঘুরতে গিয়েছিল। ওখানেই ইফতির সাথে আলাপ তাদের। তখন থেকে তাকে ভালো লেগে যায় আমেনার বাবার৷ কারণ পড়াশোনা কে তিনি গুরুত্ব দেন অত্যধিক। সেই থেকে তার সাথে যোগাযোগ রাখেন। পরে বাংলাদেশে আসলেই বিয়ের প্রস্তাব দেন। আমেনা ও ইফতিও একে অপরকে পছন্দ করলো। তারপর বিয়েটা হয়েই যায়।
বাসায় এসে আমেনার সাথে চয়নের পরিচয় করিয়ে দিলো ইফতি। অসাধারণ রমনী আমেনা। প্রথম দেখাতেই কথার মাধ্যমে আপন করে নিয়েছে চয়নকে। ইফতি জানালো, এখন কোনো পদ খালি নেই। তাই ওর জব হতে কিছুদিন সময় লাগবে। ততদিন সে এখানেই থাকবে। পরদিন থেকেই ইফতি অফিসের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। চয়নের খাতির যত্নে কোনো অভাব হতে দেয় না আমেনা। একা বাসায় দুজনে দুজনের সাথে গল্প করে সময় কাটায়। কথায় কথায় জানতে পারলো, চয়নের মা বাবা নেই। সে এখানে একটা চাকরির আশায় এসেছে। এসব শুনে মায়া লাগলো আমেনার। দিন পার হতে লাগলো। দেখতে দেখতে চয়ন ও আমেনার সম্পর্ক টা কয়েকধাপ এগুলো। ভালো বন্ধু হলো তারা৷ ইদানীং ইফতি তাকে মোটেও সময় দেয়না। বাড়িতে ফিরে রাত করে।
তাই আমেনা প্রায় তার সব কাজেই অনেকাংশে চয়নের উপর নির্ভর হয়ে পড়েছে। একদিন চয়নকে বলেই ফেলল সে- তুমি আমার যতটা কেয়ার করো, ইফতি করেনা। মাঝেমধ্যে মনেহয় তোমার মতো কাউকে স্বামী হিসেবে পেলে আর কিছু বললো না আমেনা। এদিকে আমেনার সাথে থাকতে থাকতে তার জন্য মনে ভালোবাসা জন্ম নিলো চয়নের। মেয়েটির মাঝে আলাদা একটা টান আছে। চয়ন ঠিক করলো তাকে ভালোবাসার কথা জানাবে। হ্যাঁ, একটা বিবাহিতা মেয়ের প্রেমে পড়া অন্যায়। কিন্তু ভালোবাসা তো অন্যায় নয়! এই ভেবে তার রুমের দিকে পা বাড়ালো চয়ন। রাতে ইফতি বাড়িতে ফিরতেই আমেনা তাকে কিছু কথা জানাতে চায় বলল। ইফতি শুনতে চায়লে সে বলল, চয়ন তাকে ভালোবাসে বলেছে। এটা শুনে ক্ষেপে যায় ইফতি। চয়নকে মারতে চায়লে তাকে থামিয়ে আমেনা জানায়, সেও তাকে ভালোবাসে। চয়নই তার স্বপ্নের পুরুষ। ইফতি তার ভুল।
ইফতি রেগেমেগে শ্বশুরবাড়িতে এসব জানালো। আমেনার বাবা আসলেন। একমাত্র মেয়ের ইচ্ছের বিরুদ্ধে তিনি কথা বললেন না। ইফতির কাছে ক্ষমা চেয়ে কারখানা ও বাড়িটি তার নামে লিখে দিলেন। আমেনা ডিভোর্স দিয়ে দিলো ইফতিকে। চয়নকে নিয়ে বাবার বাড়িতে উঠল আমেনা। ঝামেলা কাটার পর চয়নের বাসায় ডাকলো ইফতি। তার হাতে লাখ খানেক টাকা ধরিয়ে দিয়ে বলল- আমেনা নামক আপদটাকে আমার জীবন থেকে সরানোর জন্য ধন্যবাদ বন্ধু। এবার আমি নিশ্চিন্তে তানিয়া কে বিয়ে করতে পারব। তাকে ডিভোর্স না দিলে তানিয়া আমাকে বিয়েই করছিল না। চয়ন হেসে বলল- এসবের জন্য যদি কারখানা আর বাড়ি হারাতে হত তোর?
-প্রশ্নই আসেনা! আমেনার বাবাকে আমি চিনি। তিনি ক্ষতিপূরণ হিসেবে এসব আমাকে দিতই। ভুল তার মেয়েই করেছে তোর প্রেমে পড়ে৷ একটা কারখানা লিখে দিলে কি হবে? তার তো আরো আছে! তাছাড়া এসব হারালেও সমস্যা নেই। তানিয়াও কোটিপতির বাবার মেয়ে! বরং আমেনার বাবার থেকেও বেশি ধনসম্পদ আছে তাদের। যাক এবার তুই যা খুশি করতে পারিস। টাকা গুলো নিয়ে চলে যা কোথাও।
-আমি কোথাও যাব না। তাকে আমি সত্যিকারে ভালোবেসে ফেলেছি। আমি তার ছায়া হয়ে থাকতে চাই।
চয়নের কথা শুনে হাসিতে ফেটে পড়লো ইফতি। সেকেন্ড হ্যান্ড বউ নিয়ে সুখে থাকার শুভেচ্ছা জানালো তাকে। চয়ন তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল- এই কাজ টা করে মোটেও আমার আফসোস হচ্ছে না। বরং আমেনা কে পেয়ে আমি ধন্য। তবে বন্ধু ভুলে যাস না, তুইও সেকেন্ড হ্যান্ড। চয়ন চলে যায়। ইফতি মাথা ঘামায় না। ফোন দেয় তানিয়া কে। এভাবে বেশকিছুদিন যাওয়ার পর তানিয়া জানায়, সে বিয়ে করতে পারবে না ইফতি কে। একটা ভালো ছেলে তার জীবনে এসেছে। যে তার বাবার পছন্দের। সে তানিয়ার সবকিছু জানে৷ এবং সে তানিয়াকে বুঝিয়েছে, আজ যে ছেলে অন্য মেয়ের জন্য আমেনাকে ছাড়তে পেরেছে সে অন্যদিন তানিয়াকেও পারবে। ইফতি তাকে জোর করলে হেনস্তা করলো তানিয়া। সব সম্পর্কই চুকিয়ে ফেলেছে।
ইফতি যেন অথৈ জলে পড়ল। ঘরের লক্ষী বউটাকে দূরে সরিয়ে দিলো তানিয়াকে পাওয়ার জন্য৷ টাকা দিয়ে চয়নকে রেখেছিল আমেনার সাথে মিথ্যে সম্পর্কে জড়ানোর জন্য। যাতে করে আমেনার দোষ দেখিয়ে সে ডিভোর্স দিতে পারে। এতসব কিছু করেও তানিয়া কে পেল না। মরীচিকার পেছনে ছুটতে গিয়ে বউ হারালো সে। ভুল! সে যা করেছে সবই ভুল! কান্নায় ভেঙে পড়লো ইফতি। হঠাৎ কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে পেছনে ঘুরে তাকালো সে। চয়নকে দেখে বলল, আমার বউ কে ফিরিয়ে দে। আমি যা করেছি তা ভুল। চয়ন জানালো, তারা বিয়ে করেছে। এটা শুনে ঘরের জিনিসপত্র ভাঙচুর করতে শুরু করলো সে। আচমকা তার হাতটা ধরে ফেললো কেউ। এই স্পর্শ তার অচেনা নয়। আমেনার দিকে তাকিয়ে সে বলল, যা করেছে সে করেছে। এসব সবই তার প্লান ছিল। তাকে থামিয়ে আমেনা বলল, আমি সবটা জানি।
-মানে?
চয়ন বলল- সেদিন আমি আমেনার রুমে যাই তাকে ভালোবাসার কথা জানাতে। তোদের খাটের পাশেই যে ছোট্ট টেবিলটা আছে, ওখানে তোদের ছবির ফ্রেম আছে। যেটা বাতাসে পড়ে ভেঙে যায়। দেখলাম আমেনা খুব ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ফ্রেমটা ভেঙেছে বলে তার চোখে পানি চলে আসে। অশ্রুসিক্ত নয়নে আমার দিকে তাকিয়ে বলে, ফ্রেমটা যেন খুব দ্রুত ঠিক করে আনি। আমি তখনি বুঝতে পারি, এই মেয়েটি তোকে অনেক ভালোবাসে৷ তাই আমি তার সাথে অভিনয় করতে পারলাম না। তুই আমাকে টাকা দিয়ে এখানে কেনো এনেছিস সব জানিয়ে দিলাম।
আমেনা বলতে শুরু করলো- হ্যাঁ আমি চাইলেই সব জেনে তোমাকে শাস্তি দিতে পারতাম। কিন্তু আমি দেখতে চেয়েছি এসব করে তুমি সুখে থাকো কিনা। তাই তোমাকে তোমার মতো ছেড়ে দিয়ে আমি চলে যাই। তুমি যেমনটা চেয়েছিলে তেমনটাই করি। কিন্তু সবটা অভিনয়। অভিনয় করি চয়ন কে ভালোবাসার। বাবাকেও সব জানাই। আমার কথামতো তিনি তোমাকে কারখানা লিখে দেন। চলে যাই তোমার জীবন থেকে। কিন্তু দেখো, আজ তুমি ভালো নেই।
ইফতি আমেনার পায়ের কাছে বসে বলল, আমি সত্যিই ভালো নেই। আমাকে ক্ষমা করো আমেনা! তোমাকে ফিরে পেতে চাই আমি। ইফতির করুণ অবস্থা দেখে আমেনাও নিচে বসে পড়ল। সে তাকে বুকে টেনে নিয়ে বলল, তোমার কাছেও ফিরে আসতে চাই আমি। তাদের দেখে চয়ন বলে উঠল- তাহলে আবার কাজি ডাকা হোক? বিয়েটা তো সারতে হবে। ইফতি তার পাশে এসে জড়িয়ে ধরে তাকে বলল- তুই আমার সত্যিকারের বন্ধু এটার প্রমাণ দিলি তুই। তোকে ধন্যবাদ জানানোর ভাষা আমার নেই।
আবারো বিয়ে হলো ইফতি ও আমেনার। চয়নকে ইফতি তার কারখানার ম্যানেজার বানিয়ে দেয়। আজ বাড়ি-গাড়ি সব আছে চয়নের। কিন্তু আমেনার স্মৃতি তাকে তাড়া করে বেড়ায়। অভিনয় করতে করতে সে সত্যিই ভালোবেসে ফেলেছিল আমেনাকে। কিন্তু তার ভালোবাসা ছিল নিঃস্বার্থ। ভালোবাসা মানেই কাউকে কাছে পাওয়া নয়। তার সুখেই সুখী হওয়া। চয়নও এখন সুখে আছে আমেনার সুখ দেখে…
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত