ভাবিকে যখন ভাই’য়ে বিয়ে করে বাড়ি নিয়ে আসে, আমি তখন ৭-৮বছরের। বড় ভাইয়ের ছোট ৩টা বোন তারপর আমি। বাড়ির সবার ছোট আমি। আমি সেই দিন দেখেছি লাল বেনারসি শাড়ী পরে ভাবি আমাদের বাড়িতে আসে। পুরো মহল্লার সবাই আসে ভাবিকে দেখতে। ভাইয়া সবার কাছে অনেক ভালো একজন ছেলে ছিলো। যুবক বয়সে কোন খারাপ কাজ করে নাই। মানুষের সব কাজে সাহায্য করার চেষ্টা করতো। তাই সবার কাছে ভাইয়া অনেক প্রিয় ছিলো।
বিয়ে করে যখন ভাইয়া ভাবিকে আনে মা তখন বউ বরন করছে। আমি মায়ের আঁচলের নিচে লুকিয়ে ভাবিকে দেখছি। ভাবিকে নিয়ে ভাইয়ার রুমে বসিয়ে রাখা হলো। সবাই যার যার মতো দেখে যাচ্ছে। সবাই দেখে চলে গেলো। ভাবি একা রুমে। আমার কেমন জানি লজ্জা করছে সেইদিন। আমাকে ধরে নিয়ে গেলো ভাইয়া । ভাইয়া ভাবিকে বলে, “এই হচ্ছে দুষ্ট। আমাদের সবার আদরের ভাই ” ভাবি তখন হেসে আমার হাতটা ধরে কাছে নিয়ে বসালো। আমাকে জড়িয়ে ধরে আদর করছে। আমার নাম জানতে চাইলো । আমার নাম বলি রানা চৌধুরী। ভাবি তখন আদর করে বলে, আমি এই নামে ডাকবো না। আজ থেকে তুমি আমার স্বামী।
এই কথা বলেই হাসতেছে। আমি সেখান থেকে দৌড়ে মায়ের কাছে গেলাম। মা’কে বলি তখন, ” মা, ওই বেডি কয়। আমি নাকি তার স্বামী? ও আমার কি হয়? ” সেখানে থাকা সব বোনরা হাসতে হাসতে শেষ। মা বলে, ” এই কথা বলে না। ও হচ্ছে তোর ভাবি। তোর সাথে দুষ্টুমি করে। ভাবি ডাকবি ” তারপর থেকে ভাবি ডাকতে শুরু করি। আমাদের পরিবারে থাকি ভাইয়া-ভাবি, মা, ছোট আপু আমি। বড় দুজনের বিয়ে হয়ে গেছে তখন। ভাবি আমাকে খুব আদর করতো। ভাবি আসার পর কেনো জানি ভাবির প্রতি অনেক ভালবাসা হয়ে গেলো। আমাকে গোসল করিয়ে দিতো, খাবার খাইয়ে দিতো। মায়ের সব কষ্ট দূর। সারাদিন ভাবি আমাকে নিয়ে ব্যাস্ত থাকতো। ভাইয়া বাজারে কাপড়ের ব্যবসা করে। ওটা আসলে বাবার ছিলো। বাবা মারা যাওয়ার পর ভাইয়া দেখে আর সংসার চালায়।
আমাকে স্কুলে যাওয়ার সময় কাপড় পরিয়ে রেডি করে দিতো। ব্যাগ গুছিয়ে স্কুলের পথ এগিয়ে দিয়ে আসতো ভাবি।
ভাবির বিয়ের বছরখানিক পরই একদিন স্কুল থেকে ভিজে বাসায় ফিরি। আমি আবার বৃষ্টির পানি ছুঁতে পারি না। ভিজলেই জ্বর। বাসায় ফিরে ভালো থাকলেও মাঝ রাতে উঠে জ্বর। মা বড় মামার বাড়ি গেছে সেইদিন। রাতে জ্বর হলে সারারাত ভাবি বসে বসে, আমার কপালে জলপট্টি দেয়। সকালে মা এই খবর শুনে আসে। আমি সকালেই ভালো হয়ে যাই। সারারাত ভাবি ঘুমায়নি। আমার সেবার করে বুকে জড়িয়ে ধরে রেখে ছিলো। যেনো আমার কষ্ট হচ্ছে না। ভাবিই কান্না করার মতো অবস্থা ছিলো।
কয়েকমাস পরই ভাবি মা হবে। বাড়ির সবাই অনেক খুশী। ভাবি আমাকে আদর আরো বেশি করে। দেখতে দেখতে বাচ্চা হওয়ার দিন হাসপাতালে নিয়ে গেলো। ভাবি আমাকে ছাড়া যাচ্ছে না। আমাকেও সাথে করে নিয়ে যায়। বাড়িতে ছোট আপু একা থাকে। মা, ভাইয়া,ভাবি ও আমি যাই। হাসপাতালে অপারেশন থিয়েটারের নেওয়া হলো। ডাক্তার ভাইয়াকে একটা কাগজে সাক্ষর করে। আমি অনেক কান্না করি সেইদিন। ঘন্টাখানিক পর ডাক্তার এসে ভাইয়ার কাছে আর বলে,৷ ” আপনার বাচ্চাকে বাচাতে পারলাম না। আর আপনার স্ত্রী’কে বাঁচাতে চাইলে। তার জরায়ু কেটে ফেলতে হবে। বাচ্চা পেটেই মৃত ছিলো তাই তাকে বের করতে গিয়ে ভুলে জরায়ু কেটে যায়। “
ভাইয়া কান্না করে বলে,”আমার স্ত্রীকে বাঁচান। যেভাবেই হউক” ডাক্তার ভাবির কাছে আবার যায়। বাহিরে মাও ভাইয়া কেঁদেই যাচ্ছে। আমি আগে থেকে কান্না করছি ভাবির জন্য। ভাবির জরায়ু কেটে ফেলতে হয়। আর কোনদিন মা হতে পারবে না। ভাবির জ্ঞান ফিরলেই আগে আমাকে ডাকে। আমি কাছে গেলে টেনে বুকে নেয়। কয়েকদিন পর ভাবিকে বাড়িতে নিয়ে আসে। ভাবি আগের থেকে চুপচাপ হয়ে যায়। আমাকে যদিও আদর করে তবে আগের মতো ভাবিকে আর খুশী দেখিনি। ভাইয়া ভাবিকে অনেক ভালবাসতো। সবসময় সাহস দিতো বাচ্চা না হলে কি হইছে? সবাই খুশী আছি এতেই হয়। বছর ১-২পরই ছোট আপুকে বিয়ে দিয়ে দেয়। সে এইচ এস সি পাশ করলে বিয়ে দেওয়া হয়ে যায়।
বাড়িতে আমরা ৪জনই ছিলাম। আমি তখন ক্লাস সিক্সে পড়ি, মাঝামাঝি বছরের। মা আমাদের ছেড়ে, দুনিয়ার ছেড়ে চলে যান। আমাদের পরিবারের আরো কষ্ট নেমে আসে। ভাবি সবসময়ই আমাকে নিয়ে থাকতো। সন্তানের মতো করে আদর করে বড় করতে থাকে। বাড়িতে আমি আর ভাবিই থাকতাম। কখনো মায়ের অভাবটা বুঝতে দেয়নি। বাজারের পাশেই বাড়ি তাই ভাইয়ারও আসা যাওয়া একটু পর পরই। আমাদের দেখতো। ভাবির আমি, ভাইয়া সবাই মিলেমিশে থাকতে থাকতে কখন আরো ৪টা বছর কেটে গেলো। ভাবি সেই প্রথম আমাদের বাড়িতে আসার মতোই, আদর করে।
আমি এস এস সি পাশ করে গ্রামেই কলেজে ভর্তি হই। ইন্টার পাশ করার পরই ঢাকায় পাঠিয়ে দেয় ভাইয়া। ঢাকা ভার্সিটিতে ভর্তি হই। আমি কখনো চাইনি ভাবির থেকে দূরে থাকি। তাই মাসে একবার হলেও ছুটে যাই ভাবির কাছে। সবসনয়ই ফিরে আসতে মন চাইতো না। সব সময় কান্না করে ফিরতাম। পড়াশোনা শেষ করে কিছুদিন আগে পুলিশের অফিসার হয়েছি। চাকুরীতে যোগ দিয়েছি ৬-৭মাস হবে। ভাবির চুলে এখন পাকা ধরছে। ভালবাসারর কখনো কমতি দেখি নাই। মায়ের মতোই আগলে রেখে বড় করছে। আমার প্রেমিকার কথা ভাবি জানে না। ভয় হয় অনেক যদি বিয়ের পর ভাবিকে অসম্মান করে। সেই ভয়ে বিয়ে করি না। ভাবিকেও বলতে পারি না যদি কষ্ট পায়। আমি কখনো ভাবিকে কষ্ট দিতে পারবো না। তিনি আমার মায়ের সমান।
আমি জানি আমার জন্য ভাবি নিজের জীবনও দিয়ে দেবে। প্রেমিকাকেও বিয়ে করিয়ে দেবে বললে এখনই। ভয় একটাই ভাবি কষ্ট পায় যদি! এই ইদে বাড়ি ফেরা হলো না। দেশে করোনা পরিস্থিতির কারণে মানুষের সেবা করেই যাচ্ছি। ভাবিকে ছাড়া এটাই প্রথম ইদ। আমার ভাবিকে যেনো সারাজীবনই হাসি খুশী রাখতে পারি। কখনো যেনো মনে না হয় তার সন্তান নাই। আমিই যে তার সন্তান। আশায় আছি কবে ভাবির আঁচলের নিচে লুকাবো। আর আদর করে খাওয়াবে।বাড়ি ফিরবো দেশের করোনা ভালো হলে।
গল্পের বিষয়:
গল্প