– নাম কি?
– হোসাইন।
– কি কেস এর আসামি?
– মা আর মেয়ে’কে হত্যা।
– তোরে দেইখা তো ভদ্র পোলা মনে হয়। আসলেই তুই খুন করছোস? নাকি কেউ ফাসায় দিছে?
– আমিই করছি।
– হেহ, আমারে বলদ পাইছোস?
তুই আর খুন? জীবনে মশা মারছোস কিনা সন্দেহো। এই আমারে দেখ এক রাইতে পাঁচ জনরে জবাই দিছি। আমার লগে দুই জন আছিলো, বেঈমানি করবার চাইছিলো। পরে ওগোরেও মাইরা দিছি। হোসাইন কোন উত্তর না দিয়ে চুপচাপ বসে রইলো। মানু ভাই এতে রেগে গেলেন । যাবৎ জীবন সাজা প্রাপ্ত মানু ভাই। জেলের ভিতর বেশ নাম তার, সবাই ভয় পায়। এক সময় নাম করা ডাকাত ছিলেন। সেই তাকে কিনা একটা হাটু বয়সি ছেলে পাত্তা দিচ্ছে না। মানু ভাই রেগে গিয়ে বললেন,
– তোর সাহস তো কম না। মানু ভাই এর কথার জবাব দেস না! জানোস? এই সেল এর সবাই আমারে ভয় পায়।
– ওরা বোকা, তাই ভয় পায়। আমি পাই না।
[ মানু ভাই আশ্চর্য হলেন ]
– আমারে তোর একটুও ভয় লাগে না?
– ভয় পাওয়ার কি কোন কারন আছে?
– নাই! আমি সাতটা খুন এর আসামি। এই গুলা ছাড়া কত প্রমান ছাড়া খুন করছি হিসাব নাই । নাম করা ডাকাইত আছিলাম। আমারে ভয় পাইবো না তো কারে পাইবো শুনি?
– আপনার বয়স কত?
– জানি না। ৪০ হইতে পারে।
– যুদ্ধ দেখছেন?
– না, তয় আম্মাহ কইছিলো আমি তহন হাফুর(হামাগরি) দেই।
– ৫০ বলবেন।
– হ তো?
– আমার ছাব্বিশ চলে, আপনার শরীর আর আমার শরীর দেখেন।
আপনিও খুন করছেন আমিও করছি। আপনারে কাবু করতে আমার এক মিনিট লাগবে না। তাহলে বলেন, ভয় পাওয়ার কি কোন কারন আছে? মানু ভাই চিন্তায় পরে গেলেন। আসলেই তো, বয়স তো কম হলো না। আগের মত শরীরে জোড়ও নেই। তাহলে ভয় কেন পাবে? ছেলেটার কথায় মানু ভাই যুক্তি খুঁজে পেলেন।
– এত সুন্দর কথায় যুক্তি দিলি। তুই নিশ্চই কোন শিক্ষিত ঘরের পোলা।
– (চুপ) মানু ভাই, প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট নিয়ে হোসাইন এর পাশে বসলেন।
– সিগারেট খাস?
– কি সিগারেট ওটা?
– হলিউড, জেলের ভিতরে এর চাইতে ভালা মাল পাবিনা। এই খানে ধনী গরীব সবাই এক ব্রান্ড টানে।
– দিন একটা
মানু ভাইয়ের থেকে একটা সিগারেট নিয়ে হোসাইন টান দিলো। আনাড়ি’র মত সিগারেট এ টান দেওয়া দেখেই মানু ভাই বুঝে গেলেন ও প্রথম বার টান দিচ্ছে। যদিও কোন কাশি দেয়নি।
– আগে কোনদিন সিগারেট খাইছোস?
– না।
– যাদের খুন করছোস, ওরা তোর কি করছিলো?
– আমার শাশুড়ি আর স্ত্রী, ধোঁকাবাজ ছিলো।
[ মানু ভাই একটু দম নিয়ে বললেন ]
– তোরে দেইখা অবাক লাগে। জীবনে মেলা আসামি দেখলাম। তোর মত দেখিনাই। তা তোর খুনের কাহিনী ক’তো একটু হুনি।
অনার্স ফাইনাল ইয়ার এ ছিলাম। বাবা একটা সরকারি অফিসের গাড়ি চালক, আর মা গৃহিণী ছিলেন। আমি অষ্টম শ্রেনীতে থাকা কালিন বোনের বিয়ে হয়ে যায়। বাবা-মা আমি, তিন জনে সুখের সংসার। ছোট থেকেই লেখাপড়ায় ভালো ছিলাম। ইচ্ছে ছিলো সেনাবাহিনী অথবা নৌ অফিসার হবো। প্রেম, ভালোবাসা সম্পর্কে তেমন কোন আগ্রহ ছিলোনা। কিন্তু আমাদের নিচ তলার নতুন ভাড়াটিয়া মেয়েটিকে দেখলেই কেমন একটা লাগতো। মেয়েটার চেহারায় এক অদ্ভুত মায়া ছিলো, যা বলার মত না।
ওর সব থেকে যে জিনিসটা আমায় বেশি আকর্ষণ করতো “ওর মায়াবী চোখ” দু’তলা বিশিষ্ট বাসার নিচ তলাতে ওরা, আর উপর তলায় আমরা ছিলাম। ছাদে উঠলেই ওর সাথে চোখাচোখি হতো সবসময়। ওহ! মেয়েটির নাম ছিলো ‘তানিয়া’। মাকে নিয়ে আমাদের বাসায় ভাড়া আসে, ওর বাবা ছিলোনা এক্সিডেন্ট নাকি মারা গেছেন। এক বিকেলে ছাদে বসে বই পড়তে ছিলাম, তখন তানিয়া এসে আমায় ভালোবাসার কথা জানায়। যেহেতু আমিও ওকে পছন্দ করতাম তাই না করতে পারিনি। তারপর থেকে আমাদের চোখে চোখে কথা বলার পরিমান বেড়ে যায়। প্রতিদিন বিকেলে ছাদে বসে দুজনের আড্ডা, সুযোগ পেলে এদিক সেদিক ঘুরাঘুরি, বেশ চলছিলো। একদিন ওর মা আমায় ডেকে পাঠান ওদের বাসায়। আমিও যাই। আন্টি আমার হাত ধরে বলেন।
– বাবা… আমরা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের লোক। তোমার আর তানিয়া’র সম্পর্ক আমি জানি। কিন্তু তোমার বাবা-মা এগুলো কখনই মেনে নিবে না।
– আপনি ভুল ভাবছেন আন্টি। আমার বাবা-মা কখনই এমন করবে না।
– বাবারে, কোন বাবা-মা’ই তার ছেলেকে যার তার সাথে বিয়ে দিবে না।
– আপনি যার তার বলতে কি বুঝাচ্ছেন? আমি তানিয়াকে পছন্দ করি। আর আমার পছন্দকে মা-বাবা কখনও ফেলে দিবে না।
– বলাতো যায় না। পরে তুমি ভালো চাকরি পেলে যদি আমার মেয়েকে ভুলে যাও?
– কখনই না।
– তাহলে তোমরা দুজনে কোর্ট ম্যারেজ করে নেও।
– কি বলছেন এগুলা?
– দেখলে? তুমি ওরে পছন্দ করলে না করতে না।
আমি একটু সময় নিতে চাইছিলাম। কিন্তু আন্টি আমায় কোন সময় দিতে রাজি ছিলেন না। ওনার এক কথা হয় তানিয়া’কে বিয়ে করো নাহয় একেবারে ভুলে যাও। আমি ভেবে দেখলাম, “আপাদত নাহয় কোর্ট ম্যারেজ করে নেই। পরে চাকরি পেলে বাবা মাকে সব বলবো। অনার্স শেষ হতেও বেশি দিন ছিলোনা” আন্টি আমার আর তানিয়ার কোর্ট ম্যারেজ করিয়ে দিলেন। শাক্ষীও উনিই ঠিক করে দিয়েছিলেন। এরপর আর আমাদের প্রেমে কোন বাধা ছিলো না। বেশ ভালোভাবেই সব চলছিলো। একদিন তানিয়া জানায় ওর গ্রামে নাকি কে মারা গেছেন সেখানে যেতে হবে। অথচ আমি সেদিনই জেনেছিলাম গ্রামে ওদের কেউ আছে তবুও কিছু বলার ছিলোনা। আন্টি আর তানিয়া চলে গেলো।
একদিন, দুইদিন করে দশ দিনেও ওর সাথে যোগাযোগ করতে পারিনি। ফোন বন্ধ দুজনের । কি করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আরো কিছুদিন পরের কথা, বাবা সেদিন বাড়িতেই ছিলেন। কয়েকজন পুলিশ এসে আমার খোঁজ জানতে চাইলেন। পুলিশের ঝামেলা থেকে আমি বরাবরই দুরত্ব বজায় রেখে চলতাম। সেই আমাকে পুলিশ খুঁজছে শুনে অবাক হয়েছিলাম খুব। পরে ঘটনা শারমর্ম শুনে আমার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গিয়েছিলো। তানিয়া আমার বিরুদ্ধে কেস করছে “আমি নাকি বিয়ে করে তানিয়াকে স্ত্রীর মর্যাদা দিচ্ছিনা” আমার কাছে কোন জবাব ছিলো না। মা-বাবা আমায় ঘটনা সত্য কিনা জিজ্ঞেস করলো, তানিয়ার সাথে আমার বিয়ে সত্য তাই আমি কি বলবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। তানিয়া এখন আমার থেকে মুক্তি চায়, কাবিননামার টাকা পেয়ে গেলে ও আমার নামের কেস উঠিয়ে নিবে। সব থেকে অবাক করার বিষয় কাবিননামা দশ লক্ষ টাকা, অথচ বিয়ের দিন দুই লক্ষ লেখা ছিলো। আমাদের সম্পত্তি বলতে বাড়িটাই ছিলো। বাবা সরকারি চাকরি করতো ঠিকই কিন্তু ঐ অবস্থায় অত টাকা দেয়ার মত সমর্থন ছিলো না। দুই দিনের ভিতরে এলাকায় জানাজানি হয়ে যায় সব। আমার সম্মান বাঁচাতে বাবা বাড়িটা বিক্রি করে দিয়ে তানিয়ার সাথে আমার বিচ্ছেদ টা করিয়ে দিলেন।
বাকি টাকা দিয়ে দুলাভাই একটা দুই রুমের বাড়ি কিনে দেয়। কিন্তু সেই বাড়িতে আর আমার বাবাকে তুলতে পারিনি, কারন তার আগেই বাবা মারা গেলেন। ছেলের সম্মান বাঁচাতে নিজের সম্মান হারিয়েছেন যে তাই । আমার জীবনে কষ্ট নেমে আসে। সবার চোখে আমি অপরাধী হয়ে যাই, কেউ মুখে না বললেও বাবার মৃত্যুর জন্য সবাই আমাকে দায়ী ভাবতে থাকে। বাবার মৃত্যুটা মা নিতে পারেনি, কিছুদিন পরে আমায় একা করে মা’ও চলে যায় না ফেরার দেশে।
আমার বাবা-মায়ের মৃত্যুর জন্য তানিয়া আর ওর মাকে আমি দায়ী মনে করতে লাগলাম। আমার সাথে এমন করার কারন খুঁজতে গিয়ে জানতে পারি আমি ওর ৪র্থ স্বামী। এর আগে আমার মত আরো তিন ছেলেকে ঠকিয়েছে। আর ওর বাবাও বেঁচে আছেন। মা মেয়ের অপকর্ম সাপোর্ট করেনা বলে এক সাথে থাকেনা।
সেদিন ঠিক করেছিলাম ওদের বেঁচে থাকার অধিকার নেই। ওরা খুনি, আমার মত চার টা ছেলের ভালোবাসাকে খুন করেছে। ওরা নারী জাতির কলঙ্ক, ওদের জন্য অন্য মেয়েদের সম্মান নষ্ট হচ্ছে সমাজে । ওদের জন্য আমার বাবা-মাকে হারাতে হয়েছে। তাই প্লান করে ওদের মা মেয়েকে আমি খুন করে দেই। নিরব দর্শকের মত এতক্ষণ মানু ভাই সবটা শুনতেছিলেন। কি বলবেন তিনি বুঝে উঠতে পারছেন না। জীবনে কত মানুষের জীবন তিনি নষ্ট করেছেন তার ঠিক নেই। হোসাইন এর কাহিনী শুনে আজ যেন তার অনুতাপ হচ্ছে। হোসাইন এর সাথে কথা বলার মত অবস্থায় তিনি আর নেই। তাই এখান থেকে চলে যেতে চাইলেন। তখন, হোসাইন বললো,
– ভাই আরেকটা সিগারেট হবে?
মানু ভাই সম্পুর্ন প্যাকেট হোসাইনকে দিয়ে হাঁটা দিলেন অন্য দিকে। মনে মনে ভাবতে লাগলেন “আপনজনদের দেয়া কষ্টের কারনেই কিছু মানুষ হিংস্র থেকে আরো হিংস্রতায় রূপ নেয় । সেদিন নিজের ভাই আর স্ত্রীকে আপত্তিকর অবস্থায় না দেখলে আজ আমি দশ বছর ধরে সাত খুনের আসামি হয়ে থাকতাম না”
গল্পের বিষয়:
গল্প