ছোটলোকি

ছোটলোকি
বাংলাদেশি ধনীদের মধ্যে আভিজাত্য ব্যাপারটা এখনও ঠিক সেভাবে জেঁকে বসতে পারেনি বলে আমার ধারণা।
১৯৭০ সালের আগ পর্যন্ত সমগ্র পাকিস্তানে ২২টি কোটিপতি বণিক পরিবারের কথা জানা যায়। তাদের মধ্যে দুটি পরিবার ছিল পূর্ব পাকিস্তানে তথা বাংলাদেশে। এদের সবাই ‘বাইশ পরিবার’ নামেই চিনত। ২২ টির মধ্যে একটিমাত্র পরিবার ছিল বাঙালি। যদিও পরিসংখ্যানের হিসাবে, বাংলাদেশে এখনকার ধনীরা সেই ২২ পরিবারকেও ছাড়িয়ে গেছেন। এখন কয়েকশ ধনী পরিবারের বসবাস এদেশে। সংখ্যাটা ২২০০ না ২২০০০ হবে সেটা বিচার্য বিষয়। গত কদিনে আমরা দেখলাম, দেশের ধনী মানুষগুলো প্লেন ভাড়া করে দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে। তাদের গন্তব্য থাইল্যান্ড, ইংল্যান্ড এসব দেশ। কেন আমি বলেছি যে, এদেশের ধনীরা ততটা ক্ল্যাসি না? কারণ আজ পর্যন্ত কাউকে নিজস্ব জেটপ্লেন নিয়ে পালাতে শুনি নাই।
গতবছরে জলবায়ু নিয়ে একটি সম্মেলনের আয়োজন করে টেকজায়ান্ট ‘গুগল’৷ সেই আয়োজনে অংশ নেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রসিডেন্ট বারাক ওবামা, ইংল্যান্ডের রাজপুত্র হ্যারি, হলিউডের লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও’র মতো তারকারা৷ তাদের মতো ১১৪ জন অতিথি ইটালির ভের্দুরা রিসোর্টে হাজির হয়েছিলেন ব্যক্তিগত উড়োজাহাজে চেপে৷
যদিও একদিকে বিশ্ব বাঁচানোর আহবান আর অন্যদিকে কার্বন পুড়িয়ে ব্যক্তিগত উড়োজাহাজে ভ্রমণ, বিষয়টিকে এক ধরনের ‘ভণ্ডামি’ হিসেবে দেখেছিলেন অনেক পরিবেশবাদী৷ কিন্তু এইসব নাদান পরিবেশবাদীরা জানে না, এইজাতীয় লোকদের একটা ক্লাস মেইনটেইন করে চলতে হয়। অপরাহ উইনফ্রে, টম ক্রুজ, জিম ক্যারি থেকে শুরু করে পাশের দেশের প্রিয়াঙ্কা চোপড়া, ঐশ্বর্য রাইদেরও আছে প্রাইভেট জেটপ্লেন। কিন্তু বাংলাদেশি ধনীদের দেশ ছেড়ে পালাতে চার্টার প্লেন ভাড়া করতে হয়! কি লজ্জা!
দেশের ভেতরে ডমেস্টিক ফ্লাইটের ইকোনমি ক্লাসের সরু করিডোর দিয়ে হেঁটে আপনার জন্য বরাদ্দ ছোট চাপা সিটটাতে পৌঁছে মনে হয়না যে, এইধরনের সিটে বসে ভ্রমণ কিভাবে আরামদায়ক হয়? অথচ দেশি ধনকুবেররা এই সিটের থেকে একটু বড়মাপের সিটেই ভ্রমণ করেন। তা-ও সবাই না। মাঝখানে পর্দা দিয়ে আলাদা করে দিলেই তারা ভাবেন, তেনারা ব্রাহ্মণ হয়ে গেছেন। এয়ারলাইন্সওয়ালারা এদের কিভাবে বেকুব বানায়! নিজস্ব প্লেন থাকাটা বিদেশে খুব কমন একটা ব্যাপার। আমাদের দেশের ধনীরা হেলিকপ্টার কেনে, তা-ও শুধু বিদেশী কাস্টমারদের ফ্যাক্টরি প্রেমিজে নিয়ে যাবার জন্যে। সেগুলো আবার এভিয়েশন কোম্পানিগুলোতে ভাড়াও খাটে৷ এয়ারপোর্টে হ্যাঙ্গারে একটা প্রাইভেট জেট দাঁড়িয়ে আছে, এটা ভাবতেও তো ভালো লাগে, তাই না? গায়ের রোম খাড়া হয়ে যায়। ফরেনাররা আসলে গর্বভরে দেখানো যাইতো, ঐ দ্যাখ ব্যাটা, আমাদের দেশি বিল গেটসের প্লেন ওইটা৷
ধনী বলতে এদেশে যাদের বুঝানো হয়, তারা মূলত ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট, শিল্প কারখানার মালিক। কিন্তু তাদের আষ্টেপৃষ্ঠে পেঁচানো আছে ব্যাংক থেকে নেয়া হাজার কোটি টাকা ঋণ। ‘পরের ধনে পোদ্দারি’- যাকে বলে। তারা নাকি নিজেদের কোম্পানি থেকে স্যালারি নেন। হাইস্যকর! তাদের আবার এইধরনের মহামারীর সময়ে সরকারের থেকে প্রণোদনা নেয়া লাগে, নইলে তারা কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দিতেই পারেন না। কি ছিঁড়তে এরা ইন্ডাস্ট্রি দিয়েছিল তাইলে? বাইরে যারা ধনী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত, তাদের ব্যাংক লোনের ইতিহাস নেই বললেই চলে। ঋণখেলাপি হওয়া তো দূর কি বাত!
বিদেশী ধনকুবেররা প্রায়ই দেখবেন নিজেদের সম্পদের একটা অংশ দান করে দিচ্ছেন। এখন পর্যন্ত শুনেছেন বাংলাদেশের কাউকে নিজের সম্পদ দান করে দিতে? তারা খুব বড়জোর গ্রামে মসজিদ মাদ্রাসার জন্য জমি দান করেন, যেই জমির দখল রাখা বাস্তবে কঠিন হয়ে যায় গ্রামবাসীদের অসহযোগিতায়। সেই কোন আমলে একজন হাজীসাহেব ছিলেন, যাকে দানবীর উপাধি দেয়া হয়েছিল। কোলকাতার অদূরের হুগলি নিবাসি, মুহম্মদ মহসিন। দানশীলতার জন্য খ্যাতি পেলেও তার সম্পত্তির বেশিরভাগ ছিল বোন মন্নুজানের কাছে থেকে পাওয়া। ইতিহাস তাই বলে।
নিজের অর্জিত সম্পদ দানে বাংলাদেশিদের চরম অনীহা। কষ্টের কামানো টাকা কাউকে দিতে গেলে নিজের কেমন
লাগে, বুঝেন তো! যেমন বাংলাদেশি কারও এখন পর্যন্ত প্রাইভেট আইল্যান্ড আছে কি না আমার জানা নেই। অথচ বিদেশে এটা না থাকা একটা প্রেস্টিজ ইস্যু। হলিউড তারকা জনি ডেপের ৪৫ একর আয়তনের একটি দ্বীপ রয়েছে। কই আমাদের সেন্ট মার্টিন কেউ কিনতে পারল না কেন? জাস্ট জোকিং, ওটা বিক্রির জন্য নয়। ব্যক্তিগত দ্বীপ রয়েছে ডিক্যাপ্রিও, মেল গিবসন, স্পিলবার্গ, জন লেনন এদেরও। কিছুদিন আগে খবরে এসেছিল ফুটবলার রোনালদো ভাইরাসের আক্রমণ ঠেকাতে নিজের দ্বীপে স্বেচ্ছা নির্বাসনে গিয়েছিলেন। শাহরুখ খানও দুবাইতে একটা দ্বীপের মালিক।
অথচ আমাদের দেশে কি হয়? চর দখল, ভূমিদস্যুতা এসব। জোর করে অন্যের জমি দখল করে প্লট, এপার্টমেন্ট বিক্রি করে তারা। কি ধরনের ছ্যাঁচড়ামো স্বভাব, চিন্তা করেন! এরা কিনবে আইল্যান্ড? আমেরিকার ইতিহাসের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়—১৮৭০ থেকে ১৯১৪ সালের পুঁজিবাদী বিকাশে ‘রবার ব্যারন’দের (Robber Baron) ভূমিকার সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-উত্তর রাঘববোয়াল পুঁজি লুটেরাদের অবিশ্বাস্য ধনসম্পদ আহরণের পদ্ধতির বিস্ময়কর মিল রয়েছে। আমেরিকায় ‘রবার ব্যারন’ বলা হতো শুধু সেই সব ব্যবসায়ী–শিল্পপতিকে, যাঁরা ‘সফল’ হয়েছিলেন অনৈতিক পন্থায়। সৎপন্থায় সফলতা অর্জনকারী ব্যবসায়ী–শিল্পপতিদের এই অভিধা দেওয়া হয়নি। জন ডি রকফেলার, কর্নেলিয়াস ভ্যান্ডারবিল্ট, অ্যান্ড্রু কার্নেগি, অ্যান্ড্রু মেলন, জন জ্যাকব অ্যাস্টর, জে কুক, জেমস বুখানান ডিউক, জে পি মর্গান, হেনরি মরিসন ফ্ল্যাগলার প্রমুখ ছিলেন এই ‘রবার ব্যারন’।
তাই বনেদী বড়লোকদের মত পশ ব্যাপারস্যাপার, আভিজাত্য- ভূঁইফোড় বাংলাদেশি ‘রবার ব্যারন’দের মধ্যে আসবেই না কোনওকালে। তাদের আয়ত্ত্বের বাইরে এসব। শিক্ষা-দীক্ষার একটা সংযোগও আছে এর সাথে। কিভাবে আশা করেন, স্বল্পশিক্ষিত কেউ দেশে বিশ্বমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল এগুলো বানাবে? তাদের তো আইডিয়াই নাই এইগুলো কিভাবে কাজে লাগে। এরা জানেনা কিভাবে বড়লোকি করতে হয়! অন্যান্য দেশের অভিজাত ধনীদের তুলনায় বাংলাদেশি ধনী ব্যক্তিদের আচার আচরণে বিস্তর ছোটলোকি এখনও রয়ে গেছে।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত