জান্নাত ক্রয়

জান্নাত ক্রয়
আম্মার বিয়ে।বর এসেছে গাড়ি করে। সাথে বরযাত্রী। আম্মাকে সাজাচ্ছেন খালা আর মামীরা।এই নিয়ে বোধহয় আম্মার চোখে দশবার কাজল মাখিয়ে দিয়েছেন বড় খালা। কিন্তু চোখের জলের কারণে সেই কাজল মুহূর্তে লেপ্টে যাচ্ছে।বড় খালা এর জন্য আম্মাকে একবার ধমকে উঠেছেন পর্যন্ত।’অত বাহানা করস ক্যান?
তাইলে আগেই না করতি বিয়ে করবি না!তোর যে বাচ্চা এক মাইয়া আছে সেই মাইয়ারে নিয়া একলা একলা বাকী জীবন কেমনে কাটাইবি? এই কথা কী আমার বইলা দিতে হয়? তুই তো অবুঝ মাইয়া মানুষ না।সব বুঝস।বুইঝাই বিয়ায় মত দিছস। তাইলে এখন মূর্ছা যাইয়া লাভ কী? শোন বইন, বরপক্ষ বাড়িতে আইসা গেছে। এখন কান্দন থামা। নিশিরে লইয়া তোর চিন্তা করন লাগবো না।মাইয়া তোর ছোট হইলেও চালাক চতুর।তারে নিয়া টেনশন করনের কিছু নাই!’ বড় খালার কথা শুনে আমার ভীষণ আনন্দ হচ্ছে। পাঁচ বছরের এই আমি বুঝে গেছি খালা আমার প্রশংসা করেছেন। আমি তখন বড় মানুষদের মতো আম্মার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে আম্মাকে শাসনের স্বরে বললাম,’এই আম্মা, তুমি কিন্তু একটুও কাঁদবে না।বিয়ে তো আনন্দের বিষয় তুমি তাহলে বোকার মতো কাঁদছো কেন?’
আমি কী ভেবে এই কথা বলেছি কী জানি! ছোটরা কী অত ভেবে চিন্তে কথা বলে? কিন্তু আমার কথাগুলো শোনে আম্মা আমাকে কোলে টেনে নিয়ে হো হো করে কেঁদে উঠেছেন। আম্মার চোখের জল এসে আমার গাল, কাঁধের খানিক অংশ ভিজিয়ে দিয়েছে। আমি আম্মার কান্না মাখা মুখের দিকে তাকিয়ে আছি বোকাদের মতন।তার কান্নার কারণ আমি মোটেও বুঝতে পারছি না। আমার আব্বা মারা গেছেন আরো দু বছর আগে। পুরনো কোনো রোগ ছিল না তার।সকাল বেলা হঠাৎ করে পেটে ব্যথা। আম্মা ভাবলেন, পেটে বোধহয় গ্যাস হয়েছে। ঘরে গ্যাসের অষুধ ছিল। সেই অষুধ এনে খাইয়ে দিয়েছেন আব্বাকে। কিন্তু আব্বা অষুধ খেয়ে আর সুস্থ হলেন না। দুপুর গড়িয়ে বিকেল আসার আগেই তিনি পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন। আমার দাদা- দাদী কেউ বেঁচে নেই।
এমনকি আব্বার আপন কোন ভাইও নেই।একবোন আছে। তিনি থাকেন ইতালির রুমে তার স্বামীর সাথে।দেশে আসেন পাঁচ বছর পর একবার। আত্মীয় স্বজনের প্রতি তার কোন মায়া মমতা নেই।আম্মা কোন আশায় বুক বেঁধে আমাকে নিয়ে তার মরে যাওয়া স্বামীর বাড়িতে পরে থেকে দিন গুণবেন! ওখানে তাকে দেখবেই বা কে! অবশেষে তিনি ফিরে এলেন আমার নানার বাড়িতে। অবশ্য এখানেও নানা- নানী বেঁচে নেই।আছে মামা আর খালারা।খালাদের বিয়ে হয়ে গেছে।মামারাও বিয়ে করেছেন। তাদের সংসার সন্তান নিয়েই তারা ব্যস্ত, আমাদের দেখার সময় কোথায় তাদের? এই জন্য আম্মার জন্য নতুন বিয়ে দেখেছেন তারা। আম্মা প্রথমে বিয়েতে রাজি ছিলেন না। কিন্তু পরে পরিস্থিতি বুঝে তাকে রাজি হতে হয়েছে।
বিয়েতে রাজি হয়েও আম্মার কান্নার কারণ খুব স্পষ্ট। আমার আম্মার নতুন স্বামীর সাথে আমায় নিয়ে কোন কথাবার্তা হয়নি। অর্থাৎ আমি কী আম্মার সাথে থাকবো না মামাদের বাড়িতে থাকবো এই বিষয়ে।মামা আর খালাদের মত হলো আমি মামাদের বাড়িতেই থাকবো। যেহেতু আমি আম্মার নতুন স্বামীর সম্পর্কে কিছুই হয়না তবে তার বাড়িতে যাওয়ার কোন প্রশ্নই আসে না আমার। এই জন্যই আম্মা কাঁদছেন। সন্তানের জন্য তো পৃথিবীতে মার দরদ সবচেয়ে বেশি। তিনি ভাবছেন,আমায় ছাড়া কী করে ওখানে একা একা থাকবেন! কিন্তু আমি এ নিয়ে মোটেও কষ্ট পাচ্ছি না। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে আম্মা আমায় ছেড়ে কোথাও চলে যাচ্ছেন না। তিনি সব সময় আমার সাথে ছায়া হয়ে আছেন। থাকবেনও। একটু পরে আমাকে আম্মার কাছ থেকে সরিয়ে নেয়া হলো।
বরযাত্রীদের অনেকেই কনের কাছে আনাগোনা করে।ওরা এসে যদি আমায় আম্মার কোলে দেখে তখন নানান গুঞ্জন উঠবে এ নিয়ে। তাছাড়া আম্মার নতুন স্বামী দেখলেও বিপদ হবে।এর শোধ হয়তো তিনি তিলে তিলে আম্মার উপর তুলবেন।জগতটা তো এমনই। পৃথিবীর সৎ মা কিংবা সৎ বাবাগুলো হন সৎ সন্তানদের প্রতি খুব অমানবিক আর নিষ্ঠুর। কেন জানি তারা সৎ সন্তানদের দু চোখের বিষ মনে করেন! আমাকে যখন আম্মার কাছ থেকে সরিয়ে নেয়া হলো তখন আমি মোটেও কাঁদলাম না। কিন্তু আম্মা কেঁদেছেন হাউমাউ করে ‌। সেই কান্না আমি অন্য ঘর থেকে শুনেছি। শুনেও চুপ করে থেকেছি। সেদিন অতটা শান্ত আমি কী করে ছিলাম তা একমাত্র আল্লাহই ভালো জানেন। বিয়ের সকল পর্ব সেরে যখন আম্মাকে সঙ্গে নিয়ে চলে যাবেন তার নতুন স্বামী তখন বাড়িতে কী একটা নিয়ে যেন হাঙ্গামা শুরু হলো ! আম্মার নতুন স্বামী মামাদের কাছে দাবী করছেন,তার উপঢৌকন থাকে বুঝিয়ে দিতে।
বাড়ির সবাই ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে গেছে। তারা কেবল একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে কিন্তু কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। এই সময় আম্মার নতুন স্বামী তার মাথার টোপর খুলে এক হাতে ধরে মামা আর খালাদের উদ্দেশ্যে বললেন,’আপনারা হয়তো ভাবছেন আমি অন্য কোথাও বিয়ের ব্যবস্হা করতে না পেরে আপনাদের বোনকে বিয়ে করতে এসেছি! আসলে এটা আপনাদের ভুল ধারণা। কারণ আমি নিজে তরুণ এবং অবিবাহিত। পড়াশোনা আছে।চাকুরিও আছে ভালো। আমি ইচ্ছে করলেই অবিবাহিত সুন্দরী তরুণী কোন মেয়েকে বিয়ে করতে পারতাম। কিন্তু আপনাদের বোনকে বিয়ে করতে এসেছি কেন জানেন ?শুধু এই জন্য যে সে বিধবা এবং তার ঘরে একটা কন্যা সন্তান আছে। আয়েশা (রাঃ) ছাড়া আমাদের নবীজির আর সকল বিবিই ছিলেন বিধবা অথবা কোন কারণে অসহায়। বিধবারাও সমাজের অসহায় মানুষ। তাছাড়া বাপ মরা একটা মেয়েও জগতের সবচেয়ে বড় অসহায়।
এই অসহায় মেয়েটিকে যদি আমি আমার নিজের সন্তান তূল্য করে লালন পালন করে বড় করতে পারি, তাকে সু শিক্ষায় শিক্ষিত করে সৎ পাত্রের হাতে তুলে দিতে পারি তবে এরচেয়ে উত্তম কাজ আর কী হতে পারে? মৃত্যুর পর কোন কারণে যদি আল্লাহ আমার প্রতি রুষ্ট হয়ে জাহান্নামে দিয়ে দিতে চান আমায় তখন আমি বলবো, আল্লাহ, আপনার বন্ধুর প্রিয় দুটো কাজ আমি করেছিলাম। আপনার বন্ধুর প্রথম স্ত্রী ছিলেন বিধবা। আমার স্ত্রীও বিধবা। আপনার বন্ধুর প্রিয় ছিল কন্যা সন্তান। আমারও কন্যা সন্তান। আপনি কী এরপরও আমায় জাহান্নামে ফেলে দিবেন? আমি নিশ্চিত,আল্লাহ সেদিন আমায় জাহান্নামে ফেলতে পারবেন না। তিনি আমায় মাফ করে দিবেন। কারণ, তিনি তো দয়ার সাগর।
আম্মার নতুন স্বামীর কথাগুলো শোনে বাড়ির সবাই আবেগে আপ্লুত হয়ে গেছে।তারা ভাবতেও পারছে না এখনও পৃথিবীতে এমন মানবিক মানুষ বেঁচে আছে। ছোট খালা দৌড়ে এসে ও ঘর থেকে আমায় কোলে নিয়ে গিয়ে আমার নতুন বাবার কোলে তুলে দিলেন। নতুন বাবা আমায় কোলে তুলে কপালে চুমু খেতে খেতে বললেন,’আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন তুমি। আমার জান্নাত!’ বিছানার উপর কনে সেজে বসে থাকা আম্মা ফের কেঁদে উঠেছেন। তাকে কেউ থামাতে পারছে না। এই কান্না সহজে থামবে না আমি জানি। কারণ,এ কান্না কোন দুঃখের কান্না নয়।এ কান্না কৃতজ্ঞতার কান্না।এ কান্না পরম সুখের কান্না। সুখের কান্নার রং হয় অতি উজ্জ্বল। আম্মার কান্না আমি সহজেই চিনতে পারি!
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত