লকডাউনে সবচেয়ে বড় যে সমস্যাটা হয়েছে সেটা হলো আব্বাহুজুর বাসায় আটকা পড়েছেন। গত দু’মাস যাবদ তিনি আমার মতোই বেকার। আপনি বাসার বড় ছেলে, পেশায় বেকার, তার ওপর অলস। এতকিছুর পরেও বাবার সাথে আপনার দা-কুমড়া সম্পর্ক যদি না হয় ভাই আপনি আর আপনার বাবা মানুষ নন। আপনারা ফেরেশতা। আমি আর আমার আব্বাহুজুর আমরা দুজনের একজন ও ফেরেশতা নই। আমাদের সম্পর্ক টম এন্ড জেরির মতো। আমি যদি বলি, ‘এক আর এক দুই হয়, তিনি বলবেন এগারো।’ আমি যদি বলি ‘মুরগি আগে, তিনি বলবেন ডিম আগে। আমি যদি একমত হয়ে বলি আচ্ছা ডিম আগে, তিনি বলবেন নাহ্ মুরগিই মনে হয় আগে।’ আমি যদি বলি, ‘সানি লিওনির গান দেখব, তিনি বলবেন ডিসকোভারি দেখব। আমি যদি বলি ডিসকোভারি দেখব, তিনি নিশ্চই বলবেন সানি লিওনি মেয়েটা কে? দেখি তো। চ্যানাল চেঞ্জ কর।’
তিনি বাসায় থাকায় সবচেয়ে বড় যে সমস্যাটা হয়েছে সেটা হলো আমি শান্তিতে সিগারেট খেতে পারছি না। সিগারেট খাওয়ার জন্য আমার অপেক্ষা করতে হয় কখন তিনি বাসা থেকে বের হবেন। গতকাল রাতে বাসার পেছনের দেয়ালে হেলান দিয়ে সিগারেট টানছি। হুট করে আব্বাহুজুরের ঘরের দরজা খোলার শব্দ। তাড়াহুড়ায় সিগারেট ফেলে আমি দেয়ালের ওপাশে লাফ দিয়েছিলাম। লাফ দেয়ার পরে মনে হলো আরে শালা আমি কেন এপাশে লাফিয়ে আসলাম? সিগারেটটা এপাশে ফেলে দিলেই তো হতো। এই বৈশাখে ঝড় কম হয়নি। বাসার বড় গাছগুলোর ডাল কাটার জন্য গাছে উঠেছি। আব্বাহুজুর সেখানেও এসে উপস্থিত। নিচ থেকে বলছেন এভাবে কাট ওভাবে কাট। এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে গাছ থেকে নেমে এসে চাপাতি আব্বাহুজুরের হাতে দিয়ে বললাম, ‘নেন আপনি কাটেন। গাছে উঠতে পারবেন নাকি তুলে দিব?’
আব্বাহুজুরের আরেক স্বভাব হলো তিনি চুপচাপ বসে থাকতে পারেন না। তাঁর কোনো না কোনো কাজ চাই। সেদিন কী কাজ করার জন্য যেন মইয়ে উঠেছেন। কিছুক্ষণ পরে ধুপ করে কিছু পড়ার শব্দ শুনে ঘর থেকে বের হয়ে দেখি আব্বাহুজুর চিত হয়ে পড়ে আছেন। ছোট মিয়াসহ চ্যাংদোলা করে ঘরে এনে শুইয়ে দিলাম। বললাম, ‘ব্যাথা পেয়েছেন?’ তিনি জানালেন তিনি ঠিক আছেন। ছোট মিয়াসহ বাইরে এসে বসলাম। একটু পরে তিনি এসে ঝাড়ি শুরু করলেন, ‘বাসায় দুটো পাঠা পালছি আমি। তোরা থাকতে আমার কাজ করতে হয় কেন? ব্লা… ব্লা… ব্লা ছোট মিয়া ফিসফিস করে বলল, ‘মালটা পড়ে গিয়ে গাজনি হয়ে গেলে ভালো হতো।’
সকালে দেরি করে ঘুম থেকে উঠলে গালি। দেরি করে গোসল করলে গালি। ভেজা গামছা বিছানায় রাখলে গালি। কানে হেডফোন গুঁজলে গালি। দিনের বেলা ঘুমালে গালি। বিষয়টা এমন যে আব্বাহুজুরের সিস্টেমে সেট হয়ে গেছে বড়টারে দেখে গালি দিতে হবে। বিশ্বাস করেন পড়শু কিচ্ছু করিনি। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় দাঁড়িয়েছি মাত্র। লুঙ্গি নাকি উল্টো করে পড়েছি সেজন্য গালি খেলাম। এতবছর আমি জানতামই না যে লুঙ্গির ওপর আর নিচের দিক আলাদা। আমিতো যে কোনো একপাশ দিয়ে মাথা ঢুকিয়ে গিট্টু বেঁধে পড়েছি এতদিন।
এই লকডাউনে আমার প্রেম না হবার আরেকটা কারণ তিনি। সারাদিন বাসায় ঘুরঘুর করেন। ফোনে কল আসলেই ভ্রু কুঁচকে তাকান। ফোন রাখলেই জিজ্ঞাসা করেন কে কল করেছিল। আরে ভাই থুক্কু আব্বা আপনি কী আমার বন্ধুদের সবাইকে চিনেন। তাঁর খবরের কাগজ পড়ার ইচ্ছা তখনি হয় যখন আমি খবরের কাগজ হাতে নেই। এখন অবশ্য যখন তখন খবরের কাগজ হাতে নেই। তিনি বুঝে গেছেন তাঁর সাথে মজা নেয়ার জন্যই এখন আমি যখন তখন খবরের কাগজ হাতে নিচ্ছি। দু’দিন ধরে অবশ্য তিনি খবরের কাগজের প্রতি তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছেন না।
আমার যে দোষ একেবারে নেই তা না। সেদিন ছেঁড়া জুতায় আঠা লাগিয়ে চেয়ার মুছে দেইনি। কিন্তু আব্বাহুজুরের উচিত ছিল বসার আগে দেখে নেয়া যে চেয়ারে কিছু আছে কী না। তিনি কিন্তু নিজের অসতর্কতার কারণে চেয়ারের সাথে আটকে গিয়েছিলেন। যাই হোক এতদিন যারা জিজ্ঞাসা করছিলেন লকডাউন কেমন কাটছে পোস্টটি তাদের উদ্দেশ্যে।।
গল্পের বিষয়:
গল্প