বয়সটা তখন আমার বুঝে ওঠতে পারার সময়। দুনিয়ার এত কিছু বুঝতে না পারলেও কিছু কিছু সময় বুঝতে পেরে ছিলাম খুব করে। তখন ঈদের সময় শীতকাল থাকতো। রমজান মাসে সেহরীর সময় ভুল করে জেগে গেলে আম্মা আমাকে আদর করে ডেকে দু’নলা ভাত খাইয়ে দিতো।
ঘুম ঘুম চোখে যখন ঘর থেকে বের হতাম হাত-মুখ ধুয়ার জন্য তখন দেখতাম চারদিকে হিরিক করে ঘন কুয়াশা বয়তে। তীক্ষ্ণ করে একটা শীত অনুভব হতো। ঘা ছমছম করে ওঠতো খানিকটা সময়। তখন বুঝতে ছিলাম শীতের সময় রমজান মাস আসে। রমজান মাস শেষ হতেই আসে ঈদ। বাড়ির হাঁস-মুরগির হৈচৈ এর ফলে ঘুম ভেঙ্গে গেল। দু’চোখ কচলিয়ে বাহিরে এসে দেখি ঘন কুয়াশা আর হালকা করে শীত। আম্মারে দেখলাম পিঠা বানানোর জন্য রান্না ঘরে খুব করে ব্যস্ত। বাড়ির আর কটি ছেলে-মেয়ের মাঝে মিশে গেলাম। আম্মা খোঁজ করে শার্টের কলার ধরে টেনে নিয়ে এসে গরম পানি দিয়ে গোসল করিয়ে দিলো। কাঁপা কাঁপা শরীর নিয়ে ঘরে আসতেই বড় আপু ঘামছা নিয়ে মুছে দিলো। আলমারীর তাক থেকে নতুন জামা বের করে আপু পরিয়ে দিলো। কত কান্না করে আব্বার কাছ থেকে সুন্দর কাপড় পেলাম।
মাথায় এক কুষ সরিষার তেল দিয়ে চিরুনি দিয়ে আচড়িয়ে ডান পাশে ফিতা তুলে দিলো। আলমারীর কোনো একটা তাক হতে তিব্বত ঘামাছি পাউডার নামের একটি টিনের বোতল বের করলো। ঐটা থেকে সাদা সাদা পাউডার বের বরে হাত-মুখে মন ভরে লাগিয়ে দিলো আপু। আম্মা এসে চালের গুড়ির পিঠা নারিকেলের সেমাই দিয়ে খাইয়ে দিলো। খাওয়া শেষে পানি খেয়ে নিলাম পেঠ ভরে। শেষ সময় আম্মার শাড়ীর আঁচল দিয়ে মুখটা মুছে দিলো। জুড় গলায় বললাম, ‘আম্মা, আস্তে মর দিতারো না’ আম্মা চলে যায় আম্মার কাজে।
বাজার থেকে আব্বা এসে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মুখে এক রাশ হাসি নিয়ে আদর মাখায় গলায় বলল, ‘আমার আব্বাডা কয়’ আমি আব্বার গলা শুনে দৌঁড়ে তাঁর কুলে যাই। বুক পকেট হতে আব্বা গুনে গুনে ২ টাকার দোয়েল নোট ৫টা দিয়ে দিলো। আমি মহা খুশি। এত টাকা আব্বা দিলো। কি করব এত টাকা দিয়ে? বাড়ির উঠোনে এসে আর কয়টা ছেলে-মেয়েকে হাতে দু’টাকার নোট গুলো নাচিয়ে নাচিয়ে দেখালাম। তারা অবাক চোখে আমার টাকা গুলোর পানে তাকিয়ে রইলো। আব্বার বাম হাতের আঙ্গুল ধরে হাঁটা ধরলাম ঈদগাহতে। আমাদের ঈদগাহটা গ্রামের পূর্ব পাশে অবস্থিত। ৫-৬ মিনিট লেগে যায় যেতে যেতে।
ঐ তো দেখা যায় সারি সারি মানুষের বসার দৃশ্য। মাথার ওপরে বাতাসে পাল গুলো ধাপে ধাপে উড়ছে। কোনো একটা গাছের ভিতর হতে মাইকের আওয়াজ শুনা যাচ্ছে। ইমাম সাহেব কি বলছেন সেটা বোধহয় আমি বুঝি না। আব্বা ঈদগাহে প্রবেশ করে বাড়ির আর কটা বড় ছেলে-মেয়ের সাথে আমাকে দিয়ে দিলো। আমাদের ঈদগাহটা একটি পুকুর ঘেষেই। পুকুরের দক্ষিণ পাশে ঈদগাহ আর পুকুরের পূর্ব পাশে স্কুল। সেই স্কুলের ভিতরেই ঈদের দিন মেলা বসে থাকে। সবার সাথে স্কুলের ভিতরে ঢুকলাম। বাচ্চা-কাচ্চাদে র যেন মেলা বসেছে এখানে। একটা বড় ধরণের হৈ হুল্লোর পড়ে আছে। আর ঐদিকে মাইকের আওয়াজ। সব মিলিয়ে যেন পুরোপুরি ভাবে ঈদের আমেজ বয়ছে। আমার নাকে-মুখে আনন্দের ছাপ। ভিতরে ভিতরে বয়তে শুুরু করলো অজানা এক সুখের আভাস।
এক এক করে সবাই নানা কিছু কিনছে। কেউবা মজা খাচ্ছে। কেউবা খেলনা কিনছে। আমার তখন সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। আমার তো মন পড়ে আছে সেই টিনের পিস্তলের দিকে। বড় ভাইয়ের হাতে একটা টিনের পিস্তল দেখেছিলাম। পিস্তলের পিছন ভাগে লাল রকম দেখতে বারুদ নামক একটা পদার্থ রেখে দিয়ে পিস্তলটা চালাতেই ঠাসস করে একটা শব্দ হয় আর আগুন দেখতে দেখা যায়। সেই টিনের পিস্তল কিনব আজকে আমি। দোকানী কে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কিও এ্যা ফিস্তলডা কত টেহা?’ দোকানী আমার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে বলল, ‘একদাম ৫ টেহা’ আমি বললাম, ‘৪ টেহা দিবাইন?’ দোকানী আমাকে আরো একটাবার নজর দিয়ে দেখে নিলো। ফিক করে এক আকাশ হেসে দিয়ে বলল, ‘দে টেহা দে’ আমি গুনে গুনে পকেট হতে ২টাকার ২টি নোট বের করে দোকানীকে দিলাম। টিনের পিস্তল আর ছোট একটা গোল বক্স দিলো। এটাতে বারুদ থাকে।
টিনের পিস্তল আর বারুদ কিনে পেন্টের পকেটে রেখে দিলাম। দু’টাকা দিয়ে লাল কালার পান্তা আইসক্রিম খেলাম। পকেটে হাত দিয়ে দেখি আরো ২টা ২ টাকার নোট আছে। ‘আরো ২ টাকার ২টা নোট আছে?’ আমি চোখ বড় বড় করে মনে মনে বললাম। কি করব আর। ভাবতে ভাবতে দেখি আমার চোখের সামনে ফুটকা। ২টাকা দিয়ে ২টা কিনে নিলাম। আরো বাকি ২টাকা। কিছু না ভেবে বাকি ২টাকা পকেটেই রেখে দিলাম। মনের সুখে বাড়িতে আসলাম। ঈদ থেকে বাড়িতে আসলাম। চোখে-মুখে আনন্দের ছাপ। টিনের পিস্তল আর বারুদ দিয়ে ঠাসস ঠাসস করে গুলি ছুড়ে মারতে লাগলাম।
বাড়ির আর অন্য ৪-৫ টা ছেলে-মেয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি তখন নিজেকে অনেক বড় মনে করতে লাগলাম। মনে হয় আমিই যেন একমাত্র সুখি। আমিই যেন আজ বহু খুশি। আমার এই আনন্দ দেখে বাকি ছেলে-মেয়েরা। আমি পরপর এক এক করে টিনের পিস্তলে বারুদ ঢুকিয়ে ঠাসস ঠাসস করে মারতে লাগলাম। সুখের দেশে হারিয়ে যেতে লাগলাম। সেই সুখ, সেই আনন্দ, সেই সময় আমরা এখন প্রত্যেকটা মানুষ প্রতিনিয়ত খুঁজতে থাকি। খুঁজতে থাকি হারানো সেই দিন গুলি, হারানো সেই ছোট বেলাকে। আমরা এখন খুব এবং খুব করে ফিরে পেতে চাই সেই ছোট বেলাকে।
গল্পের বিষয়:
গল্প