যারা ভালোবেসেছিল

যারা ভালোবেসেছিল
অর্থকষ্টে লাঞ্চিত এক ভাই নিজের গলায় বৈদ্যুতিক তার প্যাঁচিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল। মৃত্যু তাকে গ্রহণ করে নি। গলায় তার প্যাচিয়ে যেই মুহূর্তে সুইচে চাপ দিল, ঠিক তখনই বিদ্যুৎ চলে গেল। আলী ভাই জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে গেল। জ্ঞান হারানোর আগে “ও মা গো” বলে বিকট কণ্ঠে একখানা চিৎকার দিয়েছিল। তার এই চিৎকার পাড়া প্রতিবেশী অনেকের কানে গিয়েছিল। ওরা দলবেঁধে ছুটে এসে মাথায় পানি-টানি ঢেলে আলী ভাইকে সুস্থ করে তুলে। সেই সব আজ থেকে দশ বছর আগের কথা। বিগত দশ বছরে পৃথিবীতে অনেক বিস্ময়কর ঘটনা ঘটেছে নিশ্চয়ই। তবে আমাদের তল্লাটে সবচেয়ে বিস্ময় ও আশ্চর্যের ঘটনা হচ্ছে, অর্থকষ্টে মরতে বসা আলী হোসেনের নাটকীয় উত্থান ও রাজকীয় অর্থ-সম্মান। আলী ভাই এখন প্রায় নগদ অর্ধকোটি টাকার মালিক।
নগদ টাকার বাইরেও সে হাওরে জমি করেছে, বাজারে ভিটা কিনেছে, বিভিন্নসব জলমহালে অর্থলগ্নি করেছে।
আর এতকিছু সত্ত্বেও আলী ভাই এখনো বিয়ে করছে না, বাড়িতে ঘর তুলছে না, আগের মতোই মলিন ও সস্তাদরের জামাকাপড় পরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন লোকে বলে, আলীর মাথায় দোষে ধরেছে। টাকার দোষ। এইবার গ্রামে আসার পর আলী ভাইয়ের বিত্তবৈভবের গল্প শুনে চমকে গিয়েছি। আলী ভাইয়ের সাথে দেখা করার জন্যে একদিন তার বাড়িতে গেলাম। উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললাম, “তুমি তো রাজা হয়ে গেছ আলী ভাই। এইবার একটা বিয়ে কর। বহুদিন বিয়া খাই না।” আলী ভাই আমার এই উচ্ছ্বাসে পাত্তা দিল না। অল্প একটু হাসার চেষ্টা করে শান্ত গলায় বলল, “হ্যা, তা বিয়ে একটা করা দরকার। কিন্তু ইচ্ছে হয় না।” অবাক কণ্ঠে জানতে চাইলাম,”ইচ্ছে হয় না কেন?” আলী ভাই ইতস্তত করে। উত্তর দেয় না। আমি বিয়ের প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে উনার ঘরদুয়ার দেখি। উঠানের বাগান, বাগানে ওপাশে বাঁধা দুধেল গাভীগুলো আর বাড়ির সামনের দিঘিটা দেখি।
“আলী ভাই..”
“হু।”
“বাড়িতে ঘর উঠাও না কেন? কোটি টাকার সম্পদ করেছে অথচ এখনো সেই মান্দাতার আমলের একটা ধ্বজভঙ্গ টিনের ঘরে বাস করছ।”
“হ্যা, ঘর একটা উঠানো দরকার। কিন্তু ইচ্ছে হয় না।”
“বিয়ে করতে ইচ্ছে হয় না, ঘর উঠাতেও ইচ্ছে হয় না, ঘটনা কি বল তো ভাই? গ্রামের লোক তোমার সম্পর্কে নানান কথা বলে।”
“কি বলে?”
“বলে, টাকার ধান্ধায় ছুটতে ছুটতে তোমার নাকি মাথায় দোষে ধরেছে।” আলী ভাই হেসে ফেলল,”হ্যা, এইগুলা ওরা দুষ্টামি করে বলে।”
“আমার কাছে কিন্তু দুষ্টামি মনে হয় না!” আলী ভাই সায় দিয়ে মাথা নাড়ে,”তাও ঠিক। যা রটে তার কিছুটা হলেও বটে!”
“লোকে বলে, তুমি নাকি রাত-বিরাতে শ্মশানে আর গোরস্তানে বেড়াতে যাও।”
“হ্যা, যাই মাঝেমধ্যে।”
“অমাবস্যার রাতে নগ্ন হয়ে নদীতে স্নান কর?”
“তাও করি মাঝেমধ্যে
“কেন কর?”
“এই, এমনিতেই…”
“তুমি মিয়া আসলেই পাগল একটা!”
“পাগল মানে জানিস?”
“যারা উল্টাপাল্টা কথা বলে, আর উল্টাপাল্টা কাজ করে!”
“আমি কখনো উল্টাপাল্টা কাজ করি?”
“তোমার প্রতিটা কাজই উল্টাপাল্টা।” আলী ভাই হাসে। প্রশ্রয়ের হাসি।
“আলী ভাই..”
“হু।”
“তুমি মরতে মরতে বেঁচে গিয়ে ভালো একটা ম্যাজিক দেখিয়েছ। মাত্র দশ বছরে কোটিপতি। গ্রামে বসে এত টাকা কেমনে বানাইলা?”
“টাকা বানানো খুব সহজ। চাইলেই বানানো যায়।”
“এইটা তুমি ঠিক বল নাই। টাকা সবাই বানাতে চায়। কিন্তু কই, পারে না তো!”
“যারা পারে না তারা বোকা অথবা অলস। টাকা বানানোর কিছু ফর্মূলা আছে। গণিতের সূত্রের মতো সূত্র আছে। এইসব সূত্র ও ফর্মূলা ধরে এগিয়ে যেতে হয়।”
“আমাকে কিছু শেখাও ভাই। আমার অনেক বড়লোক হবার শখ।”
শেষের বাক্যটায় অল্প হলেও অনাস্থা কিংবা দুষ্টামির ছায়া ছিল। আলী ভাইয়ের মুখ কালো হয়ে গেল। “আচ্ছা বস, চায়ের কথা বলে আসি…” বলে আচমকা উঠে দাঁড়াল সে। আমি করুণ গলায় বললাম,”স্যরি ভাই। দুষ্টামি করছিলাম। তবে তোমাকে নিয়ে আমি প্রায়ই ভাবি।”
“তুই লেখক মানুষ। ভাবাভাবি তোর পেশা।”
“তাও ঠিক। তোমাকে নিয়ে একটা গল্প লিখতে চাই। যদি অনুমতি দাও।”
“কী লিখবি?”
“এই যে টাকার অভাবে সুইসাইড করতে বসছিলা, আর এখন তুমি বস্তা বস্তা টাকার মালিক। বেঁচে থাকলে সব হয়। বেঁচে থাকা জরুরি। তোমার জীবনের উদাহরণ দিয়ে জাতিকে মোটিভশন দিব।”
“মোটিভেশন দিয়া হাতিকে আকাশে উড়ানো যায়?”
“না, তবে যেইসব হাতি আমার মতো গাধামি করে শুয়ে-বসে দিন কাটাচ্ছে তাদের একটু জাগিয়ে দেওয়া যায়। লাইফে একটু গতির সঞ্চার হয়।”
“তাইলে একটা দামী কথা কই শোন।”
“জ্বি ভাই, বলেন।”
“কথাটা খুব গোপন, এখনো বলি নি কাউকে…”
“আচ্ছা!”
“লোকে বলে টাকার অভাবে সুইসাইড করতে চেয়েছিলাম আমি, এইটা একটা ভুল কথা। দারিদ্র্য ছিল। কিন্তু শুধু দারিদ্র্যের কারণে কেউ মরে না। প্রয়োজন হয় না…”
“আচ্ছা!”
“একটা মেয়ের সাথে আমার রিলেশন ছিল। বিয়ে করার কথা ছিল আমাদের…”
“তারপর?”
“মেয়েটা খুব রূপবতী ছিল। ওর বাবা মা ছিল চামার টাইপ। ক্লাস নাইনে পড়ার সময়ে ওর বাবা-মা কুয়েত ফেরত একটা লোকের কাছে মেয়েটাকে বিক্রি করে দেয়…”
“বিক্রি মানে কি ভাই? বিয়ে দিয়ে দেয়?”
“ধুর বাল, বিয়ে নয়, বিক্রি। কুয়েত ফেরত একটা মধ্যবয়সী শুয়ার আমার ভালোবাসার মেয়েটাকে নগদ পনের লাখ টাকা দিয়ে মেয়েটাকে কিনে নিয়ে যায়।”
“ধুর, এইটা তুমি কি বল। এও সম্ভব?”
“হ্যা সম্ভব। আমি নিজেও এখন একটা মেয়ে খুজে বেড়াচ্ছি… টাকা পনের লাখের জায়গায় পঁচিশ লাখ দিব… কিন্তু একটা মেয়ে, অবিকল সুমির মতো একটা মেয়ে চাই আমার… পাখির মতো চঞ্চল ও মিষ্টি একটা মেয়ে, পাচ্ছি না…”
“সুমি কে? আপনার সেই প্রেমিকা?”
“হ্যা।”
“সে এখন কোথাও আছে?”
“সে নাই। বিয়ের দেড় বছরের মাথায় সন্তান দিতে গিয়ে মরে গেছে।”
“আহা রে!”
আলী ভাই হাসে। বোকাটে হাসি। আমার হঠাৎ ধাক্কা লাগে। শ্মশানে ঘুরে বেড়ানোর কথাটা মাথায় উঁকি দিয়ে যায়। দ্বিধান্বিত কণ্ঠে জানতে চাই,”মেয়েটা কি অন্য ধর্মের?”
“না, না। মুসলমান।”
“যা হবার তা হয়ে গেছে। এইবার নিজেকে একটু গুছিয়ে নাও।”
“তুই কখনো প্রেম করেছিস?”
“না।”
“নিজের প্রেমিকারে মধ্যবয়সী কোন খাটাশের হাত ধরে চলে যেতে দেখেছিস?”
“না।”
“দোয়া করি যেনো কখনো দেখতে না হয়। আমি দেখেছি, এই কষ্ট শুধু আমি জানি…”
“এইজন্যই উল্টাপাল্টা কাজ কর? নিজেকে ভুলিয়ে রাখার জন্যে?”
“নাহ, ঠিক তাও নয়। সুমির বিয়ের পর, রাত হলেই একটা বিচ্ছিরি দৃশ্য এসে আমার মাথায় ঘাই দিতো। সুমি নগ্ন হচ্ছে, ওর বুকে অন্য একটা পুরুষের হাত। অন্য একটা পুরুষ ওকে বিছনায় ফেলে… সুমি আনন্দে কিংবা যন্ত্রণায় শীৎকার করছে… আমার খুব যন্ত্রণা হতো, এইজন্যেই মরতে চেয়েছিলাম কিন্তু পারলাম না আলী ভাইয়ের এই গল্প আমি জানতাম না। কেউ কখনো বলে নি আমাকে। ওর কথা শুনে মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠে।
আলী ভাই বলল,”বছর তিনেক আগে উজানধল গিয়েছিলাম। খালার বাড়ি। খালা আমার জন্যে একটা মেয়ে পছন্দ করল। প্রথমে রাজি হই নি। এরপর শুনলাম, মেয়েটা নাইনে পড়ে। সুমির কথা মনে হল। রাজি হয়ে গেলাম। মনে হলো যেনো সুমিকেই ফিরে পাচ্ছি “তারপর?” “বিয়ের কথা পাকা হয়ে গেল। একদিন সন্ধ্যায় খালার বাড়ি থেকে একটু দূরে বাজারের দিকে ঘুরতে গেছি। হঠাৎ তিনটা ছেলে আসল। কলেজ পড়ুয়া অল্প বয়সী ছেলে। আমাকে তিনদিন থেকে ঘেরাও দিয়ে ধরল। সামনে দাঁড়ানো ছেলেটা আমার কলার চেপে ধরে বাঘের মতো হুংকার দিয়ে বলল, শালা বুইড়া খাটাস… বুড়া বয়সে বালিকা বিয়ের শখ হইছে…”
“ওরা কারা?”
“ওখানকার ছেলে সব। ওদের একজন বোধহয় মেয়েটার প্রেমিক। যার সাথে আমার বিয়ে ঠিক হইছিল।”
“তারপর? তুমি কি করলা?”
“আমি কিছু করি নাই। ওরা হুমকি দিল, যদি আমি পারুল বিয়ে করি, খুন করে ফেলবে আমাকে…”
“ওহ মাই গড!”
“প্রথমে খুব রাগ হল। গরীব ঘরের মেয়ে পারুল। ওর বাবামা খুব করে চাইছিল, আমার সাথে বিয়েটা হোক। কিন্তু আমি, পারলাম না। ইচ্ছে হল না।”
“এইটা একটা ভালো কাজ করেছ। অন্য কোন মেয়ে দেখো। পারুল ছাড়াও তো জগতে মেয়ে আছে। আর তোমার বয়স এখন প্রায় পয়ত্রিশ। নাইনে কিংবা কলেজে পড়ুয়া মেয়ে তোমার সাথে যায় না “আমার সাথে এখন আর কোন মেয়েই যায় না। গত বর্ষায় একটা মেয়ের সাথে বিয়ের কথা চলছিল। মেয়েটা কলেজে পড়ে। বিয়ের কথা পাকা হবার আগেই আমি ওর নাম্বার নিলাম। কথা বললাম… জানতে চাইলাম, তোমার কোন রিলেশন আছে? সে বলল, হ্যা আছে… আমি আর কথা বাড়ালাম না। ছেড়ে দিলাম “তোমার দেখি কপালই খারাপ। দুনিয়াতে হাজার হাজার সিঙ্গেল মেয়ে থাকতে তুমি খালি ভেজাল জায়গায় হাত বাড়াও!” আলী ভাই আবারও হাসে। শুষ্ক মুখে বিষাদের হাসি। আমার দিকে তাকিয়ে জানতে চায়,
“প্রেমটেম আছে তো?”
“হ্যা।”
“তাত্তাড়ি বিয়ে করে ফেল।
নিজের প্রেমিকারে বিয়া করা এখন ইবাদতের শামিল। নিজের প্রেমিকা ছাড়া অন্য যেকোন মেয়েকে বিয়ে করা পাপ!” আলী ভাইয়ের এই কথাটা আমাকে ধাক্কা দিল। প্রেমের মানুষ পাগল হয়। সেই পাগলামি কোনো যুক্তিতেই মিলে না। আবেগ দিয়ে মেলাতে হয়। নরম গলায় বললাম,”সুমি আপুকে এখনো তুমি ভুলতে পার নাই, তাই না?” আলী ভাই তাকিয়ে থাকে। ইতস্তত কণ্ঠে বলে,”স্যরি, শুরুতেই তোকে একটা মিথ্যে বলেছি।”
“কি মিথ্যে?”
“সুমি মারা যায় নি। বেঁচে আছে। স্বামীর ঘরেই আছে। বাচ্চাকাচ্চা হয় নি এখনো।”
“কথা হয় তোমার সাথে?”
আলী ভাই বিষাদের দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে। কাতর কণ্ঠে বলে,”ওর স্বামীটা একটা চামার। কিছু হলেই গায়ে হাত তুলে। কুত্তীর মতো ধর্ষণ করে। ভালোবাসে না একফোঁটা।” আমি আবারও জানতে চাইলাম,”তোমার সাথে কথা হয় এখনো?”
আলী ভাই ক্লান্ত কণ্ঠে বলে, “না, কিন্তু আমি বুঝতে পারি। আমার থেকে সে শতমাইল দূরে আছে, তবুও… এইটা খুব অদ্ভুত, তুই হয়তো বিশ্বাস করবি না। সুমি এখনো মনে মনে আমাকে খুজে। কান্না করে আমার জন্যে। আমি ঘুমের ভেতরেও ওর ডাক শুনতে পাই ওর চোখের জল ওর গোঙিয়ে কান্না আমি শুনতে পাই। আমার খুব মরে যেতে ইচ্ছে হয় আলী ভাইয়ের চোখের পাতা ভিজে আসে। বাগানের ওপাশে বোবা গরুগুলির দিকে চুপচাপ তাকিয়ে থাকি আমি। আল্লাহ আমাদের মুখ দিয়েছেন সত্য, কিন্তু বুকের ভেতর এতবেশি কষ্ট দিয়েছেন কিছু কিছু কষ্ট এতবেশি গাঢ়, মুখে বলে কিছুতেই ব্যক্ত করা যায় না “আলী ভাই একটা কবিতা শুনবা?” “হ্যা বল শুনি!” আল মাহমুদের সমুদ্র নিষাদ থেকে পাঠ করলাম আমি “স্বপ্নের মতো মেয়েটিকে বলি শোনো, ঢেউয়ে ভেসে গিয়ে নামবো অথৈ তলে কেন মিছেমিছি তটের বালুকা গোণো নেমে এসো সাথে মানিক কুড়াব জলে।
মেয়ে গো, হৃদয়ে সাগরের সুরজাল জীবন কেটেছে কত তাইপুন ঝড়ে জলদস্যুরা করবে যে গালাগাল জন্ম নিয়েছি জলদস্যুর ঘরে!” আলী ভাই মুগ্ধ হবার ভান করে হাসার চেষ্টা করেও কেঁদে ফেলে। হাতের উল্টোপিঠে দুচোখের জল মুছে আবারও হাসিমুখে বলে, “আহা, কী সুন্দর… শেষের লাইনগুলো বল, আরও একবার বল শুনি”মেয়ে গো, হৃদয়ে আমাদের সাগরের সুরজাল জীবন কেটেছে কত তাইপুন ঝড়ে জলদস্যুরা করবে যে গালাগাল, জন্ম নিয়েছি জলদস্যুর ঘরে”
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত