‘দিহান আমি প্রেগন্যান্ট, আমাদের এখন উচিৎ দুই পরিবারকে বিষয়টা জানানো।’ ‘কি বলছো তুমি এসব! প্রেগন্যান্ট মানে? দেখো ইলোরা তুমি খুব ভালো করে জানো আমার পক্ষে এই মুহুর্তে কাউকে বলা সম্ভব নয়।’
‘দিহান তুমি এই কথাটা গত দুই বছর ধরে বলে আসছো, আমি মেনে নিয়েছি। কিন্তু এখন আমি মা হতে চলছি আর তাছাড়া বাসা থেকে বিয়ের জন্য খুব চাপ দিচ্ছে। আমি আর সামাল দিতে পারছি না।’ ‘আচ্ছা, ঠিক আছে। আমি দেখছি কি করা যায়।’ কথা শেষ না হতেই দিহান ফোনটা রেখে দিলো। ভেবেছিলাম দিহান হয়তো বাবা হওয়ার খবরে উৎফুল্ল হয়ে উঠবে। ওর আনন্দে আমিও খুশিতে হেসে উঠবো। মা বলেছিলেন একবার, ‘মেয়েদের জীবনে মা হওয়ার খবরটা সবথেকে বেশি আনন্দের। নারীর পরিপূর্ণতা তার মাতৃত্বে।’ কিন্তু আজ আমার কোনোই আনন্দ হচ্ছে না বরং ভয় হচ্ছে, ভয় হচ্ছে আমার ভেতরে আসা জীবনকে নিয়ে। এই মুহুর্তে প্রার্থনা একটাই, সবকিছু ঠিকঠাক থাকুক।
সকালে খাবার টেবিলে খাবার মুখে দিতেই বমি চলে এলো, গতকাল রাতেও এমন হয়েছে। বাড়ির সবাইকে অম্বলের সমস্যা বলে কাটিয়ে গেলেও মনের মধ্যে সঙ্কা থেকেই গেলো আর তারপর বিকেলে জানতে পারলাম সমস্যাটা অম্বলের নয়। খবরটা নিশ্চিত হওয়ার পরে খুশি হবো নাকি মন খারাপ করবো ভেবেই দুশ্চিন্তা বেড়ে গেলো। শিলা বললো এখনই দিহানকে জানাতে। জানালাম, কিন্তু দুশ্চিন্তা কমলো না বরং আরও বাড়লো। এই মুহুর্তে শিলা ছাড়া কেউ আমার পাশে নেই। শিলা মেয়েটা সেই স্কুল জীবন থেকে আমার সবকিছুতে সবসময় পাশে থেকেছে, পরামর্শ দিয়েছে, অনেক সমস্যার সমাধান হিসেবে উপরওয়ালা ওকে আমার জীবনে আশীর্বাদ হিসেবে পাঠিয়েছেন। ওর মত বন্ধু পাওয়া ভাগ্যের বিষয়, এটা মানতেই হবে।
‘হ্যালো, ইলোরা?’
‘হ্যাঁ বলো।’ ‘তুমি এক কাজ করো শিলাকে নিয়ে গাজী মেডিকেলে চলে আসো আমি ওখানেই আসছি।’
‘গাজী মেডিকেলে কেন আসবো?’ ‘ইলোরা এখন আমাদের বাবা-মা হওয়ার সময় নয়। আমাদের সময় দরকার আরও। এসবের জন্য প্রস্তুত নয় আমরা এখন। ভুল করে একটা দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে, এর সমাধান নিশ্চয়ই আছে। গাজী মেডিকেলে এক ডাক্তারের সাথে হাসিব কথা বলেছে, ডাক্তার হাসিবের পরিচিত। গত বছর হাসিব ওর প্রেমিকাকে নিয়ে ওখানেই গিয়েছিলো এই সমস্যার জন্যই, সমাধান হয়ে গেছে। আমাদেরও হয়ে যাবে। তুমি চিন্তা করো না আমি আছিতো, তুমি শিলাকে নিয়ে চলে এসো।’ ‘দিহান তুমি কি বাচ্চা নষ্ট করার কথা বলছো?’ দিহান চুপ থাকে উত্তর দেয় না। খানিক বাদে বলে ওঠে, ‘হ্যাঁ ইলোরা। আর কোনো উপায় নেই আমার কাছে। এখন একমাত্র এটাই সমাধান।’ চোখ ভিজে পানি আসে। সামলে নিয়ে বলি, ‘দিহান আমি কিন্তু তোমার প্রেমিকা নই, আমি তোমার বিয়ে করা বউ।’ ‘আমি জানি ইলোরা।’
‘তাহলে তোমার এত ভয় কিসের সবাইকে জানাতে? হ্যাঁ আমাদের পরিকল্পনা ছিলো যে তুমি চাকুরি না পাওয়া অব্দি বিষয়টা কাউকে আমরা জানাবো না। কিন্তু তখনের কথা ভিন্ন ছিলো, এখন আমরা দুইজন নয় আমাদের মাঝে আরেকজনের বসবাস। এখন জানানোটা খুব দরকার।’ ‘ইলোরা আমার পক্ষে সম্ভব নয়, তুমি যেটা চাচ্ছো।’ ‘তুমিও শুনে রাখো দিহান, আমার পক্ষেও সম্ভব নয় তুমি যেটা করতে চাইছো।’ ‘ইলোরা বোঝার চে….’ ফোনটা রেখে দিয়ে চোখ বেয়ে পড়তে থাকা পানি মুছতে লাগলাম। দিহানের থেকে আমি এটা কখনও প্রত্যাশা করি নি। মানুষ কিভাবে এতটা স্বার্থপর হতে পারে, ভাবতেই বারবার অবাক হচ্ছি আমি।
সান্ত্বনা হিসেবে শিলাই আমার এখন আশ্রয়। বাড়ির লোকজনের থেকে কতদিন এভাবে লুকিয়ে পারবো আমি জানিনা। দিহানকে শিলা অনেকভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। তার একটাই কথা বাচ্চা নষ্ট করা ছাড়া আর কোনোকিছুই তার করার নেই। দিহান যত বাচ্চা নষ্ট করার কথা বলে, আমার ততই ওর প্রতি ঘৃণা বেড়ে যায়।
দিহানের সাথে পরিচয় আমাদের ভার্সিটিতে বর্ষ বরণ অনুষ্ঠানে। আমার তিন ব্যাচ সিনিয়র। তারপর মাঝে মধ্যে ফেসবুকে হাই, হ্যালো’ই একসময় ভালো একটা সম্পর্কে রূপ নেয়। ততদিনে দিহানকে আমি বিশ্বাস করেও ফেলেছি। তারপর একদিন সম্পর্কের নাম দাঁড়ায় ভালোবাসার সম্পর্ক। আমি খুলনার স্থানীয় হলেও দিহান এখানকার না। ওর বাসা রাজশাহী। প্রথম প্রথম ভয় হত। মনে হত, ঠিক হচ্ছে না হয়তো। দিহানের পড়াশোনা শেষ হলে খুলনা ছেড়ে ঠিকই চলে যাবে। আর যদি যোগাযোগ না করে, খুঁজে না পাই।
দিহানই সাহস দিয়ে বলতো, ‘যেখানে মনের নিকটত্ব এতটা বেশি, সেখানে স্থানের দূরত্ব হিসেব করা সময় অপচয়।’
ভালোবাসা গাঢ় হয়। অনেকের মত দিহানের আবদারও বাড়ে। আমি তখন দিহানের ভেতর সম্পূর্ণ ডুবে থাকলেও নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার বিষয়ে খুব সচেতন। দিহানকে বোঝাতে থাকি, দিহান শোনে না। একদিন রাগ করে বলি, ‘যতদিন তুমি প্রেমিক থাকবে আমার মন তোমার। আর যখন থেকে তুমি আমার বর হবে তখন থেকে মনের সাথে শরীরটাও তোমার।’ দিহান জেদ করে বলেই ফেলে, ‘চলো আজই বিয়ে করবো। এখনই করবো।’ আমি কেন যেন তখন না করতে পারিনি, পারিনি নিজেকে শক্ত করে ধরে রাখতে। ওর ওই জেদ মাখা কথার ভেতর আমি ভালোবাসা খুঁজে পেয়েছিলাম। দেখেছিলাম মায়ার টান। ভুল দেখেছিলাম কিনা তখন পরখ করতে আর যাই নি। রাজি হয়ে যাই। বিয়ে হয় আমাদের। দিহানের বন্ধু হাসিবসহ আরও দুইজন ছিলো ওখানে, আর আমার দিকের কেবল শিলাই সবটা জানতো।
তারপর বাড়িতে মাঝে মাঝে শিলার বাসার নাম করে দিহানের বাসায় আমার থাকা শুরু হয়। সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে খুনসুটি, মায়া, মুগ্ধতা মিলিয়ে ভালোবাসাময় সময় কাটে আমাদের। আমাদের বিয়ে হয়েছে মাস দশেক হলো। শিলা আর দিহানের কয়েকজন বন্ধু ছাড়া এখন অব্দি বিষয়টা সবার অগোচরেই রয়ে গেছে। দেখতে দেখতে দিহানের পড়াশোনা শেষ হয়ে গেলো। খুব বেশিদিন নেই ও খুলনাতে আর। এখন একটা চাকুরি হলেই দুই পরিবারে জানানো হবে বিষয়টা, ঠিক এমন সময় অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে আমাদের মাঝে তৃতীয় জনের প্রবেশ। তার জন্যই এখন সব এলোমেলো। তবুও আমি তার পাশে আছি এবং থাকবো।
জেনে বুঝে একটা জীবন খুন করার অপরাধের দায়ভার নিয়ে আমি এ পৃথিবীর আলো বাতাসে ঘুরতে পারবো না। দিহান ইদানীং আমার সাথে ভালোভাবে কথা বলে না, দেখা করতেও চায় না। খুব কম কথা হয় আমাদের। যতটুকু কথা হয় ততটুকুই ঝগড়া হয়। ওর কথা একটাই, ‘বাচ্চাটা নষ্ট করে ফেলো ইলোরা।’ এখন তাই আমিই তেমন কথা বলিনা দিহানের সাথে। আরও কিছুদিন সময় গেলে দিহান আস্তে আস্তে সবটা বুঝে নিয়ে মেনে নিবে আর তখন পরিবারকেও জানাতে ওর দ্বিধা কাজ করবে না, এটাই এখন আমার ধারনা। ‘ইলোরা শুনেছিস দিহান ভাই রাজশাহী চলে গিয়েছে গতকাল রাতে।’
শিলার কথাটা যেন মাথায় আকাশ ভেঙে ফেললো। দিহান চলে গেলো আর একটাবার আমাকে জানিয়ে গেলো না! প্রতিবার যাওয়ার আগে আমার সাথে দেখা করে তারপর রওনা হয়। আর এবার একটা বার জানানোর প্রয়োজন মনে করলো না। কল না করুক, একটা মেসেজ তো দিতে পারতো! শিলার সাথে কথা শেষ না করেই দিহানকে কল করলাম, কিন্তু নাম্বার বন্ধ। অনেকবার কল দিয়েও পেলাম না। হাসিব ভাইয়াকে ফোন করে জানলাম, সবকিছু গুছিয়ে নিয়েই একেবারে চলে গিয়েছে দিহান। আমি জানিনা এটা তারা কেউই জানেনা। যখন বললাম আমি জানিনা সে বেশ অবাক ভঙ্গিতেই বললো, ‘কেনো তোমাকে বলে যায় নি দিহান?’ আমি চুপ করে রইলাম। তারপর জবাবে বললাম, ‘না, বলে যায় নি।’
দিহানের সাথে কোনোভাবে যোগাযোগ না করতে পেরে একসময় বাধ্য হয়ে মা’কে সবটা বলে দেই। বাবা ভীষণ রেগে গেলেও মা তাকে বুঝিয়ে শান্ত করেছেন। শিলা আমাকে নিয়ে রাজশাহীতে ওর এক আত্নীয়ের বাসায় বেড়াতে যায়। মুলত দিহানের খোঁজ পেতেই ওখানে যাওয়া। কিন্তু দুর্ভাগ্য দিহানের খোঁজ মেলেনি কাঙ্ক্ষিত সেই ঠিকানায়। বাড়ির সবাই বাচ্চা নষ্ট করার চাপ দিলেও আমার অমতের কাছে সবাই একসময় চুপ হয়ে যায়। বাবা, ভাই-ভাবি, আপা-দুলাভাই কেউ’ই আমার সঙ্গে ভালো করে কথা বলেন না। মা মাঝে মাঝে আমার দিকে তাকিয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠেন। আমি মাকে সান্ত্বনা দেই, কখনওবা মা আমাকে সান্ত্বনা দেয়।
ভাইয়া ছুটিতে খুলনা ফিরলে সে রাজশাহীতে যেতে চায় দিহানের পরিবারের সাথে দেখা করে বোঝাপড়া করতে। রাজশাহীতে তার পরিচিত লোকের মাধ্যেমেই সে দিহানের পরিবারের খোঁজ বের করে। আমি বারণ করি। যে মানুষ স্বেচ্ছায় দূরে থাকতে চায়, তাকে যত দূরে থাকতে দেওয়া যায় ততই ভালো। দূরের মানুষ দূরে রাখাই শ্রেয়। ভাইয়াকে বুঝিয়ে থামিয়ে দেই। দেখতে দেখতে সময় চলে আসে। পৃথিবীর আলোতে ঝলমলিয়ে ওঠে সদ্য জন্মানো ইয়ানার সৌন্দর্য। সে সৌন্দর্যে সবার মুগ্ধতা বেড়ে যায়। ইয়ানা নামটা আমার দেওয়া। শিলা প্রথম মেয়েটাকে কোলে তুলে ইয়ানা বলে ডাক দেয়। কেঁদে ওঠে ইয়ানা, হেসে ওঠে বাকি সবাই। হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে ফিরলে ভাইয়া আমার হাতে একটা কাগজ দিয়ে বলে, ‘খুলে দেখ।’
কাগজটা খুললাম। দিহানের সাক্ষরিত তালাকনামার কাগজ। চোখ ভিজে এলো। ভাবি আর আপা এসে পাশে বসলো। সান্ত্বনার বুলি আওড়ালো। তারিখটা পরখ করলাম, ইয়ানার জন্ম তারিখের সাথে মিলে গেলো। ইয়ানার মুখের দিকে খানিক চুপ করে তাকিয়ে রইলাম। দীর্ঘশ্বাস ছাড়া আর কিছুই করার নেই আমার। ইয়ানা বড় হতে লাগলো। পড়াশোনা শেষ করে চাকুরিতে যোগদান করলাম। দিহানের খবর নেওয়ার বিন্দুমাত্র চেষ্টাও করিনা। বাবা-মা এবার উঠে পড়ে লেগেছেন আমার বিয়ের জন্য। আমি স্পষ্ট জানিয়ে দিলাম, আমি আর কখনও বিয়ে করবো না। ইয়ানাকে নিয়ে বাকি জীবনটা আমার বেশ কেটে যাবে। বাবা মা জোর করলেও আমার জেদের কাছে একসময় চুপ করে যান।
ইয়ানাকে নিয়েই আমার দিন কাটে এখন। দেখতে দেখতে মেয়েটা বড় হয়ে যাচ্ছে। হাসিব ভাইয়ের সাথে মাঝে দেখা হয়েছিলো। তার থেকেই জানতে পারি, দিহান বিয়ে করেছে। মেয়ে দিহানের পূর্বপরিচিত। বিয়েতে হাসিব ভাইসহ বাকি বন্ধুরাও গিয়েছিলো। কথা বাড়তে থাকে। কথায় কথায় এটাও জানা গেলো দিহানের বিয়ে অনেক বছর আগে থেকেই ঠিক হয়ে ছিলো তার মামাতো বোন জয়ার সাথে। জয়ার সাথে তার কলেজ জীবন থেকে সম্পর্ক। পরে দুই পরিবার মিলে সিদ্ধান্ত নেয় দিহানের পড়াশোনা শেষ হলেই বিয়ে দিবে দু’জনের। আমার মস্তিষ্কে আরেকবার আঘাত লাগলো। তাহলে কি দিহান আমাকে ভালোইবাসেনি কখনও! সবটা শুধু সময়ের প্রয়োজন ছিলো, কখনওই আমি ওর প্রিয়জন ছিলাম না! চোখে পানি টলমল করে ওঠে। হাসিব ভাই ইয়ানাকে কোলে তুলে নিয়ে হেসে বলে ওঠে, ‘একদম দিহানের মত হয়েছে দেখতে। যে কেউ দেখলেই বলতে পারবে এটা দিহানের মেয়ে।’
ইয়ানা দেখতে দিহানের মত হয়েছে এটা শিলাই সেদিন হাসপাতালে প্রথম উচ্চারণ করেছিলো। আমি ইয়ানার মুখের দিকে যতবার তাকাই দিহানকে দেখতে পাই। দিহানের মত চোখ, মুখ, নাক, দিহানের মতই মেয়েটা হাসে। আমি নির্বাক হয়ে তাকিয়ে দেখি। দীর্ঘশ্বাস ক্রমশ বাড়ে। তবুও মেয়েটাই এখন আমার ভালো থাকার একমাত্র কারন। আমার হৃৎস্পন্দন। শুনেছি দিহান ঢাকাতে চাকুরি করে। ওখানেই বউ নিয়ে থাকে। বেশ ভালোই আছে। এদিকে ইয়ানাটাও বেশ বড় হয়ে গিয়েছে। ওর বাবা সম্পর্কে এখন ও সবটাই জানে। বাবার প্রতি ওর বিন্দুমাত্র ভালোবাসা আমি টের পাইনা। বাবার প্রতি ওর আক্ষেপ অনেক। ইয়ানাকে যখন কেউ বলে, ‘তুমি দেখতে একদম তোমার বাবার মত হয়েছো।’ ও জোরালো কন্ঠে তা অস্বীকার করে বলে ওঠে, ‘না, আমি আমার মায়ের মত হয়েছি।’ মেয়েটা আমায় ভীষণ ভালোবাসে।
চোখে চশমা পরা শুরু করেছি। ইয়ানা হেসে বলে, ‘অল্প বয়সে আমার মা’টা বুড়ি হয়ে গেলো।’ আমি হাসি, প্রতিত্তোরে কিছু বলি না। দেখতে দেখতে মেয়েটা কত বড় হয়ে গেলো। বিকেলে বেলকনিতে বসে আছি। ইয়ানা আমার পাশে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরতেই ওর ফোনে রিংটোন বেজে উঠলো। ‘আপনাকে বলেছি তো আমাকে আর কখনও আপনি ফোন করবেন না। দয়া করে আমাকে আর বিরক্ত করবেন না। আপনি কি বোঝেন না আপনার কথায়, কলে, মেসেজে আমি খুব বিরক্ত হই!’ বলেই ইয়ানা ফোনটা রেখে দিলো। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি রে এত ক্ষেপে গেলি কেন? কার ফোনকল ছিলো?’ ও হেসে জবাব দিলো, ‘ছাড়ো তো মা! এক লোক খুব বিরক্ত করে। বাজে লোকের কি আর অভাব আছে।’ আমি কিছু বলতে যাবো এমন সময় ও আমায় শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।
সন্ধ্যায় ওর ফোনটা বেজেই যাচ্ছে। আমি নামাজ শেষ করে ওর রুমে গিয়ে দেখি ইয়ানা রুমে নেই। ফোনটা হাতে তুলতেই দেখি কল হওয়া নাম্বারটা ইংরেজি অক্ষর দিয়ে ‘দিহান খান’ নামে সেইভ করা। বুকের ভেতরটা মোচড় দিলো। ইয়ানার সাথে তাহলে ওর বাবার কথা হয়! অনেক প্রশ্ন এসে জড় হলো মস্তিষ্কের ভেতরটাতে। প্রশ্নগুলো ছটফট করছিলো উত্তরের জন্য। আঙুলের চাপ লেগে ভুল করেই কলটা রিসিভ হয়ে গেলো। কানে তুলতেই ওপাশ থেকে সেই পরিচিত কন্ঠস্বর, ‘ইয়ানা মা, ফোনটা রেখে দিস না দয়া করে। আমি তোর বাবা লাইনটা পুরোপুরি শেষ হওয়ার আগেই ফোনটা রেখে দিলাম। ফোনটা হাতে নিয়ে ভালো করে চেক করতেই দেখি বিকেলের কলটা দিহানের ছিলো। কিছু বুঝে উঠতে না পেরে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম।
হাসিব ভাই সেদিন বাসায় এসেছিলেন। কথায় কথায় দিহানের প্রসঙ্গ তুললেন। এত বছরেও দিহানের সংসারে কেউ আসে নি। ডাক্তার বলেছেন জয়া নাকি কখনও মা হতে পারবে না। দিহানের সংসারে এখন কেবল দীর্ঘশ্বাসে ছেয়ে আছে। তবে কি এই জন্যই দিহান ইয়ানার সাথে যোগাযোগ করে! নাকি মেয়ের টানে ছুটে আসতে চায়! হঠাৎ রুমে ইয়ানা এসে হাজির। আমার হাতে ওর ফোন দেখতেই চুপ করে পাশে এসে দাঁড়ায়। তারপর নরম স্বরে প্রশ্ন করে, ‘দিহান খানের কল ছিলো?’ আমি ওর দিকে তাকিয়ে বলি, ‘নাম ধরে বলতে নেই। উনি তোর বাবা।’ ইয়ানা আক্রোশে ফেটে ওঠে। ‘তুমি যা’ই বলো না কেন আমি তাকে কখনওই বাবা বলবো না।’ আমি চুপ করে থাকি। ইয়ানা আমার হাতটা চেপে ধরে বলে, ‘তোমাকে বলি নি তুমি মন খারাপ করবে তাই। তুমি দুশ্চিন্তা করো আমি চাই না, এই কারনেই জানানো হয় নি। আমি তোমাকে ভালোবাসি মা। তোমায় রেখে কোথায়ও যাওয়ার চিন্তাও করি না।
তোমায় যারা কষ্ট দেয়, কষ্ট দিয়েছে আমি তাদের কখনও ক্ষমা করবো না। আর যে মানুষটি আমাকে উপেক্ষা করেছে, তাকে ক্ষমা করার মত ভুল আমি করবো না।’ ইয়ানার কথায় মস্তিষ্কে জমা সব প্রশ্নের উত্তর মেলে। তবুও সংশয় হয় কখন না বাবার কাছে চলে যায়। রক্তের টান বড় টান। বাবা বলতেন, ‘সব সম্পর্ক উপেক্ষা করা যায়, কেবল রক্তেরটাই বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। উপেক্ষা করা যায় না। একদিন না একদিন ঠিকই সবাই তার রক্তের টানে ফিরে আসে, ফিরে যায়। ভাঙ্গা বন্ধন জোড়া লাগে।’ মনের ভেতর সংশয় এখন একটাই, ‘দিহানও তো উপেক্ষা করে থাকতে পারলো না। ইয়ানা এভাবে কতদিন উপেক্ষা করতে পারবে?
গল্পের বিষয়:
গল্প