এবং প্রবঞ্চিত যুবক

এবং প্রবঞ্চিত যুবক
কানের কাছে মশার ভনভন শব্দে নাহিদ ঘুমাতে পারছে না। অগত্যা উঠে পড়ল সে। দুপুরে ক্লান্ত হয়ে পার্কের একটা বেঞ্চিতে ঘুমানোর জন্য শুয়ে পড়েছিল। মশার অস্থির যন্ত্রণায় তা আর হল না। মশার সাথে আরেক যন্ত্রণাকর জিনিস এই একটা যন্ত্র। যন্ত্রটার ব্যবহার পরিধি বিশাল। গান শোনা, ছবি তোলা, ইন্টারনেটসহ এই যন্ত্রটার নাম মোবাইল। অপরাজিতা তাকে মোবাইলটা দিয়েছে যাতে নাহিদের সাথে যোগাযোগ করতে পারে। এই যন্ত্রটার প্রতি নাহিদের বিশেষ অনীহা আছে। এই যন্ত্রের যন্ত্রণায় মানুষ যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছে। নাহিদ মোবাইলটা বাধ্য হয়ে ব্যবহার করছে। অপরাজিতা তাকে এটা ব্যবহার করার জন্য টাকা পেমেন্ট করে। মোবাইলটা ধরে উলোটপালোট করে দেখতে দেখতেই মোবাইল বেজে উঠল। অপরিচিত নাম্বার থেকে কল এসেছে। এই ফোনে অপির কল ছাড়া অন্য কারও কল আসে না। অপি মানে অপরাজিতার ডাকনাম।
-হ্যালো, কে বলছেন?
-আমি রূপা।
নাহিদ বুঝতে পারছে না কোন রূপা। তার কয়েকটা রুপার সাথে পরিচয় আছে। কিন্তু এই কোকিলকণ্ঠী মেয়েটাকে নিশ্চয় জিজ্ঞেস করা যায় না যে সে কোন রূপা।
-ও আচ্ছা। ভাল আছেন?
-আপনি মনে হয় আমাকে চিনতে পারেন নি।
-না, মানে ইয়ে….
-আচ্ছা, চেনা লাগবে না। রাখছি।
ফোনটা কেটে দিয়েছে। মাথায় সূক্ষ্ম যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। ইদানীং মাথার যন্ত্রণাটা বেশি যন্ত্রণা করছে। নাহিদ উঠে চায়ের দোকানে গেল। চা শেষ না করেই একটা গোল্ড লিফ সিগারেট ধরিয়ে হাটা শুরু করল। বিকেলবেলা ভিড়ের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি করে হাটা আরেক যন্ত্রণা। হাঁটতে হাঁটতে শেরেবাংলা নগর এসে পড়েছে। রাস্তার পাশে একটা জটলা দেখা যাচ্ছে। নাহিদ সেদিকে এগিয়ে গেল। “আশ্চর্য মলম ভাই, যে কাজেতে দিবেন ভাই, সেই কাজেতে লাগে ভাই। ঘাড়ে ব্যথা হলে ভাই, মালিশ দিয়ে দেবেন ভাই।
দেখবেন কোন ব্যথা নাই……” সুরে সুরে মলম বিক্রি করছে একটা লোক। সবাই দর্শকশ্রোতা, কোন ক্রেতা দেখা যাচ্ছে না। বিক্রেতার সাথে ১২ বছর বয়সী একটা ছেলে দেখা যাচ্ছে। ছেলেটার মুখ একজন বিখ্যাত ব্যক্তির সাথে মিল আছে কিন্তু নামটা মনে পড়ছে না। নাহিদ দশ মিনিট ধরে খেয়াল করল যে একটা মলমও বিক্রি হয়নি। নাহিদ ভিড় ঠেলে লোকটাকে বলল, ভাই, আপনাকে কোথায় কোথায় খুঁজেছি আপনি জানেন না। আপনার মলম নিয়ে আমার অনেক উপকার হয়েছে। নাহিদের এই কথার সাথে সাথে ভিড় থেকে অনেকে বলল, আমাকে একটা দেন, আমাকে একটা দেন। দশমিনিটের মধ্যে প্রায় দুশো টাকা বিক্রি হয়ে গেছে। নাহিদ পাশের চায়ের দোকান থেকে চা ও সিগারেট নিল। এখন এখানে থাকা উচিৎ হবে না। একটা গাড়িতে উঠে পড়ল। এ শর্ট জার্নি টু গুলশান বাই বাস। নাহিদ মূলত এসেছে থানায়। থানা হল পাপীদের শুদ্ধ বানানোর যায়গা আবার শুদ্ধ ব্যক্তিদেরকে পাপী বানানোর যায়গা। মুখে মোলায়েম হাসি হেসে সালাম দিয়ে ভিতরে ঢুকল।
-কেমন আছেন, স্যার?
-ভাল, কে আপনি?
অফিসারের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল এক কনস্টেবল। সে ফিসফিস করে বলল, স্যার, একে একরাতে ফার্মগেট পার্কে দেখা গিয়েছিল প্রায় ছয় মাস আগে। নাহিদ হাসছে। কনস্টেবলের ফিসফিসানি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে। আর এই কথার জন্য ফিসফিস করার দরকার নেই।
-কী নাম যেন আপনার?
-নাহিদ
-তা কী মনে করে থানায় এলেন?
-ঘুরতে এসেছি।
-থানাকে কি চিড়িয়াখানা আর আমাদের কি জানোয়ার মনে হয়? নাহিদ বুঝতে পারছে কোন কারণে দারোগা সাহেব রেগে আছেন।
-স্যার, যার জান আছে সেই জানোয়ার। আপনাদের কি জান নেই?
-কনস্টেবল, ওকে সার্চ কর।
-স্যার, সার্চ করা লাগবে না।
আমার কাছে এই ম্যাচ, এই সিগারেট আর একটা যন্ত্রণাদায়ক যন্ত্র আছে, মোবাইল।
কনস্টেবল এগুলো রেখে দিল। আর নাহিদকে থানা হাজতে ঢুকিয়ে দিল। নাহিদের বেশ উত্তেজনাবোধ হচ্ছে। জীবনের প্রথম হাজতবাস। ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ সিনেমার মত গান গাইতে ইচ্ছে করছে, “আমি বন্দি কারাগারে,, আছি গো মা বিপদে বাইরের আলো চোখে পড়ে না।” তবে নাহিদের মনে হচ্ছে সে বিপদে পড়ছে না। দারোগা বসে বসে অদ্ভুত ভঙ্গিতে দাঁত খোঁচাচ্ছেন আর মাঝেমধ্যে নাহিদের দিকে তাকাচ্ছেন। হঠাৎ নাহিদের ফোন বেজে উঠল। দারোগা ভয়ে কেঁপে উঠলেন। এরকম ভয়ঙ্কর রিংটোন হতে পারে তা দারোগার জানা ছিল না। প্রথমবার বেজে গেল। রিসিভ করা হয়নি। দ্বিতীয়বার বাজছে। দারোগা মোবাইলের স্ক্রিনে নাম দেখলেন, অপি।
-হ্যালো, কে বলছেন?
-অপি বলছি। আপনি কে?
-গুলশান থানা থেকে এস আই মনির বলছি।
-নাহিদকে কি থানায় আটকে রেখেছেন?
-হ্যাঁ।
-ওর অপরাধ কী?
-পুলিশের সাথে টালটুবাজি করে। ও জানে না, পুলিশে ছুঁলে কত ঘাঁ। আপনি জানেন, পুলিশে ছুঁলে কত ঘাঁ?
-তা জানি না। তবে নেতারা ছুঁলে কত ঘা এটা জানি। শুনবেন?
-শুনেন, আমাকে নেতার ভয় দেখাবেন না। রাখছি। দারোগা ফোন কেটে দিয়ে নাহিদের কাছে চলে গেল খুব এগ্রেসিভ মুডে। কিন্তু কাছে গিয়ে শান্ত হতে গেল।
-বড় নেতা আপনি? নাহিদ চুপ করে আছে। বুঝতে পারছে না কী হয়েছে।
-চুপ করে আছেন কেন?
-আপনার কথা শুনছি।
-আপনার নেতাগিরি ছুটাচ্ছি। আপনার যে কী অবস্থা হবে…
কথাটা শেষ করার আগেই কনস্টেবল বলল, স্যার আপনার টেলিফোন। দারোগা সাহেব টেলিফোন ধরেই বুক সোজা করে দাঁড়িয়ে গেলেন। ওপাশের কথা শোনা যাচ্ছে না। তবে দারোগার কথা স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে।
-স্যার
-স্যার, স্যার স্যার, স্যার, স্যার, স্যার, স্যার, ইয়েস স্যার। কথা শেষে দারোগার মুখটা আমশুটকি হয়ে গেল। সেন্ট্রিকে বলল, উনাকে বাইরে নিয়ে আসতে।
-সরি ভাই, আমি বুঝতে পারিনি। আপনি আগেই বলতেন যে, আপনি এত বড় মাপের ব্যক্তি।
-কী হয়েছে বলুন তো…
-অপি নামের একটা মেয়ে ফোন করেছিল। তার সাথে একটু খারাপভাবে কথা বললাম তারপর…
-ও আচ্ছা।
-আপনি থানায় এসেছেন কিসের জন্য ভাই?
-চা, নাস্তা খেতে এসেছি। আসলে পকেটে টাকা নেইতো।
দারোগার মনে হচ্ছে যে তার ভয় পাওয়াকে কাজে লাগিয়ে মজা করছে। সরকারী চাকরীর এই সমস্যা, অনেক কিছু সহ্য করতে হয়। চায়ের অর্ডার দিলেন তিনি। চায়ে চুমুক দিয়ে নাহিদ বলল, থানার চা এত সুন্দর হয়, জানতাম নাতো। আমি যদি প্রতিদিন চা খেতে আসি, চা খাওয়াবেন?
-হুম, আসবেন। আমি খুবই দুঃখিত, ভাই। আসলে আমার চাকরী নিয়ে সমস্যা হয়েছে। চাকরী চলে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে আর যদিও না যায় তাহলে পোস্টিং হবে জঙ্গলে। এইজন্য আপনার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছি।
-ঠিক আছে, ভাল থাকবেন। নাহিদ বের হয়ে গেল। অপির ক্ষমতা আছে তা বুঝাই যাচ্ছে। ক্ষমতাবান লোকেরা তাদের ক্ষমতা দেখাতে খুবই পছন্দ করে। তারা চায় সবাই তাদের ক্ষমতাকে ভয় পাক। নাহিদ শেরেবাংলা নগরের দিকে গেল। তার মন বলছে মলম বিক্রেতা এখনো আছে। সবেমাত্র সন্ধ্যা হয়েছে। এত আগে ব্যবসা গুটিয়ে সে ঘরে ফিরবে না। নাহিদ গিয়ে দেখল, এখনো ব্যবসা জমজমাট চলছে। কি মনে করে মলম বিক্রেতা ব্যবসা গুটিয়ে ফেলল। নাহিদের কাছে গিয়ে বলল, ধন্যবাদ ভাই।
-ধন্যবাদ কেন?
-আপনি আমার বেচাকেনা শুরু করে দিয়েছেন। আজ অনেক টাকা লাভ হয়েছে। আপনার জন্যই হয়েছে।
-আপনার বাড়ি কোথায়?
-গোপালগঞ্জ।
-আপনার ছেলে কই? লোকটা গলা উঁচিয়ে তার ছেলেকে ডাকল, এই মন্টু, এদিকে আয়।
-আপনার ছেলের সুন্দর একটা নাম রাখতে পারেন নাই?
-গরীবের আবার সুন্দর নাম? ভাল একটা নাম আছে, ডাকা হয় না। আমি নিজেই মাঝেমাঝে ওর ভাল নামটা ভুলে যায়। মন্টু পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।
-কিরে, তোর ভাল নাম কী?
-নজরুল ইসলাম।
-খুব সুন্দর নাম। এই নামে হল বাংলাদেশের জাতীয় কবির নাম। জানিস?
-জ্বি জানি।
-লেখাপড়া করিস? মন্টুর বাবা বলল, ওর মাথা ভাল। এইবার কিলাস ফাইভে এ পিলাস পাইছে।
-তাহলে লেখাপড়া থামালেন কেন?
-কী করব ভাই? গরীব মানুষ লেখাপড়া কইরা কি হবে?
-মানুষ মানুষই, গরীব মানুষ বলে কিছু নেই। কোথায় থাকবেন?
-কমলাপুর বস্তিতে। আপনারে একটা কথা বলব, রাখবেন?
-রাখব, বলেন।
-আমার সাথে দুইটা ডালভাত খাইবেন। লোকটা তাকে নিয়ে একটা হোটেলে ঢুকল। ডালভাত না, মাছভাত খেতে হয়েছে। খাওয়ার সময় নাহিদ বলল, খুব ভাল রান্না হয়েছে, তাইনা?
-হুম, আরেকপিস মাছ নেন? নাহিদের চোখ ভিজে এল। হোটেলের কোনার টেবিলের মৃদু আলোতেও মন্টুর আর তার বাবার চোখে নাহিদের চোখের জল ধরা পড়ল।
-কী হয়েছে ভাই? কাঁদছেন কেন?
-কাঁদছি না ভাই, ঝাল লেগেছে। তরকারীতে ঝাল বেশি, আমি আবার বেশি ঝাল খেতে পারি না।
খাওয়া তাড়াতাড়ি শেষ করে নাহিদ ব্যস্ততা দেখিয়ে বিদায় নিয়ে চলে গেল। পার্কে এসে সিগারেট ধরিয়ে টানছে। হঠাৎ পিছন থেকে ডাকল, এইযে মিস্টার। কেমন আছেন? নাহিদ চমকে গেল। পরিচিত একটা কণ্ঠ। সেই নিশি ভাবনাটা শেষ করার আগেই পিছন থেকে মেয়েটা সামনে চলে এল। তাকে চিনতে নাহিদের কষ্ট হল না।
-কেমন আছেন, মিস সিলভার, সরি রূপা?
-বাব্বাহ, নামটা মনে রেখেছেন তাহলে?
-আপনি আমাকে ফোন করেছিলেন?
-হ্যাঁ।
-আমার মোবাইল নাম্বার পেলেন কোথায়?
-আমি আপনাকে প্রায় ফলো করি।
-তাই নাকি? কেন?
-এমনি। একদিন দেখলাম একটা দোকানে টাকা রিচার্জ করার জন্য গেছেন, আমি পরে লুকিয়ে আপনার নাম্বারটা নিয়েছি। নাহিদ অবাক হচ্ছে, মেয়েটা কি অনায়াসে সত্যমিথ্যার মিশ্রণ ঘটাচ্ছে। অপি তাকে মোবাইল দেওয়ার পর সে টাকা রিচার্জ করেনি। মাঝেমাঝে অপিই তার ফোনে রিচার্জ করে দেয়।
-তা এতদিন পর হঠাৎ কী মনে করে? এখনো কি আগের মত আছেন নাকি নতুন কিছু করছেন?
-তাতে আপনার কী এসে যায়? বাদাম খাবেন?
বলেই রূপা বাদামের একটা ঠোঙা বের করল। নাহিদ বাদাম নিতে গিয়ে বুঝল বাদাম গরম আছে। রুপা মৃদুস্বরে গান ধরল, নিশিরাত বাঁকা চাঁদ আকাশে, চুপিচুপি বাঁশি বাজে বাতাসে, বাতাসে নিশিরাত বাঁকা চাঁদ আকাশে গানে চাঁদের কথা শুনে নাহিদ লক্ষ্য করল, আকাশে সত্যি বাঁকা চাঁদ উঠেছে। গানের সাথে পটপট করে বাদাম ছিলার শব্দ দারুণ এক সঙ্গীতের সৃষ্টি করেছে। বাদাম শেষ হলেই নাহিদ রূপাকে প্রশ্ন করল, আপনার সাথে আমার শুধু রাতেই দেখা হয় কেন? কিছুক্ষণ চুপ থেকে রূপা বলল, কারণ আমি নিশিকন্যা। নাহিদ নির্বাক হয়ে রইল। কিছুক্ষণ পর রূপা উঠে চলে যাচ্ছে। গান শোনা যাচ্ছে, নিশিরাত বাঁকা চাঁদ আকাশে….
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত