ছেলেটার চোখজোড়া বরাবরই আমাকে বিভ্রান্ত করে।বাড়ি থেকে এক কিলো দূরে জাহিদ মামার টঙদোকানে প্রায় এই অপরিচিত ভদ্রলোকটিকে দেখি। বিভিন্ন রঙের টি-শার্টে নিজেকে আবদ্ধ রাখে।সাথে ম্যাচ করা ট্রাউজার।হাতে ড্রেসের সাথে মিলিয়ে ঘড়ি,কালো রঙের একটি সেলফোন এবং সাথে করে একটি কালো গাড়ি নিয়ে আসে।টঙদোকানে এরকম সম্ভ্রান্ত পরিবারের কেউ আড্ডা দেয় বা বসে চা খায় এটা নিতান্তই চিন্তার বাহিরে।কিন্তু এই ছেলেটা এখানে এসে বন্ধুদের সাথে সময় কাটায়।হাসলে গালের টোলটাও আমার দৃষ্টিসীমা নিখুঁতভাবে আকর্ষণ করে।তবে তাকে দেখার সময়টা আমার দীর্ঘতম কখনোই হয়ে ওঠে না।হাঁটার মধ্যেই যতটুকু দেখা যায়।তাকে আমার ভালোই লাগে।
চোখতুলে কখনোই খেয়াল করে নি যে তার অগোচরে তাকেই রোজ লুকিয়ে একটা মেয়ে দেখে।কেমন অদ্ভুত ব্যাপার, তাইনা ? কোথায় ছেলে আমাকে দেখবে তা নয় উল্টো আমি তাকেই দেখি।মৃদৃ হেসে নিজেই নিজের বোকামোগুলো উপভোগ করছি। কনজারভেটিভ পরিবারের একটি মেয়ে আমি।যথেষ্ট কড়া শাসনেই বড় হয়েছি। যেমন এটা করো না, ওটা করো না,এখানে যেওনা,ওখানে যেওনা,ছেলেদের সাথে কথা বলো না।লোকে বাজে বলবে।বোরখার আড়ালে আমাদের তিন বোনের বেড়ে ওঠা।আমি সবার বড়। অনার্স ফাইনাল ইয়ারে পড়ছি।মেজো বোন ইন্টারে আর ছোট বোন ক্লাস এইটে পড়ছে।বাবা সরকারী চাকরী করতেন,এখন রিটায়ার্ড করেছেন।মা, গৃহিণী। বাবার পেনশনের টাকা দিয়ে আমাদের সংসার চলে।
রোজ ক্লাস শেষে তিনটা টিউশনি করাই।অন্তত নিজের হাত খরচের টাকা হয়ে যায় এবং মায়ের হাতেও কিছু টাকা তুলে দেই।আমার মত মধ্যবর্তী পরিবারের মেয়েদের জন্য এসব ভালোলাগা ভালোবাসাটা নিতান্তই অহেতুক।তার উপর সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলে হলে তো ব্যাপারটা আরও বেশি লোক হাসানো টাইপ। ছেলেটাকে কখনোই বলা হয়নি, তাকে আমি ভীষণরকম ভালবাসি।কেবল তাকে লুকিয়ে দেখার মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিলো সবকিছু। গতকাল বাবা স্ট্রোক করেছেন।হসপিটালে এডমিট। বাবার মাথায় তিন বোনকে নিয়েই চিন্তা। কোনো ভালো পরিবারের ছেলের সাথে বিয়ে দেওয়াটা বাবার প্রধান কর্তব্য বলে তিনি মনে করেন।
মাসখানেক পরই তিনি আমায় বিয়ে দেওয়ার জন্যই ছেলে খুঁজতে লাগলেন।ছেলের খোঁজখবর নিয়ে যদি মনে হয় মানানসই তবেই মেয়ে দেখানোটা আমাদের পরিবারের রেওয়াজ। মাস ছয়েকের মাথায় পাত্র ঠিক হয়ে গেছে।ছেলেপক্ষ দেখতে এসেই যদি আমাকে পছন্দ করে তবে তারা বিয়ে পড়িয়ে নেওয়ার কথাবার্তা বলেছেন।আমার বাবাও তাদের সাথে সহমত হয়েছেন। কিন্তু সেই ছেলেটার কথা আমার এত বেশি মনে পড়ছে যে আমি তাকে কোনোভাবেই ভুলতে পারছিলাম না। আমাদের জীবনটা আসলেই অদ্ভুত! না পাওয়া জিনিসের প্রতি আগ্রহটা প্রবল থাকে। মা, আমাকে দুটো শাড়ি দিয়ে গেছেন।একটা কালো আরেকটা লাল।আমি কালো শাড়িটা নিয়েই পরেছি।মাথায় ঘোমটা উঠিয়ে চুলের সাথে যুক্ত করে একটি সেফটিপিন লাগিয়ে নিলাম। যাতে কোনোভাবেই মাথার ঘোমটা খ’সে না পড়ে।
পর্দার ওপাশে মা আর দুই বোনকে রেখেই পাত্রপক্ষের সামনে গিয়ে সালাম দিতেই ভদ্রলোকের বাবা হবে হয়তো,উনি আমাকে বসতে বললেন। পাঁচ মিনিট অতিবাহিত হওয়ার পর আমায় ভেতরে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হলো।আমি চোখ তুলে তাদের কাউকেই দেখি নি।কেবল সামনে বসে থাকা লোকটার জুতাজোড়ায় চোখ ছিলো।কালো রঙের একজোড়া জুতা। এর মধ্যে আমায় তারা কোনো প্রশ্নও করেন নি।হয়তো পছন্দ হয়নি তাই।এসব ভাবতে ভাবতে ড্রেসিংটেবিলের সামনে বসে কানের দুল খুলছিলাম। তখন কারো গলার শব্দে আচমকা ভাবনার অবসান ঘটলো।
–এটা তাহলে আপনার ঘর ?
লোকটা এক কদম দু কদম করে কালো জুতাজোড়া পায়ে জড়ানো অবস্থায় আমার দিকে এগিয়ে আসছে।আমি মাথা নিচু করেই তার এগিয়ে আসা দেখে ভয় পাচ্ছিলাম।ড্রয়িংরুমে এই জুতোজোড়া আমার বিপরীতে বসা ভদ্রলোকের পায়ে ছিলো।তাহলে ইনি কি পাত্র ? ইনি আমার রুমে কেন আসছেন ?
–হ্যালো মিস. ভয় পাচ্ছেন ? আরে ভয় পাবেন না। একটু পর আমাদের বিয়ে। মুরব্বীরা সব রেডি করছেন।সেই সুযোগে আপনার বাবাকে ওয়াশরুমে যাবো বলেই আপনার মেজো বোনকে হাত করে আপনার রুমে আসা। দেখেছেন, কত কষ্ট করেছি এখানে আসতে! কথাটা বলেই ভদ্রলোক আমার খাটে বসে পড়লেন।আমি থতমত খেয়ে বলতে লাগলাম,
–যা যা যান এখান থেকে।আ আপনি আমার রুমে কেন এসেছেন? এসব আমার একদম পছন্দ নয়।
–আমাকেও না?
কথাটা বলে লোকটা আমার চিবুক ধরে নুয়ে রাখা মাথাটা উঁচিয়ে ধরে প্রশ্ন করলেন।আমি উনার চেহারাটা দেখে ভীষণ অবাক হলাম।কতদিন পর দু’চোখ ভরে উনাকে দেখছি!উনার মায়াঘেরা চোখজোড়া আমায় ব্যাপাকভাবে জানান দিচ্ছে, ভালবাসি তোমাকে! যেন তার চোখের ভাষা কি নিখুঁতভাবে পড়ে ফেলছি আমি!
–এই যে ম্যাডাম, আপনার জন্য যে জাহিদ মামার টঙদোকানে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে সময় কাটিয়েছি। আপনি সেটা জানেন ? রোজ তো লুকিয়ে একটা ছেলেকে দেখতেন,একটু সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলার সুযোগ দিলে কি আপনার খুব ক্ষতি হত, শুনি? আর শুনুন, একটু যাচাইবাছাই করতে পারতেন। ছেলেটা আদৌ ভালো নাকি খারাপ, এসবের। কিন্তু না,আপনি তো বোরখার আড়ালে থেকেই নিজেকে লুকিয়ে রেখেছিলেন আমার থেকে।
–তার মানে, আপনি সব জানতেন ?
–আশ্চর্য! আপনি আমাকে দেখবেন আর সেটা আমি জানবো না? তবে আমি যে দেখতাম সেটা আপনি জানতেন না।এই ব্যাপারটাই বেশ ইন্টারেস্টিং,তাইনা? আপনার সম্পর্কে জাহিদ মামার কাছ থেকেই সব জেনেছি।তারপর বিয়ের প্রস্তাব পাঠানো হয় আমাদের বাড়ি থেকে।
— আপনি বেশ চালাক তো! অথচ আমিই বোকার মত নিজেকে এতদিন চালাক ভাবতাম!
–আপনি তো বোকাই।সে যাকগে, আপনাকে কিন্তু কালো শাড়িটাতে অসম্ভব মানিয়েছে! আচ্ছা বিয়ের শাড়িটা যদি কালো হয় তাহলে আপত্তি থাকবে ?
–ঘোর আপত্তি থাকবে।বিয়ের শাড়ি লাল বেনারসি হবে। কালো শাড়িতে কেবল আপনি আমায় দেখার জন্যই বরাদ্দ থাকুক। কথাটা বলেই উনাকে রুম থেকে বের করলাম।বিয়ের লাল শাড়িটা পরতে পরতেই ভাবছি, সত্যি জীবনে দারুণ মিরাকল ঘটে !
গল্পের বিষয়:
গল্প