নানার উপহার

নানার উপহার
– এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন ? জীবনে কখনো মেয়ে দেখেননি ? (মেয়েটি)
– দেখেছি কিন্তু আপনার মতো কাউকে দেখিনি ।
– দেখা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকুন অতি বাড় বেরোনা ঝড়ে পরে যাবে ।
– ঝড়ের মধ্যে টিকে থাকার চেষ্টা করবো ।
– কে আপনি ?
– আমার নাম সজীব ।
– গ্রামের মধ্যে নতুন মনে হয় তাই না ? আমাকে কি আপনি চিনেন ? যদি চিনতেন তাহলে ওভাবে তাকিয়ে থাকার সাহস হত না ।
– লেগেছে ভালো তাই ছিলাম তাকিয়ে , কাজল কালো চোখের নীলে গেছি হারিয়ে ।
– বাহহ কবি নাকি ?
– ছন্দের তালে আসে মনের অনুভূতির ভাষা, তাইতো প্রকাশ করি সৌন্দর্যে মুগ্ধ বিদিশা ।
– তারপর ?
– চুল গুলো এলোমেলো দুলছে বাতাসে , কাশফুল নিয়ে দিতাম খোলা আকাশে ।
– বাসা কোথায় আপনার ? নাকি এখানে বেড়াতে এসেছেন ?
– জ্বি হ্যাঁ, বেড়াতে এসেছি । মেয়েটি কিছু একটা বলতে যাবে ঠিক তখনই একটা মধ্যবয়সী মহিলা এসে বললো,
– কিরে নাজমা এখনো দাঁড়িয়ে আছিস ? চল চল তাড়াতাড়ি বাস ধরতে হবে নাহলে সিট পাওয়া যাবে না । (মহিলা)
– হ্যাঁ মা চলো তাড়াতাড়ি ।
এ কথা বলেই মেয়েটি মহিলার পিছনে পিছনে হাটা শুরু করলো । আমি কিছুক্ষণ তার পথের পানে তাকিয়ে রইলাম কিন্তু সে যে আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে সেটা মনেই হলো না । খুব ভালো লেগেছে কিন্তু পরবর্তীতে যোগাযোগ করার মতো কোনোই উপায় রইলো না । আজ ২১ শে রমজান । মোড়েলগঞ্জ ছোলমবাড়িয়া বাস স্টেশনে বাস থেকে নেমে রাস্তার পাশে চোখ আঁটকে গেল ৷ নীল থ্রি-পিছ পরে একটা মেয়ে রাস্তায় এক ভিক্ষুণীর সাথে কথা বলেছে । আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে দেখি তার হাসি বকুল ফুলের মতো ছড়িয়ে যাচ্ছে । হাতে কোন চুড়ি নেই কিন্তু কপালে নীল টিপ আর চুলের অর্ধেক পিছনে রেখে বাকি অর্ধেক সামনের দিকে রেখে দিয়েছে । কিছুক্ষণ পর পর নাকের উপর পরা ক্ষুদ্র চুল ডান দিয়ে সরিয়ে দিচ্ছে ।
আমি অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে ছিলাম তাই আমার সামনে এসে উপরের মিষ্টি কথা গুলো বলে গেল । বাবা গল্প, উপন্যাস খুব পছন্দ করতেন তাই আমার না রেখেছে “কাব্য” , মা আমাকে “সজীব” বলে ডাকে কিন্তু কপাল খারাপ কারণ স্কুলের সার্টিফিকেট নাম “মোঃ সাইফুল্লাহ” । সুতরাং আমি হলাম, মোঃ সাইফুল্লাহ ( কাব্য সজীব ) ।মা-বাবা ২৭ বছর আগে পালিয়ে বিয়ে করে ঢাকা শহরে চলে গেলন । আজও গ্রামের বাড়ি আসেন নাই তাই আমি ঢাকা শহরে জন্মের পর থেকে বেরে উঠেছি । আমার বয়স এখন ২৪ বছর ৭ মাস চলে পড়াশোনা এখনো শেষ করতে পারি নাই । এ বছর গ্রামের বাড়ি যাবার জন্য মনটা কেমন কেমন করছে তাই মা-বাবার নিষেধ অমান্য করে চলে এলাম গ্রামের বাড়ি ।
মা বলেছিলেন, বাস থেকে নেমে আরো ৬/৭ কিঃমিঃ দুরত্বে হচ্ছে নানাবাড়ি । ২৭ বছর আগে মেঠোপথ ছিল কিন্তু তার ধারণা এখন সে সমস্ত রাস্তাঘাট পাকা সড়ক হয়ে গেছে । গ্রামের নাম “সূর্যমূখী” প্রথমেই আমি নাম শুনে অবাক হলাম কারণ এ নামের গ্রাম আমার কল্পনার বাইরে ছিল । আর মা-বাবার কথা অনুযায়ী গ্রামের মধ্যে এক সময় প্রচুর পরিমাণে সূর্যমূখী ফুলের চাষ করা হতো । আস্তে আস্তে সেই বদৌলতে গ্রামের নাম হয়ে গেল সূর্যমূখী বাহহ চমৎকার নাম তাই না ? বাবা ছিলেন মায়ের খালাতো ভাই, সম্পর্কে দুজন খালাতো ভাই-বোন তাই তাদের সম্পর্ক আজও কেউ মেনে নেয় নাই । তাই মা-বাবা আমি আর ছোট বোন নাজনীন সুলতানা মাহি এই চার জনের ছোট্ট সুখের সংসার ৷ বাবা-মা দুজনেই চাকরি করে ।
একটা মোটরসাইকেল ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করে তার সাথে ” সূর্যমূখী ” গ্রামের দিকে রওনা দিলাম । রাস্তাঘাট সত্যি সত্যি অনেক উন্নত হয়ে গেছে তাই মা যদি এখন আসে তাহলে সে চিনতেই পারবে না যে এটা তার জন্মভূমি । গ্রামের মধ্যে “শেখ বাড়ি” বলে নাকি উপজেলার যেকোনো যায়গা থেকে আসা যায় কারণ সবাই এক নামে চেনে ৷
রোজার মাস তাই বেলা বেশি না হতেই বাজারের সব বেচাকেনা শেষ হয়ে গেছে । মোটরসাইকেল করে প্রায় ২০ মিনিট পরে আমি “সূর্যমূখী” গ্রামের শেখ বাড়ির সামনে নামলাম । চারিদিকে ইটের দেয়াল দিয়ে ঘেরা বিশাল বাড়ি তবে অনেক পুরাতন । সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে গ্রামের মধ্যে দিয়ে ছোট্ট একটা নদী বয়ে গেছে । আর নদীটা নানাবাড়ি থেকে সামান্য দুরে তাই চাইলেই মাঝে মাঝে নদীর তীরে হাঁটতে পারবো ।
গেট খোলা ছিল , ভিতরে এতবড় বাড়ি, চারিদিকে এতবড় দেয়াল কিন্তু গেট যদি খোলা থাকে তাহলে লাভ কি ?
আসরের আজান দিচ্ছে চারিদিকে, ১৫/১৬ বছর বয়সের একটা মেয়ে লাল একটা মোরগ তাড়া করতে করতে আমার সামনে এসে পরলো । আমাকে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে মনে হয় চমকে গেল কারণ শেখ বাড়ি এভাবে কেউ আসে না মনে হয় । আমার দিকে তাকিয়ে থেকে তার এতক্ষণ ধরে তাড়া করা মোরগটি চলে গেছে ।
সাদা পাঞ্জাবি, সাদা লুঙ্গি, মাথায় বরিশালের চরমোনাই মুরিদের টুপি মাথায় দিয়ে কাধে একটা জায়নামাজ নিয়ে একটা লোক এগিয়ে আসছে । তার মাথা আর দাঁড়ির মধ্যে একটাও কালো চুল পাওয়া যাবে না মনে হয়, তবে দাড়ি গুলো মেহেন্দী দিয়ে টকটকে লাল করা হয়েছে ।
– আসসালামু আলাইকুম । (আমি)
– ওয়া আলাইকুম আসসালাম , কে তুমি ? (বৃদ্ধ)
– আমি মোঃ সাইফুল্লাহ বাবা ভালবেসে কাব্য ডাকে আর মা ভালবেসে সজীব বলে ডাকে তবে আপনি আমাকে সজীব বলে ডাকতে পারেন ।
– তোমার মত বাচ্চা ছেলের নাম আমি তো চিনতে পারবো না , তোমার বাবার নাম কি ? কার কাছে এসেছো ?
– আমার বাবা মোঃ ওসমান সিরাজ আর মা মোসাঃ মরিয়ম বেগম । এই বাড়ির বা গ্রামের বর্তমান রানিং চেয়ারম্যান সৈয়দ আলী শেখ আমার নানা ।
– বুঝতে পারছি , রোজা রেখেছো ?
– জ্বী হ্যাঁ ।
– তাহলে চলো আসরের নামাজ পড়ে আসি , কাঁধের ব্যাগটা ওর কাছে দেও ও নিয়ে যাবে ।
– জ্বি আচ্ছা কিন্তু ….!
– কোনো কিন্তু নেই তোমার ব্যাগ চুরি হবে না সেই ভয় করো না ।
– আচ্ছা ঠিক আছে চলুন ।
মসজিদের সামনে গিয়ে আমি কিছুটা অবাক হলাম কারণ সবাই আমার সাথের বৃদ্ধকে সালাম দিচ্ছে । তিনি আমাকে অজু করতে বলে নিজে মসজিদের মধ্যে প্রবেশ করলো । আমি অজু করে মসজিদের মধ্যে প্রবেশ করলাম , মসজিদের বারান্দায় দাঁড়িয়ে এক লোক জিজ্ঞেস করলো ;-
– ভাই কি গ্রামের মধ্যে নতুন ? (লোকটি)
– জ্বি ভাই আমি ঢাকা শহর থেকে আসছি ।
– ওহহ আচ্ছা তা চেয়ারম্যান সাহেবর সাথে কোন কাজ আছে নাকি ?
– জ্বি কিন্তু আপনি কিভাবে জানলেন ?
– হাহাহা আপনি তো চেয়ারম্যান সাহেবের সাথে মসজিদে আসলেন তাই বোঝাই যাচ্ছে যে তার কোন মেহমান হবেন ।
– মানে আমি যার সাথে মসজিদে আসলাম তিনি কি এই গ্রামের চেয়ারম্যান ?
– হ্যাঁ, কেন আপনি চিনেন না ?
– জ্বি না ।
লোকটা কিছু একটা বলতে যাবে ঠিক তখনই হঠাৎ মসজিদের ভিতরে নামাজের জন্য সবাই দাঁড়িয়ে গেল । তাই কথাবার্তা বন্ধ করে সবাই মসজিদের ভিতরে গিয়ে নামাজে দাঁড়িয়ে গেলাম । মনে মনে ভাবলাম, তাহলে আমি নানার সাথে মসজিদে এসেছি এবং তিনি আমাকে চিনতে পেরেছেন । যাক তাহলে প্রাথমিক ধাক্কা সামলে গেল এখন বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করতে হবে । নামাজ শেষ করে বেরিয়ে আমি মসজিদের সামনে দাঁড়িয়ে আছি । এক এক করে সবাই বাহির হচ্ছে আর আমাকে ঢাকা শহরের শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরের আশ্চর্য বস্তুর মত দেখছেন । আমি তো শুধু বারবার মসজিদের ভিতরে তাকাচ্ছি কিন্তু নানা জানকে বের হতে দেখছি না । অবশেষে নানা ইমাম সাহেবের সাথে কথা বলতে বলতে বেরিয়ে এলেন । তার সাথে আরো ৭/৮ জন দাড়ি পাকা মুরব্বিরা রয়েছে । মসজিদ থেকে বেরিয়ে নানা হাতের ইশারায় আমাকে কাছে ডাকলেন এবং আমি নানার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম ।
– নানা আমার কাঁধে হাত রেখে ইমাম সাহেব কে উদ্দেশ্য করে বললেন , হাফেজ সাহেব এই হচ্ছে আমার মেয়ে মরিয়ম এর ছেলে সজীব । তার একটা ইসলামিক নাম আছে মোঃ সাইফুল্লাহ কিন্তু আমার মেয়ে তাকে ভালবেসে সজীব বলে ডাকে তাই আপনারাও সবাই সজীব বলে ডাকবেন ।
– আসসালামু আলাইকুম ভালো আছো নাতি ভাই ? ( ইমাম )
– ওয়া আলাইকুম আসসালাম, জ্বি আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি আপনারা সবাই কেমন আছেন ?
– আলহামদুলিল্লাহ ভালো , তা এত বছর পরে নানা বাড়ির কথা মনে পরলো ?
– মনে সবসময়ই পরে কিন্তু সবকিছু সবসময় ইচ্ছে অনুযায়ী করা যায় না । অনেক কিছু আমাদের হাতের নাগালে থাকলেও জড়তা কাটিয়ে সেটা টেনে নিতে ইচ্ছে হয়না ।
– বাহহহ দারুণ গুছিয়ে কথা বলো তো তুমি ।
– ঠিক আছে হাফেজ সাহেব, ইফতারের দাওয়াত রইল আসবেন কিন্তু তাড়াতাড়ি । (নানা)
– জ্বি ইনশাহ-আল্লাহ ।
আমি আর নানা পাশাপাশি হাঁটছি, আমার মধ্যে কেমন একটা উত্তেজনা বিরাজ করছে যেটা কখনো বোঝানো সম্ভব না ।
– তোমার মা-বাবা সবাই ভালো আছে ? (নানা)
– জ্বি আলহামদুলিল্লাহ । (আমি)
– মাহি কেমন আছে ?
– জ্বি ?
– আরে মাহি মানে তোমার ছোট বোন সে কেমন আছে ?
– আলহামদুলিল্লাহ ভালো, কিন্তু আপনি মাহির নামও জানেন ?
– নানা এই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বললেন, হঠাৎ করে সূর্যমূখী গ্রামের দিকে মুখ ঘুরালে কেন ?
– আসলে নানা জান সবসময়ই মনের মধ্যে গ্রামের জন্য টান অনুভব করি ।
কিন্তু কিভাবে কোন যায়গা থেকে শুরু করবো ভেবে পাইনি কারণ ছোটবেলা থেকে নানা-দাদার সাথে কখনো কথা হয়নি বলে । বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করে দেখি বৃদ্ধা মহিলা দাঁড়িয়ে আছে আর তার পাশে সেই ১৫/১৬ বছরের মেয়েটা এবং আরো একটা মহিলা দাঁড়িয়ে আছে ।
– আমি বাড়ির মধ্যে ঢুকলাম আর বৃদ্ধা মহিলা আমার সামনে এসে বললো, তুই আমার মরিয়ম এর ছেলে তাই না ?
– জ্বি, আপনি তাহলে আমার নানি ?
– শোনাে পাগলের কথা , দেখে চিনতে পারছিস না তোর মায়ের চেহারা তো আমার মত ।
– জ্বি পারছি ।
– আয় আয় বাড়ির ভিতরে আয় ।
আমাদের মতো নানা নানির একটা ছেলে একটা মেয়ে ছিল ৷ কিন্তু মা বাবার সাথে চলে যাবার পরে বড় মামাকে নিয়েই নানা নানির জীবন । ইফতার শেষ করে নানির সাথে গল্প করতে বসলাম পাশে আছে বিকেলের সেই ছোট্ট মামাতো বোন শারমিন আক্তার তনু । কথায় কথায় জানলাম যে তনুরা হচ্ছে দুই বোন , তনু ছোট এবং ওর বড় বোন আছে তার নাম বৃষ্টি । মামি আর বৃষ্টি খুলনা শহরে গেছে ঈদের কেনাকাটা করতে ।
নানির কাছে একটা কথা শুনে আমি অবাক হলাম, বাবার সাথে নাকি মামার শত্রুতা তাই আজও মা বাবা গ্রামের বাড়ি আসে না । নানা নানির কোনো আপত্তি নেই কিন্তু বাবা-মায়ের বিয়ের পরে নাকি তারা একবার দাদা বাড়িতে বেড়াতে গেছিলেন । আর আমার মামা নাকি লোকজন নিয়ে গিয়ে সেখান বসে বাবাকে মেরেছিলেন । আর সেই রাগের জন্য বাবা মামার সঙ্গে কথা বলে না এবং মাও তার ভাইয়ের সাথে কথা বলে না । এবং মা-বাবার সন্দেহ হচ্ছে যে এই সমস্ত সবকিছু আমার নানা করিয়েছে তাই নানার সাথে কথা বলে না । নানার সাথে মসজিদে গিয়ে তারাবী নামাজ পড়ে আসলাম এবং ডিনার করে আমার জন্য বরাদ্দ রাখা রুমের মধ্যে আসলাম । মামা খুলনা শহরে বেশি থাকে সেখানে রড সিমেন্টের ব্যাবসা আছে । মামি এবং মামাতো বোন বৃষ্টি বাড়িতে থাকতো কিন্তু সম্প্রতি তারা খুলনা গেছে ।
– মোবাইল বের করে মায়ের নাম্বারে কল দিলাম কিন্তু রিসিভ করলো মাহি বললো ;- হ্যালো ভাইয়া কেমন আছো ?
– ভালো আছি , মা কোই ?
– বাবা কে খাবার বেরে দিচ্ছেন, নানা নানি কেমন আছে ভাইয়া ? তোকে কেউ বকাবকি করেছে নাকি আদর করে ?
– আদর করে ।
– মামার নাকি দুটো মেয়ে আছে তা তুমি আবার লাইন মারা শুরু করছো নাকি ? আরে ধুর না, আমি এমন ছেলে না ।
– হ তাতো জানি ।
– তুই মায়ের কাছে মোবাইল দে ।
– আচ্ছা এক মিনিট লাইনে থাকো ।
– হ্যালো সজীব ? কেমন আছো ঠিকমতো পৌঁছে গেছো তো ? (মা)
– হ্যাঁ মা কোনো সমস্যা হয়নি আর আগে কল দিতাম কিন্তু ভাবলাম নামাজ পড়বে তাই ।
– মা-বাবা কেমন আছে রে ?
– সবাই ভালো আছে মা ।
– তোকে আদর করেছে তো ?
– হ্যাঁ মা আমি আসাতে খুব খুশি হয়েছে তারা ।
– সাবধানে থাকিস, আর যদি ভালো না লাগে তাহলে চলে আসবি ।
– আচ্ছা ঠিক আছে মা তবে আমার মনে হয় না যে খারাপ লাগবে । পরিবেশটা সুন্দর আছে ।
– আচ্ছা ঠিক আছে ভালো থাক তাহলে আর মাঝে মাঝে কল দিস ।
– ঠিক আছে ।
ভোরবেলায় গ্রামের মধ্যে নদী দেখতে গেলাম নদীর তীরের নরম কাঁদার পাশে কাশফুলের গোড়া দেখে হকচকিয়ে গেলাম । নদীর ঢেউ কল্পনা করলে সে হয়ে যায় কিন্তু আকাশের মত বিশাল কিন্তু নিস্তব্ধ- প্রাণময় বা অশান্ত অনিবার এমন বিশাল এবং প্রায় জীবন্ত কিছু যে পৃথিবীতে থাকতে পারে তা আজকে এই সূর্য ওঠার আগে ছেলেমানুষী কল্পনায় এর আগে কখনো আসেনি । নদী আর সমুদ্রের ঢেউয়ের তালে দোলায় দুলতে তীব্র আকর্ষণ ক্ষমতা আছে । সে তো সারাক্ষণ ডাকে মানুষকে তার কাছে আয় আয় কাছে আয় হারিয়ে যাও আমার মাঝে ।
জোহরের নামাজের পরে রুমের মধ্যে সুয়ে সুয়ে ঘুমিয়ে পরেছিলাম । কতক্ষণ কেটেছে জানিনা তবে হঠাৎ করে বাড়ির মধ্যে খুব জোরে জোরে কথার আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে গেল । আমার রুম ছিল বাড়ির দোতলায় তাই জানালা খুলে নিচে বাড়ির উঠনে তাকিয়ে দেখলে ভালো হতো কিন্তু ইচ্ছে করে না । তাই চোখ বন্ধ করে অন্য পাশ ফিরে আবারও ঘুমিয়ে পরার চেষ্টা করছি । হয়তো চোখ বুঝে গেছিলো কিন্তু হঠাৎ করে কানের মধ্যে কেউ একজন শলার কাঠি ঢুকিয়ে দিল । আমি আচমকা লাফিয়ে উঠে বিছানার উপর বসে তাকিয়ে দেখি একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে । কিন্তু তার দিকে তাকিয়ে আমি যতটা অবাক হলাম তারচে বেশি মনে হয় মেয়েটি অবাক হয়েছে । কারণ গতকাল বাস স্টেশনে নেমে যার সাথে দেখা হয়েছিল এটা সেই মেয়ে । কিন্তু আমার যতটুকু মনে পড়ে গতকাল তার মা তাকে নাজমা বলে ডেকেছে ।
– আপনি এখানে ? (নাজমা)
– আমি সজীব ।
– উঁহু নামতো গতকাল বলেছিলেন কিন্তু এই বাড়িতে মানে কি ? আপনি কি মরিয়ম ফুফুর ছেলে ?
– হ্যাঁ, কিন্তু তুমি ?
– আমি নাজমা আক্তার বৃষ্টি আপনার মামাতো বোন বুঝতে পারছেন ?
– আলহামদুলিল্লাহ , একেই বলে ” যদি থাকে নসিবে আপানা আপনি আসি “।
– মানে ?
– তোমার মতো মেয়ে চলার পথে সচারাচর সবসময় দেখা যায় না । হঠাৎ করে যখন একবার দেখা হয়ে যায় তখন তাকে যেকোনো একটা সম্পর্কের বন্ধনে জড়িয়ে রাখতে হয় ।
– হুম বন্ধন তো আগেই হয়ে আছে ফুফাতো মামাতো ভাই বোন ৷
– সে জন্য আল্লাহ কে অসংখ্য ধন্যবাদ ।
– তো কেমন আছেন আপনি ?
– অনেক ভালো ।
– ফুফু ফুফা তারপর মাহি তারা কেমন আছে ?
– সবাই ভালো আছে । আচ্ছা আমাদের পরিবারের সবার কথা তোমরা জানো তাই না ?
– হ্যাঁ । দাদা খবর রাখে সবসময় । আপনার সাথে আগেই দেখা হতো কিন্তু গতকাল খুলনা গেছিলাম শপিং করতে ।
– আচ্ছা ।
– আপনি থাকেন তাহলে আমি বাইরে যাচ্ছি রাতের বেলা গল্প করবো ।
– ঠিক আছে । রাতের বেলা বৃষ্টির সাথে তেমন কথা হয়নি তবে মা’র সাথে এ বিষয় কথা হয়েছে ।
– মা আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল মামার বড় মেয়ে গুলো কেমন ?
– আমি বললাম , বড় মেয়ে বৃষ্টিকে দেখলে চোখের পলক পরে না । আর তার ছোট বোন শারমিন আক্তার তনু ওর চেয়ে ৩/৪ বছরের ছোট হবে ।
– ২৭ বছর আগে তোর বাবা আমাদের বাড়িতে গিয়ে আমাকে পছন্দ করার পরে কিন্তু আজ এতদূর হয়েছে । সুতরাং সাবধানে থাকবি, ওদের কাছ থেকে দুরে দুরে রবি ।
– ২৭ বছর আগের সেই ঘটনা যদি আবারও ঘটে তাহলে কি বেশি সমস্যা হবে মা ?
– মানে কি ? তোর বাবা জানলে খুন করে দেবে ।
– বৃষ্টিকে দেখে পছন্দ হতেই পারে মা কারণ বৃষ্টি অনেক সুন্দর দেখতে ।
– ঢাকা শহরে অনেক সুন্দর সুন্দর মেয়ে আছে তুই বৃষ্টির দিক বাদ দিয়ে দে নাহলে খারাপ হবে ।
– আচ্ছা দেখি কি করা যায় ?
– পাগলামি করিসনা বাবা , তোকে কিন্তু তোর বাবা যেতে দিতে চায় নাই । আমি জোর করে রাজি করিয়ে পাঠালাম কিন্তু উল্টো পাল্টা কিছু হয়ে গেলে আমার রক্ষা হবে না ।
– সেই চিন্তা আমার উপর ছেড়ে দেও ।
– আচ্ছা ঠিক আছে তুই যত দ্রুত সম্ভব ঢাকা চলে আয় ।
পরদিন বিকেলে বৃষ্টির সাথে নদীর ধারে ঘুরতে বের হলাম । পড়ন্ত বিকেল তাই নদীর তীরে দুটো সূর্য দেখা যাচ্ছে একটা পশ্চিমাকাশের কোলে আরেকটা নদীর পানির নিচে । মৃদু মৃদু ঢেউয়ে নদীর তীরে যেন টুপুরটুপুর শব্দ হচ্ছে আর বাতাসে কাশফুল দুলে দুলে যাচ্ছে ।
– আমাদের গ্রামটা অনেক সুন্দর তাই না ? (বৃষ্টি)
– হুম অসম্ভব সুন্দর ৷ (আমি)
– কবি সাহেব একটা কবিতা হবে ?
– চেষ্টা করতে পারিন৷
– ওকে চেষ্টা করুন আমি চুপ করে থাকি ।
– হুম ঠিক আছে শোনো তাহলে ,
তুমি থাকলে পাশে, একটা আকাশ রংতুলি দিয়ে সাজিয়ে দেব । মনের সকল অনুভূতি ভালবেসে কাছে টানবে । যখন দুহাত বাড়িয়ে দেবে, আমি পুলকিত হয়ে বাহুতে টেনে নেবো । তোমার জন্য কদম ফুলের তোড়া বানাবো, তুমি কি করবে ? অবাক হবে ? নাকি ভালবাসবে ? পাশাপাশি হাঁটছি তুমি আমি অনবরত অজানা । পথ ফুরিয়ে যাবে টের পেলাম না । দেখেছো তোমার নিজের পাণে ? তোমার ওই রূপ দেখে প্রকৃতিও হিংসা করে । আমি অবাক হই । এটাকে নিজের করে পেতে বড্ড ইচ্ছে করে । হাত গুটিয়ে ফিরে যাই, যদি হারিয়ে যাও ? তবুও ভালবাসবো গোপনে , মাঝে মাঝে তোমাকে লুকিয়ে দেখবো । গভীর রাতে চাঁদের সাথে তোমার প্রশংসা করবো । সে তোমাকে দেখতে চাইবে । তুমি কি একদিন আমার সাথে যাবে ?
– বাহহহ চমৎকার । (বৃষ্টি)
– ধন্যবাদ ।
– কাউকে ভালবাসেন ?
– হ্যাঁ ।
– দেখতে খুব সুন্দর তাই না ?
– হ্যাঁ ।
– কতটুকু ভালবাসেন ?
– যতটুকু ভালবাসা বলা যায় ।
– আর সে ?
– সে এখনো জানেনা ।
– মানে একতরফা প্রেম ?
– আপাতত সেরকম ।
– নিজের মনের মধ্যে না রেখে তাকে বলে ফেলুন নাহলে পরে অন্য কেউ নিয়ে যাবে ।
– হুম প্রস্তুতি চলছে ।
– বাহহহ ভালো তো, আচ্ছা চলুন আজকে বাড়ি ফেরা যাক তাহলে ।
– ঠিক আছে চলো ।
আরো ৬ দিন পার হয়ে গেল , আমি আর বৃষ্টি প্রায় প্রতিদিন বিকেলে নদীর তীরে হাঁটতে যেতাম । শুধু একদিন তনু আমাদের সাথে গিয়েছিল আর সবসময় আমরা দুজনেই একসাথে যেতাম । মাত্র ছয় দিন কথা বলতে বলতে নেশা লেগে গেল যেটা চাইলেই কাটানো যাবে না । আজকে বিকেলে নদীর তীরে হাঁটতে গিয়ে হঠাৎ করে বৃষ্টি মন খারাপ করে চলে এসেছে । কিন্তু মন খারাপ করার মতো কোন কারণ ছিল না, বারবার জিজ্ঞেস করছি কিন্তু কিছু বলে নাই । নদীর তীরে গিয়ে শুধু একটা কবিতা শুনতে চেয়েছিল এবং আমিও শুনিয়েছিলাম । তবে কবিতা একটু প্রপোজ টাইপের ছিল তাই মনে হয় মনে মনে রাগ করেছে । কবিতাটা ছিল ;- জীবনের অনেকটা বছর পেরিয়ে গেছে ।
আজও কোন রমণীর শ্যামল আবরণে তাকিয়ে, বলিনি ভালবাসি তোমাকে । কিন্তু সেদিন দেখেছি তোমায় , নাড়া দিয়েছে আমার হৃদয়ের সুপ্ত ভালবাসা । তুমি কি সেই ? যাকে খুঁজে বেরাই পৃথিবীর পথে । হঠাৎ হারিয়ে গেলে , কিন্তু আবারও খুঁজে পেলাম ভাগ্যের বলে । আমি স্বপ্ন দেখি তোমায় নিয়ে । হবে কি স্বপ্ন পূরণের সাথী ? খুব ভালবাসবো সবটা দিয়ে , বিনিময়ে তুমিও ভালবাসা দিও । যত্ন করে সাজিয়ে রেখে দেবো আলপনা করে । চাবির রিং পরে যায় বনে । জানিনা তুমি বুঝতে পারো কিনা ! পারলে সাড়া দেও মোরে । আর কতকাল এমনি করে রবো ? আমি তোমার ভালবাসার হবো । থেকো না দুরে শুধু দেখতে চাই হাসি , সত্যি বলছি তোমাকে অনেক ভালবাসি । মধ্যে রাতের বেলা রুমের মধ্যে সুয়ে আছি মাথার মধ্যে বৃষ্টিকে নিয়ে হাজারো ভাবনা । ঠিক তখনই মোবাইল বেজে উঠল, তাকিয়ে দেখি বৃষ্টির নাম্বার থেকে কল এসেছে । ৩/৪ দিন আগে বৃষ্টির নাম্বার নিছিলাম আর বৃষ্টিও আমার নাম্বার নিয়েছিল ।
– কল রিসিভ করলাম আর বললাম , হ্যালো বৃষ্টি ?
– কি করেন ?
– সুয়ে আছি কিন্তু ঘুম আসছে না, তুমি কি করো ?
– ছাঁদে দাঁড়িয়ে আছি, আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে ছাঁদে আসবেন ?
– কেউ যদি দেখে ?
– সবাই ঘুমাচ্ছে আপনি আসুন ।
– আচ্ছা ঠিক আছে ।
– ছাঁদে গিয়ে দেখি সত্যি সত্যি বৃষ্টি দাঁড়িয়ে আছে । এত রাতে ছাঁদে দাঁড়িয়ে আছো ভয় লাগে না ?
– না তেমন ভয় লাগে না, আপনার ভয় করছে নাকি বলেন তো ?
– না তবে শহরের ছেলে হিসেবে গ্রামের নির্জন এই ছাঁদে ভয় লাগতেই পারে ।
– হুম তা ঠিক , আচ্ছা সজীব ভাই আপনি আর কতদিন থাকবেন ?
– সঠিক বলতে পারছি না কিন্তু কেন ?
– ঈদের পরে আরও ১০ দিনের মতো থাকতে পারবেন ?
– ইচ্ছে করলে পারবো কিন্তু কেন ?
– এবার বৃষ্টি তার হাতটা সামনে দেখিয়ে বললো, ঈদের পাঁচ দিন পরে আমার বিয়ে । এনগেজমেন্ট হয়ে গেছে ঈদের পরে মহা ধুমধাম করে আমার বিয়ে সম্পন্ন হবে । তাই আপনি যদি থাকেন তাহলে বিয়ে তে অংশগ্রহণ করবেন ।
– আমি মুখটা কালো করে ফেললাম কিন্তু রাতের বিশাল অন্ধকারে সেটা বৃষ্টি হয়তো দেখতে পেলো না কপাল । বললাম , পারিবারিক ভাবে কি বিয়ে টা ঠিক করা হয়েছে ?
– হ্যাঁ ।
– সেই ছেলেকে তোমার পছন্দ ?
– বিয়ে যেহেতু ঠিক করা হয়েছে সেহেতু বিয়ে হয়ে গেলে এমনিতেই পছন্দ হয়ে যাবে ।
– আমি তোমাকে ভালবাসি ।
– আমি জানতাম আপনি এটা বলবেন তাই আপনি বলার আগেই আমার বিয়ের কথাটা জানানো উচিত ছিল । কিন্তু নানান ব্যাস্ততার জন্য আপনার কাছে এখনো হয়তো দাদা-দাদী কেউ বলে নাই । তাই বাধ্য হয়ে রাতের আঁধারে আমি আপনাকে ডেকেছি শুধু সত্যিটা জানানোর জন্য ।
– আমি আসলে মাত্র কিছুদিনের মধ্যে তোমাকে অনেক বেশি ভালবেসে ফেলেছি । চাইলেই এখন সেই ভালবাসার জাল থেকে বেরিয়ে যেতে পারবো না আমি ।
– আপনি শহরের ছেলে তাই যত তাড়াতাড়ি পারেন শহরে চলে যান তাহলে ব্যাস্ত শহরের মাঝে দাঁড়িয়ে গ্রামের এই বৃষ্টি কে আর মনে পরবে না ।
– না বৃষ্টি, আমি চাইলেই তোমার কাছ থেকে দুরে গিয়ে নতুন করে কাউকে ভালবাসতে পারবো না ।
– আপনি অবশ্যই জানেন , আপনার মা-বাবার সাথে আমার বাবার অনেক বড় শত্রুতা । তার মধ্যে আবার আমার বিয়ে ঠিক করা আছে তাই এমন অসম্ভব বিষয় নিয়ে প্লিজ কিছু বলবেন না ৷
– তাহলে কোন উপায় নেই ?
– হ্যাঁ একটা উপায় আছে, আমি আপনার মায়ের মতো আপনার হাত ধরে পালিয়ে যেতে পারি । আমি আবারও একটা বংশের শত্রুতা বৃদ্ধি করতে পারি । আমি আপনার হাত ধরে পালিয়ে গিয়ে মা-বাবার সম্মান দাদার সম্মান নষ্ট করতে পারি । গ্রামের সবাই এই চেয়ারম্যান বাড়িকে প্রেমের বাড়ি বলে উপহাস করবে সেটা তৈরী করতে পারি ৷ কিন্তু মাফ করবেন প্লিজ , আমি সেটা পারবো না তাই আপনি দয়া করে এমন কথা বলে লজ্জা দিবেন না । সেই ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি মরিয়ম ফুপুকে হারিয়ে প্রতিদিন দাদী কান্না করে । মাঝে মাঝে আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে তাই আমি চাইনা আমার মা-ও দাদীর মত কান্না করুক৷
– আমি নানা-নানির সাথে এ বিষয় কথা বলবো ।
– প্লিজ এমনটা করবেন না , দাদা-দাদী খুব কষ্ট পাবে আর বাবা জানলে মহাপ্রলয় আরম্ভ হবে ।
– তবুও চেষ্টা করবো ।
– দয়া করে এমন কথা বলে সবার মনের ভিতরে টেনশন দিবেন না ৷ আর আপনি এমনটা সবাই কে বললে এই বাড়িতে আপনার সামনে যেতেও আমার লজ্জা করবে । নিজের মধ্যে সঙ্কোচ বোধ তৈরি হবে ৷
– তাহলে কি আমি গ্রামের বাড়ি এসে ভুল করছি ?
– কেন এমন মনে হয় ?
– কারণ তোমার কাছে আমার মনটা হারিয়ে গেছে আমি চাইলেই সেটা ফিরিয়ে নিতে পারবো না ৷ এই জীবনের শেষ নিশ্বাস ছাড়া পর্যন্ত তোমার মুখ টা মনে থাকবে আমার ।
– কিছু দিন পরে ঠিক হয়ে যাবে ।
– সব ভালবাসা একই রকম হয়না বৃষ্টি ।
– আপনার সাথে কথায় পারবো না, আপনি বুঝেও বোঝার চেষ্টা করছেন না । একটা অনুরোধ করবো যদি পারেন খুব তাড়াতাড়ি এ বাড়ি থেকে চলে যান তাহলে আমি খুশী হবো ।
– আচ্ছা ঠিক আছে তাই হবে ।
– মন খারাপ করবেন না, মনে করবেন ভুল করে ভুল সময়ে একটা ভুল মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে ।
– যার সন্তান হয়না, সে জানে সন্তানের আকাঙ্খা কি ? বেকার ছেলেটার কাছে একটা ছোট্ট চাকরি হচ্ছে সোনার হরিণ। আমার কাছে কিছু চাওয়া থেকে যাকনা ভাবনাতেই । কিছু পাওয়া পড়ে থাক কল্পনায় প্রাপ্তিগুলো মূল্যহীন হয়ে যাওয়ার চেয়ে অমূল্য হয়ে থাক আজনম প্রিয়তমার মতন ।
– আমি গেলাম, ভালো থাকবেন আপনি । আর রুমের মধ্যে গিয়ে সবকিছু মাথা থেকে বের করে ঘুমিয়ে পড়ুন । কাল সকালে নতুন সূর্য উঠুক আপনি সেই সূর্যের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিন । যখন বেশি মন খারাপ হবে তখনই শুধু একটা বিষয়ই মনে করবেন যে আপনি অনেক গুলো মানুষের মুখে হাসি দেখতে চান ।
– চেষ্টা করবো , ভালো থেকো তুমি । রুমের মধ্যে এসে কিছুক্ষণ নীরবে বসে রইলাম আর অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নিলাম যে সকালে উঠেই যেকোন একটা বাহানা দিয়ে চলে যাবো । বড় প্রেম শুধু কাছে টানেনা, দুরেও ঠেলে দেয় মাঝে মাঝে । কাপড় গুলো রাতেই ব্যাগের মধ্যে গুছিয়ে নিলাম । আর সবকিছু চিন্তা ভাবনা বাদ দিয়ে ঘুমিয়ে পরার চেষ্টা করছি । আগামীকাল ৩০ শে রমজান তাই কালই চলে যেতে হবে নাহলে ঈদের দিন যেতে পারবো না । গভীর রাতে ঘুমানোর ফলে সকালে দেরি করে ঘুম ভেঙ্গেছে । ঘুম থেকে ওঠার পরে দেখি ঘড়িতে সকাল সাড়ে নয়টা পেরিয়ে গেছে । হাত মুখ না ধুয়ে ফ্রেশ না হয়েই নানার সাথে দেখা করতে গেলাম । বাড়ির উঠনে বৈঠক খানার ঘরে বসে ৩/৪ জন গ্রামের মানুষের সাথে কথা বলছে।
– আমি তার সামনে গিয়ে কোন রকম ভূমিকা ছাড়াই বললাম , নানাজান আমাকে এখনই ঢাকা যেতে হবে বাবা খুব অসুস্থ । (আমি)
– সে কি ? কখন থেকে ? (নানা)
– একটু আগে ঢাকা থেকে কল এলো আর কল পেয়ে আমি ঘুম থেকে লাফ দিয়ে উঠলাম । আপনি অনুমতি দিলে আমি এখনই বেরিয়ে পরবো কারণ শহরেতো আপন বলতে কাউকে পাওয়া যায় না ।
– অবশ্যই যাবে , কিন্তু আমাদের সকলের মন খারাপ হবে কারণ তুমি এবারই প্রথম গ্রামের বাড়ি ঈদের জন্য এসেছো। কিন্তু অসুস্থতার উপর তো কারো হাত নেই নানাভাই তাই তুমি তাহলে বেরিয়ে পড়ো । আমি বাস স্টেশন ফোন করে তোমার জন্য ঢাকার বাসের টিকিট রাখতে বলি ।
– ঠিক আছে নানা ।
নানা-নানি আর মামির কাছে বিদায় নিয়ে দ্রুত বের হয়ে গেলাম ৷ চেহারার মধ্যে টেনশনের ভাব বজায় রাখতে হবে নাহলে ধরা পড়ে যাবো । নানা কল দিয়ে একটা মোটরসাইকেল ড্রাইভার এনে হাজির করলো বাড়ির সামনে ৷ নানা-নানি কে সালাম দিয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম এতক্ষণ ধরে বৃষ্টি কে দেখতে পারি নাই কিন্তু এই মাত্র বাড়ির ছাঁদে চোখ পরলো । ছাঁদের রেলিং ধরে কাঠের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে যেন হারিয়ে যাচ্ছে কোনো আপনজন । দোলা পরিবহনের টিকিট কাউন্টারে বসে আছি, বাস ছাড়বে ৩০ মিনিট পরে তাই কাউন্টারে বসে অপেক্ষা করছি । কিন্তু ২০ মিনিট পরে কাউন্টার থেকে জানালো যে, আমাকে নাকি পরবর্তী গাড়ি আরো এক ঘন্টা পরে তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে । কারণ এই গাড়ির সিট নাকি সব ভর্তি হয়ে গেছে কিন্তু এখন ঈদের সময় শহরে কারা যাচ্ছে মাথায় আসলো না । হঠাৎ করে পকেটে মোবাইল বেজে উঠল বের করে দেখি ঢাকা থেকে ছোট বোন মাহি কল দিয়েছে । বের করে রিসিভ করে বললাম ;-
– হ্যা মাহি বল । (আমি)
– ভাইয়া তুই কি কেন ঝামেলা করেছিস ? (মাহি)
– না তো , কেন ?
– বাবা এইমাত্র বললো তাড়াতাড়ি কাপড় চোপড় গুছিয়ে নিতে আমরা নাকি নানা বাড়ি যাবো । তুই বল ভাবা যায় এগুলো ?
– কিন্তু কারনটা কি বলতো ? আমি তো আরো বাস স্টেশন বসে আছি একটু পরে রওনা দেব ।
– লে হালুয়া, তুই আসতেছিস কিসের জন্য ? তোর আবার কি হলো ? সবাই পাগল হয়ে গেছে নাকি ?
– বুঝতে পারছি না তুই ফোন রেখে মায়ের কাছে জিজ্ঞেস করে দেখ তো ।
– আচ্ছা ঠিক আছে ।
মোবাইল কেটে দিয়ে পকেটে রেখে সামনে তাকিয়ে দেখি বৃষ্টি দাঁড়িয়ে আছে । আমি পুরো ভ্যাবাচ্যাকা হয়ে গেলাম কারণ বৃষ্টি এখানে কেন ? আমি সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম ;-
– বৃষ্টি তুমি ? (আমি)
– কেন আসতে পারি না ? (বৃষ্টি)
– কিন্তু কেন ?
– ভালবাসি তাই !
– মানে কি ?
– আমাকে নেবে না তোমার সাথে ?
– তোমার তো বিয়ে ঠিক করা আছে ।
– বিয়ে সঠিক তারিখেই হবে ।
– তাহলে আমার কাছে কেন ?
– বিয়ের তারিখ ঠিকই থাকবে কিন্তু পাত্র পরিবর্তন করা হয়েছে ।
– মানে কি ? কেন ? আর তুমি কি একা এসেছো ?
– না দাদা নিয়ে এসেছে আমাকে ।
– দাদা কি সবকিছু জেনে গেছে ?
– হ্যাঁ ।
– তুমি বলেছো ?
– হ্যাঁ ।
– কেন ?
– তুমি বাসা থেকে বের হবার পরেই নানা ঢাকা শহরে কার কাছে যেন ফোন করে জানতে পেরেছে যে তোমার বাবার কিছু হয়নি । তুমি মিথ্যা কথা বলে গ্রাম থেকে চলে যাচ্ছো সেটার কারণ দাদা বুঝতে পারছে না । তাই আমাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলো আসল ঘটনা কি ? তারপর আমি সবকিছু বলে দিয়েছি । তারপর দাদা আমাকে জিজ্ঞেস করছেন যে আমি আপনাকে ভালবাসি কিনা ?
– তুমি কি বললে ? আমাকে ভালবাসনা তাই না ?
– গাধা নাকি ? সেটা যদি বলতাম তাহলে কি আমি এখানে থাকতাম নাকি ?
– তাহলে তুমিও আমাকে ভালবাসো ?
– চোখ দেখে বুঝে নিন ।
– আমি কিছু একটা বলতে যাবো ঠিক তখনই নানা পিছন থেকে বললো , কি চলে এখানে ? (নানা)
– নানা প্রেম চলে প্রেম । (আমি)
– কামডা করছোস কি নাতি ? আমার যুবতী বউটা তুই দখল করে নিলি ? কপাল ।
– এই ভাঙ্গা শরীরে আর কত নানা ? এবার নিজের কিছু দায়িত্ব আমার কাছে দাও ।
– হুম দিলাম তো, গত ২৪ বছর ধরে মোট ৪৮ টা ঈদের জন্য তোকে কিছুই দিতে পারিনি । তাই আজ ২৪ বছর পরে সবকিছু সুদে আসলে একটা উপহার দিয়ে পরিশোধ করলাম ।
– হাহাহা হাহাহা হাহাহা ।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত